হংকং-এর তাই পোর ওয়াং ফুক কোর্টে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড দেখিয়ে দিয়েছে যে উঁচু ভবনে জরুরি অবস্থায় মানুষের নিরাপদে বের হওয়া কতটা কঠিন হতে পারে। আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ায় মৃত্যু ও ক্ষয়ক্ষতি বেড়ে যায়, এবং সবচেয়ে বড় বিলম্বের একটি কারণ হলো মানুষের স্বাভাবিক আচরণ।
ঘটনার সারসংক্ষেপ
২৬ নভেম্বর ওয়াং ফুক কোর্টের একাধিক ভবনে আকস্মিকভাবে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। এই ঘটনায় এখন পর্যন্ত ৪০ জনের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে এবং প্রায় ৩০০ জন নিখোঁজ রয়েছেন, পাশাপাশি বহু মানুষ গুরুতর অবস্থায় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। এটি সাম্প্রতিক দশকের মধ্যে হংকং-এর সবচেয়ে প্রাণঘাতী অগ্নিকাণ্ড, যা ১৯৯৬ সালের গার্লি বিল্ডিং-এর আগুনের পর সবচেয়ে ভয়াবহ বলে বিবেচিত হচ্ছে। প্রায় ৯০০ জনকে সরিয়ে নেওয়া গেলেও এখনও কতজন ভবনের ভেতরে আটকা আছেন তা নিশ্চিতভাবে জানা যায়নি। জ্বলন্ত বাঁশের মাচা এবং প্রবল বাতাস আগুনকে এক ভবন থেকে আরেক ভবনে ছড়িয়ে পড়তে সহায়তা করেছে, ফলে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে ওঠে।
উঁচু ভবনে উচ্ছেদ কেন এত কঠিন
উঁচু ভবনে উচ্ছেদ শুধু “মানুষকে বের করে আনা”র সরল বিষয় নয়। এটি ভবনের কাঠামো, দীর্ঘ সিঁড়িপথ এবং মানুষের স্বভাবজাত আচরণের সমন্বয়ে তৈরি এক জটিল প্রক্রিয়া, যেখানে প্রতিটি উপাদানই নিরাপদ উচ্ছেদকে কঠিন করে তোলে।
সবচেয়ে বড় বাধা: নিরাপদে নামতে দীর্ঘ সিঁড়িপথ
উঁচু ভবনে সিঁড়িই সাধারণত একমাত্র নির্ভরযোগ্য পথ। ড্রিলের সময় মানুষ প্রতি সেকেন্ডে ০.৪ থেকে ০.৭ মিটার গতিতে নামতে পারলেও বাস্তব আগুনের সময় সেই গতি অনেক কমে যায়। ৯/১১–র অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, ধোঁয়া, ভয় এবং ক্লান্তির কারণে অনেক সময় গতি ০.৩ মিটার প্রতি সেকেন্ডেরও নিচে নেমে আসত। উঁচু ভবনে দীর্ঘ পথ নামতে গিয়ে দ্রুত ক্লান্তি দেখা দেয় এবং তলার পর তলা নেমে যেতে হতে থাকলে গতি আরও কমে যায়। ২০১০ সালের সাংহাইয়ের উঁচু ভবনের অগ্নিকাণ্ডে বয়স্কদের প্রায় অর্ধেক উল্লেখযোগ্যভাবে ধীর হয়ে পড়েছিলেন, যা পরিস্থিতিকে আরও বিপজ্জনক করে তোলে।
জট ও ধীরগতি
একই সিঁড়ি ব্যবহার করে বহু তলার মানুষ যখন একত্রে নিচে নামতে থাকে, তখন স্বাভাবিকভাবেই জট তৈরি হয় এবং গতি কমে যায়। বয়স্ক, শারীরিকভাবে দুর্বল ব্যক্তি অথবা একসঙ্গে চলা পরিবার ও বন্ধুদের দল চলাচলের গতি আরও নিচে নামিয়ে দেয়। আবাসিক ভবনে মানুষের বৈচিত্র্যের কারণে এই ধীরগতি আরও স্পষ্টভাবে দেখা যায়, যা দ্রুত উচ্ছেদে বড় বাধা হয়ে ওঠে।
অন্ধকার ও ধোঁয়ার প্রভাব
অন্ধকার, বিদ্যুৎ বিভ্রাট বা ঘন ধোঁয়ার কারণে যখন দৃশ্যমানতা নষ্ট হয়ে যায়, তখন মানুষ আরও সতর্ক ও ধীরগতিতে হাঁটতে বাধ্য হয়। ভুল পদক্ষেপ নেওয়ার আশঙ্কায় তারা থেমে যায় বা দ্বিধায় পড়ে, ফলে সিঁড়িতে চলাচলের সামগ্রিক গতি উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যায়। দৃশ্যমানতার অভাব উচ্ছেদকে সবচেয়ে বেশি বিপজ্জনক করে তোলে।
