অমিতাভ ঘোষের জগতে অতীত কখনও পুরোপুরি পেছনে পড়ে থাকে না।
তার কাছে বাস্তব আর কল্পনার এই জগৎগুলো একে অপরের সঙ্গে এমনভাবে জড়িয়ে থাকে যে সেগুলো যেন পাশাপাশি থাকা সমান্তরাল মাত্রা। কারণ কোনও দুইটি সংস্করণ কখনও একরকম হয় না।
অমিতাভ ঘোষের নতুন বই ‘ঘোস্ট-আই’, যা আগামী ১৫ ডিসেম্বর প্রকাশিত হতে যাচ্ছে, আমাদের অতীত ধারণাটিকে আরও বিস্তৃত করে দেখতে চায়। এই বইয়ে পুনর্জন্ম ও পূর্বজন্মের স্মৃতির মতো ভাবনাকে সামনে আনা হয়েছে।
এই গল্পের কেন্দ্রে রয়েছে বর্ষা নামে তিন বছরের একটি মেয়ে। কলকাতার এক নিরামিষভোজী মারোয়ারি পরিবারে তার জন্ম। হঠাৎ করেই সে মাছ ছাড়া আর কিছু খেতে রাজি হয় না এবং সুন্দরবনে কাটানো এক পূর্বজীবনের নানা খুঁটিনাটি স্মৃতির কথা বলতে শুরু করে।
শেষ পর্যন্ত গল্পটি আবার ফিরে আসে সেই বিষয়েই, যা ঘোষকে সবচেয়ে বেশি ভাবায়—জলবায়ু সংকট। আমরা যদি প্রযুক্তিনির্ভর ইউটোপিয়ান কল্পনায় বিশ্বাস রাখতে পারি, তাহলে কি অন্য ধরনের কিছু কল্পনাপ্রসূত সম্ভাবনাকেও একেবারে উড়িয়ে দেওয়া উচিত? বিশেষ করে যদি সেগুলো আমাদের একে অপরের সঙ্গে এবং আমাদের গ্রহের সঙ্গে নতুন করে যুক্ত হতে সাহায্য করে।
“এই বইটি লেখা আমার জন্য একটু আলাদা অভিজ্ঞতা ছিল,” বলেন ঘোষ। “সাধারণত একটি উপন্যাস লিখতে আমার তিন বছর, কখনও চার বছরও লেগে যায়। কিন্তু এই বইটি যেন নিজেই নিজেকে লিখে ফেলেছে, প্রায় এক বছরের মধ্যেই। মনে হয়েছিল, ধারণাটা কোথাও থেকে হঠাৎ এসে গেছে, আর আমি শুধু লিখে যেতে শুরু করেছি।”
একটি সাক্ষাৎকারের নির্বাচিত অংশ।
প্রশ্ন: ‘ঘোস্ট-আই’-এর কেন্দ্রে পূর্বজন্মের ভাবনাকে রাখার সিদ্ধান্ত কেন নিলেন?
উত্তর: পুনর্জন্ম এমন একটি বিষয়, যাকে ভারতে আমাদের অনেকেই স্বাভাবিক ধরে নিই এবং বিশেষভাবে ভেবে দেখি না। আমার এক বন্ধু আছে, যার পূর্বজন্মের স্মৃতি খুব স্পষ্ট। সে মনে করতে পারত, মুম্বইয়ের কোন পরিবারে তার জন্ম হয়েছিল, এমনকি চার বছর বয়সেই একদিন সে সেই বাড়িটিও দেখিয়ে দিয়েছিল, যেখানে সে নাকি তার আগের জীবনে থাকত।
তবু এই ঘটনাগুলো আমাদের পৃথিবী সম্পর্কে গড়ে ওঠা ধারণাকে এতটাই চ্যালেঞ্জ করে যে আমরা আসলে এগুলো নিয়ে ভাবতেই চাই না। কোথায়, কীভাবে এসব ঘটে—এর কোনও ব্যাখ্যা আমার নেই।
আমি কি বিশ্বাস করি যে এসব ঘটে? হ্যাঁ, করি। এর পক্ষে যে প্রমাণ পাওয়া যায়, তা একেবারেই উপেক্ষা করার মতো নয়।
প্রশ্ন: প্রিয়জনের মৃত্যু অনেক সময় জীবন আর মৃত্যুর পরের বিষয় নিয়ে আমাদের ধারণা বদলে দেয়। আপনার জীবনে কি এমন কোনও ক্ষতি ছিল, যা এই বইটি লেখার পেছনে প্রভাব ফেলেছে?
