অযোধ্যার বাবরি মসজিদের অনুকরণে পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদে মসজিদ তৈরি করতে চান বিধায়ক হুমায়ুন কবীর। এর জন্য শনিবার মসজিদের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছেন তৃণমূল কংগ্রেস থেকে সদ্য বহিষ্কৃত এই নেতা।
১৯৯২ সালের ছয়ই ডিসেম্বর ভেঙে ফেলা হয়েছিল অযোধ্যার বাবরি মসজিদ যাকে কেন্দ্র করে দেশজুড়ে আলোড়ন দেখা দেয়। সে কথা মাথায় রেখেই এই দিনকেই মুর্শিদাবাদে বাবরি মসজিদের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন বা শিলান্যাসের দিন হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন হুমায়ুন কবীর।
দলের ‘ভ্রূকুটি’ উপেক্ষা করেই অবশ্য বাবরি মসজিদের শিলান্যাসের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন মুর্শিদাবাদের ভরতপুরের বিধায়ক এবং তার এই কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে বেশ কয়েকদিন ধরেই উত্তপ্ত ছিল রাজ্য রাজনীতি।
একদিকে বিজেপি এবং কংগ্রেস যেমন তাকে কটাক্ষ করতে ছাড়েনি, তেমনই তার নিজের দল তৃণমূল কংগ্রেসও সম্প্রতি হুমায়ুনকে সাসপেন্ড করে। তার বিরুদ্ধে তৃণমূলের তরফে ধর্মীয় বিভাজনের অভিযোগ তোলা হয়েছিল। বিজেপির সঙ্গে তার যোগ রয়েছে বলে অভিযোগও তোলে।
অন্যদিকে, শনিবারের কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে শান্তি ও নিরাপত্তা ভঙ্গ হতে পারে এমন আশঙ্কা জানিয়ে একটা পিটিশন দায়ের করা হয়েছিল। এই বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে রাজি হয়নি আদালত, বরং রাজ্য সরকারের উপরেই নিরাপত্তা ও শান্তি বজায় রাখার দায়িত্ব দেওয়া হয়।
প্রসঙ্গত, কেন্দ্র সরকারের আনা ওয়াকফ আইনের বিরোধিতায় অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল মুর্শিদাবাদে। সেই সময় কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা হয়। তখন থেকেই কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন রয়েছে ওই জেলায়। প্রয়োজন হলে শনিবার সেই বাহিনী ব্যবহার করা যাবে বলে কেন্দ্র জানিয়েছিল।

নাম না করেই মুখ্যমন্ত্রী মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী সম্প্রতি তার বিরুদ্ধে কড়া মন্তব্য করেন।
মুর্শিদাবাদের বেলডাঙ্গায় বাবরি মসজিদের শিলান্যাস কর্মসূচির আগে শুক্রবার থেকেই বাড়ানো হয়েছিল নিরাপত্তা ব্যবস্থা, র্যাপিড অ্যাকশন ফোর্স বা র্যাফ মোতায়েন করা হয়েছিল। অন্যদিকে সকাল থেকেই অনুষ্ঠান মঞ্চে মানুষ জড়ো হতে থাকে।
শিলান্যাসের সময় কিছুটা চ্যালেঞ্জের সুরে হুমায়ুন কবীর বলেছেন, “বাবরি মসজিদ তৈরি হবে হবে হবেই। কোনো শক্তি আটকাতে পারবে না, আটকাতে এলে জীবনের বিনিময়ে হলেও মোকাবিলা করব”।
বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ৩৩ বছর পর, সেইদিনকে ঘিরেই উত্তাপ পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক ময়দানে। তৃণমূলের পক্ষ থেকে প্রতিবছর এই দিনে সংহতি দিবস হিসেবে পালন করা হয়, এবারেও তা হচ্ছে।
সকালেই মুখ্যমন্ত্রী সাধারণের উদ্দেশে সম্প্রীতির বার্তা দিয়েছেন। ফিরহাদ হাকিম, চন্দ্রিমা ভট্টাচার্যের মতো তৃণমূলের শীর্ষনেতারা অনুষ্ঠানমঞ্চ থেকে স্পষ্ট করে দেন দল ‘ধর্মীয় সম্প্রীতির’ পক্ষে এবং সেখানে ‘ধর্মান্ধতার’ কোনো জায়গা নেই। নাম না করে তারা হুমায়ুন কবীরকেও কটাক্ষ করতে ছাড়েননি।
অন্যদিকে, হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের পক্ষ থেকে ছয়ই ডিসেম্বরই শৌর্য যাত্রার আহ্বান করা হয়, যার নেতৃত্বে ছিলেন শুভেন্দু অধিকারী। পাশাপাশি অন্যান্য বিজেপি নেতারাও ছিলেন।
মতুয়া সম্প্রদায়ের একটা মিছিলের আয়োজনও করা হয়েছিল ঠাকুরনগরে।
ভোটার তালিকায় যে বিশেষ নিবিড় সংশোধনী প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে প্রথম থেকেই সরব তৃণমূল। উত্তর ২৪ পরগনার ঠাকুর নগর, যা মতুয়াদের গড় বলেই পরিচিত সেখানে সভা করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। ঠাকুরনগরেই শনিবার পাল্টা কর্মসূচির ডাক দিয়েছে বিজেপি। মতুয়া সম্প্রদায়ের নেতা শান্তনু ঠাকুর, বিজেপির রাজ্য সভাপতি শমীক ভট্টাচার্যর নেতৃত্বে ছিল সেই কর্মসূচি।
বামেরাও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির আহ্বান জানিয়েছে।
মোটের ওপর পশ্চিমবঙ্গে ২০২৬-এর ভোট যে আসন্ন, তা শনিবারের ঘটনাবহুল কর্মসূচিতে ইতোমধ্যে পরিষ্কার। ভোটের আগে প্রতিটা রাজনৈতিক দলই নিজেদের মতো করে সক্রিয়-তা সে বিজেপি হোক, তৃণমূল কংগ্রেস হোক বা সদ্য হুমায়ুন কবীর, যিনি ইতিমধ্যে নতুন দল তৈরি করে আসন্ন ভোটে লড়ার চ্যালেঞ্জ জানিয়েছেন। বিরোধীদের একচুলও জমি ছাড়তে নারাজ–– এই বিষয়টা স্পষ্ট করে দিয়েছে প্রত্যেকেই।

সম্প্রতি হুমায়ুন কবীরকে সাসপেন্ড করে তৃণমূল
‘আমি অসাংবিধানিক কাজ করছি না’
মুর্শিদাবাদে বাবরি মসজিদ তৈরি নিয়ে নিজের সিদ্ধান্ত দীর্ঘ সময় ধরেই অনড় ছিলেন হুমায়ুন কবীর। দলের কোনোরকম আপত্তিই গ্রাহ্য করেননি তিনি। বরং জানিয়ে দিয়েছিলেন মুর্শিদাবাদে বাবরি মসজিদ তিনি তৈরি করবেন।
মঞ্চ থেকে হুমায়ুন কবীর বলেছেন, “আমি কোনো অসাংবিধানিক কাজ করছি না। হাই কোর্ট বলে দিয়েছে, হুমায়ুন কবীর কোনো অসাংবিধানিক কাজ করেনি”।
পাশাপাশি তিনি জানিয়েছেন, বাবরি মসজিদের ভিত্তিপ্রস্ত স্থাপনের ঘোষণার পর বিজেপি পাল্টা কর্মসূচি ঘোষণা করে।
