যে সময়টিকে আমার পেশাগত জীবনের সবচেয়ে প্রভাবশালী অধ্যায় বলে মনে করেছি, তা ছিল শিল্প উন্নয়ন মন্ত্রণালয়ের উৎপাদনশীলতা উপদেষ্টা হিসেবে আমার দায়িত্ব পালন। এই দায়িত্ব আমি চাইনি, বরং একটি সংবাদপত্রে “জাতীয় উৎপাদনশীলতা বর্ষ” নিয়ে সমালোচনামূলক লেখা প্রকাশের পর মন্ত্রণালয় আমাকে আহ্বান করে—“যেহেতু সমালোচনা করছেন, তাহলে এসে সাহায্যও করুন।” এই মনোভাবই দেখায়, কীভাবে সমালোচনাকে গঠনমূলক কাজে রূপান্তর করা যায়।
আমি সঙ্গে সঙ্গে রাজি হই। শ্রীলঙ্কার উৎপাদনশীলতা বাড়ানো আমার কাছে শুধু আগ্রহ নয়—এটা জাতীয় প্রয়োজন মনে হয়েছিল। এরপরের অভিজ্ঞতাগুলো অনেক শিক্ষায় ভরপুর—কখনো হাস্যকর, কখনো কঠিন, আবার কখনো অত্যন্ত বাস্তবমুখী।
উচ্চপর্যায়ের আমলাদের সামনে অবাঞ্ছিত প্রেজেন্টেশন
মন্ত্রণালয়ের সচিব মনে করলেন, উৎপাদনশীলতার আলোচনার শুরু হওয়া উচিত সর্বোচ্চ সরকারি পর্যায় থেকে। তাই তিনি আমাকে ‘ডেভেলপমেন্ট সেক্রেটারিজ’—বিভিন্ন উন্নয়ন মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ আমলাদের সভায় বক্তৃতার আয়োজন করে দেন।
আমি প্রেজেন্টেশন সেটআপ করতে আগেভাগে উপস্থিত হই। একে একে সবাই ঢুকে সন্দেহের দৃষ্টিতে ল্যাপটপ–প্রজেক্টর দেখে বললেন—
“আমরা উৎপাদনশীলতা জানি।”
“এটা অপ্রয়োজনীয়।”
“আজ সময় কম, একটু ছোট করে বলবেন?”
৪৫ মিনিটের প্রেজেন্টেশন নামতে নামতে ৩০, তারপর ২০ মিনিটে এসে দাঁড়ায়।

একজন ফিলিপিনো বিশেষজ্ঞের কথা মনে পড়ল—উনার সময় ৪৫ থেকে ২০ মিনিটে কমানো হলে তিনি বলেন, “তো, আমি কনটেন্ট বাদ দিলাম, চার্ট বাদ দিলাম, শুধু কৌতুকগুলো রাখলাম!” অবশ্যই আমি এমন রিস্ক নিলাম না।
কিন্তু যখন শুরু করলাম, সবাই চুপচাপ শুনলেন, প্রশ্ন করলেন, শেষ পর্যন্ত স্লাইড চাইলেন। সন্দেহকে আগ্রহে রূপান্তর করার প্রথম সফলতা সেটাই।
মালয়েশিয়া–সিঙ্গাপুর ভ্রমণ: উৎপাদনশীলতার বাস্তব পাঠ
অল্পদিন পরই আমাদের তিনজন—আমি, এনআইবিএমের ডিজি ও লেসলি ডি’ভেন্দ্রা—মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরে স্টাডি ট্যুরে যাই। দুটো দেশই কয়েক দশকে নিজেদের বদলে ফেলেছে।
মূল শিক্ষা: নেতৃত্বই উৎপাদনশীলতার জ্বালানি
দুই দেশেই উৎপাদনশীলতা কোনো আমলাতান্ত্রিক গহ্বরে আটকে নেই। রাজনৈতিক নেতৃত্ব তা কেন্দ্র থেকে পরিচালনা করে। বার্ষিক থিম নির্ধারিত হয়, মন্ত্রণালয়গুলো সেই অনুযায়ী কাজ করে।
একটি মূল বিশ্বাস—
উৎপাদনশীল সরকারি ব্যবস্থা ছাড়া উৎপাদনশীল বেসরকারি খাত গড়ে ওঠে না।

মালয়েশিয়া: এমপিসির কঠোরতা, মান ও ধারাবাহিকতা
মালয়েশিয়ার জাতীয় উৎপাদনশীলতা সংস্থা—Malaysia Productivity Corporation (MPC)—ছিল অত্যন্ত শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান।
১৯৬৬: এনপিসি হিসেবে যাত্রা—জাপানি ‘কোয়ালিটি সার্কেলস’, কর্মী সম্পৃক্ততা ও প্রাথমিক উৎপাদনশীলতা চর্চা।
১৯৯০–এর দশক: এমপিসি নামে রিব্র্যান্ড—প্রতিযোগিতা, উদ্ভাবন, প্রক্রিয়া পুনর্গঠন যোগ হয়।
২০০০–২০১০: লিন ম্যানেজমেন্ট, রেগুলেটরি রিফর্ম, জাতীয় ব্যবসা প্রক্রিয়া উন্নয়ন।
২০২০–এর দশক: ডিজিটাল রূপান্তরের নেতৃত্ব, ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বে শীর্ষ ১২ প্রতিযোগিতাশীল অর্থনীতির লক্ষ্য।
এমপিসি ছিল শক্তিশালী আইনি ক্ষমতাসম্পন্ন স্বশাসিত সংস্থা, কোনো মন্ত্রণালয়ের কোণে লুকোনো ছোট ইউনিট নয়।
তাদের বলতেই শুনলাম—
সব মন্ত্রণালয়কে ওই বছরেই ISO 9001 নিতে হবে।
আমি জিজ্ঞেস করলাম—“না নিলে?”
তারা বলল—“মাহাথির সময়সীমা দিলে সবাই পালন করে। কেউ সাহস করে উপেক্ষা করে না।”
নেতৃত্বের শক্তির এটাই সেরা উদাহরণ।
সিঙ্গাপুর: যেখানে উৎপাদনশীলতাই জীবনধারা
সিঙ্গাপুরের সরকারি ব্যবস্থা, পরিবহন, জনপরিসর—সবই শৃঙ্খলা ও দক্ষতার নিদর্শন।

