এ সপ্তাহে দ্বিপক্ষীয় শীর্ষ বৈঠকে যোগ দিতে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ভারত সফরকে নয়াদিল্লির ‘সিদ্ধান্ত নেওয়ার স্বাধীনতা’ ও ‘কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন’-এর নীতির প্রকাশ হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর। রুশ তেল ও প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম কেনা কমানোর জন্য যুক্তরাষ্ট্রের চাপে থাকার পরও শনিবার তিনি এ কথা বলেন।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও পুতিনের বৈঠকে পাঁচ বছরের একটি অর্থনৈতিক কর্মসূচি, বাণিজ্যে বৈচিত্র্য ও ভারসাম্য আনা, চলাচল–সংক্রান্ত একটি চুক্তি এবং জ্বালানি খাতে অংশীদারত্ব আরও গভীর করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়। ২৩তম হিন্দুস্তান টাইমস লিডারশিপ সামিটে বক্তব্য দিতে গিয়ে জয়শঙ্কর বলেন, গত প্রায় আট দশকে বৈশ্বিক রাজনীতিতে নানা উত্থান–পতনের মধ্যেও ভারত–রাশিয়া সম্পর্ক বড় শক্তিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে স্থিতিশীল সম্পর্কগুলোর একটি হিসেবে টিকে আছে।
পুতিনের সফর কি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কে জটিলতা তৈরি করেছে—এ প্রশ্নের জবাবে জয়শঙ্কর বলেন, ভারত সব বড় দেশের সঙ্গেই সম্পর্ক বজায় রাখে এবং দিল্লি তার কূটনৈতিক সম্পর্ক কীভাবে গড়ে তুলবে, তা কোনো দেশই নির্ধারণ করতে পারে না। তিনি বলেন, “আমরা বারবার পরিষ্কার করেছি, আমাদের বহুমাত্রিক সম্পর্ক রয়েছে। আমাদের নিজস্ব সিদ্ধান্ত নেওয়ার স্বাধীনতা আছে। আমরা কৌশলগত স্বায়ত্তশাসনের কথা বলি এবং তা এখনো অব্যাহত আছে। কেউ কেন উল্টো কিছু আশা করবে, তা আমার বোধগম্য নয়।”
হাস্যরসের ছলে ব্রিটিশ অভিনেতা হিউ গ্রান্টের সেশনের পর মঞ্চে উঠার প্রসঙ্গ টেনে জয়শঙ্কর বলেন, বর্তমানে পররাষ্ট্রনীতি অনেক সময় যেকোনো সিনেমার চেয়েও বেশি উত্তেজনাপূর্ণ। তিনি ব্যাখ্যা করেন, পুতিনের এই সফরের মূল লক্ষ্য ছিল ভারত–রাশিয়া সম্পর্ককে নতুনভাবে কল্পনা ও গড়ে তোলা, কারণ অর্থনৈতিক সম্পর্ক প্রতিরক্ষা ও কৌশলগত সম্পর্কের মতো গতিতে এগোয়নি।

তিনি বলেন, “রাশিয়া পশ্চিমা দেশগুলো এবং চীনকে তাদের প্রধান অর্থনৈতিক অংশীদার হিসেবে দেখেছে। আমরাও সম্ভবত একইভাবে ভেবেছি। ফলে দুই দেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ক পিছিয়ে পড়েছিল। এই সফর মূলত সেই সম্পর্ককে নতুনভাবে গড়ে তোলার ব্যাপারেই ছিল।” তিনি আরও বলেন, ভারতে রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে বিপুল জনসমর্থন রয়েছে।
জয়শঙ্কর জানান, চুক্তির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল একটি চলাচল–সংক্রান্ত চুক্তি, যা ভারতীয়দের রাশিয়ায় কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করবে। এ ছাড়া সার উৎপাদনে যৌথ উদ্যোগ গড়ারও সমঝোতা হয়েছে। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ সার আমদানিকারক দেশ হিসেবে ভারতকে প্রায়ই অস্থিতিশীল উৎসের ওপর নির্ভর করতে হয়—এ প্রসঙ্গে তিনি ইঙ্গিতে চীনের কথা উল্লেখ করেন। তার মতে, সার উৎপাদনে যৌথ উদ্যোগ খাদ্য নিরাপত্তার সঙ্গেও সরাসরি সম্পর্কিত।
