লাক্সারি বাজারে ধীরগতির আভাসের মাঝেই নতুন কৌশল
বিশ্বের সবচেয়ে বড় লাক্সারি কনগ্লোমারেট এলভিএমএইচ তাদের ফ্যাশন বিভাগে বড় ধরনের নেতৃত্ব পরিবর্তনের ঘোষণা দিয়েছে। ডিওরের সফল প্রধান পিয়েত্রো বেক্কারিকে এখন পুরো ফ্যাশন গ্রুপের চেয়ারম্যান ও সিইও করা হচ্ছে—অর্থাৎ তার হাতে যাচ্ছে ডজনখানেক প্রভাবশালী ব্র্যান্ডের দিকনির্দেশনা। এই সিদ্ধান্ত এসেছে এমন এক সময়ে, যখন প্রাডা সদ্য ভেরসাচে কিনে নিয়েছে এবং উচ্চ প্রান্তের ফ্যাশন বাজার আগের তুলনায় অনেক বেশি প্রতিযোগিতামূলক ও সতর্ক।
গত এক দশকে চীনা গ্রাহক, পর্যটক এবং মহামারী–পরবর্তী “রিভেঞ্জ শপিং”–এর ঢেউ লাক্সারি বিক্রিকে যে গতিতে ঠেলেছে, তা এখন আর তত তীব্র নয়। কিছু দেশে ক্রেতারা দামি ব্যাগ ও কুটুরের বদলে অপেক্ষাকৃত সাশ্রয়ী বিকল্প বেছে নিচ্ছেন, আবার তরুণ প্রজন্ম অনেক বেশি সচেতন—কোন ব্র্যান্ড তাদের ব্যক্তিত্ব আর মূল্যবোধের সঙ্গে মানায়, সেটাই বড়। এই প্রেক্ষাপটে এলভিএমএইচ চায় তাদের প্রতিটি ফ্যাশন হাউস যেন স্পষ্টভাবে আলাদা পরিচয় নিয়ে দাঁড়াতে পারে, একে অন্যের বিকল্প হয়ে না ওঠে। ডিওরে বেক্কারির নেতৃত্বে একদিকে ঐতিহ্যকে উজ্জ্বল করা, অন্যদিকে সাহসী পরীক্ষা–নিরীক্ষার যে মিশেল দেখা গেছে, তা তাকে স্বাভাবিকভাবেই বড় দায়িত্বের সামনে এনে দাঁড় করিয়েছে।

নতুন ভূমিকায় বেক্কারির জন্য অপেক্ষা করছে বিনিয়োগ ও গল্প বলার নরম–কঠিন মিশ্র এক সমীকরণ। কিছু ব্র্যান্ডে হয়তো নতুন ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর আনতে হবে, কোথাও আবার রেডি–টু–ওয়্যার লাইনকে শক্ত করতে হবে। অন্যদিকে কিছু লেবেল হয়তো আরও বেশি জোর দেবে লেদারগুডস ও অ্যাকসেসরিজে, যেখানে লাভের মার্জিন বেশি। একই সঙ্গে উঠছে প্রশ্ন—উদীয়মান বাজারগুলোতে কতটা আক্রমণাত্মকভাবে সম্প্রসারণ করা যায়, যাতে স্টোর বাড়ে, কিন্তু ব্র্যান্ডের এক্সক্লুসিভিটিও নষ্ট না হয়। সিউল, রিয়াদ থেকে ব্যাংকক—নতুন নতুন শহরে ফ্ল্যাগশিপ স্টোর খোলার পরিকল্পনা করে এলভিএমএইচ, কিন্তু খুব বেশি দেখা–সোনা হয়ে গেলে “দুষ্প্রাপ্যতার জাদু” কমে যাওয়ার ঝুঁকিও রয়েছে।
