নয়াদিল্লি – পাকিস্তানকে ঘিরে নিজেদের প্রকাশ্য বক্তব্যে ভারতের পরিবর্তিত সুর এখন বেশ স্পষ্ট, বিশেষ করে ১০ নভেম্বর নয়াদিল্লিতে ঘটে যাওয়া বোমা বিস্ফোরণকে ঘিরে সরকারের তুলনামূলক সংযত প্রতিক্রিয়া বিবেচনায় নিলে। দুই দশকের মধ্যে রাজধানীতে এটি ছিল সবচেয়ে বড় বোমা হামলা।
ঐতিহাসিক লালকেল্লার কাছে সংঘটিত এই হামলায় অন্তত ১৩ জন নিহত হন। প্রাথমিক তদন্তে পাকিস্তানভিত্তিক জইশ-ই-মোহাম্মদ জঙ্গিগোষ্ঠীর সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার ইঙ্গিত পাওয়া গেলেও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সরকার প্রকাশ্যে পাকিস্তানকে দোষারোপ করা থেকে বিরত রয়েছে।
হামলার পরপরই প্রধানমন্ত্রী মোদি সতর্ক করেছিলেন যে পাকিস্তান থেকে উৎসারিত যেকোনো সন্ত্রাসী হামলাকে যুদ্ধের সমতুল্য হিসেবে বিবেচনা করা হবে। তবে এবার সরকার আগের মতো পাকিস্তানকে সরাসরি অভিযুক্ত করেনি, যেমনটি করেছিল গত এপ্রিলে কাশ্মীরের পাহালগাম হামলার পর, যেখানে ২৫ জন ভারতীয় ও একজন নেপালি নিহত হন।
পাহালগামের সেই ঘটনা দুই শত্রুতাপূর্ণ দক্ষিণ এশীয় প্রতিবেশীর মধ্যে ৭ থেকে ১০ মে পর্যন্ত সংঘটিত সীমিত সামরিক সংঘর্ষে রূপ নেয়, যা ভারত ‘অপারেশন সিন্ধুর’ নামে অভিহিত করে।
দিল্লিভিত্তিক ইনস্টিটিউট ফর কনফ্লিক্ট ম্যানেজমেন্টের নির্বাহী পরিচালক অজয় সাহনি বলেন, “এই সংযম মূলত অপারেশন সিন্ধুর পর তাদের নিজস্ব ঘোষণারই ফল। তখন তারা বলেছিল, যেকোনো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডকে যুদ্ধ হিসেবে ধরা হবে। এখন যদি তারা সংযম হারাত, তবে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কঠোর প্রতিক্রিয়ার পথে বাধ্যতামূলকভাবে অগ্রসর হতে হতো।”
তিনি আরও বলেন, এমন প্রতিশ্রুতি থেকে সরে আসা সরকারের জন্য অত্যন্ত কঠিন হতো।

বিশ্ব যখন ইউক্রেন, মধ্যপ্রাচ্য ও সুদানের মতো একাধিক উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে ব্যস্ত, তখন ভারত-পাকিস্তানের উত্তেজনাও ক্রমেই বাড়ছে। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায়ও বড় ধরনের অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে টানাপোড়েন এবং চীনের সঙ্গে সম্পর্ক পুনর্গঠনের মাঝেও ভারতকে নতুন কূটনৈতিক ভারসাম্য খুঁজতে হচ্ছে।
অপারেশন সিন্ধুর পর ভারত বুঝতে পারে, পাকিস্তান পাহালগাম হামলায় জড়িত নয় বলে দাবি করলেও বিশ্বনেতারা ভারতের অবস্থানের প্রতি খুব বেশি সমর্থন দেখাচ্ছেন না। সীমান্তের ওপারে হামলার আগে পাকিস্তানের জড়িত থাকার পর্যাপ্ত প্রমাণ উপস্থাপন করতেও ব্যর্থ হয়েছিল ভারত। এই পরিস্থিতিতে ভারত ক্রস-বর্ডার সন্ত্রাসবাদের বিষয়ে নিজেদের অবস্থান তুলে ধরতে ৩৩টি দেশে সর্বদলীয় প্রতিনিধি দল পাঠায়।
অজয় সাহনি বলেন, “অপারেশনের অপ্রত্যাশিত পরিণতি ছিল কূটনৈতিক ব্যয়। আজ পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে আরও ভালো অবস্থানে রয়েছে।”
চীন-পাকিস্তান ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ২০২৫ সালের মার্কিন কংগ্রেস রিপোর্টেও উল্লেখ করা হয়েছে। রিপোর্টে বলা হয়, মে মাসের ভারত-পাকিস্তান সংঘর্ষকে চীন নিজেদের সর্বাধুনিক অস্ত্র ও গোয়েন্দা প্রযুক্তি পরীক্ষার সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করেছে।
পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার দাবি করেন, ৭ মে চীনা তৈরি জে-১০সি জেট ব্যবহার করে পাকিস্তান পাঁচটি ভারতীয় যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করে, যার মধ্যে রাফালে ছিল। ভারত এ দাবি অস্বীকার করলেও মে মাসের শেষে নিশ্চিত করে যে ওই সংঘর্ষে তারা বেশ কয়েকটি যুদ্ধবিমান হারিয়েছে, যদিও সংখ্যা প্রকাশ করেনি। অক্টোবরে ভারতীয় বায়ুসেনা প্রধান আমর প্রীত সিং দাবি করেন, ভারত অন্তত পাঁচটি পাকিস্তানি বিমান ভূপাতিত করেছে।
ট্রাম্প প্রশাসনের আমলে যুক্তরাষ্ট্র আবারও পাকিস্তানের দিকে ঝুঁকছে, যদিও সেখানে ওসামা বিন লাদেনকে খুঁজে পাওয়া ও হত্যা করা হয়েছিল। পাকিস্তান গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য ও ট্রানজিট রুটে অবস্থিত এবং আফগানিস্তান ও ইরানের সঙ্গেও সীমান্ত রয়েছে।
