যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নতুন জাতীয় নিরাপত্তা কৌশল বলছে, কোনো দেশকে এমন পর্যায়ে শক্তিশালী হতে দেওয়া যাবে না, যাতে তা মার্কিন স্বার্থের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। শুধু বৈশ্বিক প্রভাবই নয়, এমনকি কোনো অঞ্চলে একক আধিপত্যও রোধ করার বিষয়টি গুরুত্ব পেয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, এটি মূলত চীনকে লক্ষ্য করেই বলা হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের মূল বার্তা: কোনো দেশের একক আধিপত্য নয়
প্রকাশিত কৌশলপত্রে ‘চীনের’ নাম সরাসরি উল্লেখ নেই। তবে বলা হয়েছে, ইন্দো-প্যাসিফিকে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ভারতকে আরও বড় ভূমিকা নিতে হবে। জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার মতো কোয়াড সদস্যদের সঙ্গে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র এশিয়ায় ‘‘কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী দেশের একক আধিপত্য’’ রোধে কাজ করবে।
কৌশলপত্রটি হোয়াইট হাউস বৃহস্পতিবার রাতে নীরবে প্রকাশ করে। ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন প্রতিশ্রুতি কমানোর জন্য এটি ‘রেস্ট্রেইনার’ গোষ্ঠীর প্রশংসা পেলেও, ইন্দো-প্যাসিফিকে চীনকে প্রতিরোধের ওপর জোর স্পষ্ট।
তাইওয়ান ইস্যু: মার্কিন কৌশলের কেন্দ্রবিন্দু
কৌশলপত্রে বলা হয়েছে, উত্তর-পূর্ব এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মাঝখানে অবস্থান করায় তাইওয়ান একটি কৌশলগত বিভাজক রেখা। পাশাপাশি বৈশ্বিক বাণিজ্যের এক-তৃতীয়াংশ দক্ষিণ চীন সাগর দিয়ে চলাচল করে। ফলে ‘‘তাইওয়ানকে কেন্দ্র করে সংঘাত প্রতিরোধ করা এবং সামরিক সক্ষমতায় এগিয়ে থাকা’’ যুক্তরাষ্ট্রের জন্য অগ্রাধিকার।
সবচেয়ে আলোচিত অংশটি হলো তাইওয়ান বিষয়ে মার্কিন ‘‘দীর্ঘদিনের ঘোষণাপত্র নীতি’’ বজায় রাখার ঘোষণা। এতে বলা হয়, ‘‘যুক্তরাষ্ট্র তাইওয়ান প্রণালীর স্থিতাবস্থা কোনো পক্ষের একতরফা পরিবর্তনকে সমর্থন করে না।’’
এটি রাজনৈতিক মহলে আলোচনার জন্ম দিয়েছে, কারণ এর আগে ধারণা করা হচ্ছিল ট্রাম্প হয়তো ভাষা পরিবর্তনে রাজি হতে পারেন। চীন চাইছিল যুক্তরাষ্ট্র শুধু ‘সমর্থন না করা’ নয়, বরং ‘বিরোধিতা’ করার অবস্থান প্রকাশ করুক। কেউ কেউ আশঙ্কা করেছিলেন ট্রাম্প হয়তো ‘শান্তিপূর্ণ একীকরণকে’ সমর্থন পর্যন্ত জানাতে পারেন।
নীতির ভাষা পরিবর্তন নিয়ে বিতর্ক
আমেরিকান এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের গবেষক জ্যাক কুপার বলছেন, নতুন ভাষায় দুটি পৃথক অবস্থানকে একত্র করা হয়েছে—
১. যুক্তরাষ্ট্র সাধারণত স্থিতাবস্থা পরিবর্তনের ‘বিরোধিতা’ করে
২. তবে যুক্তরাষ্ট্র তাইওয়ান স্বাধীনতাকে ‘সমর্থন করে না’
