ওলেকসান্দ্রা মাতভিইচুক ও মাইকেল ও’ফ্ল্যাহার্টি
রাশিয়ার ইউক্রেনের বিরুদ্ধে চালানো নিষ্ঠুর আগ্রাসী যুদ্ধের অবসান ঘটাতে কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়ছে। বিশ্ব এখন শ্বাসরুদ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে। এই উদ্যোগ প্রয়োজনীয় ও স্বাগত হলেও এতে রয়েছে বড় ঝুঁকি। দ্রুত কোনো সমঝোতায় পৌঁছানোর তাড়াহুড়ো দেখে আশঙ্কা জাগে, শেষ পর্যন্ত যে ‘শান্তি’ আসবে তা হবে ফাঁপা, অন্যায্য এবং টেকসই নয়।
কিয়েভসহ ইউক্রেনের বিভিন্ন বেসামরিক জনবসতিতে রাশিয়ার সাম্প্রতিক বড় আকারের হামলা পরিস্থিতির তীব্রতা স্পষ্ট করছে। কারণ এগুলো বৃহত্তর উত্তেজনা বৃদ্ধির ধারাবাহিকতারই অংশ। নির্মম বাস্তবতা হলো, ২০২৫ সাল পর্যন্ত ইউক্রেনীয় বেসামরিক হতাহতের সংখ্যা ২০২৪ সালের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি। এর ওপর রাশিয়ার হামলায় ইউক্রেনের জ্বালানি অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় ব্যাপক বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্নতা দেখা দিয়েছে। ফলে অনেক ইউক্রেনীয় আশঙ্কা করছেন, পূর্ণমাত্রার আগ্রাসন শুরুর পর সবচেয়ে কঠিন শীতের মুখে তারা পড়তে যাচ্ছেন।
পরিসংখ্যানের বাইরে তাকিয়ে সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনে এর বিপুল প্রভাব স্বীকার করা আমাদের সবার দায়িত্ব। মানবিক ক্ষতি অবর্ণনীয়। হতাহত ও শারীরিক যন্ত্রণার পাশাপাশি প্রায় ৬০ লাখ মানুষ, যার মধ্যে ১৬ লাখ শিশু, ইউক্রেনের প্রায় ২০ শতাংশ ভূখণ্ডে বসবাস করছে যা এখনো সাময়িকভাবে রাশিয়ার দখলে। সেখানে তারা চরম নির্যাতনের শিকার হচ্ছে; তাদের ভাষা, জাতীয় ও সাংস্কৃতিক পরিচয় এবং মর্যাদা কেড়ে নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া আরও ৩৭ লাখ মানুষ দেশের ভেতরেই বাস্তুচ্যুত হয়েছে এবং ৬৯ লাখ মানুষ বিদেশে পালিয়ে গেছে। ইউরোপে গত ৮০ বছরে সবচেয়ে বড় এই বাস্তুচ্যুতি পরিবার ভেঙে দিয়েছে এবং দারিদ্র্য বাড়িয়েছে।
এই সর্বনাশ একটাই বিষয় স্পষ্ট করে—মানবাধিকার শুধু ভবিষ্যৎ শান্তির শর্ত নির্ধারণের জন্য নয়, আজই প্রাণ বাঁচানোর জন্য অপরিহার্য। লড়াই থামানো এবং মানবিক সহায়তা পৌঁছে দেওয়া শীর্ষ অগ্রাধিকার হওয়া উচিত। কিন্তু সাম্প্রতিক শান্তি প্রচেষ্টা মূলত লেনদেনভিত্তিক, যেখানে মূল্যবোধভিত্তিক লক্ষ্য অনুপস্থিত। আলোচনায় জমি, সামরিক সক্ষমতা ও সম্পদের কথা বলা হচ্ছে, অথচ যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত লক্ষ লক্ষ মানুষের ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রায় নীরবতা।

ইউক্রেনীয়দের কাছে শান্তির মানদণ্ড সহজ হলেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যেকোনো চুক্তিকে যুদ্ধ স্থায়ীভাবে শেষ করতে হবে, সাময়িক বিরতি নয়, এবং বর্তমান ও ভবিষ্যৎ কল্যাণ নিশ্চিত করতে হবে। মানুষের কথা উপেক্ষা করা শান্তি ভবিষ্যৎ আগ্রাসনের নকশা। ভুক্তভোগীকে দুর্বল করে সামরিক বিধিনিষেধ চাপানো বা অবৈধ ভূখণ্ড দখলকে বৈধতা দেওয়া মানে ‘শক্তিই ন্যায়’—এমন এক নতুন বাস্তবতা ডেকে আনা। আগ্রাসীকে ক্ষমা দেওয়ার কোনো পরিকল্পনা মানবিক মর্যাদার পরিপন্থী এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর গড়ে ওঠা আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার মৌল নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
