কাচ্চাতিভু নিয়ে ভারত–শ্রীলঙ্কার রাজনৈতিক উত্তেজনা আলোচনার কেন্দ্র দখল করলেও প্রকৃত সংকট আরও গভীর—পাক-বেই ও মান্নার উপসাগরে শিল্পোৎপাদনভিত্তিক বটম ট্রলিং, মৎস্যসম্পদের মারাত্মক ক্ষয়, এবং দুই দেশের উপকূলীয় পরিবেশের দ্রুত অবনতি। সার্বভৌমত্ব নয়, টিকে থাকা এখন মূল প্রশ্ন।
কাচ্চাতিভু প্রশ্নে নতুন করে নজর
কাচ্চাতিভু দ্বীপকে ঘিরে সাম্প্রতিক সময়ে দুই দেশের জেলে, রাজনীতিক এবং বিচার বিভাগের দৃষ্টি আবারও কেন্দ্রীভূত হয়েছে। বহু আলোচনার পর সমাধান হওয়া ইস্যুটি নতুন মাত্রা পায় এই বছরের সেপ্টেম্বরে, যখন শ্রীলঙ্কার রাষ্ট্রপতি অনুরা কুমারা দিসানায়েকা দ্বীপটি পরিদর্শন করেন। প্রথমবারের মতো শ্রীলঙ্কার একজন রাষ্ট্রপ্রধান এই বিতর্কে আগ্রহ প্রকাশ করলেন।
একই সময়ে ভারতের প্রধান বিচারপতি সূর্য কান্ত সরাসরি কিছু না বললেও পরিবেশগত সহযোগিতাকে তিনি টিকে থাকার শর্ত হিসেবে উল্লেখ করেন।
সীমান্ত ও মালিকানা বিতর্ক
১৯৭৪ ও ১৯৭৬ সালের চুক্তির মাধ্যমে ভারত–শ্রীলঙ্কা আন্তর্জাতিক সামুদ্রিক সীমারেখা (IMBL) নির্ধারণ করে। এতে কাচ্চাতিভুর মালিকানা শ্রীলঙ্কার বলে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি পায়।
এই চুক্তিতে ভারতীয় জেলেদের শ্রীলঙ্কার জলে ঐতিহ্যগত মাছ ধরার অধিকার স্বীকার করা হয়নি। একই সময়ে শ্রীলঙ্কান জেলেরা উইজ ব্যাংক ও পেদ্রো ব্যাংকের মতো দীর্ঘদিনের মাছ ধরার এলাকা হারায়, যা ভারতের নিয়ন্ত্রণে যায়। তবু ভারতীয় জেলেরা এখনও ঐতিহ্যগত অধিকারের দাবি জানিয়ে আসছে।

চুক্তি থাকা সত্ত্বেও কেন উত্তেজনা অব্যাহত
চুক্তি সম্পন্ন হলেও রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থের কারণে কাচ্চাতিভু ও অবৈধ মাছ ধরার ইস্যু টিকে আছে। তামিলনাড়ুর দাবি সার্বভৌমত্ব নয়—সমৃদ্ধ মৎস্যক্ষেত্রে প্রবেশাধিকার রক্ষা করাই তাদের মূল উদ্দেশ্য।
২০২৪ সালের মধ্য জুলাই পর্যন্ত শ্রীলঙ্কা ২৪টি ভারতীয় ট্রলার ও ১৮১ জন জেলেকে আটক করে। এরপরও আগস্ট থেকে নভেম্বর পর্যন্ত বেশ কয়েক দফায় ট্রলার ও জেলে জব্দের ঘটনা ঘটে।
প্রকৃত সংকট: বটম ট্রলিং ও পরিবেশ ধ্বংস
তামিলনাড়ুর দাবি কাচ্চাতিভুকে কেন্দ্র করে বিরোধ সৃষ্টি হলেও বাস্তবে ভারতীয় ট্রলারগুলো শ্রীলঙ্কার উত্তর, উত্তর-পশ্চিম ও পূর্ব উপকূলে পর্যন্ত ঢুকে পড়ছে। কাচ্চাতিভু কেবল রাজনৈতিক আড়াল—মূল সমস্যা হলো বাণিজ্যিক মুনাফার জন্য নির্বিচার বটম ট্রলিং।
বটম ট্রলিং সমুদ্রতলের বাস্তুসংস্থান ধ্বংস করে, কিশোর মাছ ও প্রজাতি-নাশী প্রাণী নিধন করে এবং মোট আহরণের প্রায় ৩০ শতাংশই অপচয় হয়।
