১০:০৪ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৮ নভেম্বর ২০২৫
রিয়াদ মেট্রো বিশ্বের দীর্ঘতম চালকবিহীন ট্রেন নেটওয়ার্কের রেকর্ড গড়ল পুলিশ ও এনজিও আইন তড়িঘড়ি পাস না করার আহ্বান ফখরুলের মালয়েশিয়ার পশ্চিম ও মধ্যাঞ্চলে ভারি বর্ষণ, আকস্মিক বন্যা ও বিপজ্জনক ভ্রমণ পরিস্থিতির সতর্কতা হংকং-এর উঁচু ভবনে অগ্নিকাণ্ড: জরুরি পরিস্থিতিতে উচ্ছেদ কেন এত কঠিন দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ায় ভয়াবহ বন্যা: ইন্দোনেশিয়া-থাইল্যান্ড-মালয়েশিয়ায় মৃত্যু বাড়ছে শেখ হাসিনার রায় পরবর্তী ধৈর্যে’র রাজনীতি ইমরান খানকে ‘ডেথ সেল’-এ একঘরে আটকে রাখার অভিযোগ: গুজবের মাঝে পরিবারের গভীর উদ্বেগ বরিশাল-ভোলা সেতুর দাবিতে শাহবাগ অবরোধে ভোলাবাসী সিলেটে শাহজালালের মাজারে খেজুরগাছ কাটায় তীব্র ক্ষোভ কিশোরকে ছুরিকাঘাতে হত্যা: সিলেটে দুই গ্রুপের সংঘর্ষে প্রাণহানি

শেখ হাসিনার রায় পরবর্তী ধৈর্যে’র রাজনীতি

১৭ নভেম্বর শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে রায় দেওয়ার আগে ১৩ নভেম্বর আওয়ামী লীগ অনলাইনের মাধ্যমে ঢাকায় “লকডাউন” কর্মসূচি দিয়েছিল। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে ভারতে গিয়ে আশ্রয় নেওয়ার পরে ১৩ নভেম্বরের “লকডাউন” ছিল আওয়ামী লীগের প্রথম কোনো কর্মসূচি।
ঢাকার মানুষের নিরপেক্ষ মতামত, তারা মনে করেছিল এই কর্মসূচি সর্বোচ্চ ৪০ ভাগ পালিত হবে। কিন্তু দিনশেষে একটি সামগ্রিক নিরপেক্ষ মতামত—৭০ ভাগ পালিত হয়।
এর পরেই রাতে সোশ্যাল ফোরামে আওয়ামী লীগ আবার ৪ দিনের বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি ঘোষণা করে। যার ভেতর শেখ হাসিনার রায়ের আগের দিন ও রায়ের দিন তাদের “শাটডাউন” কর্মসূচি ছিল।
কিন্তু ১৫ তারিখ বিকেলের দিকে সাংবাদিক, ব্যবসায়ীসহ প্রায় সবাই জেনে যায়—আওয়ামী লীগ ১৬ ও ১৭ নভেম্বরের কর্মসূচি প্রত্যাহার না করলেও তা পালনের দিক থেকে তাদের মনোযোগ উঠিয়ে নিয়েছে।
যেহেতু আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল প্রায় সব নেতাই আত্মগোপনে—অন্যদিকে বাংলাদেশে বসে একমাত্র শেখ হাসিনার কর্মীরা ছাড়া কেউ তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে সাহসী হয় না—এমনকি সাংবাদিকতার প্রয়োজনেও।
এ কারণে স্বাভাবিকই দেশের রাজনীতি সচেতন মানুষের একটি সামষ্টিক মতামতই গ্রহণ করা ছাড়া কোনো উপায় থাকে না।
সে মতামতে এমন বিষয়গুলো সামনে এসেছে—আওয়ামী লীগ দ্রুতই তাদের কর্মসূচির ওপর থেকে গুরুত্ব তুলে নেয়—প্রথমত এ মুহূর্তে তাদের কর্মীদের শক্তি ক্ষয় করার কাজ বন্ধ করার জন্য। তবে প্রথম মতটির থেকে দ্বিতীয় মতামতটি বেশি গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে—রায়-পরবর্তী শেখ হাসিনার বিবৃতি ও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের বক্তব্যে।

