সীমান্তে নতুন গোলাগুলি, আতঙ্কে সাধারণ মানুষ
কাম্বোডিয়া–থাইল্যান্ড সীমান্তের কয়েকটি পয়েন্টে টানা গোলাগুলি ও ভারি অস্ত্রের হামলায় আবারও দাউ দাউ করে জ্বলছে বহু বছরের জমে থাকা উত্তেজনা। বর্ডার পোস্টের কাছে কামানের গোলা আর মর্টারের বিস্ফোরণে দুই দেশেরই সেনা ও সাধারণ মানুষের হতাহতের খবর মিলেছে। রাতারাতি গ্রামের মানুষ স্কুল, মন্দির আর কমিউনিটি সেন্টারে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছেন; কেউ কেউ গবাদি পশু এবং বাড়ির গুরুত্বপূর্ণ জিনিসপত্র ফেলে চলে আসতে পারেননি। স্থানীয় প্রশাসন কয়েকটি অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্র খুললেও, সীমান্তঘেঁষা অনেক পরিবার আবার ফিরে গেছেন ফসল ও ঘরবাড়ি দেখাশোনা করতে, যাতে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে দ্রুত স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেন।
গোলাগুলি শুরুর জন্য উভয় দেশই একে অন্যকে দায়ী করছে। থাই কর্তৃপক্ষের দাবি, কাম্বোডিয়ার সেনারা সীমান্ত অতিক্রম করে তাদের বাংকার ও আউটপোস্টের দিকে গুলি ছুড়েছে। অপরদিকে কাম্বোডিয়ান সেনাবাহিনী বলছে, থাই কামানের গোলা সাধারণ মানুষের বাড়ি, স্কুল ও মন্দির লক্ষ্য করে নিক্ষেপ করা হয়েছে। বছরের শুরুতে যে যুদ্ধবিরতি চুক্তি হয়েছিল, এই নতুন সংঘাত সেটিকে কতটা অর্থহীন করে তুলছে—তা নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে বিশ্লেষকদের মধ্যে। সীমান্তে কয়েকটি হটলাইন খোলা হলেও, গ্রামবাসীরা অভিযোগ করছেন, অনেক সময় কোনো ধরনের সতর্কবার্তা ছাড়াই গোলাগুলি শুরু হয়, ফলে ঘরে বসেই আতঙ্কে দিন কাটাতে হয়।
দুই দেশের ভেতরের রাজনীতিও এই সংঘাতকে আরও জটিল করে তুলতে পারে। অর্থনৈতিক ধীরগতি আর বিক্ষোভের চাপে থাকা থাই সরকার সীমান্ত প্রশ্নে নরম ভাবমূর্তি এড়িয়ে চলতে চাইছে। অন্যদিকে নতুন নেতৃত্বাধীন কাম্বোডিয়া প্রমাণ করতে চায় যে তারা দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে সক্ষম, একই সঙ্গে থাইল্যান্ডের সঙ্গে বাণিজ্য ও পর্যটন সম্পর্কও বজায় রাখতে আগ্রহী। এ অবস্থায় সামান্য ভুল বোঝাবুঝিও যদি বড় সংঘাতে রূপ নেয়, তবে সীমান্ত পারাপারের খাদ্য, নির্মাণসামগ্রী এবং শ্রমিকের সাপ্লাই চেইন মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বলে সতর্ক করেছেন অর্থনীতিবিদেরা।

আসিয়ান চাপের মুখে, সীমান্তজুড়ে মানবিক সংকটের আশঙ্কা
এই সংঘাতকে ঘিরে নতুনভাবে আলোচনায় এসেছে আসিয়ানের সংকট মোকাবিলা সক্ষমতা। প্রতিবেশী কয়েকটি দেশ দ্রুত উত্তেজনা কমানোর আহ্বান জানালেও এখন পর্যন্ত জরুরি বৈঠক বা আনুষ্ঠানিক মধ্যস্থতার কোনো উদ্যোগ দৃশ্যমান নয়। ঐকমত্যভিত্তিক সিদ্ধান্তপ্রক্রিয়ার কারণে সদস্য রাষ্ট্র দুটির পারস্পরিক দোষারোপের মাঝে আসিয়ানের পক্ষে দ্রুত কোনো ভূমিকা নেওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর ফলে মাঠ পর্যায়ের কমান্ডাররা দিনদিন ভিত্তিতে পরিস্থিতি সামলানোর চেষ্টা করছেন, কিন্তু রাজনৈতিক নির্দেশনা পরিষ্কার না থাকায় স্থায়ী সমাধান এগোচ্ছে না।
মানবিক সহায়তাকর্মীরা বলছেন, সংঘাত দীর্ঘস্থায়ী হলে সীমান্তঘেঁষা জেলার স্বাস্থ্যসেবা, পানীয় জল ও খাদ্য সরবরাহ নিয়ে বড় সংকট দেখা দিতে পারে। স্কুল ও মন্দিরে আশ্রয় নেওয়া মানুষদের জন্য খাবার, ত্রিপল, শয্যা এবং ওষুধের ঘাটতি তৈরি হচ্ছে দ্রুত। একই সঙ্গে ছোট ব্যবসায়ী ও ট্রাকচালকেরা জানাচ্ছেন, হঠাৎ করে চেকপোস্ট বন্ধ হয়ে যাওয়ায় চাল, তেল ও নিত্যপণ্যের ট্রিপে বাড়তি খরচ ও সময় লাগছে। পর্যটন খাতও নতুন ধাক্কার আশঙ্কায়; অনেকে আগাম বুকিং বাতিল করে বিকল্প গন্তব্য বেছে নিচ্ছেন।
গ্রামবাসীদের বক্তব্য, তারা ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন বারবার গোলাগুলি, যুদ্ধবিরতি আর অনিশ্চিত শান্তির চক্রে আটকে থাকতে থাকতে। বয়স্করা স্মরণ করছেন আগের সংঘাতে কীভাবে ঘরবাড়ি পুড়ে গিয়েছিল, কৃষিজমিতে রয়ে গিয়েছিল অবিস্ফোরিত গোলা। স্থানীয় মানবাধিকার ও সিভিল সোসাইটি সংগঠনগুলো দাবি তুলেছে, বেসামরিক এলাকায় হামলার অভিযোগের স্বচ্ছ তদন্ত, ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন এবং সীমান্তের বিরোধপূর্ণ এলাকাগুলোর হালনাগাদ মানচিত্র জনসমক্ষে প্রকাশের। আপাতত দুই দেশের সাধারণ মানুষের আশা, আঞ্চলিক কূটনীতি যেন পরের ধাপের গোলাগুলির আগে দায়িত্বশীল ভূমিকা নিয়ে শান্তির পথ দেখাতে পারে।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