“আমরা ঘোষণা করার পরই বিজেপি বললো এখানে মুর্শিদাবাদে রাম মন্দির স্থাপন করবে। আমরা বাধা দিইনি। সবার নিজের নিজের ধর্ম পালন করার অধিকার ভারতবর্ষের সংবিধানে রয়েছে,” বলেছেন তিনি।
এরপরই বিজেপিকে আক্রমণ করেন তিনি।
তার কথায়, “আমরা বাবরি মসজিদ তৈরি করতে পারব না? আমার মাথার দাম এককোটি টাকা ঘোষণা করা হচ্ছে। এত বড় হিম্মত! আমরা আমাদের ধর্মের প্রতি যেমন আস্থাশীল, তেমনই অন্য ধর্মের প্রতিও আমরা শ্রদ্ধাশীল। মধ্যপ্রদেশের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন মুর্শিদাবাদ থেকে এক একটা ইট খুলে নিয়ে যাবেন, তাহলে বলি পশ্চিমবঙ্গে যে ৩৭ শতাংশ জনসংখ্যা রয়েছে তারা জীবন দিয়ে বাবরি মসজিদকে রক্ষা করবে”।
তিনি জানিয়েছেন মসজিদের পাশাপাশি হাসপাতাল, মেডিক্যাল কলেজ, হোটেল তথা রেস্টুরেন্ট, পার্কসহ অনেক কিছুই তৈরি হবে সেখানে।
হুমায়ুন কবীরের কথায়, “৩০০ কোটি টাকা বাজেট। আমাকে একজন ব্যবসায়ী কথা দিয়েছেন ৮০ কোটি টাকা দেবেন”।
এর আগেই অবশ্য তিনি জানিয়েছিলেন যে সরকারি অর্থে এই মসজিদ তৈরি হবে না।
অযোধ্যার বাবরি মসজিদ ভাঙার প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেছেন, “৩৩ বছর আগে মুসলমানদের হৃদয়ে আঘাত হানা হয়েছিল। সেই আঘাতে আজ সামান্য হলেও প্রলেপ পড়েছে। আমি বলছি এখানে বাবরি মসজিদ তৈরি হবে হবে হবেই”।
প্রসঙ্গত তৃণমূল কংগ্রেসের ফিরহাদ হাকিম দিন কয়েক আগে প্রশ্ন তুলেছিলেন, “স্কুল-কলেজ তৈরি করতে পারতেন, মসজিদ কেন? মানুষকে ধর্মান্ধ করে রাখতে চাইছেন?”
শনিবারের অনুষ্ঠান থেকে সেই প্রশ্নেরই জবাব দিয়েছেন হুমায়ুন কবীর।

তৃণমূল তার দলগত অবস্থান স্পষ্ট করে দিয়েছে- ফাইল ছবি
‘বাংলার মানুষ ধর্মান্ধতায় বিশ্বাস করে না’
প্রসঙ্গত ভোটার তালিকায় বিশেষ নিবিড় সংশোধনকে ঘিরে বিজেপির সঙ্গে তৃণমূলের বিরোধ ইতোমধ্যে প্রকাশ্যে এসেছে। সেই দিক থেকেও চলতি বছরের সংহতি দিবসের অনুষ্ঠান গুরুত্বপূর্ণ ছিল বলেই মনে করা হচ্ছে।
পাশাপাশি হুমায়ুন কবীরের বিরুদ্ধে দলের অবস্থান আরো একবার নাম না করেই জানিয়ে দেওয়া হয়। নাম না করে হুমায়ুন কবীরের সঙ্গে বিজেপির ‘আঁতাতের’ ইঙ্গিতও দেওয়া হয়েছে।
তৃণমূলের ফিরহাদ হাকিম বলেছেন, “আজকের দিনটা ভারতবর্ষের সবচেয়ে কালো দিন। সেদিন শুধু একটা মসজিদের ধাঁচা ভাঙা হয়নি, সেদিন একটা বিশ্বাসকে ভাঙা হয়েছিল যে এই দেশটা আমার। আর সেই বিশ্বাস ভেঙ্গেছিল বিজেপি”।
এরপর বিজেপিকে আক্রমণ করেন তিনি। তিনি বলেছেন, “বিজেপি ধর্মের নামে বিভাজনের চেষ্টা করছে আর তাতে সাহায্য করছে আমাদের কিছু মীরজাফর। সমাজকে এক করে রাখতে হবে। ধর্মান্ধতার কারণে আজ পাকিস্তান এত পিছিয়ে আছে। আর ধর্মনিরপেক্ষতার কারণে ভারত এতটা এগিয়ে”।