দ্বিতীয় মতটি—আওয়ামী লীগ দ্রুতই তাদেরকে কর্মসূচি থেকে সরিয়ে নেয়—এ কারণে, যদি তারা এই রায় নিয়ে বড় কোনো আন্দোলনে যেত, তাহলে রায়ের যথার্থতাকে পরোক্ষভাবে মেনে নেওয়া হতো। যেখানে আওয়ামী লীগের অবস্থান—‘৫ আগস্ট পূর্ববর্তী সময়ে জুলাই আন্দোলনের সময় তারা যা করেছে তা রাষ্ট্রের স্বার্থে যথার্থ ছিল—এবং এই সরকার অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারী।’ সেখানে সেই সরকারের আমলে দেওয়া কোনো রায় নিয়ে বড় আন্দোলনে যাওয়ার অর্থ পরোক্ষভাবে সরকারকে বৈধতা দেওয়া। তাই ১৩ তারিখ তারা তাদের যে শক্তি প্রদর্শন করেছে সেখানেই তারা থেকে যেতে চায়।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ গঠন করে প্রজ্ঞাপন জারি | দৈনিক আনন্দবাজার

এখন প্রশ্ন—শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে এই রায় পরবর্তীতে আওয়ামী লীগের অবস্থান কী হবে?

আওয়ামী লীগ ৭৬ বছরের একটি রাজনৈতিক দল। এ রাজনৈতিক দলটির যথেষ্ট উত্থান–পতন আছে। আর এই দলটি সম্পর্কে বর্তমান সরকারের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাখাওয়াত ৫ আগস্ট পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের উদ্দেশে বলেছিলেন, “আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের একটি সম্পদ, এই দলটির অনেক অর্জন আছে, এই দলের নেতৃত্বেই আমরা স্বাধীনতা যুদ্ধ করেছি।”
তবে এ মুহূর্তে আওয়ামী লীগের অতীতের রাজনীতি বিশ্লেষণ করে বলা যায়—আওয়ামী লীগের রাজনীতি আগ্রেসিভ রাজনীতি, কখনও ডিফেন্সিভ রাজনীতি নয়। কখনও কখনও আওয়ামী লীগের মূল নেতার বা তার সমমানের নেতাদের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত দেখে মনে হয়—আপোষকামী রাজনীতি। কিন্তু পরবর্তীতে প্রমাণ করে—ওটাই ছিল তার সবচেয়ে বেশি আগ্রেসিভ রাজনীতি।
যেমন ১৯৭১ সালে শেখ মুজিবুর রহমান আন্ডারগ্রাউন্ডে যেতে পারতেন। কিন্তু তিনি পাকিস্তানের কারাগারে গেলেন। তার কারাগারে যাওয়া, তার বিরুদ্ধে এক ধরনের ক্যাঙারু কোর্টে অভিযোগ এনে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া—সবকিছুই আওয়ামী লীগের আগ্রেসিভ রাজনীতিরই প্রমাণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে—ইতিহাসের বিচারে।
এবারও শেখ হাসিনা যেভাবে ৫ আগস্ট দেশ ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন—তাও একটি অবিশ্বাস্য বিষয়। এবং সে রহস্য পৃথিবীর গুটিকয়েক মানুষ ছাড়া বাকিদের কাছে এখনও অস্বচ্ছ ও অজানা—একটি বিস্ময়ও। বাংলাদেশের একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা মেজর (অব.) আখতারুজ্জামান—যিনি বিএনপি নেতাও—তিনি একটি টকশোতে শেখ হাসিনার ৫ তারিখের ভারতে যাওয়াকে বলেছেন—যুদ্ধে শক্তি ক্ষয় না করে রিট্রিট করা। এবং তাঁর মতে শেখ হাসিনাই এ যাবৎকালের বাংলাদেশের সবচেয়ে স্মার্ট সরকারপ্রধান—আর তিনি যে স্মার্টলি ৫ তারিখে রিট্রিট করেছেন তা অন্য কারও পক্ষে সম্ভব হতো না।
শেখ হাসিনার রায়ের দিনের কর্মসূচি থেকে আওয়ামী লীগের এই রিট্রিট করাও রাজনৈতিক বিশ্লেষণে স্মার্ট সিদ্ধান্তই হবে তাদের রাজনৈতিক অবস্থানে দাঁড়িয়ে।

