শান্তি প্রতিষ্ঠার নামে ডোনাল্ড ট্রাম্প আবারও বিশ্বমঞ্চে আলোচনার কেন্দ্রে। প্রশ্ন একটাই—এটি কি টেকসই শান্তির চেষ্টা, নাকি নিজের ভাবমূর্তি গড়ার আরেকটি বড় প্রদর্শনী।
শান্তির ভবনে নামফলক বদল
ওয়াশিংটনের ন্যাশনাল মলের পাশে যুক্তরাষ্ট্র শান্তি ইনস্টিটিউটের ভবনে খোদাই করা শান্তির নামের পাশে হঠাৎই ঝলমলে রুপালি অক্ষরে বসেছে ডোনাল্ড ট্রাম্পের নাম। দৃশ্যটি অনেকের কাছে কৃত্রিম মনে হলেও ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠদের যুক্তি স্পষ্ট। শান্তির দূত হিসেবে নিজের ভাবমূর্তি গড়ে তুলতে যা কিছু তাকে উৎসাহিত করে, সেটাই নাকি এখন কার্যকর কৌশল। বাস্তবে শান্তি আসুক বা না আসুক, অন্তত শান্তির মঞ্চটি যেন তার সময়ের জন্য প্রস্তুত।
ইনস্টিটিউট থেকে মঞ্চে রূপান্তর
একসময় যেসব নীরব কূটনীতিক যুদ্ধক্ষেত্রে সমাধানের পথ খুঁজতেন, তাদের বড় অংশই বিদায় নিয়েছেন। মাসের পর মাস ভবনটি প্রায় ফাঁকাই ছিল। প্রযুক্তি উদ্যোক্তা ইলন মাস্কঘনিষ্ঠ এক অভিযানের পর তিন শতাধিক কর্মীর মধ্যে হাতে গোনা কয়েকজন ছাড়া সবাই ছাঁটাই হন। এই প্রেক্ষাপটে ট্রাম্পের কূটনীতি যেন হয়ে উঠেছে কাঠামো ভাঙা, দ্রুত সিদ্ধান্ত আর ব্যক্তিকেন্দ্রিক প্রদর্শনের গল্প।

আফ্রিকার চুক্তি, প্রশ্নের ছায়া
ডিসেম্বরের শুরুতে এই ভবনেই ট্রাম্প আয়োজন করেন আফ্রিকার গ্রেট লেকস অঞ্চলের দুই রাষ্ট্রনেতার বৈঠক। রুয়ান্ডা ও কঙ্গোর প্রেসিডেন্ট অর্থনৈতিক সহযোগিতার এক চুক্তিতে সই করেন। ট্রাম্প এটিকে বিশ্বের দীর্ঘস্থায়ী এক সংঘাতের অবসান বলে ঘোষণা দেন। অথচ বাস্তবতায় পূর্ব কঙ্গোর সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো চুক্তির বাইরে, সহিংসতাও থামেনি। এমনকি সই শেষে দুই নেতার মধ্যে হাত মেলানো পর্যন্ত দেখা যায়নি।
শান্তির বিনিময়ে লাভের হিসাব
চুক্তির ঘোষণায় ট্রাম্পের কণ্ঠে ছিল পরিচিত সুর। সবার লাভ হবে, যুক্তরাষ্ট্র পাবে গুরুত্বপূর্ণ খনিজ সম্পদের সুবিধা। শান্তিকে এখানে নৈতিক অর্জনের চেয়ে লেনদেনের হিসাবেই বেশি গুরুত্ব পায়। বিদেশি নেতাদের প্রশংসায় ভাসতে ভাসতে ট্রাম্প ভবনটিকে নতুন বলে আখ্যা দেন, যদিও সেটির বয়স এক দশকের বেশি।
ইতিহাস আর বাস্তবতা উপেক্ষিত
এই ইনস্টিটিউট গড়ে উঠেছিল যুদ্ধফেরত সৈনিক ও আইনপ্রণেতাদের উদ্যোগে, সাবেক রিপাবলিকান প্রশাসনের সময়। ইরাক থেকে আফ্রিকার হর্ন অঞ্চল পর্যন্ত বহু সংঘাতে নীরব মধ্যস্থতার কাজ করেছে তারা। এমনকি ট্রাম্পের দলীয় মিত্ররাও একসময় এই প্রতিষ্ঠানের প্রশংসা করেছেন। অথচ তার বাজেট ছিল প্রতিরক্ষা ব্যয়ের তুলনায় নগণ্য। তবু সেখানেই নেমে আসে সবচেয়ে কঠোর কোপ।

শান্তির দাবি, বিতর্কের তালিকা
ট্রাম্প দাবি করেন এক বছরেরও কম সময়ে তিনি একাধিক যুদ্ধ শেষ করেছেন। সরকারি নথিতে যেসব সংঘাতের কথা বলা হয়, তার অনেকগুলোতেই সহিংসতা চলছেই বা আদৌ যুদ্ধ ছিল না। ভারত-পাকিস্তান সীমান্ত, সার্বিয়া-কসোভো উত্তেজনা কিংবা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সীমান্ত বিরোধ—সব ক্ষেত্রেই তার ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। গাজায় যুদ্ধ থামেনি, ইউক্রেন ইস্যুতে শান্তির নামে আগ্রাসী পক্ষকে ছাড় দেওয়ার অভিযোগও জোরালো।
জোরালো ঘোষণা, ক্ষণস্থায়ী বিরতি
ট্রাম্পের শান্তি অনুসরণ অনেকটা তার যুদ্ধনীতির মতোই। দ্রুত, উচ্চকণ্ঠ আর নাটকীয়। এতে সাময়িক বিরতি আসতে পারে, কিন্তু দীর্ঘস্থায়ী সমাধান নয়। শান্তি শুধু ঘোষণা দিয়ে আসে না, সেটি বিশ্বাস আর পরিশ্রমের ফল—ইনস্টিটিউটের দেয়ালে খোদাই করা সেই কথাই আজ সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা
বিশ্ব নিশ্চিন্ত থাকতে পারে এক বিষয়ে। ট্রাম্প শান্তির ট্রফিতে তৃপ্ত হবেন না। নোবেল পুরস্কারের স্বপ্ন তার চোখে এখনও ঝুলছে। সেই স্বপ্ন কতটা বাস্তব হবে, তা নির্ভর করবে প্রদর্শনের বাইরে গিয়ে সত্যিকারের কঠিন কাজটি তিনি আদৌ করেন কি না।

সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















