যখন যে–কেউ মোটামুটি গ্রহণযোগ্য কাজ তৈরি করতে পারে, তখন প্রকৃত প্রতিভা আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
অস্কার প্রতিযোগিতায় থাকা চলচ্চিত্র ‘দ্য ব্রুটালিস্ট’ বিদেশি উচ্চারণ নিখুঁত করতে এআই ব্যবহার করছে, এআই–তৈরি কান্ট্রি গান চার্টে শীর্ষে উঠছে—এইসব পরিবর্তনে সৃজনশীল মহলে উৎকণ্ঠা দেখা দিয়েছে। অনেকে আশঙ্কা ছড়াচ্ছেন যে এআই শিল্পকে শূন্য করে দেবে, পেশাগুলোকে দক্ষতাহীন করে ফেলবে এবং মৌলিক চিন্তার ক্ষমতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। কিন্তু তা হবে না। বরং এআই সৃজনশীলতাকে আরও সমৃদ্ধ করবে।
সত্যি বলতে, এআই নিজে নিজেই কোনো কাজ শেষ করতে পারে; তবে এতে মানুষের সৃজনশীলতার স্বভাব পাল্টায় না—বরং শুধু আউটপুটের পরিমাণ বাড়ে। কঠোর ও সময়–সাপেক্ষ কাজগুলো থেকে এআই মানুষকে মুক্তি দেয়—সেগুলোই সবসময় অনুপ্রেরণার চেয়ে বেশি মানবশক্তি খরচ করেছে। শিল্পীরা কখনোই তাদের ব্যবহৃত যন্ত্র দিয়ে নিজেদের পরিচয় দেননি; তারা পরিচিত হয়েছেন সেসব যন্ত্র দিয়ে কী সৃষ্টি করেন, তা দিয়ে।
শিল্পবিপ্লবের সময়ও এ ধরনের ভয় ছড়িয়েছিল। এই পত্রিকার সাম্প্রতিক এক লেখায় ফিল গ্রাম ও মাইকেল সোলন মনে করিয়ে দিয়েছেন, কিভাবে কারুশিল্প থেকে শিল্পোৎপাদনে রূপান্তরকে ‘বিপর্যয়কর’ ও ‘ভয়াবহ’ বলা হয়েছিল—যদিও একই পরিবর্তন মানবজীবনের আয়ু ২৫% পর্যন্ত বাড়িয়েছিল এবং জীবনমান উন্নত করেছিল। কিছু কাজ বিলীন হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু তার চেয়ে বহু বেশি ও উন্নত চাকরি তৈরি হয়েছিল। একই পরিণতি দেখা গিয়েছিল অ্যাসেম্বলি লাইন, রোবোটিক্স, কম্পিউটার এবং ইন্টারনেটের ক্ষেত্রেও।
আশ্চর্যের বিষয় ভয় নয়, বরং এই সত্য যে আমরা বারবার ভুলে যাই—যখন যন্ত্র বদলায়, মানব সৃজনশীলতা সংকুচিত নয়, বরং প্রসারিত হয়।
এআই–সহায়িত শিল্পকে ‘কম মানবিক’ ভাবার পেছনে রয়েছে এক ভ্রান্ত বিভাজন—আধুনিকতা বনাম অর্থবোধ, অ্যালগোরিদম বনাম কল্পনা। শিল্পীরা সবসময়ই উন্নততম যন্ত্রকে স্বাগত জানিয়েছেন, কারণ শিল্পের মহত্ত্ব কখনোই যন্ত্রের সরল বা ‘পবিত্র’ প্রকৃতির ওপর নির্ভর করেনি। অরসন ওয়েলস ‘সিটিজেন কেনে’ প্রযুক্তিকে প্রত্যাখ্যান করেননি; বরং তিনি ডিপ–ফোকাস সিনেমাটোগ্রাফি উদ্ভাবন করেছিলেন, অনন্য ক্যামেরা অ্যাঙ্গেলের জন্য সেটে ছাদ যোগ করেছিলেন, আলোক–ব্যবহারকে মনস্তাত্ত্বিক গভীরতা দিয়েছিলেন এবং সময় কাটিংয়ের নতুন মাত্রা দেখিয়েছিলেন। তার সৃজনশীলতা ছিল ১৯৪১ সালের প্রযুক্তিগত সীমানার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
স্ট্যানলি কুব্রিকের ‘২০০১: এ স্পেস অডিসি’ আজও চলচ্চিত্র ইতিহাসের সাহসী দৃষ্টিভঙ্গির একটি কারণ তিনি প্রযুক্তিকে আলিঙ্গন করেছিলেন। কৃত্রিম মাধ্যাকর্ষণের জন্য ঘূর্ণায়মান সেট বানানো থেকে শুরু করে বিস্তৃত মডেল–কাজ এবং ‘স্টারগেট’ দৃশ্যের কিংবদন্তি স্লিট–স্ক্যান প্রযুক্তি—সবকিছুই তিনি যন্ত্রের সাহায্যে কল্পনার পরিধি বাড়াতে ব্যবহার করেছিলেন।
আজ যদি কুব্রিক আধুনিক CGI–এর সুবিধা পেতেন, তিনি হয়তো আরও দ্রুত ও নিখুঁতভাবে একই শিল্প–দর্শন বাস্তবায়ন করতে পারতেন। কিন্তু তাই বলে কি ‘২০০১’–এর মূল্য কমে যেত? ওয়েলসের উদ্ভাবন কি কম গুরুত্বপূর্ণ হতো যদি কম্পিউটার–সহায়িত লেন্স তখন থাকত? এই যুক্তি প্রথম পরীক্ষাতেই ভেঙে পড়ে।