দলের লোগো পরিবর্তন করছে জামায়াত

তাই ৫ তারিখের পর থেকে শেখ হাসিনা বা আওয়ামী লীগ যে পথে তাদের রাজনীতি করে আসছে—বা অতীতেও তারা যে রাজনীতি করেছে—শেখ হাসিনার এই রায়ের পরেও তাদের রাজনীতির পথ পরিবর্তনের কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।
১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের পূর্ব পর্যন্ত আওয়ামী লীগ ও তাদের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনীতি ছিল রিকনসিলিয়েশনের রাজনীতি। কিন্তু ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট-পরবর্তী আওয়ামী লীগের রাজনীতির চরিত্র বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়—তাদের রাজনীতি হচ্ছে বাংলাদেশের ধর্মীয় মৌলবাদী ও বাঙালির ভূমি-নির্ভর সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদী (যার সঙ্গে উদার ইসলাম ও অন্যান্য ধর্মের মানুষের স্বাভাবিক সহযাত্রা থাকে) রাজনীতিকে স্পষ্ট করা এবং মানুষের সামনে এর স্পষ্ট বিভাজন তুলে ধরা।
এ কাজটি শেষ হলে মৌলবাদীদেরও ন্যাচারাল সমর্থক থাকবে, অন্যদিকে ভূমিজাত সংস্কৃতি-নির্ভর জাতীয়তাবাদীদেরও ন্যাচারাল সমর্থক থাকবে। ক্ষমতায় যেই যাক না কেন—রাজনীতি অনেকটা পরিষ্কার হয়ে যাবে বাংলাদেশে। আর রাজনীতি এভাবে যখন বাংলাদেশে স্পষ্ট অবস্থান নেবে, সে সময়ে ওই পক্ষে—অর্থাৎ মৌলবাদ—তাই কঠোর মৌলবাদ হোক বা মডারেট মৌলবাদ হোক—যেই থাকুক না কেন, এ পক্ষে আওয়ামী লীগই থাকবে। কারণ এ পক্ষের টিকে থাকার জন্য স্মারক স্তম্ভগুলো আওয়ামী লীগই তৈরি করেছে।
শেখ হাসিনাও ৫ আগস্ট ২০২৪-এর পরে আন্তর্জাতিক মিডিয়া রয়টার্সকে দেওয়া দেয়া সাক্ষাত্‌কারের কিছু বক্তব্যে তেমনই।তিনি বলেছেন,  —“আওয়ামী লীগ থাকবে। আর দলটি যে তার পরিবারের নেতৃত্বে থাকবে তেমনটি নয়। বরং আওয়ামী লীগসহ ইনক্লুসিভ নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশে সরকার প্রতিষ্ঠিত হতে হবে—সেখানে আওয়ামী লীগ সরকারে বা বিরোধী দলে যেখানেই থাকুক না কেন।”
আসলে বাংলাদেশের রাজনীতিকে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে এই রিয়েলিস্টিক শার্প বিভাজনটা করার চেষ্টা শেখ হাসিনার রাজনীতির প্রায় শুরু থেকেই।
এরশাদ-বিরোধী আন্দোলনের সময় শেখ হাসিনার জোটের কমিউনিস্ট পার্টি ও আধা-কমিউনিস্ট পার্টিগুলো বারবারই শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া—অর্থাৎ আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে এক করার চেষ্টা করেছেন। একবার মাত্র তারা বসেছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত চূড়ান্তভাবে শেখ হাসিনাই এক হওয়ার চেষ্টাকে ভেঙে দেন।
১৯৮৮ সালে চট্টগ্রামে শেখ হাসিনাকে হত্যা করার জন্য পুলিশ গুলি চালালে—যদিও কয়েক শ্রমিক নেতার আত্মদানের ফলে তিনি বেঁচে যান। ওই ঘটনা রাজনীতিতে বড় নাড়া দেয়। আওয়ামী ও বিএনপি–জোটের বামপন্থী ও আধা-বামপন্থীরা মিলে এর প্রতিবাদে হাসিনা ও খালেদার একত্র কর্মসূচি দেন—কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। সেখানে বেগম জিয়া উপস্থিত হলেও শেখ হাসিনা ৩২ নম্বর বঙ্গবন্ধু ভবনেই বসে কর্মী ও সাংবাদিকদের সঙ্গে গল্প করছিলেন।
এমনকি ১৯৯১ সালে নির্বাচনে বড় দল হিসেবে বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট পার্টি (বিএনপি) আবির্ভূত হলে অনেক বুদ্ধিজীবী রাষ্ট্রক্ষমতা ও বিএনপি থেকে জামায়াত ইসলামকে দূরে রাখার জন্য শেখ হাসিনার প্রতি নানা ভাবে অনুরোধ করেন—তিনি যেন বিএনপিকে সমর্থন দেন, বিএনপি সরকার গঠন করুক। শেখ হাসিনা সে কাজ করেননি।

