০৩:৩৬ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৮ ডিসেম্বর ২০২৫
কারখানার ঝুঁকিতে শৈশব, দেশের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ শিশুশ্রমিক শিল্প খাতে কাজ করছে খ্রিস্টমাসের আগে খাদ্যসহায়তার ডাক, বক্স পৌঁছাতে স্বেচ্ছাসেবক খুঁজছে পিটার ম্যাকি কমিউনিটি ফুড সেন্টার স্নিকো বিভ্রাটে রেহাই ক্যারি, অভিযোগের পথে ইংল্যান্ড কলকারখানা বন্ধে ফাঁকা হচ্ছে গ্রাম, মানুষ হারাচ্ছে নিউজিল্যান্ড বিরল সাদা লেজওয়ালা ঈগল নিখোঁজে স্তব্ধ ব্রিটেন, পুনরুদ্ধার প্রকল্পের গভীর উদ্বেগ মেরু ভালুকের মমতা বিস্ময় জাগাল, পরের শাবক দত্তক নিয়ে নতুন আশার গল্প বয়সের সঙ্গে নীরব ক্ষয়, সত্তর পেরোলেই আলঝেইমারের মতো পরিবর্তন ভয়াবহ হারে রাশিয়ার হুমকির ছায়ায় ইউরোপ, জব্দ সম্পদ ঘিরে বেলজিয়াম ও অর্থনৈতিক নেতৃত্বের ওপর চাপ ইউক্রেনের জন্য রাশিয়ার জমাট সম্পদ ব্যবহারে ইইউর কঠিন সিদ্ধান্ত, বেলজিয়ামের আপত্তি আর মস্কোর হুমকি নিরাপত্তা পুরোপুরি ব্যক্তিগত বিষয়: নির্বাচন নিয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা

কলকারখানা বন্ধে ফাঁকা হচ্ছে গ্রাম, মানুষ হারাচ্ছে নিউজিল্যান্ড

নিউজিল্যান্ডের গ্রামীণ জীবন যেন ধীরে ধীরে ফুরিয়ে আসছে। পাহাড় আর কলকারখানাকে ঘিরে গড়ে ওঠা রুয়াপেহু অঞ্চলে একের পর এক শিল্পপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ায় মানুষ কাজ হারাচ্ছে, পরিবার ভেঙে যাচ্ছে, আর গ্রাম ছেড়ে শহর কিংবা বিদেশে পাড়ি দিচ্ছে। একসময়ের কর্মচঞ্চল এই অঞ্চল এখন দেশজুড়ে গ্রামীণ জনশূন্যতার প্রতীক হয়ে উঠছে ।

রুয়াপেহু অঞ্চলের প্রাণ ছিল দুটি কেন্দ্র। একটি হলো মাউন্ট রুয়াপেহু পাহাড়, যেখানে শীতকালীন পর্যটন আর নানা কাজের সুযোগ মানুষকে টানত। অন্যটি ছিল মিল বা কারখানা, বিশেষ করে উইনস্টোন পাল্প পরিচালিত কাগজকল, যা প্রজন্মের পর প্রজন্মকে কাজ দিয়েছে। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে পাহাড়ে তুষারপাত কমে যাওয়ায় পর্যটন মৌসুম ছোট হয়েছে, কর্মী ছাঁটাই হয়েছে। তার ওপর ২০২৩ সালে প্রায় একশ বছরের পুরোনো শাতো টোঙ্গারিরো হোটেল বন্ধ হয়ে যায়। শেষ আঘাত আসে ২০২৪ সালের অক্টোবরে, যখন উচ্চ বিদ্যুৎমূল্যের অজুহাতে দুইটি বড় মিল বন্ধের ঘোষণা দেয় কর্তৃপক্ষ।

ওহাকুনে ও রায়তিহি শহরের শত শত মানুষ একদিনে কর্মহীন হয়ে পড়ে। স্থানীয় উদ্যোক্তা জ্যানেল ফিঞ্চ বলেন, মিল বন্ধ হওয়া ছিল হৃদয়ে ছুরিকাঘাতের মতো। বন্ধুস্বজনরা শহর ছাড়তে বাধ্য হয়েছে, যার প্রভাব পড়েছে পুরো সমাজে। নভেম্বরের শেষ দিকে এলাকায় গেলে দেখা যায়, সারি সারি দোকান বন্ধ, বাড়ির সামনে বিক্রির সাইনবোর্ড ঝুলছে।