“এখন বাংলাতেও সুড়সুড়ি দেওয়া হচ্ছে। কেউ মন্দিরের নামে, কেউ মসজিদের নামে সুড়সুড়ি দিচ্ছে। বাংলার মানুষ ধর্মান্ধতায় বিশ্বাস করে না”।
চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য আবার যুক্তি দিয়েছেন সংবিধান ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলে তৃণমূল সেই নীতিতেই বিশ্বাস করে।
তৃণমূল কংগ্রেসের সুপ্রিমো তথা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী অবশ্য এর আগেই স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন যে তার দল সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির পক্ষে। সেই সম্প্রীতি ‘ক্ষুণ্ন’ হোক এমন কোনো পদক্ষেপ ‘বরদাস্ত’ করবেন না তিনি।
দলের সঙ্গে বেশ কিছুদিন ধরেই দূরত্ব তৈরি হয়েছিল হুমায়ুন কবীরের। বিভিন্ন সময়ে তার বিরুদ্ধে বিতর্কিত মন্তব্যের অভিযোগ তুলে সতর্কও করা হয়েছিল। এরপর দলের পক্ষে কথা বললেও, তার সঙ্গে দূরত্ব স্পষ্ট করে দেয় তৃণমূল কংগ্রেস এবং তাকে সাসপেন্ড করা হয়।
এর আগে বহরমপুরের সভা থেকে মুখ্যমন্ত্রী হুমায়ুন কবীরের নাম না করে বলেছিলেন ”ভোটের আগে অনেকে ব্ল্যাকমেল করে। বিজেপির টাকা খেয়ে তাঁবেদারি করে। তাদের বিশ্বাস করবেন না”।
এর পরপরই হুমায়ুন কবীরকে সাসপেন্ড করা হয়।

শমীক ভট্টাচার্য
বিজেপি কী বলছে?
শৌর্যযাত্রা উপলক্ষে কলকাতায় যে পদযাত্রার আয়োজন করা হয়েছিল তাতে অংশ নিয়েছিলেন অনেক বিজেপি নেতা। হুমায়ুন কবীরের প্রসঙ্গে তৃণমূলকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী বলেছেন, “বেলডাঙ্গাতে যা হচ্ছে, তার জন্য অনুমতি আছে? এত মানুষের জমায়েত তার জন্য পুলিশের অনুমতি আছে? প্রশাসন একচোখ বন্ধ করে আছে?”
রাজ্য সরকারকে দুষেছেন শমীক ভট্টাচার্যও। তিনি বলেছেন, “এখানে ধর্মান্ধতার সরকার চলছে, বাবরের সরকার চলছে। পশ্চিমবঙ্গের বৃহত্তর অংশের মানুষ চুপ করে বসে থাকবে না”।
“এটা হুমায়ুন কবীরকে সামনে রেখে তৃণমূলের একটা ন্যারেটিভ। যখন হুমায়ুন কবীর হিন্দুদের মেরে ভাসিয়ে দেবে বলেছিল তখন তাকে সাসপেন্ড করেননি মুখ্যমন্ত্রী”।
মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে তোপ দেগেছেন কংগ্রেসের অধীর চৌধুরীও। তার কথায়, “মুখ্যমন্ত্রী সবসময় হুমায়ুন কবীরকে সমর্থন করে এসেছেন, এখন তিনি হাত থেকে বেরিয়ে যাওয়ায় তাকে সাসপেন্ড করেছেন। এর আগেও তার বিরুদ্ধে দল পদক্ষেপ নিয়েছে পরে সব ভুলে গিয়ে ফিরিয়ে নিয়েছে”।
বিবিসি নিউজ বাংলা
Sarakhon Report 



