আওয়ামী লীগের সম্মেলন ২৪ ডিসেম্বর | প্রথম আলো

এমনকি এ নিয়ে আওয়ামী লীগের থিঙ্কট্যাঙ্কদের মধ্যেও মতবিরোধ ছিল। অনেকে শেখ হাসিনার প্রতি অখুশিও ছিলেন। তাদের বক্তব্য ছিল—শেখ হাসিনা বাংলাদেশের সেন্টার-রাইটদের ঠেলতে ঠেলতে রাইটিস্ট বা মৌলবাদীদের কোলে তুলে দিচ্ছেন। আর অন্য ধারার বক্তব্য ছিল—শেখ হাসিনা সঠিক আছেন, বিভাজন যতদিন না স্বচ্ছ হবে ততদিন রাজনীতি করা কঠিন থাকবে।
শেখ হাসিনার সাম্প্রতিক সাক্ষাৎকারগুলোর লাইন বিটুইন কিন্তু এমন একটি বিষয় আসছে যে—তিনি ৫ আগস্টের ঘটনা বা জুলাইয়ের মেটিকুলাস ডিজাইনের ফলে বাংলাদেশে যা ঘটেছে—সেটাকে পজিটিভভাবে নিচ্ছেন। তিনি তাঁর বিরুদ্ধে দেওয়া রায়, তাঁর দলের বিপর্যয়—এগুলোকে খুব গুরুত্ব দিচ্ছেন না। তাঁর দলের কর্মীদের এটিটিউডও তেমনি। বরং তারা সবসময়ই খেয়াল রাখছে বা সোশ্যাল মিডিয়ায় তুলে ধরার চেষ্টা করছে—বাংলাদেশের কমপক্ষে ৬ কোটি থেকে ৮ কোটি মানুষ তাদের পক্ষে।
তাদের পক্ষে একটি সংখ্যক মানুষ আছে তা বর্তমান সরকারের সমর্থক মিডিয়ার রিপোর্টিং ও মতামত কলামে প্রায়ই দেখা যায়—তারা শুধুই বলতে চায়—আওয়ামী লীগের ভোট কোথায় যাবে? বিএনপির পক্ষে যাবে, না জামায়াতে ইসলামীর পক্ষে যাবে? হিন্দুদের একটি বড় অংশ আওয়ামী লীগকে ভোট দিত—এবার তারা কী করবে?
অন্যদিকে শেখ হাসিনার সাক্ষাৎকারের লাইন বিটুইন বক্তব্য এবং নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ যে আস্তে আস্তে খোলস ছাড়ছে—সেটা কি শুধু তাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার স্বার্থে—না তাদের সহ নির্বাচনের স্বার্থে?
রাজনীতির ঘটনাপ্রবাহের গতি প্রকৃতি খুবই দ্রুত বদলায়। তাই এ মুহূর্তে শুধু এটুকুই বলা যায়—শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে যে রায় এসেছে তা আওয়ামী লীগের ভবিষ্যত রাজনীতির গতি-প্রকৃতি বদলে যাওয়ার কোনো কারণ নয়। বরং বাস্তবতা হচ্ছে—৭৬ বছরের পুরোনো এই রাজনৈতিক দলটি বড়ই ধীরস্থির। অন্যদিকে তাকে পরাজিত করে মেটিকুলাস ডিজাইনের মাধ্যমে যারা ক্ষমতায় এসেছে—তারা প্রয়োজনের থেকেও বেশি অস্থির। এটাই ভবিষ্যত রাজনীতির গতি-প্রকৃতি নির্ণয়ে একটি বড় নিয়ামক হবে।

লেখকঃ বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত সাংবাদিক, সম্পাদক, সারাক্ষণ, The Present World.