তিনি আরও জানান, পুতিন বড় ধরনের ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদল নিয়ে ভারতে এসেছিলেন, যার লক্ষ্য ছিল বাণিজ্য ও বিনিয়োগে অগ্রগতি আনা।
ভারত–যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘস্থায়ী বাণিজ্য আলোচনার প্রেক্ষাপটে জয়শঙ্কর বলেন, বাণিজ্যকেন্দ্রিক মার্কিন প্রশাসনের সঙ্গে ভারত ‘যুক্তিসঙ্গত শর্তে’ সমঝোতায় যেতে প্রস্তুত, তবে জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে আপস করে নয়।
তার মতে, ভারত–যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক এখন একটি জটিল ইস্যুর প্যাকেজের মুখোমুখি। দুই দেশই কঠিন আলোচনার মাধ্যমে এমন এক সমঝোতা খুঁজছে, যা কৃষক, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীসহ নানা খাতকে প্রভাবিত করবে। জয়শঙ্কর বলেন, “এই মুহূর্তে বাণিজ্যই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। ওয়াশিংটনে এটি অত্যন্ত কেন্দ্রীয় বিষয়—আগের প্রশাসনগুলোর তুলনায় অনেক বেশি। আমরা তা বুঝি এবং আলোচনায় প্রস্তুতও আছি, তবে শর্ত হতে হবে যুক্তিসঙ্গত।”

জয়শঙ্কর আরও বলেন, “কূটনীতি কারও মন ভোলানোর উপায় নয়। আমার কাছে কূটনীতি মানে জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করা।” তিনি আশাবাদী, দুই পক্ষের বাণিজ্যিক স্বার্থের একটি গ্রহণযোগ্য সমাধান পাওয়া যাবে।
তিনি সতর্ক করে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনায় ভারতকে খুবই বিচক্ষণ হতে হবে, কারণ প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁর পূর্বসূরিদের তুলনায় সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের নেতা। সমস্যাগুলোর সমাধানে দুই দেশকেই আলোচনার মাধ্যমে এগোতে হবে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
ট্রাম্পের বারবার দাবি—ভারত–পাকিস্তানের সংঘাতকালে তিনি নাকি যুদ্ধবিরতি করিয়েছেন—এই প্রসঙ্গে ভারত কি তাকে ‘সন্তুষ্ট’ করতে পারত? এমন প্রশ্নের জবাবে জয়শঙ্কর বলেন, “আমার দেশ ও দেশের মানুষ যা বিশ্বাস করে, তার পরিপন্থী কোনো কথা আমি বলতে পারি না। সশস্ত্র বাহিনী ও জনগণের প্রতি অবিচার হয়—এমন কোনো মন্তব্য আমি করব না।”
নয়াদিল্লি বরাবরই বলেছে, চার দিনের সংঘাতের পর ভারত ও পাকিস্তানের জ্যেষ্ঠ সামরিক কর্মকর্তাদের আলোচনার মাধ্যমেই যুদ্ধবিরতি হয়েছিল। এটি এসেছিল পাকিস্তানে সন্ত্রাসী ঘাঁটির বিরুদ্ধে ভারতের সামরিক হামলার পর শুরু হওয়া উত্তেজনার প্রেক্ষাপটে। ভারত স্পষ্টভাবে জানিয়েছে, পাকিস্তান প্রসঙ্গে তৃতীয় পক্ষের মধ্যস্থতার কোনো সুযোগ নেই এবং ট্রাম্পের মধ্যস্থতার দাবিও তারা প্রত্যাখ্যান করেছে।
ভারত–চীন সম্পর্ক নিয়ে কথা বলতে গিয়ে জয়শঙ্কর বলেন, নিয়ন্ত্রণরেখায় (এলএসি) শেষ দফার ‘ঘর্ষণ–বিন্দু’ নিয়ে ২০২৪ সালের অক্টোবরে সমঝোতায় পৌঁছানোর পর সীমান্ত এলাকায় স্থিতিশীলতা ফিরেছে। দুই দেশের সেনাদের টহল পুনরায় শুরু হয়েছে এবং তা এখন স্বাভাবিকভাবে চলছে।

