সিরিয়ার উত্তর–পূর্বের মরুভূমির বন্দিশিবিরে বড় হচ্ছে হাজার হাজার শিশু, যাদের অনেককে মায়েরা নিজ হাতে শেখাচ্ছেন আইএসের কট্টর আদর্শ। আল-হোল ও রোজ শিবিরে আটকে থাকা এই পরিবারগুলো আজ শুধু মানবিক সংকট নয়, বরং ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার জন্যও ভয়ংকর এক বার্তা হয়ে উঠছে। যুদ্ধ–পরবর্তী সিরিয়ার সামনে এই বাস্তবতা নতুন করে বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে।
আল-হোল ও রোজ শিবিরের বাস্তবতা
সিরিয়ার উত্তর–পূর্বাঞ্চলের শুষ্ক প্রান্তরে আল-হোল ও রোজ—এই দুই বন্দিশিবিরে এখন আইএস যোদ্ধাদের পরিবারভুক্ত মানুষের সংখ্যা সাতাশ হাজারের বেশি। শিবির কর্তৃপক্ষ জানায়, এই দুই শিবিরের প্রায় ষাট শতাংশই শিশু, যাদের বয়স আঠারোর নিচে। চারদিকে কাঁটাতার আর কঠোর নজরদারির ভেতরে তারা বড় হচ্ছে এমন এক পরিবেশে, যেখানে আইএসের কট্টর মতাদর্শ এখনো সক্রিয়ভাবে প্রভাব ফেলছে।
পরিবার, কিন্তু অপরাধ ছাড়াই বন্দি
এই শিবিরে থাকা অধিকাংশ মানুষই আইএস যোদ্ধাদের স্ত্রী, বোন কিংবা সন্তান। তাদের বিরুদ্ধে কোনো আনুষ্ঠানিক অপরাধের অভিযোগ নেই। যোদ্ধারা আলাদা কারাগারে আটক থাকলেও পরিবারগুলো বছরের পর বছর ধরে শিবিরেই বন্দি জীবন কাটাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় কুর্দি নেতৃত্বাধীন বাহিনী আইএসকে পরাজিত করার সময় এসব পরিবারকে আটক করা হয়েছিল।

যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা কমছে, বাড়ছে অনিশ্চয়তা
যুক্তরাষ্ট্র ধীরে ধীরে সিরিয়া থেকে সেনা প্রত্যাহার করছে। ফলে শিবির ও কারাগারের দায়ভার নতুন করে সিরিয়ার সরকারের হাতে তুলে দেওয়ার চাপ বাড়ছে। একই সঙ্গে কুর্দি নেতৃত্বাধীন বাহিনীকে দেশটির নতুন সেনাবাহিনীর সঙ্গে একীভূত করার উদ্যোগ চলছে। তবে কুর্দিদের মধ্যে গভীর অনাস্থা রয়েছে। তাদের আশঙ্কা, ইসলামপন্থী পটভূমির নতুন সরকার আইএসের বিরুদ্ধে আগের মতো কঠোর অবস্থান ধরে রাখবে কি না।
আইএসের নতুন তৎপরতা ও হামলার শঙ্কা
সিরিয়ার সরকার প্রকাশ্যে আইএসের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানের কথা বলছে এবং যুক্তরাষ্ট্র–নেতৃত্বাধীন জোটে যোগ দিয়েছে। তবু জাতিসংঘ ও যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক মূল্যায়নে দেখা যাচ্ছে, গত এক বছরে আইএসের হামলার পরিসর ও প্রাণঘাতিতা দুটোই বেড়েছে। দামেস্কে একটি গ্রিক অর্থোডক্স গির্জায় হামলা এবং সরকারি বাহিনীর ওপর বোমা হামলা নতুন করে উদ্বেগ বাড়িয়েছে।
শিবিরের ভেতরে উগ্রবাদ ছড়ানোর ভয়