( এই লেখাটি India Today তে প্রকাশিত লেখার বাংলা অুনবাদ। India Today এর লেখার link https://www.indiatoday.in/opinion/story/sheikh-hasina-death-sentence-politics-of-patience-bangladesh-election-awami-league-mujibur-rahman-jamaat-bnp-2825569-2025-11-26

জনপ্রিয় সংবাদ

রিয়াদ মেট্রো বিশ্বের দীর্ঘতম চালকবিহীন ট্রেন নেটওয়ার্কের রেকর্ড গড়ল

শেখ হাসিনার রায় পরবর্তী ধৈর্যে’র রাজনীতি

০৮:৫১:০২ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৮ নভেম্বর ২০২৫

১৭ নভেম্বর শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে রায় দেওয়ার আগে ১৩ নভেম্বর আওয়ামী লীগ অনলাইনের মাধ্যমে ঢাকায় “লকডাউন” কর্মসূচি দিয়েছিল। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে ভারতে গিয়ে আশ্রয় নেওয়ার পরে ১৩ নভেম্বরের “লকডাউন” ছিল আওয়ামী লীগের প্রথম কোনো কর্মসূচি।
ঢাকার মানুষের নিরপেক্ষ মতামত, তারা মনে করেছিল এই কর্মসূচি সর্বোচ্চ ৪০ ভাগ পালিত হবে। কিন্তু দিনশেষে একটি সামগ্রিক নিরপেক্ষ মতামত—৭০ ভাগ পালিত হয়।
এর পরেই রাতে সোশ্যাল ফোরামে আওয়ামী লীগ আবার ৪ দিনের বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি ঘোষণা করে। যার ভেতর শেখ হাসিনার রায়ের আগের দিন ও রায়ের দিন তাদের “শাটডাউন” কর্মসূচি ছিল।
কিন্তু ১৫ তারিখ বিকেলের দিকে সাংবাদিক, ব্যবসায়ীসহ প্রায় সবাই জেনে যায়—আওয়ামী লীগ ১৬ ও ১৭ নভেম্বরের কর্মসূচি প্রত্যাহার না করলেও তা পালনের দিক থেকে তাদের মনোযোগ উঠিয়ে নিয়েছে।
যেহেতু আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল প্রায় সব নেতাই আত্মগোপনে—অন্যদিকে বাংলাদেশে বসে একমাত্র শেখ হাসিনার কর্মীরা ছাড়া কেউ তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে সাহসী হয় না—এমনকি সাংবাদিকতার প্রয়োজনেও।
এ কারণে স্বাভাবিকই দেশের রাজনীতি সচেতন মানুষের একটি সামষ্টিক মতামতই গ্রহণ করা ছাড়া কোনো উপায় থাকে না।
সে মতামতে এমন বিষয়গুলো সামনে এসেছে—আওয়ামী লীগ দ্রুতই তাদের কর্মসূচির ওপর থেকে গুরুত্ব তুলে নেয়—প্রথমত এ মুহূর্তে তাদের কর্মীদের শক্তি ক্ষয় করার কাজ বন্ধ করার জন্য। তবে প্রথম মতটির থেকে দ্বিতীয় মতামতটি বেশি গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে—রায়-পরবর্তী শেখ হাসিনার বিবৃতি ও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের বক্তব্যে।

দ্বিতীয় মতটি—আওয়ামী লীগ দ্রুতই তাদেরকে কর্মসূচি থেকে সরিয়ে নেয়—এ কারণে, যদি তারা এই রায় নিয়ে বড় কোনো আন্দোলনে যেত, তাহলে রায়ের যথার্থতাকে পরোক্ষভাবে মেনে নেওয়া হতো। যেখানে আওয়ামী লীগের অবস্থান—‘৫ আগস্ট পূর্ববর্তী সময়ে জুলাই আন্দোলনের সময় তারা যা করেছে তা রাষ্ট্রের স্বার্থে যথার্থ ছিল—এবং এই সরকার অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারী।’ সেখানে সেই সরকারের আমলে দেওয়া কোনো রায় নিয়ে বড় আন্দোলনে যাওয়ার অর্থ পরোক্ষভাবে সরকারকে বৈধতা দেওয়া। তাই ১৩ তারিখ তারা তাদের যে শক্তি প্রদর্শন করেছে সেখানেই তারা থেকে যেতে চায়।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ গঠন করে প্রজ্ঞাপন জারি | দৈনিক আনন্দবাজার