তিনি বলেন, “আমাদের মূল বক্তব্য ছিল—সীমান্তে শান্তি ও স্থিতিশীলতা দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের অগ্রগতির পূর্বশর্ত। এখন তা বজায় রয়েছে এবং আরও উন্নত হচ্ছে। তবে সীমান্তই যে একমাত্র সমস্যা, তা নয়। বাণিজ্য, বিনিয়োগ, প্রতিযোগিতা, ভর্তুকি, স্বচ্ছতাসহ আরও নানা ইস্যু আছে, যেগুলোর কিছু গালওয়ান ঘটনার আগের।”
তার ভাষায়, কিছু সমস্যা যেমন সরাসরি বিমান যোগাযোগ পুনরায় চালুর মতো বিষয় ইতোমধ্যে সমাধান হয়েছে, অন্য কিছু ইস্যু তুলনামূলক বেশি জটিল।
পাকিস্তানের সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনির সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে ক্ষমতা আরও সুসংহত করার প্রেক্ষাপটে জয়শঙ্কর বলেন, পাকিস্তানে বাস্তবে সামরিক বাহিনী সবসময়ই—প্রকাশ্যে, গোপনে, বা মিশ্রভাবে—ক্ষমতার কেন্দ্রে ছিল। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক মহল প্রায়ই পাকিস্তানকে ‘লেনদেন–ভিত্তিক’ভাবে দেখে—সেখানে ‘ভালো ও খারাপ সন্ত্রাসী’, ‘ভালো ও কম ভালো সামরিক শাসক’—এভাবে বিভাজন করা হয়। “আমাদের কাছে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বাস্তবতা সবসময়ই পরিষ্কার। আমাদের অধিকাংশ সমস্যাই সেখান থেকেই তৈরি,” বলেন তিনি।
তিনি উল্লেখ করেন, পাকিস্তান সেনাবাহিনী সন্ত্রাসবাদকে প্রশ্রয় দেয়, প্রশিক্ষণ শিবির চালায় এবং ভারতের বিরুদ্ধে প্রায় মতাদর্শিক পর্যায়ের বৈরিতা বজায় রাখে। তিনি বলেন, “দিনের শেষে পাকিস্তানের অবস্থা দেখুন। দুই দেশের সক্ষমতা, পারফরম্যান্স ও আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি তুলনা করুন। তাদের নিয়ে অতিরিক্ত ব্যস্ত হওয়ার কোনো কারণ নেই।”

বাংলাদেশ প্রসঙ্গে জয়শঙ্কর বলেন, অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার আগের আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে হওয়া নির্বাচনের বৈধতা নিয়ে আপত্তি তুলেছিল। তিনি বলেন, “দিনের শেষে যদি পুরো বিষয়টাই সুষ্ঠু নির্বাচনকে ঘিরে হয়, তবে বৈধতা পায় এমন নির্বাচন হওয়াই যৌক্তিক। আমরা বাংলাদেশকে শুভকামনা জানাই… যেকোনো গণতান্ত্রিক দেশই চায় মানুষের ইচ্ছা যেন গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রতিফলিত হয়।” ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠেয় নির্বাচনের ফলাফল দুই দেশের সম্পর্কে “ভারসাম্যপূর্ণ ও পরিপক্ব দৃষ্টিভঙ্গি” আনবে বলেও তিনি আশা প্রকাশ করেন।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, যিনি সরকারের পতনের পর ঢাকা ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন, তিনি কি ইচ্ছামতো ভারতে থাকতে পারবেন—এ প্রশ্নের জবাবে জয়শঙ্কর বলেন, “এটি ভিন্ন প্রসঙ্গ। তিনি বিশেষ পরিস্থিতিতে এখানে এসেছেন এবং সেই পরিস্থিতিই তাঁর ভবিষ্যৎ অবস্থান নির্ধারণে বড় ভূমিকা রাখবে। তবে শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত তিনি নিজেই নেবেন।”
সারাক্ষণ ডেস্ক 



















