পানি বহু যুগ ধরে নবায়নযোগ্য জ্বালানির অন্যতম প্রধান উৎস। দুই হাজার বছর আগে চীনারা শস্য মাড়াইয়ের জন্য জলচাকা ব্যবহার করত। ১৭০০ সালের দিকে জলচাকা ব্রিটেনে শিল্প বিপ্লবের সূচনা ঘটায়। ১৮৭০-এর দশকে শিল্পপতি উইলিয়াম আর্মস্ট্রং ব্রিটেনের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় বাড়ি ক্র্যাগসাইডে বিশ্বের প্রথম জলবিদ্যুৎ ব্যবস্থা স্থাপন করেন। এবার আবিষ্কারের নতুন ধারা এগোচ্ছে ‘অস্মোসিস’ নামের স্বাভাবিক প্রক্রিয়াকে কাজে লাগিয়ে।
অস্মোসিস কী এবং কীভাবে বিদ্যুৎ তৈরি হয়
অস্মোসিস হলো এমন একটি প্রক্রিয়া যেখানে কম লবণাক্ত পানি একটি অর্ধভেদ্য ঝিল্লি পেরিয়ে বেশি লবণাক্ত পানির দিকে প্রবাহিত হয়। দুই পাশের ঘনত্ব সমান না হওয়া পর্যন্ত এ প্রবাহ চলতে থাকে। এই প্রবাহের ফলে লবণাক্ত দিকের পানির পরিমাণ বাড়ে এবং সেখানকার পানি টারবাইনের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহার করা যায়। ভবিষ্যতে এই প্রযুক্তি উপকূলীয় অঞ্চল, যেমন অস্ট্রেলিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের সম্প্রদায়গুলোকে স্থায়ী জ্বালানি সরবরাহ করতে পারে। একই সঙ্গে এটি লবণমুক্ত পানি তৈরির কারখানা—ডেসালিনেশন প্ল্যান্ট—থেকে অতিরিক্ত শক্তি পুনরুদ্ধারেও সহায়ক হতে পারে। জাপান ও ফ্রান্সে চলমান নতুন প্রকল্পগুলো এ প্রযুক্তির অগ্রগতিকে আরও দৃশ্যমান করেছে।
ফুকুওকায় জাপানের অগ্রগতি
২০২৫ সালের আগস্টে জাপানের কিউশু দ্বীপের উত্তর উপকূলে ফুকুওকা শহরে ৭০০ মিলিয়ন ইয়েন ব্যয়ে একটি অস্মোসিস বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু হয়। ১১০ কিলোওয়াট উৎপাদনক্ষম এই প্ল্যান্ট প্রায় ২০০ পরিবারের বিদ্যুতের চাহিদা মেটাতে পারে। উৎপাদিত শক্তি শহরের পাশের লবণমুক্ত পানি উৎপাদনকারী ডেসালিনেশন প্ল্যান্ট পরিচালনায় ব্যবহার হবে।

ডেসালিনেশন প্ল্যান্টে সাধারণত ‘রিভার্স অস্মোসিস’ পদ্ধতিতে উচ্চচাপে লবণাক্ত পানি ঝিল্লির মাধ্যমে সরিয়ে লবণ বাদ দেওয়া হয়। এতে অত্যন্ত লবণাক্ত বর্জ্য পানি তৈরি হয়, যা সমুদ্রে ফিরিয়ে দিলে পরিবেশের ক্ষতি হতে পারে। ফুকুওকার নতুন প্ল্যান্টটি ডেসালিনেশন প্ল্যান্টের সেই অতি-লবণাক্ত বর্জ্যকে সম্পদ হিসেবে ব্যবহার করছে, কারণ এটি অস্মোসিসকে আরও দ্রুত কার্যকর করে। তাজা পানি ব্যবহার না করে প্ল্যান্টটি শহরের পয়ঃশোধনাগার থেকে প্রক্রিয়াজাত পানি ব্যবহার করে। পানি কর্তৃপক্ষ আশা করছে ভবিষ্যতে সমুদ্রের লবণাক্ত পানি সরাসরি মিশিয়ে আরও বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব হবে।