এখন প্রশ্ন—শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে এই রায় পরবর্তীতে আওয়ামী লীগের অবস্থান কী হবে?

আওয়ামী লীগ ৭৬ বছরের একটি রাজনৈতিক দল। এ রাজনৈতিক দলটির যথেষ্ট উত্থান–পতন আছে। আর এই দলটি সম্পর্কে বর্তমান সরকারের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাখাওয়াত ৫ আগস্ট পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের উদ্দেশে বলেছিলেন, “আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের একটি সম্পদ, এই দলটির অনেক অর্জন আছে, এই দলের নেতৃত্বেই আমরা স্বাধীনতা যুদ্ধ করেছি।”
তবে এ মুহূর্তে আওয়ামী লীগের অতীতের রাজনীতি বিশ্লেষণ করে বলা যায়—আওয়ামী লীগের রাজনীতি আগ্রেসিভ রাজনীতি, কখনও ডিফেন্সিভ রাজনীতি নয়। কখনও কখনও আওয়ামী লীগের মূল নেতার বা তার সমমানের নেতাদের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত দেখে মনে হয়—আপোষকামী রাজনীতি। কিন্তু পরবর্তীতে প্রমাণ করে—ওটাই ছিল তার সবচেয়ে বেশি আগ্রেসিভ রাজনীতি।
যেমন ১৯৭১ সালে শেখ মুজিবুর রহমান আন্ডারগ্রাউন্ডে যেতে পারতেন। কিন্তু তিনি পাকিস্তানের কারাগারে গেলেন। তার কারাগারে যাওয়া, তার বিরুদ্ধে এক ধরনের ক্যাঙারু কোর্টে অভিযোগ এনে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া—সবকিছুই আওয়ামী লীগের আগ্রেসিভ রাজনীতিরই প্রমাণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে—ইতিহাসের বিচারে।
এবারও শেখ হাসিনা যেভাবে ৫ আগস্ট দেশ ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন—তাও একটি অবিশ্বাস্য বিষয়। এবং সে রহস্য পৃথিবীর গুটিকয়েক মানুষ ছাড়া বাকিদের কাছে এখনও অস্বচ্ছ ও অজানা—একটি বিস্ময়ও। বাংলাদেশের একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা মেজর (অব.) আখতারুজ্জামান—যিনি বিএনপি নেতাও—তিনি একটি টকশোতে শেখ হাসিনার ৫ তারিখের ভারতে যাওয়াকে বলেছেন—যুদ্ধে শক্তি ক্ষয় না করে রিট্রিট করা। এবং তাঁর মতে শেখ হাসিনাই এ যাবৎকালের বাংলাদেশের সবচেয়ে স্মার্ট সরকারপ্রধান—আর তিনি যে স্মার্টলি ৫ তারিখে রিট্রিট করেছেন তা অন্য কারও পক্ষে সম্ভব হতো না।
শেখ হাসিনার রায়ের দিনের কর্মসূচি থেকে আওয়ামী লীগের এই রিট্রিট করাও রাজনৈতিক বিশ্লেষণে স্মার্ট সিদ্ধান্তই হবে তাদের রাজনৈতিক অবস্থানে দাঁড়িয়ে।

