মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভেনিজুয়েলার আরেকটি তেলবাহী ট্যাঙ্কার জব্দ করায় নড়বড়ে হয়ে পড়েছে নিকোলাস মাদুরোর ক্ষমতার ভিত্তি। তেলই ভেনিজুয়েলার প্রধান অর্থনৈতিক শক্তি, আর সেই উৎসে বড় আঘাত হানায় তৈরি হয়েছে টিকে থাকার অস্তিত্বগত সঙ্কট।
মাদুরো বরাবরই যুক্তরাষ্ট্রের মাদকচক্র পরিচালনার অভিযোগ অস্বীকার করে আসছেন। তবে দেশটির রপ্তানি আয়ের ৯০ শতাংশের বেশি আসে তেল থেকে, আর ক্ষমতাসম্পর্কিত অভিজাতদের বিরুদ্ধে বহু বছর ধরে অভিযোগ—তারা নাকি বিলিয়ন ডলারের তেল আয়ে হাত সাঁটেন। নতুন করে ট্যাঙ্কার জব্দ এবং জব্দের হুমকি তেলের ক্রেতাদের কাছে বড় ডিসকাউন্ট দিতে বাধ্য করছে ভেনিজুয়েলাকে। এতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আরও দ্রুত কমে যাচ্ছে, আর মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণও কঠিন হয়ে পড়ছে।
তেলবাহী যে ট্যাঙ্কারটি বুধবার জব্দ করা হয়েছে, তাতে ছিল প্রায় ৮ কোটি ডলারের তেল। এটি ভেনিজুয়েলার মাসিক আমদানি ব্যয়ের প্রায় পাঁচ শতাংশের সমান। ফলে নিত্যপণ্যে ঘাটতির আশঙ্কা আরও ঘনিয়েছে।

মার্কিন ঘোষণা এবং ক্ষমতা থেকে সরানোর চাপ
মার্কিন কর্মকর্তারা জানাচ্ছেন, এই অভিযান এখানেই থামবে না। আরও ট্যাঙ্কার জব্দের পরিকল্পনা আছে, যা মূলত মাদুরোকে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য করার বড় কৌশল। ক্যারিবীয় অঞ্চলে ইতিমধ্যে সামরিক উপস্থিতি বাড়ানো হয়েছে, সন্দেহভাজন মাদকবাহী নৌকায় হামলা চালানো হয়েছে, এমনকি ভেনিজুয়েলায় বিমান হামলার হুমকিও দেওয়া হয়েছে। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, মাদুরোর ‘দিন গোনা শুরু হয়ে গেছে’।
জ্বালানিবিষয়ক বিশ্লেষকরা বলছেন, তেলখাতে এই চাপ অব্যাহত থাকলে মাদুরোর শাসন অস্থিতিশীল হয়ে পড়বে। যুক্তরাষ্ট্র যদি মাসে একটি করে ট্যাঙ্কারও জব্দ করে, তবে ভেনিজুয়েলা নতুন করে গভীর মন্দায় পড়বে।
বন্ধ হয়ে যাচ্ছে ট্যাঙ্কার চলাচল
জব্দের হুমকিতেই ভেনিজুয়েলার প্রধান বন্দরগুলোতে ট্যাঙ্কার চলাচল প্রায় থমকে গেছে। সাধারণত যেসব স্থানে প্রতিদিন একাধিক ট্যাঙ্কার তেল লোড করতে আসে, সেখানে এখন ডজনখানেক জাহাজ উপকূলে দাঁড়িয়ে থাকলেও কেউই লোডিংয়ে এগোচ্ছে না। কর্মীদের মধ্যেও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে; অনেকে কাজে যেতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছেন।

ভেনিজুয়েলার তেল এখন আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার আওতায়; ফলে সাধারণ বাজারে এর বেচাকেনা প্রায় অসম্ভব। পুরোনো, জরাজীর্ণ ‘শ্যাডো ফ্লিট’ নামের প্রায় হাজার খানেক জাহাজই এসব তেল বহন করে। অধিকাংশ জাহাজ যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার তালিকায় রয়েছে।
ট্যাঙ্কারট্র্যাকার্স ডটকম জানায়, ভেনিজুয়েলার আশপাশে এখন প্রায় ৮০টি তেলবাহী জাহাজ রয়েছে, যার মধ্যে ৩০টিরও বেশি মার্কিন নিষেধাজ্ঞার আওতাভুক্ত।
জব্দের আইনি লড়াই এবং মাদুরোর ক্ষোভ
জব্দ হওয়া স্কিপার নামের ট্যাঙ্কারটিতে প্রায় ১৮ লাখ ব্যারেল তেল ছিল। মার্কিন কর্মকর্তারা জানান, প্রয়োজনীয় আইনগত প্রক্রিয়া শেষে তেলের মালিকানা যুক্তরাষ্ট্র নিয়ে নেবে। জাহাজটি অতীতে ইরানি তেল বহন করেছিল বলেই মূলত নিষেধাজ্ঞার তালিকায় ছিল।
এদিকে মাদুরো যুক্তরাষ্ট্রকে জলদস্যুতার অভিযোগে অভিযুক্ত করেছেন। এক সমাবেশে তিনি বলেছেন, জনগণকে “যোদ্ধার মতো সতর্ক থাকতে হবে” এবং প্রয়োজনে “আমেরিকান সাম্রাজ্যের দাঁত ভাঙার” প্রস্তুতি নিতে হবে।
কালোবাজারি জাহাজ, গোপন লেনদেন এবং বাড়তি ঝুঁকি
ইরান ও রাশিয়ার মতো মিত্র দেশের কাছ থেকে কালোবাজারি তেল পরিবহন পদ্ধতি শিখে নেয় ভেনিজুয়েলা। এসব জাহাজ প্রতিদিন গড়ে ৬ লাখ ব্যারেলের বেশি তেল বাজারে পৌঁছে দেয়, যার বড় অংশই চীনে পৌঁছায়। বিভিন্ন দেশের তেলের সঙ্গে মিশে মূল উৎস গোপন হয়ে যায়।
তবে পণ্য পরিবহন ব্যয় ভেনিজুয়েলাকেই বহন করতে হয়, আর ক্রেতাদের আকৃষ্ট করতে প্রতি ব্যারেলে প্রায় অর্ধেক দামে তেল ছাড়তে হয়। বহু লেনদেন নগদে বা অস্পষ্ট ক্রিপ্টোকারেন্সি প্ল্যাটফর্মে করা হয়, যা মাদুরো সরকারের জন্য বড় ঝুঁকি।
চাপ বাড়লে সাধারণ মানুষের সঙ্কটই বাড়বে
বিশ্লেষকদের মতে, তেল রপ্তানিতে চাপে পড়লে সাধারণ মানুষই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। দীর্ঘ অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মধ্যেও মাদুরো দমননীতি ও খাদ্য সহায়তার মিশ্র কৌশলে ক্ষমতা ধরে রেখেছেন। নতুন করে তেলের আয়ে বড় ধস নামলে সেই সংকট আরও কঠোর রূপ নেবে।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