‘ফাইন সিটি’ দর্শন
“ফাইন ফর লিটারিং”, “ফাইন ফর ইটিং ইন ট্রেনস”, “ফাইন ফর স্মোকিং”—সর্বত্রই নিয়ম–শৃঙ্খলা।
স্প্রিং সিঙ্গাপুরের টয়লেট শিক্ষা
টয়লেটে লেখা—
“ফ্লাশ না করলে ২০ ডলার জরিমানা।”
আমি তিনবার ফ্লাশ করলাম।
প্রশ্ন করা হলে তারা হাসি দিয়ে বলল—
“শুধু শ্রীলঙ্কানরাই জিজ্ঞেস করে—কে ধরবে?”
ওরা বলল—সিঙ্গাপুরে মানুষ নিয়ম মানে কারণ এটিই সঠিক। ধরা–খাওয়ার ভয়ে নয়।
স্প্রিং → এন্টারপ্রাইজ সিঙ্গাপুর: ধারাবাহিকতার মডেল
১৯৭২: সিঙ্গাপুর প্রোডাক্টিভিটি বোর্ড
পরবর্তীতে SISIR–এর সঙ্গে একীভূত হয়ে PSB
২০০০–এর দশকে SPRING Singapore
২০১৮: IE Singapore–এর সঙ্গে একীভূত হয়ে Enterprise Singapore
তাদের লক্ষ্য ছিল—রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ তৈরি করা, প্রতিক্রিয়া দেখানো নয়।

শ্রীলঙ্কার দুঃখজনক তুলনা
মালয়েশিয়ার এমপিসি আছে।
সিঙ্গাপুরের স্প্রিং/এন্টারপ্রাইজ সিঙ্গাপুর আছে।
দুটিই শক্তিশালী আইনি ক্ষমতাসম্পন্ন প্রতিষ্ঠান।
শ্রীলঙ্কার আছে—National Productivity Secretariat (NPS)—একটি ছোট ইউনিট, না আছে ক্ষমতা, না স্থায়িত্ব।
আমরা প্রস্তাব দিয়েছিলাম এটিকে শক্তিশালী আইনগত সংস্থা করার। এপিও–তেও প্রস্তাব পাঠানো হয়েছিল। কিছুই হয়নি।
এটাই দেশের প্রতিযোগিতা–সংকটের নীরব ট্র্যাজেডি।
এনপিএস গঠনের লড়াই
আইনি কাঠামো না থাকলেও আমরা এনপিএস নামে পরিচিতি তৈরি করি। স্টিয়ারিং কমিটি ছিল, কিন্তু তর্ক–বিতর্ক থামত না।
লোগো নিয়েই মাসের পর মাস ঝামেলা—কেউ বলছে ফল–ভর্তি গাছ, কেউ বলছে 4M—মানুষ, মেশিন, টাকা, পদ্ধতি।

আমি নিজেই একটি এজেন্সিকে দিয়ে ডিজাইন করালাম (বিনা খরচে), মন্ত্রীর অনুমোদন এনে বললাম—
“মন্ত্রী অনুমোদন দিয়েছেন, এখন গ্রহণ করি?”
সবার সম্মতি হয়ে গেল।
এটাই দেখায়—নেতৃত্ব মানে কখনো কখনো নরম দক্ষতায় এগোনো।
নীতিনির্ধারকদের জন্য শিক্ষা
১. উৎপাদনশীলতা রাজনৈতিক নেতৃত্বের বিষয়
২. শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান ছাড়া জাতীয় রূপান্তর সম্ভব নয়
৩. সরকারি খাতের উৎপাদনশীলতাই মূল চালিকা শক্তি
৪. আচরণগত শৃঙ্খলা রাষ্ট্র গঠনের ভিত্তি
৫. সংস্কার টিকিয়ে রাখতে সাহস লাগে, শুধু কমিটি নয়
শেষ ভাবনা
উৎপাদনশীলতা কোনো প্রযুক্তিগত শব্দ নয়। এটি একটি জাতীয় মানসিকতা। জাপান, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়ার মতো দেশগুলো উৎপাদনশীলতাকে স্থায়ী রাষ্ট্রীয় অগ্রাধিকার হিসেবে ধরে রেখেছে।
শ্রীলঙ্কার সম্ভাবনা আছে। কিন্তু সম্ভাবনা যথেষ্ট নয়—প্রয়োজন নেতৃত্ব, শৃঙ্খলা, ধারাবাহিকতা ও কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়ার সাহস।
আমি চাই ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব এই অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে শ্রীলঙ্কাকে সত্যিকার রূপান্তরের পথে নিয়ে যাক।
লেখক :
সুনীল জি. বিজেসিঙ্গা,
উৎপাদনশীলতা ও জাপানি ব্যবস্থাপনা–বিশেষজ্ঞ
অবসরপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান/ডিরেক্টর
এপিও আঞ্চলিক পুরস্কারপ্রাপ্ত
জাপান সরকারের ‘অর্ডার অব দ্য রাইজিং সান’ পদকপ্রাপ্ত
সুনীল জি. বিজেসিঙ্গা 



