দলের লোগো পরিবর্তন করছে জামায়াত

তাই ৫ তারিখের পর থেকে শেখ হাসিনা বা আওয়ামী লীগ যে পথে তাদের রাজনীতি করে আসছে—বা অতীতেও তারা যে রাজনীতি করেছে—শেখ হাসিনার এই রায়ের পরেও তাদের রাজনীতির পথ পরিবর্তনের কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।
১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের পূর্ব পর্যন্ত আওয়ামী লীগ ও তাদের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনীতি ছিল রিকনসিলিয়েশনের রাজনীতি। কিন্তু ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট-পরবর্তী আওয়ামী লীগের রাজনীতির চরিত্র বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়—তাদের রাজনীতি হচ্ছে বাংলাদেশের ধর্মীয় মৌলবাদী ও বাঙালির ভূমি-নির্ভর সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদী (যার সঙ্গে উদার ইসলাম ও অন্যান্য ধর্মের মানুষের স্বাভাবিক সহযাত্রা থাকে) রাজনীতিকে স্পষ্ট করা এবং মানুষের সামনে এর স্পষ্ট বিভাজন তুলে ধরা।
এ কাজটি শেষ হলে মৌলবাদীদেরও ন্যাচারাল সমর্থক থাকবে, অন্যদিকে ভূমিজাত সংস্কৃতি-নির্ভর জাতীয়তাবাদীদেরও ন্যাচারাল সমর্থক থাকবে। ক্ষমতায় যেই যাক না কেন—রাজনীতি অনেকটা পরিষ্কার হয়ে যাবে বাংলাদেশে। আর রাজনীতি এভাবে যখন বাংলাদেশে স্পষ্ট অবস্থান নেবে, সে সময়ে ওই পক্ষে—অর্থাৎ মৌলবাদ—তাই কঠোর মৌলবাদ হোক বা মডারেট মৌলবাদ হোক—যেই থাকুক না কেন, এ পক্ষে আওয়ামী লীগই থাকবে। কারণ এ পক্ষের টিকে থাকার জন্য স্মারক স্তম্ভগুলো আওয়ামী লীগই তৈরি করেছে।
শেখ হাসিনাও ৫ আগস্ট ২০২৪-এর পরে আন্তর্জাতিক মিডিয়া রয়টার্সকে দেওয়া দেয়া সাক্ষাত্‌কারের কিছু বক্তব্যে তেমনই।তিনি বলেছেন,  —“আওয়ামী লীগ থাকবে। আর দলটি যে তার পরিবারের নেতৃত্বে থাকবে তেমনটি নয়। বরং আওয়ামী লীগসহ ইনক্লুসিভ নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশে সরকার প্রতিষ্ঠিত হতে হবে—সেখানে আওয়ামী লীগ সরকারে বা বিরোধী দলে যেখানেই থাকুক না কেন।”
আসলে বাংলাদেশের রাজনীতিকে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে এই রিয়েলিস্টিক শার্প বিভাজনটা করার চেষ্টা শেখ হাসিনার রাজনীতির প্রায় শুরু থেকেই।
এরশাদ-বিরোধী আন্দোলনের সময় শেখ হাসিনার জোটের কমিউনিস্ট পার্টি ও আধা-কমিউনিস্ট পার্টিগুলো বারবারই শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া—অর্থাৎ আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে এক করার চেষ্টা করেছেন। একবার মাত্র তারা বসেছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত চূড়ান্তভাবে শেখ হাসিনাই এক হওয়ার চেষ্টাকে ভেঙে দেন।
১৯৮৮ সালে চট্টগ্রামে শেখ হাসিনাকে হত্যা করার জন্য পুলিশ গুলি চালালে—যদিও কয়েক শ্রমিক নেতার আত্মদানের ফলে তিনি বেঁচে যান। ওই ঘটনা রাজনীতিতে বড় নাড়া দেয়। আওয়ামী ও বিএনপি–জোটের বামপন্থী ও আধা-বামপন্থীরা মিলে এর প্রতিবাদে হাসিনা ও খালেদার একত্র কর্মসূচি দেন—কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। সেখানে বেগম জিয়া উপস্থিত হলেও শেখ হাসিনা ৩২ নম্বর বঙ্গবন্ধু ভবনেই বসে কর্মী ও সাংবাদিকদের সঙ্গে গল্প করছিলেন।
এমনকি ১৯৯১ সালে নির্বাচনে বড় দল হিসেবে বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট পার্টি (বিএনপি) আবির্ভূত হলে অনেক বুদ্ধিজীবী রাষ্ট্রক্ষমতা ও বিএনপি থেকে জামায়াত ইসলামকে দূরে রাখার জন্য শেখ হাসিনার প্রতি নানা ভাবে অনুরোধ করেন—তিনি যেন বিএনপিকে সমর্থন দেন, বিএনপি সরকার গঠন করুক। শেখ হাসিনা সে কাজ করেননি।