শিবির প্রশাসকদের অভিযোগ, আইএসের সক্রিয় সমর্থকেরা এখনো ভেতরে রয়েছে এবং তারা পরিকল্পিতভাবে শিশুদের উগ্রবাদে দীক্ষিত করছে। রোজ শিবিরের এক প্রশাসকের ভাষায়, অনেক ক্ষেত্রে মায়েরাই শিশুদের আইএসের আদর্শ শেখাচ্ছেন, আর এটিই সবচেয়ে বড় বিপদ। বছরের পর বছর এমন পরিবেশে বড় হওয়া শিশুরা ভবিষ্যতে কোন পথে যাবে, তা নিয়ে গভীর শঙ্কা রয়েছে।
মানবিক সংকট ও সহিংসতা
আল-হোল ও রোজ—দুই শিবিরেই জীবনযাত্রার অবস্থা অত্যন্ত করুণ। অসন্তোষ, সহিংসতা ও রোগব্যাধি নিত্যদিনের সঙ্গী। অস্ত্র পাচার হয়, পালানোর চেষ্টা চলে নিয়মিত। প্রতিদিন শত শত যানবাহন শিবিরে প্রবেশ করে, যা ত্রাণ সরবরাহের পাশাপাশি লোক পাচারের পথ হিসেবেও ব্যবহৃত হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এমনকি পানির ট্যাংকেও লুকানোর জায়গা তৈরির ঘটনা ধরা পড়েছে।
সহায়তা কমায় পরিস্থিতির অবনতি
চলতি বছর যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা কমে যাওয়ায় পানীয় জল, খাদ্য ও চিকিৎসা সেবায় বড় ধাক্কা লাগে। পরে পানি ও রুটি সরবরাহ আংশিকভাবে শুরু হলেও চিকিৎসা, শিশু সুরক্ষা ও শিক্ষা কার্যক্রম এখনো বন্ধ রয়েছে। এর ফলে সহিংসতা ও পালানোর ঘটনা বেড়েছে। একপর্যায়ে সহায়তা সংস্থার কার্যালয়ে হামলা, জানালা–দরজা ভাঙচুর এবং নিরাপত্তাকর্মীদের আহত হওয়ার ঘটনাও ঘটে।

চরমপন্থার বিপজ্জনক নজির
শিবিরে এক নিরাপত্তা অভিযানের সময় এক দম্পতি নিজেরা তৈরি বিস্ফোরক বেল্ট পরে আত্মঘাতী হামলার হুমকি দেয়। আত্মসমর্পণে অস্বীকৃতি জানালে তারা নিহত হয়। এই ঘটনা স্পষ্ট করে দেয়, শিবিরের ভেতরে চরমপন্থার ঝুঁকি কতটা গভীর ও সক্রিয়।
ফেরত পাঠানো নিয়ে জটিলতা
শিবিরে আটক অনেকেই নিজ নিজ দেশে ফিরতে চায়—সিরিয়া, ইরাক কিংবা ইউরোপ ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশে। কিন্তু বহু দেশ নিরাপত্তার অজুহাতে তাদের ফিরিয়ে নিতে রাজি নয়। ফলে নারী ও শিশুরা অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মধ্যে আটকে রয়েছে।
সমাধানের চাপে সিরিয়া ও ইরাক
শিবির প্রশাসকেরা বলছেন, দ্রুত শিবিরের জনসংখ্যা কমানো জরুরি। ইরাক ও সিরিয়া তাদের নাগরিকদের ফেরাতে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। ইরাক ইতিমধ্যে হাজার হাজার নাগরিক ফিরিয়ে নিয়েছে এবং বাকিদেরও ফেরানোর লক্ষ্য ঘোষণা করেছে। সিরিয়াও উদ্যোগ নিয়েছে, যদিও এখনো খুব অল্প মানুষই পুনর্বাসনের সুযোগ পেয়েছে।
আল-হোল ও রোজ শিবির এখন আর শুধু বন্দিত্বের জায়গা নয়, বরং ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার এক বড় পরীক্ষাকেন্দ্র। এখানে বেড়ে ওঠা শিশুদের জীবন কোন পথে যাবে, তা নির্ভর করছে আজকের সিদ্ধান্তের ওপর। মানবিক সহায়তা, পুনর্বাসন ও নিরাপত্তার মধ্যে ভারসাম্য আনতে না পারলে আইএসের ছায়া এই মরুভূমিতেই রয়ে যাবে।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















