চীনের শহরগুলোতে কাজের সুযোগ দ্রুত সঙ্কুচিত হচ্ছে। নির্মাণ, কারখানা আর পরিষেবা খাতে চাকরি কমে যাওয়ায় বিপুল সংখ্যক অভিবাসী শ্রমিক আবার ফিরছেন নিজ নিজ গ্রামে। অনেকেই আর শহরে ফেরার তাড়া অনুভব করছেন না। এই উল্টো স্রোত নিয়ে এখন বাড়ছে উদ্বেগ, কারণ এতে গ্রামীণ অর্থনীতি থমকে যাওয়ার আশঙ্কা দেখছে প্রশাসন।
শহর ছেড়ে গ্রামে ফেরা কেন
সুজৌ শহরের একটি নির্মাণ সংস্থায় কাজ হারিয়ে চল্লিশ বছর বয়সী ঝাং ফেং ফিরে গিয়েছিলেন প্রতিবেশী আনহুই প্রদেশের গ্রামে। ভেবেছিলেন দু’মাসের মধ্যেই নতুন কাজ পেয়ে যাবেন। আট মাস পেরিয়ে গেলেও চাকরির দেখা নেই। শহরে আর কিছু নেই—এই বিশ্বাস থেকেই তিনি এখন স্থায়ীভাবে গ্রামেই থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কম খরচে থাকা যায়, পরিবার কাছে থাকে, শহরের একাকীত্ব আর অনিশ্চয়তা তাকে আর টানে না।
এই অভিজ্ঞতা একক নয়। চীনের অর্থনীতি যখনই ধাক্কা খেয়েছে, তখনই শহরমুখী শ্রমিকদের একটি অংশ গ্রামে ফিরে গিয়েছে। তবে সাম্প্রতিক মাসগুলোতে এই প্রবণতা অনেক বড় আকার নিয়েছে। চীনা নববর্ষের পর থেকেই বিপুল সংখ্যক বেকার শ্রমিক গ্রামে ফিরে আর শহরে ফিরছেন না। এই ঘটনাকে বলা হচ্ছে উল্টো অভিবাসন।
সরকারের সতর্কবার্তা
নভেম্বরে কৃষি ও গ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় সতর্ক করে জানিয়েছে, ব্যাপক হারে শ্রমিক গ্রামে ফিরে গেলে সেখানে কর্মসংস্থানের চাপ বাড়বে এবং অর্থনৈতিক স্থবিরতা তৈরি হতে পারে। কারণ গ্রামগুলোতে আগে থেকেই কাজের সুযোগ সীমিত। শহরফেরত শ্রমিকদের পাশাপাশি স্থানীয় তরুণদের জন্যও কাজ জোগানো কঠিন হয়ে পড়ছে।
সংকুচিত শহুরে চাকরি বাজার
চীনের শহরগুলোতে চাকরি কমার পেছনে একাধিক কারণ কাজ করছে। আবাসন খাতের গভীর মন্দা, অভ্যন্তরীণ চাহিদার দুর্বলতা এবং আন্তর্জাতিক ভূরাজনৈতিক টানাপোড়েন অর্থনীতির গতি শ্লথ করেছে। সাম্প্রতিক পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, কারখানা, নির্মাণ ও পরিষেবা—তিন ক্ষেত্রেই কার্যক্রম সঙ্কুচিত হয়েছে। উৎপাদন ও পরিষেবা সূচক একটানা দীর্ঘ সময় ধরে সংকোচনের ইঙ্গিত দিচ্ছে।
এছাড়া উচ্চমূল্য সংযোজনমুখী শিল্পে রূপান্তরের নীতিও প্রচলিত শ্রমনির্ভর খাতে কাজ কমিয়ে দিচ্ছে। কারখানায় প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ায় আগের মতো বিপুল শ্রমিকের দরকার হচ্ছে না। কম দক্ষ শ্রমিকরাই আগে ছাঁটাইয়ের মুখে পড়ছেন।

বেতন কমা আর অনিশ্চয়তা
হেনান প্রদেশের একাধিক এলাকায় দেখা গেছে, চীনা নববর্ষের পর বহু শ্রমিক আগের কাজে ফিরতে পারেননি। কেউ কেউ জানিয়েছেন, কাজ থাকলেও বেতন অর্ধেক হয়ে গেছে। বাধ্যতামূলক ছুটি আর মজুরি কাটা এখন সাধারণ ঘটনা। এমন বাস্তবতায় শহরে থাকার আগ্রহ হারাচ্ছেন অনেকে।
গ্রামেই কি ভবিষ্যৎ
তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, বিষয়টিকে একপেশেভাবে দেখার সুযোগ নেই। প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের ফলে শহরে শ্রমনির্ভর কাজ কমা স্বাভাবিক। একই সঙ্গে গ্রাম ও ছোট শহরগুলোতে পরিষেবা আর প্রযুক্তিনির্ভর নতুন কাজের সুযোগও তৈরি হচ্ছে। সরকার পেশাগত প্রশিক্ষণ বাড়াচ্ছে, যাতে শ্রমিকরা নতুন দক্ষতা অর্জন করতে পারেন।
পরিসংখ্যান বলছে, সাম্প্রতিক সময়ে গ্রামীণ এলাকায় আয়ের বৃদ্ধি শহরের তুলনায় দ্রুত হয়েছে। যদিও মোট আয়ের ব্যবধান এখনো বড়, তবু কম জীবনযাত্রার খরচের কারণে গ্রামে অর্থের মূল্য বেশি টেকে।

শহর আর গ্রামের ভেদরেখা বদলাচ্ছে
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শহর মানেই সুযোগ আর গ্রাম মানেই পিছিয়ে থাকা—এই ধারণা ভাঙতে হবে। এখন শ্রমিকরা নিজেরাই ঠিক করতে পারছেন কোথায় থাকলে তারা বেশি স্বস্তি ও স্থায়িত্ব পাবেন। সঠিক মজুরি আর কাজ মিললে অনেকেই আবার শহরে ফিরতে রাজি, তবে আপাতত অনেকে গ্রামেই সুযোগ খুঁজে দেখছেন।
এই পরিবর্তন চীনের শ্রমবাজারে এক নতুন বাস্তবতার ইঙ্গিত দিচ্ছে। শহরকেন্দ্রিক উন্নয়নের পাশাপাশি গ্রামভিত্তিক অর্থনীতির ভবিষ্যৎই হয়তো আগামী দিনে আরও বেশি গুরুত্ব পাবে।

সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