ভুল বুঝবেন না—এটি কেবল কোনো স্থানীয় ব্যর্থতা হবে না। আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা এমনিতেই তীব্র চাপে রয়েছে, মানবাধিকার রক্ষার রাজনৈতিক সদিচ্ছা ক্ষয়িষ্ণু। এই প্রেক্ষাপটে রাশিয়া আগ্রাসী যুদ্ধ চালিয়েছে। ইউক্রেন নিয়ে যা-ই সিদ্ধান্ত হোক, তা আন্তর্জাতিক আইনের ভবিষ্যতের জন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে।
মূল্যবোধই একমাত্র বিষয় নয়। পুরোপুরি লেনদেনভিত্তিক পন্থা বাস্তবসম্মতও নয়, কার্যকরও নয়—কারণ ন্যায়বিচারবিহীন শান্তি টিকে না। ন্যায়সঙ্গত, কার্যকর ও টেকসই শান্তি নিশ্চিত করতে পুরো প্রক্রিয়াকে বিদ্যমান আন্তর্জাতিক মানবাধিকার কাঠামোর ওপর দাঁড়াতে হবে।
বিশেষভাবে, মানুষকেন্দ্রিক শান্তি তিনটি মূল নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত হতে হবে। প্রথমত, ন্যায়বিচার নিয়ে কোনো আপস নয়। আন্তর্জাতিক অপরাধের জন্য জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে, অপরাধমূলক বিচারসহ, এবং ২০১৪ সাল থেকে রুশ আগ্রাসনে ক্ষতিগ্রস্ত সব ভুক্তভোগীর কাছে ন্যায্য ক্ষতিপূরণ পৌঁছাতে হবে।
দ্বিতীয়ত, সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণদের সুরক্ষা সক্রিয়ভাবে নিশ্চিত করতে হবে—শরণার্থী, দেশের ভেতরে বাস্তুচ্যুত মানুষ, নিখোঁজ ব্যক্তি, যুদ্ধবন্দি, বেসামরিক আটককৃত, অপহৃত শিশু এবং সাময়িকভাবে দখলকৃত অঞ্চলে আটকে পড়া লক্ষ লক্ষ মানুষের অধিকার রক্ষা করতে হবে।
তৃতীয়ত, প্রক্রিয়াটি অন্তর্ভুক্তিমূলক হতে হবে। আন্তর্জাতিক সংস্থা ও নাগরিক সমাজসহ সব অংশীজনের অবদান নিতে হবে। একই সঙ্গে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাব ১৩২৫-এর নীতিমালা অনুযায়ী আলোচনার টেবিলে নারীদের অর্থবহ উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হবে—যেখানে সংঘাত প্রতিরোধ ও সমাধান, মানবিক সাড়া এবং যুদ্ধোত্তর পুনর্গঠনে নারীদের সমান অংশগ্রহণ ও পূর্ণ সম্পৃক্ততার গুরুত্ব পুনর্ব্যক্ত করা হয়েছে।
রাশিয়ার আগ্রাসনের মোকাবিলা এবং ইউক্রেনের নিরাপত্তা জোরদার করতে আমাদের স্পষ্টভাবে সেই মূল্যবোধগুলো রক্ষা করতে হবে, যেগুলো আক্রমণের মুখে। ন্যায়সঙ্গত সমঝোতা অবশ্যই মানবাধিকারের ভিত্তিতে দাঁড়াতে হবে। তা না হলে কিছুই মীমাংসা হবে না। লক্ষ্য শুধু যুদ্ধবিরতি নয়; এমন এক ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করা, যেখানে ইউক্রেনীয়দের অধিকার ও মর্যাদা পূর্ণভাবে সম্মানিত হবে।
লেখক: ওলেকসান্দ্রা মাতভিইচুক ইউক্রেনীয় সেন্টার ফর সিভিল লিবার্টিজের প্রধান; প্রতিষ্ঠানটি ২০২২ সালে যৌথভাবে নোবেল শান্তি পুরস্কার পায়। মাইকেল ও’ফ্ল্যাহার্টি ইউরোপ কাউন্সিলের মানবাধিকার কমিশনার।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















