হঠাৎ করে ১৫০টিরও বেশি ফ্লাইট বাতিল হওয়ায় দেশের বড় বড় বিমানবন্দরে নেমেছে তীব্র বিশৃঙ্খলা। নতুন ক্রু–রোস্টার বিধি, সফটওয়্যার আপডেটের জটিলতা এবং খারাপ আবহাওয়ার প্রভাব মিলিয়ে ইন্ডিগো–র পরিচালনায় তৈরি হয়েছে নজিরবিহীন সংকট। যাত্রীরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে পড়ে ক্ষোভে ফেটে পড়ছেন।
বুধবার যাত্রী আটকে হাজারো
বুধবার অন্তত ১৫০টি ফ্লাইট বাতিল করল ইন্ডিগো। নতুন ক্রু রোস্টার বিধির প্রভাবে শুরু হওয়া সামান্য অপারেশনাল সমস্যা দ্রুতই বড় সংকটে রূপ নেয়। দিল্লি, মুম্বাই, বেঙ্গালুরু ও হায়দ্রাবাদসহ বড় বিমানবন্দরগুলোতে যাত্রীরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষায় থেকে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানান।
ইন্ডিগোর সতর্কতা: পরের ৪৮ ঘণ্টায় আরও বাতিল হতে পারে
সংস্থাটি জানিয়েছে, আগামী ৪৮ ঘণ্টায় ফ্লাইট বাতিলের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে।
তাদের দাবি—
• প্রযুক্তিগত জট
• খারাপ আবহাওয়া
• বিমানবন্দরে ভিড়
• নতুন এফ–ডি–টি–এল (ফ্লাইট ডিউটি টাইম লিমিটেশন) নীতি
এগুলো মিলিয়েই পরিস্থিতি অস্বাভাবিকভাবে জটিল হয়েছে।

জরুরি সফটওয়্যার আপডেটেই বিপত্তি
নভেম্বরের ২৯–৩০ তারিখে এয়ারবাস এ–থ্রি–টু–জিরো (এ৩২০) বিমানে জরুরি সফটওয়্যার প্যাচ ইনস্টল করতে হয়। সেই আপডেটের পর থেকেই ক্রু রোস্টারিংয়ে বড় ধরনের গোলযোগ তৈরি হয়। নতুন এফ–ডি–টি–এল নীতি সংস্থাকে অতিরিক্ত সময় ও নমনীয়তার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করে।
ডিজিসিএর তথ্যমতে, শুধু নভেম্বরেই ইন্ডিগো ১,২৩২টি ফ্লাইট বাতিল করেছে, যার ৭৫৫টি সরাসরি এফ–ডি–টি–এল–সংক্রান্ত সমস্যা থেকে এসেছে। সময়মতো ফ্লাইট ছাড়ার হার ৮৪ শতাংশ থেকে কমে ৬৭ দশমিক ৭ শতাংশে নেমে যায়।
দিল্লি বিমানবন্দরে ব্যাগেজ সিস্টেম ভেঙে পড়া
বুধবার দিল্লির টার্মিনাল–ওয়ান ও টার্মিনাল–থ্রি–তে ব্যাগেজ সিস্টেমে ত্রুটি দেখা দেয়।
টার্মিনাল–থ্রি–তে সমস্যা কম থাকলেও টার্মিনাল–ওয়ান–এ দুপুর ১টা ৩০ থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত গুরুতর বিঘ্ন ঘটে।
যাত্রীরা অভিযোগ করেন, গ্রাউন্ড স্টাফও যথাসময়ে উপস্থিত ছিলেন না।
দেশজুড়ে যাত্রীদের চরম ক্ষোভ
দিল্লি, বেঙ্গালুরু, হায়দ্রাবাদ ও মুম্বাইয়ে শতাধিক ফ্লাইট বাতিল হওয়ায় যাত্রীরা ক্ষোভে সোশ্যাল মিডিয়ায় অভিযোগে ভরিয়ে দেন টাইমলাইন।
একজন ৭৬ বছরের যাত্রী গৌতম পাটিল বলেন,
“৪০ ঘণ্টার ভ্রমণের পর বৃহস্পতিবার সকাল ৫টা ৩০–এর আগে কোনো ফ্লাইট নেই বলা হয়েছে। আমরা দিল্লিতে থাকি না; কোনো থাকার ব্যবস্থাও দেয়নি।”
পুনের নেহা মুলায়ে বলেন,
“কোচি যাওয়ার দু’টি কানেক্টিং ফ্লাইটই মিস করেছি।”
আরেক যাত্রী জানান,
“মুম্বাইগামী ফ্লাইটে পাঁচ ঘণ্টা দেরি। প্রতি ১৫ মিনিটে নতুন ঘোষণা, কিন্তু কোনো স্বচ্ছতা ছিল না।”