এই দুটি অবস্থান মিলে অস্পষ্টতা তৈরি হয়েছে বলে তিনি মনে করেন। তাঁর মতে, ভাষাগত এই পরিবর্তন ভবিষ্যতে শব্দচয়ন বদলের সুযোগ রাখে।
আরেক বিশেষজ্ঞ রায়ান ফেদাসিয়ুক মনে করেন, এটি হয়তো ইচ্ছাকৃত ‘‘মধ্যমপন্থী’’ অবস্থান, যা বেইজিংকে পুরোপুরি সন্তুষ্ট না করলেও উত্তেজনা কমানোর চেষ্টা।
জার্মান মার্শাল ফান্ডের বিশেষজ্ঞ বনি গ্লেজার বলেছেন, বেইজিং সন্দেহ করতেই থাকবে যে আগের ঘোষণায় থাকা ‘‘তাইওয়ান স্বাধীনতাকে সমর্থন না করা’’ এখন আর যুক্তরাষ্ট্রের নীতি নয়।
চীনের কূটনৈতিক চাপ বাড়বে
আগামী বছরে ট্রাম্প-শি একাধিকবার বৈঠক করতে পারেন। গ্লেজারের মতে, প্রতিটি আলোচনায় শি জিনপিং চাপ দেবেন, যাতে ট্রাম্প আরও স্পষ্টভাবে ‘‘তাইওয়ান স্বাধীনতার বিরোধিতা’’ ও ‘‘চীনের পুনরেকত্রীকরণকে সমর্থন’’ জানান।
অক্টোবরে দক্ষিণ কোরিয়ায় ট্রাম্প-শি বৈঠকের পর তাইওয়ান উল্লেখ না থাকায় কার্নেগি এনডাউমেন্টের গবেষক তং ঝাও বলেন, বেইজিং মনে করছে ‘‘ঐতিহাসিক সুযোগ’’ এসেছে মার্কিন নীতি নিজেদের অনুকূলে ঘুরিয়ে নেওয়ার। তাঁর মতে, চীন মনে করছে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর তাদের ভূ-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব এখন অনেক বেশি, তাই তারা ওয়াশিংটনের চিন্তা ও সিদ্ধান্তে চাপ দিতে পারবে।
ঝাও আরও বলেন, ২০২৬ সালের এপ্রিল মাসে ট্রাম্পের বেইজিং সফরের আগে চীন তাঁকে নিজের একীকরণ বয়ানে রাজি করাতে নানা প্রলোভন ও চাপ ব্যবহার করতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ সংকেত: নীতিতে সূক্ষ্ম পরিবর্তন
ট্রাম্প প্রশাসনের দ্বিতীয় মেয়াদের শুরুতে পররাষ্ট্র দপ্তর নিজেদের ওয়েবসাইটে থাকা একটি লাইন মুছে দেয়— যেখানে লেখা ছিল ‘‘আমরা তাইওয়ান স্বাধীনতাকে সমর্থন করি না’’। রেখে দেওয়া হয় শুধু এই অংশ: যুক্তরাষ্ট্র কোনো পক্ষের একতরফা স্থিতাবস্থা পরিবর্তনের বিরোধিতা করে।
এক প্রশাসনিক কর্মকর্তা জানান, এটি কোনো নতুন নীতি পরিবর্তন নয়। তাঁর ভাষায়, ‘‘আমরা মনে করি না যে আমাদের অবস্থান প্রকাশ্যে বলা সবসময় সহায়ক। স্থিতাবস্থা বজায় রাখা এবং একতরফা পরিবর্তন না হওয়াই যথেষ্ট বার্তা।’’
আগামী কূটনৈতিক সময়সূচি
২০২৬ সালে ট্রাম্প ও শি চারবার পর্যন্ত দেখা করতে পারেন—
এপেক সম্মেলনে চীন
জি-২০ সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্র
দুই দেশের রাষ্ট্রীয় সফর
এ প্রতিটি পর্যায়ে তাইওয়ান ইস্যুতে বেইজিংয়ের চাপ আরও বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
#যুক্তরাষ্ট্র-চীন সম্পর্ক | ট্রাম্প প্রশাসন | তাইওয়ান সংকট | ইন্দো-প্যাসিফিক নিরাপত্তা
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