মানব আচরণও বিলম্ব ঘটায়
সতর্কতা বাজার পরেও মানুষ সাধারণত সঙ্গে সঙ্গে ভবন ছাড়ে না। তারা প্রথমেই জানতে চায় ঠিক কি ঘটছে—কোথায় আগুন লেগেছে, আদৌ বের হওয়া জরুরি কিনা। অনেকেই জানালা দিয়ে তাকায়, পরিবারকে ফোন করে, প্রতিবেশীকে ডাকে বা ঘোষণার অপেক্ষা করে। এই কয়েক মিনিটই সবচেয়ে মূল্যবান এবং একইসঙ্গে সবচেয়ে ক্ষতিকর দেরির কারণ। বিশেষ করে আবাসিক ভবনে মানুষ নিজেদের পরিবার বা প্রতিবেশীদের সঙ্গে দলবদ্ধভাবে বের হতে চায়, যা চলাচলের গতি আরও কমিয়ে দেয়। গবেষণায় দেখা গেছে, যদি মানুষ “সাপের সারি”-র মতো এক লাইনে হেঁটে চলে, তাহলে গতি বাড়ে, জায়গা কম লাগে এবং অন্যরাও দ্রুত নামতে পারে। কিন্তু বাস্তবে আতঙ্কের মুহূর্তে অনেকেই ছন্দ হারায়, ফলে সিঁড়িতে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়।
শুধু সিঁড়ি যথেষ্ট নয়
উঁচু ভবন যত উঁচু হচ্ছে এবং জনসংখ্যায় বয়স্ক মানুষের সংখ্যা যত বাড়ছে, “সবাই সিঁড়ি ব্যবহার করে নামতে পারবে” ধারণাটি ততই অবাস্তব হয়ে উঠছে। অনেকের জন্য লম্বা সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামা শারীরিকভাবে প্রায় অসম্ভব। এই বাস্তবতার কারণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তিন ধরনের সমাধান বাস্তবায়িত হচ্ছে, যাতে উচ্ছেদ প্রক্রিয়া আরও দ্রুত, কার্যকর ও নিরাপদ হয়।
রিফিউজি ফ্লোর
রিফিউজি ফ্লোর হলো আগুন ও ধোঁয়ায় সুরক্ষিত বিশেষ তলা, যেখানে মানুষ আশ্রয় নিতে পারে, বিশ্রাম নিতে পারে বা ভিড় এড়াতে সাময়িকভাবে অবস্থান করতে পারে। এই তলাগুলো উচ্ছেদ প্রক্রিয়াকে অংশে ভাগ করে সহজ করে, ফলে বড় ভবনে চাপ কমে এবং নিরাপদ বিকল্প তৈরি হয়।
ইভাকুয়েশন এলিভেটর
উচ্চ ভবনের জন্য বিশেষভাবে নকশা করা এই লিফটগুলো আগুন লাগার সময় ব্যবহার করা যায়। এগুলোর শ্যাফট চাপযুক্ত থাকে, লবি সুরক্ষিত থাকে এবং ব্যাকআপ বিদ্যুৎ থাকে, যাতে ধোঁয়া প্রবেশ করতে না পারে। সিঁড়ি এবং এই বিশেষ এলিভেটর একসঙ্গে ব্যবহার করলে সবচেয়ে দ্রুত ও কার্যকর উচ্ছেদ নিশ্চিত করা সম্ভব হয়।
সমন্বিত ব্যবস্থা
উঁচু ভবনের জন্য কোনো একক সমাধান কার্যকর নয়। নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সিঁড়ি, রিফিউজি ফ্লোর এবং সুরক্ষিত ইভাকুয়েশন এলিভেটর—এই তিনের সমন্বিত ব্যবস্থাই সবচেয়ে সফল ও কার্যকর বলে বিবেচিত। আধুনিক উঁচু ভবনের নিরাপদ নকশা এবং জরুরি পরিকল্পনায় এই তিনটির সমন্বয় অপরিহার্য।
হংকং-এর সাম্প্রতিক অগ্নিকাণ্ড আবারও মনে করিয়ে দেয় যে উঁচু ভবনে আগুন লাগলে সময়ের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু হয়। মানুষের আচরণের দেরি, সিঁড়ির দীর্ঘ পথ, ধোঁয়া, জট—সব মিলিয়ে নিরাপদ উচ্ছেদ অত্যন্ত কঠিন হয়ে ওঠে। তাই সঠিক নকশা, আশ্রয়তলা এবং জরুরি লিফট—সবকিছু একসঙ্গে পরিকল্পনায় থাকতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে এ ধরনের দুর্ঘটনার ঝুঁকি কমানো সম্ভব হয়।
#: অগ্নিকাণ্ড হংকং #উঁচু_ভবন #উচ্ছেদ #জরুরী পরিস্থিতি
সারাক্ষণ রিপোর্ট 




