উত্তর: অবশ্যই। মহামারির সময়, ২০২০ সালের আগস্টে আমি আমার মাকে হারাই। তিনি কোভিডে মারা যাননি; তিনি দীর্ঘদিন ধরে সিওপিডি বা ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজে ভুগছিলেন।

আমি তখন নিউইয়র্কে, আর তিনি কলকাতায়। লকডাউনের কারণে আমি তার কাছে যেতে পারিনি।
তারও আগে, ওই বছরের জানুয়ারিতে আমি যখন তার সঙ্গে ছিলাম, তখন তাকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছিল। হাসপাতালে থাকাকালীন তিনি এমন একটি অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যান, যাকে এখন প্রায়-মৃত্যুর অভিজ্ঞতা বলা হয়। সেই ঘটনাই পৃথিবী, জীবন—এই সবকিছু নিয়ে নানা ভাবনার দরজা খুলে দিয়েছিল। হ্যাঁ, এই বই লেখার ক্ষেত্রে সেটির খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল।
প্রশ্ন: ‘ঘোস্ট-আই’-এর প্রধান চরিত্র দিনানাথ দত্ত একজন বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ, কিন্তু এমন কিছু ধারণার সঙ্গেও লড়াই করে, যেগুলো এখন পশ্চিমা বিজ্ঞানও নতুন করে ভাবছে, যেমন প্রায়-মৃত্যুর অভিজ্ঞতা। সে যেমন লজ্জা পায় তার মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ে ঝোলানো এক ভাসমান ভারতীয় যোগীর ছবিটি দেখে।
উত্তর: দেখুন, আমার নিজেরই পিএইচডি আছে। অর্থাৎ আমাকে এমনভাবে শিক্ষা দেওয়া হয়েছে, যেখানে যুক্তিবাদই মুখ্য—যা দেখা যায়, ছোঁয়া যায়, সেটাই বাস্তব। যেন এর বাইরে কিছু নেই। এখনও আমার মনের একাংশ এভাবেই কাজ করে।
কিন্তু মনের আরেকটি অংশ একেবারেই ভিন্ন। সেটি অন্যরকম জিনিস দেখে। এই দুই অংশের মধ্যে সব সময়ই এক ধরনের সংলাপ চলে। আমার মনে হয়, আধুনিক পৃথিবীতে আমাদের সবার মধ্যেই এই সংলাপটা আছে। এটাকে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়।
বিজ্ঞানের একটি দিক আমার খুব ভালো লাগে—তার ভাষা, তার উপস্থাপন। এই দ্বিপদ নামকরণ, সরলরৈখিক শ্রেণিবিন্যাস। কিন্তু এগুলো কি সত্যিই আমাদের পৃথিবীকে বোঝার ক্ষেত্রে একজন জেলে, শিকারি বা ভেষজবিদের জ্ঞানের চেয়ে বেশি কার্যকর?
ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, এই দুই জগৎ আসলে খুব ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিল। উদ্ভিদবিদরা শিখেছেন প্রথাগত ভেষজ চিকিৎসকদের কাছ থেকে। সপ্তদশ শতকের বিখ্যাত লাতিন উদ্ভিদবিষয়ক গ্রন্থ ‘হর্টুস মালাবারিকাস’-এর ভূমিকাতেই কেরালার এক এঝাভা ভেষজবিদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানানো হয়েছে। এই যোগসূত্রটা আমার কাছে ভীষণ আকর্ষণীয়।
প্রশ্ন: এক অর্থে, এই বইটি খাবারের সঙ্গেও আমাদের সম্পর্কের গল্প।
উত্তর: আপনি ঠিকই বলেছেন। অনেক দিক থেকেই এটি খাবার নিয়ে লেখা একটি বই। আমি সবসময় রান্না করতে আর মানুষকে খাওয়াতে ভালোবাসি, ফলে বইটিতে আমার জীবনের এই দিকটি অবশ্যই এসেছে। তবে এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো—মানুষের পরিবেশের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে ওঠার সবচেয়ে মৌলিক পথটাই হলো খাবার।
অত্যন্ত শিক্ষিত মানুষরা প্রায়ই এই বিষয়টি ভুলে যান, কারণ তারা পৃথিবীর সঙ্গে খুব বিমূর্তভাবে সম্পর্ক তৈরি করেন, আর সেটি দিন দিন আরও বাড়ছে।
আজকের অনেক তরুণই জানে না তাদের খাবার কোথা থেকে আসে, কীভাবে তৈরি হয়। তারা যেন ভাবেই খাবার সুপারমার্কেটে জন্মায়। যারা এভাবে ভাবে, সরবরাহব্যবস্থা ভেঙে পড়লে তারা সবচেয়ে বেশি অসহায় হয়ে পড়বে—আর এমন বিপর্যয় মোটেও অসম্ভব নয়।
প্রশ্ন: বইটি এক জায়গায় এমন এক প্রায়-জাদুর ধারণার দিকে ফিরে যায়, যাকে প্রযুক্তিনির্ভর ইউটোপিয়ান স্বপ্নের বিকল্প হিসেবে দেখানো হয়েছে। এই জাদু বলতে আপনি কী বোঝাতে চান? নাকি ‘ঘোস্ট-আই’ মূলত এই কথাই মনে করিয়ে দেয় যে শেষ পর্যন্ত চাকা ঘুরতেই থাকে?
উত্তর: আমি বিশ্বাস করি, চাকা ঘুরবেই। আমরা যেভাবে পৃথিবীকে চিনি, সেটি ভেঙে পড়লেও কোনও না কোনওভাবে নতুন করে নিজেকে গড়ে তুলবে।
এখন স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে যে, বিশ্বজুড়ে প্রভাবশালী অভিজাতদের অনেক ধারণাই জাদুর মতোই অবাস্তব। আমার ‘দ্য গ্রেট ডিরেঞ্জমেন্ট’ বইয়ে আমি জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় প্রযুক্তিনির্ভর দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে পোপ ফ্রান্সিসের ভাবনার তুলনা করেছিলাম। পোপ ফ্রান্সিস বলেছেন, ‘প্রযুক্তিনির্ভর দৃষ্টিভঙ্গির’ কারণেই আমরা আমাদের বর্তমান ব্যর্থতার গভীরতম শিকড়গুলো দেখতে পাই না, এমনকি প্রযুক্তির নিজের ভূমিকাও বুঝতে ব্যর্থ হই।
এই অংশটি লেখার সময় আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে যায় যে, পোপ ফ্রান্সিসের দৃষ্টিভঙ্গি তথাকথিত টেকনোক্র্যাটদের তুলনায় অনেক বেশি বাস্তবসম্মত। কারণ টেকনোক্র্যাটরা যেন সব বিশ্বাস ঢেলে দেন এমন সব প্রযুক্তির ওপর, যেগুলো আদৌ অস্তিত্বই রাখে না।
আমার মনে হয়, শেষ পর্যন্ত আমাদের মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব আর মানবকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গিকে একটু হলেও কেন্দ্র থেকে সরাতে হবে।
আমি আশা করি, এই বইটি আমাদের চারপাশের পৃথিবীর সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে কিছুটা বিনয় শেখাবে। কারণ এই পৃথিবী আমাদের কল্পনার চেয়েও অনেক বেশি অদ্ভুত, অনেক বেশি বিস্ময়কর।
কণিকা শর্মা 


