লাক্সারির এই ক্ষমতার রদবদল আসলে কেবল ব্যবসায়িক খবর নয়; এটি জীবনযাপন ও রুচির রাজনীতিকেও প্রভাবিত করে। বড় ফ্যাশন হাউসের রানওয়ে থেকে যে ধারা লঞ্চ হয়, কিছুদিনের মধ্যেই তার প্রতিফলন দেখা যায় হাই–স্ট্রিট ব্র্যান্ড, ইনস্টাগ্রাম ফিড আর বিবাহের লেহেঙ্গা–শাড়িতেও। তাই এলভিএমএইচের ফ্যাশন–কৌশলের নতুন রূপ এশিয়ার নতুন মধ্যবিত্তের পোশাক, গহনা আর উৎসবের সাজেও প্রভাব ফেলবে—চাই তারা ঢাকায় থাকুন, চাই ম্যানিলায়।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো স্থায়িত্ববিষয়ক প্রতিশ্রুতি। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে লাক্সারি গ্রুপগুলো টেকসই কাঁচামাল, ট্রেসেবল সাপ্লাই চেইন আর রিপেয়ার সার্ভিস নিয়ে অনেক বড় বড় কথা বলেছে; কিন্তু বাস্তব অগ্রগতি অনেক ক্ষেত্রেই অসম কিংবা সীমিত। ফ্যাশন গ্রুপের মতো শক্তিশালী ইউনিটের প্রধান চাইলে প্রতিটি ব্র্যান্ডকে বাধ্য করতে পারেন পরিবেশগত রিপোর্টিং এক ছাঁচে আনতে, পুনর্ব্যবহারযোগ্য উপাদান অন্বেষণে বিনিয়োগ বাড়াতে এবং পণ্য মেরামতকে “সার্ভিস” নয়, বরং পরিচয়ের অংশ হিসেবে দেখাতে।
বিনিয়োগকারীরা আপাতত এই রদবদলকে ইতিবাচক সংকেত হিসেবেই ধরছেন। তাদের ধারণা, অভিজ্ঞ ও পরিচিত এক নেতা ফ্যাশন গ্রুপের দায়িত্ব নিলে ক্রিয়েটিভ দিক থেকে ধারাবাহিকতা বজায় রাখা সহজ হবে, বিশেষত এমন সময় যখন কিছু প্রতিদ্বন্দ্বী হাউস ডিজাইনার পাল্টানোর ধাক্কায় তাল সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে। তবে অর্থনীতির বৃহত্তর ওঠানামা থেকে কোনো লাক্সারি গ্রুপই সম্পূর্ণ মুক্ত নয়—মার্কিন বা ইউরোপীয় বাজারে মন্দা দেখা দিলে তার ঢেউ শেষ পর্যন্ত পৌঁছায় প্যারিস, মিলান কিংবা টোকিওর ফ্ল্যাগশিপ স্টোরেও।
দোকানের বাস্তবতায় এই পরিবর্তন অনুভূত হবে ধীরে ধীরে। নিয়মমতোই ভিআইপি ক্রেতাদের জন্য থাকবে শ্যাম্পেন, প্রাইভেট ভিউয়িং আর ব্যক্তিগত মেসেজিং। কিন্তু কয়েক মৌসুমের মধ্যে দেখা যাবে, কোন ধরনের ব্যাগ বেশি প্রাধান্য পাচ্ছে, কোন কাস্টমার–ইভেন্টে কতটা জোর দেওয়া হচ্ছে, কিংবা নতুন ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর হিসেবে কাকে বেছে নেওয়া হচ্ছে—এসব জায়গায় ফুটে উঠবে বেক্কারির স্বাক্ষর। তিনি যদি ডিওরে গড়ে তোলা নাটকীয়তা আর দৃঢ় ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গি একসঙ্গে পুরো গ্রুপে প্রয়োগ করতে পারেন, তাহলে ২০২০–এর দশকের শেষভাগে “লাক্সারি” বলতে আমরা যা বুঝি, তার অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে রাখবে এলভিএমএইচ।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