আসলে ভয়ের মূল হলো এআই প্রতিভাকে মুছে ফেলবে নয়; বরং এআই সস্তা, প্রচুর পরিমাণে মাঝারি মানের কাজ তৈরি করবে। কিন্তু এটিও নতুন কিছু নয়। গণউৎপাদন কারুশিল্পকে নিঃশেষ করেনি; বরং তার মর্যাদা বাড়িয়েছে। হেনরি ফোর্ড অ্যাসেম্বলি লাইন চালু করে নির্ভরযোগ্যতা নিশ্চিত করেছিলেন; একইসঙ্গে হাতে তৈরি গাড়িকে পরিণত করেছিলেন এক বিশেষ বৈভবে। একবার লেক্সাস ও অ্যাস্টন মার্টিন চালিয়ে দেখলেই বোঝা যায় যন্ত্রের নির্ভুলতা আর মানুষের স্পর্শের পার্থক্য। উভয়েরই নিজস্ব মূল্য আছে।
এআইও এমনই বিভাজন তৈরি করবে। এআই–নির্মিত কনটেন্ট যত বাড়বে, প্রকৃত শিল্প ততই স্পষ্ট হয়ে উঠবে। যখন যে–কেউ একটি মোটামুটি অনুচ্ছেদ লিখতে পারে বা গল্পের বোর্ড বানাতে পারে, তখন অসাধারণ প্রতিভা আরও দৃশ্যমান হয়। পরিবর্তন ঘটে সৃজনশীলতার প্রকৃতিতে নয়—বরং স্রষ্টারা তাদের সময় কীভাবে ব্যয় করবেন, তাতে। এবং আগের সব সৃজনশীল বিপ্লবের মতো, এআইও প্রবেশ–বাধা কমিয়ে দেয়। ব্যক্তিগত কম্পিউটার যেমন প্রকাশনাকে গণতান্ত্রিক করেছিল, তেমনি নতুন এআই–যন্ত্র উদীয়মান স্রষ্টাদের এমন ধারণা বাস্তবায়নের সুযোগ দিচ্ছে যা আগে শুধু স্টুডিও বা পুঁজি–সমৃদ্ধ সংস্থাগুলোর পক্ষে সম্ভব ছিল।

এতে শিল্পের পরিসর বিস্তৃত হবে—লাখো মানুষ যাদের আনুষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ নেই, তারাও আঁকতে, সুর করতে, নকশা তৈরি করতে ও নতুন কিছু অনুসন্ধান করতে পারবে।
অনেকে উদ্বেগ প্রকাশ করছেন যে দর্শকরা হয়তো মানবিক কাজ আর কৃত্রিম কাজ আলাদা করতে পারবে না—এটি বাস্তব উদ্বেগ, তবে সাময়িক। নতুন প্রযুক্তি এলেই সত্যতা–বোধ নিয়ে নতুন নিয়ম তৈরি হয়।
গভীর সত্য হলো, এআই মানুষের সৃজনশীলতার প্রতিদ্বন্দ্বী নয়; বরং তার গুণক। এটি মানুষকে সময় দেয় এমন কাজের জন্য যা যন্ত্র কখনো করতে পারবে না—রুচি, বিচার, কণ্ঠস্বর, কল্পনা। ভাষা–মডেল হেমিংওয়ের ছন্দ নকল করতে পারে, কিন্তু তার আত্মা নয়; শেক্সপিয়ারের তাল অনুসরণ করতে পারে, কিন্তু তার চেতনা নয়। এআই মুহূর্তের জন্য আমাদের কানে প্রতারণা করতে পারে—সেই শক্তির কারণ অনুকরণ। কিন্তু হৃদয়ের গভীরে স্পর্শ করতে পারে না—এ কারণেই মানবিক মৌলিকতা আজ আরও মূল্যবান।
সৃজনশীলতা কোনো যান্ত্রিক আউটপুট নয়; এটি বাস করে সিদ্ধান্তে—কোনটি গুরুত্ব পাবে, কোনটি বাদ যাবে, কী ঝুঁকি নেওয়া হবে—এসব বিচারবোধ কোনো যন্ত্র স্বয়ংক্রিয় করতে পারে না। তাই নীতিনির্ধারকদের উচিত ভয়ের বশে এআই–কে দমিয়ে না রাখা। নীতি হওয়া উচিত স্বচ্ছ স্বত্ব, তথ্যব্যবহার ও মালিকানা–বিধি প্রতিষ্ঠা করা, যাতে সৃজনশীল অর্থনীতির সবচেয়ে দুর্লভ উপাদান—মানবিক মৌলিকতা—প্রাপ্য পুরস্কার পায়।
শিল্পবিপ্লব, তথ্যযুগ ও প্রারম্ভিক ডিজিটাল যুগ ইতোমধ্যে প্রমাণ করেছে—উদ্ভাবনকে মুক্ত রাখলে বেশি সুযোগ, বেশি আবিষ্কার এবং বেশি অপ্রত্যাশিত প্রতিভার জন্ম হয়। দশ বছর পর আমরা সম্ভবত আজকের সময়টিকে মানব সৃজনশীলতার সমাপ্তি নয়, বরং মৌলিকতার পুনর্জন্ম–ক্ষণের মতো দেখব।
ব্রায়ান জে. গ্রস 


