প্রযুক্তিগত উন্নতি: উন্নত ঝিল্লির ব্যবহার
অস্মোসিস প্রযুক্তির অন্যতম বড় উন্নতি এসেছে বিশেষভাবে নকশা করা ঝিল্লি (মেমব্রেন) তৈরির মাধ্যমে। এগুলো দিয়ে পানি দ্রুত প্রবাহিত হয় এবং দূষণ জমে ঝিল্লি বন্ধ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাও কম। একই কারণে ডেসালিনেশন প্ল্যান্টগুলো আরও কার্যকর হচ্ছে।
ফ্রান্সে বৃহৎ প্রকল্পের প্রস্তুতি
ফ্রান্সের দক্ষিণে রোন নদীর ডেল্টায় সুইচ এনার্জি একটি অস্মোসিস বিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণ করছে। ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের উষ্ণ আবহাওয়া ও উচ্চ বাষ্পীভবনের কারণে এখানকার পানি বেশি লবণাক্ত—যা অস্মোসিস বিদ্যুতের জন্য বিশেষ উপযোগী। পরীক্ষামূলক প্ল্যান্ট সফল হলে প্রতিষ্ঠানটি আগামী দশকে ৫০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার একটি বড় কেন্দ্র নির্মাণ করতে চায়, যা মার্সেই শহর ও আশপাশের ১৯ লাখ মানুষের বিদ্যুৎ চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম হবে। প্রতিষ্ঠানটির আরও কয়েকটি দেশেও একই ধরনের প্রকল্প চলছে।

ব্যাটারি-ধর্মী ‘আয়ন অস্মোসিস’ প্রযুক্তি
সুইচ এনার্জির প্রযুক্তি প্রচলিত পানিপ্রবাহভিত্তিক অস্মোসিসের চেয়ে আলাদা। এখানে ব্যবহৃত ঝিল্লি দিয়ে কেবল পানি নয়, বরং চার্জযুক্ত কণা—আয়ন—পাস করতে পারে। আয়নের এই চলাচল বৈদ্যুতিক বিভব তৈরি করে, যা ব্যাটারির মতো সরাসরি বিদ্যুৎ উৎপাদন করে। রোন নদীর তীরে স্থাপিত এই জেনারেটরগুলোতে একাধিক আয়ন-নির্বাচনকারী ঝিল্লি স্তরে স্তরে সাজানো থাকে, যার মধ্যে দিয়ে নদীর মিঠা পানি ও ডেল্টার লবণাক্ত পানি প্রবাহিত হয়। আগে এ ধরনের ঝিল্লি তৈরি অত্যন্ত ব্যয়বহুল ছিল। এখন প্রতিষ্ঠানটি কাঠসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক উপাদান দিয়ে ন্যানোটিউব ব্যবহার করে সস্তা ও কার্যকর ঝিল্লি বানাতে সক্ষম হয়েছে। যদিও তাদের প্রযুক্তিগত বিবরণ গোপন রাখা হয়েছে।
ব্যয়ের দিক থেকে সম্ভাবনা
সুইচ এনার্জির লক্ষ্য প্রতি মেগাওয়াট-ঘণ্টা বিদ্যুৎ উৎপাদনের গড় ব্যয় ১০০ ডলারের নিচে নামিয়ে আনা। সৌর ও বায়ুশক্তির কিছু উৎস আরও সস্তা হলেও আবহাওয়া অনির্ভরশীলতার কারণে সেখানে ব্যাটারি প্রয়োজন হয়। কিন্তু অস্মোসিস বিদ্যুৎ নদী থেকে সমুদ্রে পানির প্রবাহ যতদিন থাকবে—দিনরাত যেকোনো আবহাওয়ায়—নিয়মিত শক্তি সরবরাহ করতে সক্ষম হবে।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