অতীতের মার্কিন প্রশাসনগুলো চীনের বিপরীতে ভারসাম্য রক্ষায় ভারতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুললেও ট্রাম্পের আমলে ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে। ট্রাম্প ভারতীয় পণ্যের ওপর ৫০ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক আরোপ করেছেন, যার মধ্যে রুশ তেল কেনার কারণে ২৫ শতাংশ শাস্তিমূলক শুল্কও রয়েছে।
ট্রাম্প দাবি করেছেন, তিনি ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধবিরতি আনতে সাহায্য করেছেন। তবে তৃতীয় পক্ষের মধ্যস্থতা ভারতের জন্য স্পর্শকাতর বিষয় হওয়ায় এ দাবি দেশটিতে ভালোভাবে গ্রহণ করা হয়নি।
বিশ্লেষকদের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এ অনিশ্চয়তার কারণেও পাকিস্তানকে ঘিরে ভারতের সতর্ক কৌশল দেখা যাচ্ছে।
সিঙ্গাপুর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ এশিয়া ইনস্টিটিউটের গবেষণা ফেলো অমিত রঞ্জন বলেন, “পাহালগামের পর বিশ্ব প্রমাণ চাইছিল। তাই এবার তারা নিশ্চিত হতে চাইছে লালকেল্লা হামলার পেছনে পাকিস্তানের সংশ্লিষ্টতা আছে কি না। তারপরই ব্যবস্থা নিতে পারে।”
লালকেল্লা বিস্ফোরণের তদন্তে উঠে এসেছে ‘হোয়াইট-কলার টেরর মডিউল’-এর তথ্য। এতে দেখা গেছে, ভারতীয় একদল চিকিৎসক আনসার ঘজওয়াত-উল-হিন্দ (আল-কায়েদা সংশ্লিষ্ট সংগঠন) এবং জইশ-ই-মোহাম্মদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে চরমপন্থায় জড়িয়ে পড়েছেন। কাশ্মীরের বিভিন্ন স্থানে জইশ-এর পোস্টার লাগানোর সূত্র ধরেই এই সেল শনাক্ত করে পুলিশ। এখন পর্যন্ত ছয়জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
অভিযুক্ত আত্মঘাতী হামলাকারী উমর-উন-নবি আল-ফালাহ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ চিকিৎসা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সহকারী অধ্যাপক। ১৪ নভেম্বর কর্তৃপক্ষ তাঁর কাশ্মীরের বাড়ি ভেঙে দেয়।
যদিও কেন্দ্র সরকারের শীর্ষ নেতারা সংযত ছিলেন, ২২ নভেম্বর মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী দেবেন্দ্র ফড়নবিস প্রকাশ্যে পাকিস্তানকে দোষারোপ করেছেন।
পাকিস্তানও একইভাবে দ্রুত প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে। লালকেল্লা বিস্ফোরণের একদিন পরই ১১ নভেম্বর ইসলামাবাদে আত্মঘাতী হামলায় ১২ জন নিহত হলে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফ ভারতকে ‘রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসবাদে’ জড়িত বলে অভিযোগ করেন। ভারত এ অভিযোগ ভিত্তিহীন বলে প্রত্যাখ্যান করেছে।
২৫ নভেম্বর পাকিস্তানের তথ্যমন্ত্রী আতাউল্লাহ তারার দাবি করেন, ওই হামলার পরিকল্পনা হয়েছিল আফগানিস্তান থেকে এবং নিষিদ্ধ তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তানের প্রধান নূর ওয়ালি মেহসুদ এর পেছনে ছিলেন।
২০২৫ সালের ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনার কেন্দ্রেও রয়েছে কাশ্মীর—যা উভয় প্রতিবেশী পুরোপুরিভাবে দাবি করে। আলাদা অংশের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে তারা দুইবার পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ এবং একবার সীমিত সংঘর্ষে জড়িয়েছে।
ভারত বহুদিন ধরেই অভিযোগ করে আসছে যে পাকিস্তান বিচ্ছিন্নতাবাদ উসকে দিচ্ছে এবং সন্ত্রাসীদের মদত দিচ্ছে। পাকিস্তান এসব অভিযোগ অস্বীকার করে।
অন্যদিকে পাকিস্তান-আফগানিস্তান সম্পর্কও এখন উত্তেজনাপূর্ণ। পাকিস্তান দাবি করছে, তালেবান আফগানিস্তানে এমন যোদ্ধাদের আশ্রয় দিচ্ছে যারা পাকিস্তানে হামলা বাড়িয়ে তুলেছে।
দুই দেশের দীর্ঘস্থায়ী শত্রুতা থাকায় ভবিষ্যতে কী ঘটবে তা বলা কঠিন। সীমান্তজুড়ে এখনও বিপুলসংখ্যক সেনা মোতায়েন রয়েছে, যা প্ররোচনার ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।
ড. রঞ্জন বলেন, “দীর্ঘমেয়াদে ভারত ও পাকিস্তান কী করবে তা ভবিষ্যদ্বাণী করা কঠিন। কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার আগে ভারতকে সব দিকই বিবেচনা করতে হবে।”
নির্মলা গণপতি 



















