ব্যক্তিগত পছন্দ থেকে ঝুঁকি মূল্যায়ন—সবখানে বটের প্রভাব
আজকের অনেক ব্যবহারকারী শুধু কাজ নয়, ব্যক্তিগত জীবনের ছোট ছোট সিদ্ধান্তেও এআই চ্যাটবটের দ্বারস্থ হচ্ছেন। কেউ বাজারের ফল কেনার পরামর্শ চাইছেন, কেউ সন্তানদের নিয়ে দুশ্চিন্তায় কী করবেন জানতে চাইছেন, আবার কেউ বাড়ির কাছে থাকা গাছটি ঝড়ে ভেঙে পড়বে কি না তা জানতে ছবি পাঠাচ্ছেন বটকে। এমনও ঘটেছে, এক ব্যবহারকারী দিনে আট ঘণ্টা পর্যন্ত নিজস্ব এআই সহকারীর সঙ্গে কথা বলেছেন—এই দীর্ঘ সময়ের সম্পৃক্ততা ধীরে ধীরে তার সিদ্ধান্ত নেওয়ার ধরনকে বদলে দিয়েছে। অনেকের জন্য বট এখন কেবল একটি টুল নয়; বরং স্থায়ী সঙ্গী।
এই আচরণকে মনোবিজ্ঞানীরা তুলনা করছেন স্মার্টফোন–নির্ভর নেভিগেশনের সঙ্গে। যেভাবে মানুষ ধীরে ধীরে নিজের এলাকার পথ ভুলতে শুরু করেছিল, এখানেও তেমনি প্রতিটি সিদ্ধান্তে বটকে জিজ্ঞেস করতে করতে নিজের অন্তরজ্ঞানকে অবিশ্বাস করার প্রবণতা তৈরি হচ্ছে। কেউ কেউ সাক্ষাৎকারের আগে পর্যন্ত বটকে দিয়ে সম্ভাব্য প্রশ্ন সাজিয়ে নেন এবং তার ভিত্তিতে নিজের উত্তর প্রস্তুত করেন। ফলে “বাস্তব” আলাপেও অদৃশ্যভাবে বটের ছাপ রয়ে যায়।
কেন এই নির্ভরতা এত আকর্ষণীয়
কারণ বোঝা কঠিন নয়। চ্যাটবট ক্লান্ত হয় না, সবসময়ই সৌজন্যমূলক, আবার দ্রুত উত্তর দেয়। অনিশ্চয়তার মুহূর্তে বট সংক্ষিপ্তভাবে তথ্য সাজিয়ে দিতে পারে, ঝগড়া মেটানোর জন্য কথোপকথনের খসড়া দিতে পারে, আবার ব্যক্তিগত দ্বিধায় সান্ত্বনা হিসেবেও পাশে থাকে। বহু দায়িত্ব সামলানো ব্যস্ত মানুষের কাছে এই তাৎক্ষণিক সহায়তা মনস্তাত্ত্বিক চাপ কমায়।
কিন্তু শঙ্কা রয়েছে অন্য জায়গায়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দীর্ঘদিন ধরে এভাবে বাহ্যিক পরামর্শের ওপর ভরসা করলে নিজের বিচারশক্তিতে ভরসা কমে যেতে পারে। সব সমস্যার একটিই “সেরা” সমাধান আছে—এই ধারণা স্বাভাবিক ভুল থেকে শেখার ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। কেউ কেউ এমনকি এই নির্ভরতাকে জুয়ার আসক্তির সঙ্গে তুলনা করেন—প্রতিটি নতুন প্রম্পট যেন আরও নিখুঁত উত্তরের প্রতিশ্রুতি দেয়।
সীমানা টানা কেন গুরুত্বপূর্ণ
এআই পুরোপুরি বাদ দেওয়ার কথা কেউ বলছেন না; বরং ব্যবহারকে সচেতনভাবে সীমাবদ্ধ রাখাই মূল পরামর্শ। কেউ কেউ কাজের ড্রাফট, অনুবাদ বা গবেষণার জন্য বট ব্যবহার করেন, কিন্তু সম্পর্ক, আবেগ বা পরিবার–সংক্রান্ত সিদ্ধান্তে মানুষের পরামর্শকেই অগ্রাধিকার দেন। কেউ কেউ দিনের নির্দিষ্ট সময়কে ‘এআই–মুক্ত’ রাখেন—কোন পথে হাঁটবেন, রাতের খাবারে কী খাবেন, কোন বই পড়বেন—এসব ছোট সিদ্ধান্ত ইচ্ছাকৃতভাবে নিজেরাই নেন।
বড় প্রশ্নটি সামাজিক। যদি কোটি কোটি মানুষ একই অ্যালগরিদমিক পরামর্শ অনুসরণ করে, তবে কি আমাদের রুটিন, কেনাকাটা বা মতামত একরকম হয়ে যাবে? আবার সুচিন্তিত সিস্টেম মানুষকে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি দেখাতেও পারে—যদি ব্যবহারকারীরা সচেতন থাকেন পরামর্শের উৎস এবং উদ্দেশ্য সম্পর্কে। ঠিক এই সচেতনতার অভাবেই নির্ভরতা বিপদে রূপ নিতে পারে।
ভবিষ্যতের রেখাচিত্র
এই অভ্যাস যেভাবে বাড়ছে, তাতে মনে হচ্ছে এআই ভবিষ্যতে ম্যাপ বা মেসেজিং অ্যাপের মতোই দৈনন্দিন জীবনের অংশ হয়ে উঠবে। পার্থক্য হলো—এআই শুধু তথ্য সাজায় না, মানুষের অনুভূতি ও বিচারেও প্রভাব ফেলতে পারে। কেউ কেউ বলছেন, বট তাদের ‘চিন্তার সঙ্গী’ হয়ে উঠেছে; আবার কেউ বলছেন, সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় নিজেদের কণ্ঠের বদলে বটের কণ্ঠই মাথায় ভেসে ওঠে। প্রযুক্তি যত মানবসুলভ হচ্ছে, এই প্রভাব তত বাড়বে—যদি না আমরা নিজেরাই সীমা টেনে দিই।
সিদ্ধান্ত নেওয়ার স্বাধীনতা, মানসিক স্বাস্থ্যে প্রভাব আর সচেতন ব্যবহারের প্রশ্নগুলো সামনে আরও তীব্র হয়ে উঠবে। অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে এগোনোর যে মানবিক অভিজ্ঞতা—তা প্রযুক্তি পুরোপুরি প্রতিস্থাপন করতে পারে না। তাই সাহায্য আর নির্ভরতার মাঝের সূক্ষ্ম রেখাটি ধরে রাখা ক্রমেই গুরুত্বপূর্ণ হবে।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