নতুন এফ–ডি–টি–এল নীতি: ক্লান্তি কমাতে গিয়ে সংকট বাড়ল
জুলাই ও নভেম্বর—দুই ধাপে চালু হওয়া এফ–ডি–টি–এল নীতিতে রয়েছে:
• সাপ্তাহিক ৪৮ ঘণ্টা বিশ্রাম
• রাতের অপারেশন সময় বাড়ানো
• রাতের ল্যান্ডিং সীমা সপ্তাহে ৬ থেকে কমিয়ে ২
পাইলটের ঘাটতি আগে থেকেই ছিল। নতুন নীতির ফলে চাপ আরও বৃদ্ধি পায়। এর সঙ্গে যুক্ত হয় এয়ারবাসের জরুরি নির্দেশ—৩৬৬টির মধ্যে ২০০টি বিমানে সফটওয়্যার আপডেট বাধ্যতামূলক।
এক সাবেক কর্মকর্তা বলেন,
“ফ্লাইট পুরোপুরি বাতিল না হলেও দেরি হচ্ছিল, ফলে এফ–ডি–টি–এল–এর সময়সীমা শেষ হয়ে যাচ্ছিল।”
চেন্নাই অঞ্চলে ঘূর্ণিঝড় ফেঙ্গাল–এর প্রভাবও পরিস্থিতিকে জটিল করে তোলে।
ডিজিসিএর তদন্ত শুরু
বুধবার ডিজিসিএ ইন্ডিগোকে তলব করে এবং সমস্ত কারণ–ব্যাখ্যা ও ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনা জমা দিতে নির্দেশ দেয়।
‘এক ধরনের বিমান’–নির্ভর কৌশলই এখন দুর্বলতা
ইন্ডিগোর ব্যবসায়িক মডেল মূলত এক ধরনের বিমান—এয়ারবাস এ–থ্রি–টু–জিরো পরিবার—ব্যবহারের ওপর নির্ভরশীল। এতে প্রশিক্ষণ, রক্ষণাবেক্ষণ ও খুচরা যন্ত্রাংশের ব্যয় কম হয়।
কিন্তু সমস্যাও রয়েছে—
একই মডেলের বিমানে সফটওয়্যার আপডেট বাধ্যতামূলক হলে বিকল্প মডেলের বিমান ব্যবহার করা যায় না।
এয়ার ইন্ডিয়া ও অন্যান্য সংস্থার মতো বৈচিত্র্যময় বহর না থাকায় ইন্ডিগোর বিকল্প প্রায় শূন্য।
ফলে একমুখী বহরই সংস্থার প্রধান দুর্বলতা হিসেবে সামনে আসছে।
সময়মতো ফ্লাইট ছাড়ার হার তলানিতে
মঙ্গলবার অন–টাইম পারফরম্যান্স মাত্র ৩৫ শতাংশ—যা দেশের সব বিমান সংস্থার মধ্যে সবচেয়ে কম। সাধারণত ইন্ডিগো এই সূচকে ৮০ শতাংশের ওপরে থাকে।

ইন্ডিগোর ব্যাখ্যা: দিন–রাত চেষ্টা চলছে
ইন্ডিগো জানিয়েছে, তারা প্রতিদিন ২,২০০ থেকে ২,৩০০টি ফ্লাইট পরিচালনা করে এবং তাদের দল ২৪ ঘণ্টা পরিস্থিতি সামলাতে কাজ করছে।
যাত্রীদের বিকল্প ভ্রমণ বা রিফান্ড—যা প্রযোজ্য তা দেওয়া হচ্ছে বলেও সংস্থা জানায়।
তাদের অনুরোধ—যাত্রীরা বিমানবন্দরে যাওয়ার আগে ওয়েবসাইটে ফ্লাইট স্ট্যাটাস দেখে নেবেন।
পাইলট সংগঠনের অভিযোগ: পরিকল্পনার ঘাটতিই বড় সংকট তৈরি করেছে
এয়ারলাইন পাইলটস অ্যাসোসিয়েশন অফ ইন্ডিয়া জানায়,
বিমান সংস্থাগুলো ১৫ দিন আগে রোস্টার সমন্বয় করলে পরিস্থিতি এড়ানো যেত।
কিন্তু তারা যথাসময়ে প্রস্তুতি নেয়নি।
পরিকল্পনার ঘাটতিই আজকের এই বিপর্যয়ের জন্য দায়ী বলে তাদের অভিযোগ।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