১৯৯৫ সালে যেখানে ৩৫ হাজার মেট্রিক টন মাছ পাওয়া যেত, ২০২৩ সালে তা নেমে এসেছে মাত্র ১৭ হাজার টনে—শ্রীলঙ্কার উত্তরাঞ্চলের একদা সমৃদ্ধ মৎস্যশিল্পের নিঃশব্দ পতনের পরিষ্কার প্রমাণ।
রাজনৈতিক সুযোগসন্ধান
শ্রীলঙ্কার জলসীমা লঙ্ঘনকারী ট্রলার আটক হলেই তামিলনাড়ুতে বিক্ষোভ শুরু হয় এবং দিল্লির ওপর চাপ সৃষ্টি করার চেষ্টা চলে। নির্বাচনী রাজনীতিতে কাচ্চাতিভুকে ভোটের ইস্যুতে রূপ দেওয়া হয়।
অন্যদিকে শ্রীলঙ্কা গত পঞ্চাশ বছরে সেন্ট অ্যান্থনি গির্জা, সংস্কার ও বার্ষিক উৎসবের বাইরে কাচ্চাতিভু নিয়ে বড় কোনো রাজনৈতিক উত্তেজনা সৃষ্টি করেনি।

বিজ্ঞানভিত্তিক সমাধানের প্রয়োজন
কাচ্চাতিভুর মালিকানা নির্ধারিত হলেও পাক-বেইয়ের পরিবেশগত সংকট ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। এখন প্রয়োজন রাজনীতি ও লাভ-লোকসান চিন্তা বাদ দিয়ে টেকসই ব্যবস্থাপনা ও বিজ্ঞানভিত্তিক সমাধানে যাওয়া।
পাথফাইন্ডার ফাউন্ডেশন বহু বছর আগে কাচ্চাতিভু দ্বীপে একটি সামুদ্রিক গবেষণা কেন্দ্র স্থাপনের প্রস্তাব দেয়। এমন একটি কেন্দ্র জাতীয় সংস্থা (মৎস্য বিভাগ, NARA, বিশ্ববিদ্যালয়) এবং ভারতের গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করতে পারে, যেমন—
অবৈধ বটম ট্রলিংয়ের ক্ষতি পরিমাপ
জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশগত ক্ষয়ক্ষতি পর্যবেক্ষণ
মাছের প্রজনন ও অভিবাসন নথিভুক্তকরণ
মৎস্যসম্পদ বৃদ্ধির বৈজ্ঞানিক নির্দেশনা উন্নয়ন
দ্বিপাক্ষিক বৈজ্ঞানিক তথ্য বিনিময় সহজতর করা
সৌরশক্তি, ডেসালিনেশন প্ল্যান্ট, ব্যাটারি স্টোরেজ ও পরিবেশবান্ধব স্যানিটেশন এখন অল্প খরচে স্থাপনযোগ্য—অতএব প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা বড় বাধা নয়।
পাক-বেইয়ের দ্রুত অবনতি রোধে ভারত–শ্রীলঙ্কার ঘনিষ্ঠ সামুদ্রিক সহযোগিতা জরুরি। নিষ্পত্তি হওয়া চুক্তিকে পুনরায় খোলার চেয়ে বিজ্ঞানভিত্তিক মৎস্যসম্পদ ব্যবস্থাপনা উভয় দেশের জন্যই অধিক লাভজনক হবে।
শ্রীলঙ্কাকে রাজনৈতিক সুবিধাবাদ পরিহার করে স্থিতিশীলতা ও টেকসই উন্নয়নের পথে নেতৃত্ব দিতে হবে। দীর্ঘমেয়াদি জাতীয় স্বার্থে পাথফাইন্ডার ফাউন্ডেশন ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় সহযোগিতা করতে প্রস্তুত।
#কাচ্চাতিভু #ভারত_শ্রীলঙ্কা #পাকবেই #মৎস্যসংকট #ট্রলিং #পরিবেশসংকট #সারাক্ষণরিপোর্ট
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