আওয়ামী লীগের সম্মেলন ২৪ ডিসেম্বর | প্রথম আলো

এমনকি এ নিয়ে আওয়ামী লীগের থিঙ্কট্যাঙ্কদের মধ্যেও মতবিরোধ ছিল। অনেকে শেখ হাসিনার প্রতি অখুশিও ছিলেন। তাদের বক্তব্য ছিল—শেখ হাসিনা বাংলাদেশের সেন্টার-রাইটদের ঠেলতে ঠেলতে রাইটিস্ট বা মৌলবাদীদের কোলে তুলে দিচ্ছেন। আর অন্য ধারার বক্তব্য ছিল—শেখ হাসিনা সঠিক আছেন, বিভাজন যতদিন না স্বচ্ছ হবে ততদিন রাজনীতি করা কঠিন থাকবে।
শেখ হাসিনার সাম্প্রতিক সাক্ষাৎকারগুলোর লাইন বিটুইন কিন্তু এমন একটি বিষয় আসছে যে—তিনি ৫ আগস্টের ঘটনা বা জুলাইয়ের মেটিকুলাস ডিজাইনের ফলে বাংলাদেশে যা ঘটেছে—সেটাকে পজিটিভভাবে নিচ্ছেন। তিনি তাঁর বিরুদ্ধে দেওয়া রায়, তাঁর দলের বিপর্যয়—এগুলোকে খুব গুরুত্ব দিচ্ছেন না। তাঁর দলের কর্মীদের এটিটিউডও তেমনি। বরং তারা সবসময়ই খেয়াল রাখছে বা সোশ্যাল মিডিয়ায় তুলে ধরার চেষ্টা করছে—বাংলাদেশের কমপক্ষে ৬ কোটি থেকে ৮ কোটি মানুষ তাদের পক্ষে।
তাদের পক্ষে একটি সংখ্যক মানুষ আছে তা বর্তমান সরকারের সমর্থক মিডিয়ার রিপোর্টিং ও মতামত কলামে প্রায়ই দেখা যায়—তারা শুধুই বলতে চায়—আওয়ামী লীগের ভোট কোথায় যাবে? বিএনপির পক্ষে যাবে, না জামায়াতে ইসলামীর পক্ষে যাবে? হিন্দুদের একটি বড় অংশ আওয়ামী লীগকে ভোট দিত—এবার তারা কী করবে?
অন্যদিকে শেখ হাসিনার সাক্ষাৎকারের লাইন বিটুইন বক্তব্য এবং নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ যে আস্তে আস্তে খোলস ছাড়ছে—সেটা কি শুধু তাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার স্বার্থে—না তাদের সহ নির্বাচনের স্বার্থে?
রাজনীতির ঘটনাপ্রবাহের গতি প্রকৃতি খুবই দ্রুত বদলায়। তাই এ মুহূর্তে শুধু এটুকুই বলা যায়—শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে যে রায় এসেছে তা আওয়ামী লীগের ভবিষ্যত রাজনীতির গতি-প্রকৃতি বদলে যাওয়ার কোনো কারণ নয়। বরং বাস্তবতা হচ্ছে—৭৬ বছরের পুরোনো এই রাজনৈতিক দলটি বড়ই ধীরস্থির। অন্যদিকে তাকে পরাজিত করে মেটিকুলাস ডিজাইনের মাধ্যমে যারা ক্ষমতায় এসেছে—তারা প্রয়োজনের থেকেও বেশি অস্থির। এটাই ভবিষ্যত রাজনীতির গতি-প্রকৃতি নির্ণয়ে একটি বড় নিয়ামক হবে।

লেখকঃ বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত সাংবাদিক, সম্পাদক, সারাক্ষণ, The Present World.

( এই লেখাটি India Today তে প্রকাশিত লেখার বাংলা অুনবাদ। India Today এর লেখার link https://www.indiatoday.in/opinion/story/sheikh-hasina-death-sentence-politics-of-patience-bangladesh-election-awami-league-mujibur-rahman-jamaat-bnp-2825569-2025-11-26