মানুষকে খুশি করার প্রবণতা আমাদের জীবনে নিঃশব্দে বড় ক্ষতির কারণ হতে পারে। অন্যকে খুশি রাখতে গিয়ে নিজের অনুভূতি, চাওয়া এবং স্বাস্থ্যের প্রতি যে অবহেলা তৈরি হয়, তা সময়ের সঙ্গে গভীর উদ্বেগ আর আত্মসম্মানহীনতার দিকে ঠেলে দেয়। মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন—এই অভ্যাস যতটা নির্দোষ মনে হয়, ভেতরে ভেতরে তা আত্মবিশ্বাসকে দুর্বল করে এবং সম্পর্ককে জটিল করে তোলে।
শৈশবের ভদ্রতার শিক্ষা থেকে জন্ম নেয় ‘হ্যাঁ’ বলার মানসিকতা
অনেকেই ছোটবেলা থেকে ভদ্রতা, আনুগত্য আর বয়োজ্যেষ্ঠদের কথামতো চলার শিক্ষা পায়। এসব নিয়ম মানতে মানতে ধীরে ধীরে মানুষের ভিতরে এমন এক অভ্যাস গড়ে ওঠে, যেখানে ‘না’ বলা কঠিন হয়ে পড়ে। লেখকের অভিজ্ঞতার মতো, স্কুলে শিক্ষকের মন জয়ে অতিরিক্ত আগ্রহ, বড়দের খুশি রাখার চেষ্টা, আর সবার কাছে ভালো ছেলে-মেয়ের পরিচয়—সবকিছু মিলেই তৈরি করে মানুষকে খুশি রাখার দমবন্ধ চাহিদা। বড় হতে হতে এই অভ্যাস শিক্ষক থেকে নিয়োগকর্তা, সহকর্মী, বন্ধু, এমনকি অপরিচিত মানুষের ক্ষেত্রেও ছড়িয়ে যায়। ফলাফল—ক্যারিয়ার বা সম্পর্কের অজুহাতে নিজের পরিবার, নিজের সময় এবং নিজের প্রয়োজনকে পিছনে ফেলে দেওয়া।
কেন মানুষকে এত খুশি রাখতে চাই?
পেনসিলভেনিয়ার শিপেনসবার্গ ইউনিভার্সিটির মনোবিজ্ঞানী প্রফেসর তোরু সাতো বলেন, মানুষকে সবসময় খুশি রাখার পেছনে থাকে গভীর এক অনিরাপত্তা। তার মতে, প্রকৃত মানুষ-খুশি-করারা আসলে বাইরের মানুষের প্রশংসা থেকে নিজেদের মূল্য বের করতে চান। তারা মনে করেন, অন্যেরা তাদের পছন্দ করলে তবেই তারা মূল্যবান। এই মানসিকতা ব্যক্তির আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং তাকে এমন এক চক্রে ফেলতে থাকে, যেখানে ত্যাগ করাই যেন ভালোবাসা পাওয়ার একমাত্র পথ।
অনুমোদনের চাহিদা ও সোশিয়োট্রপি
মনোবিজ্ঞানে এই প্রবণতাকে বলা হয় সোশিয়োট্রপি—এক ধরনের ব্যক্তিত্ব বৈশিষ্ট্য। সোশিয়োট্রপিক মানুষ অন্যেরা তাদের সম্পর্কে কী ভাবছে, তা নিয়ে অতিরিক্ত চিন্তিত থাকে। তাদের আত্মসম্মান প্রায় পুরোপুরি নির্ভর করে অন্যের অনুমোদনের ওপর। কেউ বিরক্ত হলে বা প্রশংসা না করলে তারা গভীর মানসিক আঘাত অনুভব করে। গবেষণায় দেখা গেছে, নারীরা পুরুষদের তুলনায় এই বৈশিষ্ট্যে বেশি নমনীয় এবং তাদের হতাশা, উদ্বেগ ও সম্পর্কের টানাপোড়েন বেশি দেখা যায়। সোশিয়োট্রপি শুধু মানুষকে দুর্বল করে না, অন্যদের দ্বারা সহজেই ব্যবহারযোগ্যও করে তোলে।
ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে ত্যাগ: সবসময় কি ভালো?
যুক্তরাজ্যের সাসেক্স ইউনিভার্সিটির মনোবিজ্ঞানী ড. মারিকো ভিসারম্যান দীর্ঘদিন ধরে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের ত্যাগ নিয়ে গবেষণা করছেন। তার মতে, সম্পর্কের ত্যাগ ভালো কিংবা খারাপ—তা নির্ভর করে ত্যাগের উদ্দেশ্যের ওপর। যদি একজন ব্যক্তি ভালোবাসা ও যত্নের কারণে ত্যাগ করেন, তাহলে এই অভ্যাস সম্পর্ককে শক্তিশালী করে। কিন্তু যদি ত্যাগ করা হয় ঝগড়া এড়াতে, অপরাধবোধ এড়াতে বা সঙ্গীর অসন্তুষ্টি ঠেকাতে, তাহলে তা সম্পর্ককে ধীরে ধীরে ক্লান্ত করে তোলে। অনেক সময় প্রাপকও অস্বস্তিতে পড়ে যায়—একদিকে কৃতজ্ঞতা, অন্যদিকে অপরাধবোধ ও ঋণের বোঝা তৈরি হয়। ফলে ত্যাগ আনন্দ নয়, বরং বোঝা হয়ে দাঁড়ায়।
আত্মসম্মান কোথায় বাঁধা?
মনোবিজ্ঞানীদের মতে, যদি কারও আত্মমূল্য সম্পূর্ণ নির্ভর করে অন্যের অনুমোদনের ওপর, তাহলে সেই অবস্থাকে বলা হয় কন্টিনজেন্ট সেল্ফ-ওর্থ। এটি অত্যন্ত অস্থিতিশীল আত্মসম্মান, যা সামান্য প্রত্যাখ্যানেই ভেঙে পড়ে। অথচ সুস্থ আত্মসম্মান আসে ভেতর থেকে—নিজের নীতি, নিজের অর্জন এবং নিজের অনুভূতি থেকে। নিজের মূল্য বুঝতে বাইরের লোকের প্রশংসা লাগলে মানুষ কখনোই মানসিকভাবে স্থির হতে পারে না।
কীভাবে মুক্তি মিলবে ‘মানুষ খুশি করার’ ফাঁদ থেকে?
প্রফেসর সাতো মনে করেন, মুক্তির প্রথম ধাপ হলো নিজের ত্যাগের উৎস খুঁজে বের করা। কেন আপনি ‘হ্যাঁ’ বলেন? প্রশংসা পেতে? প্রত্যাখ্যান এড়াতে? নাকি সত্যিই কাউকে সাহায্য করতে চান? বাইরের স্বীকৃতিকে অভ্যন্তরীণ মূল্যে রূপান্তর করা জরুরি। “আমি ভালো যদি সবাই আমাকে ভালোবাসে”—এই বিশ্বাস বদলে করতে হবে—“আমি ভালো কাজ করলে আমি নিজেই ভালো অনুভব করি।” ত্যাগের সিদ্ধান্ত পরিস্থিতির সাথে মিলিয়ে নিতে হবে, অন্ধভাবে নয়। নিজের প্রয়োজন, অনুভূতি ও সীমা বজায় রেখে ‘হ্যাঁ’ বলা গেলে তবেই সত্যিকারের সুখ এসেছে বলে ধরা যায়।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