এই সংকট শুধু রুয়াপেহুতেই সীমাবদ্ধ নয়। ২০২৩ সালের পর থেকে দেশজুড়ে একাধিক গ্রাম ও ছোট শহরে মিল ও কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে, যার ফলে অন্তত এক হাজার মানুষ চাকরি হারিয়েছে। কোম্পানিগুলোর ভাষ্য, জ্বালানি ব্যয় বেড়ে যাওয়া, চাহিদা কমে যাওয়া আর উৎপাদন খরচ বাড়ার কারণেই এই সিদ্ধান্ত।

অনেকে এখনো এলাকায় টিকে থাকার চেষ্টা করছেন, আবার অনেকে বাধ্য হয়ে চলে যাচ্ছেন। রায়তিহির শিশু যত্নকেন্দ্রের ব্যবস্থাপক ব্রেন্ডা বার্নার্ড ২৫ বছর পর এলাকা ছেড়ে যাচ্ছেন। তাঁর স্বামী মিলের চাকরি হারিয়ে আগেই অন্য শহরে চলে গেছেন। তিনি বলেন, এই অঞ্চলের সঙ্গে তাদের শারীরিক ও মানসিক বন্ধন আছে, কিন্তু সামনে তাকানো ছাড়া উপায় নেই।

রুয়াপেহুর প্রায় অর্ধেক মানুষ মাওরি জনগোষ্ঠীর। আদিবাসী অনেক শ্রমিকের জন্য এই চলে যাওয়া আরও বেদনাদায়ক। স্থানীয় নগাতি রাঙ্গি গোষ্ঠীর প্রধান নির্বাহী হেলেন লিহি জানান, হাজার বছরের উত্তরাধিকার ছেড়ে যেতে হচ্ছে অনেক পরিবারকে। মিল বন্ধের পর প্রায় দশ থেকে পনের শতাংশ শ্রমিক পরিবারসহ অস্ট্রেলিয়ায় চলে গেছে। গোষ্ঠীটি এখন দক্ষতা উন্নয়ন ও কর্মপ্রশিক্ষণের মাধ্যমে মানুষকে এলাকায় ধরে রাখার চেষ্টা করছে।

সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত এক বছরে নিউজিল্যান্ডের ১৬ অঞ্চলের মধ্যে সাতটিতে আগমনের চেয়ে প্রস্থান বেশি হয়েছে। সমাজবিজ্ঞানীরা সতর্ক করছেন, দেশটির জনসংখ্যা এক নতুন পর্যায়ে প্রবেশ করছে, যেখানে উত্তর দ্বীপের বড় শহরগুলোতে মানুষ জমা হবে, আর গ্রাম ও প্রান্তিক অঞ্চল ক্রমেই ফাঁকা হয়ে যাবে।

গত অক্টোবর পর্যন্ত এক বছরে ৭১ হাজারের বেশি মানুষ নিউজিল্যান্ড ছেড়েছে, যার প্রায় ৬০ শতাংশই গেছে অস্ট্রেলিয়ায়। অর্থনীতিবিদদের মতে, শক্তিশালী অর্থনীতি ও বড় শ্রমবাজার মানুষকে টেনে নিচ্ছে। সরকার বলছে, অর্থনীতি চাঙা হলেই এই প্রবণতা কমবে। কিন্তু রুয়াপেহুর বাসিন্দাদের অভিযোগ, গ্রামীণ শিল্প রক্ষায় সরকার যথেষ্ট ভূমিকা রাখেনি।

তবু সব হতাশার মাঝেও কিছু মানুষ এখনো একসঙ্গে লড়াইয়ের কথা বলছেন। স্থানীয় ব্যবসায়ী অস্টিন হবসন বলেন, কঠিন সময়ে সবাই একে অপরের পাশে আছে, আর এই পারস্পরিক সহায়তাই এলাকাকে এখনো বাঁচিয়ে রেখেছে।

জনপ্রিয় সংবাদ

কারখানার ঝুঁকিতে শৈশব, দেশের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ শিশুশ্রমিক শিল্প খাতে কাজ করছে

কলকারখানা বন্ধে ফাঁকা হচ্ছে গ্রাম, মানুষ হারাচ্ছে নিউজিল্যান্ড

১২:২৯:৩৬ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৮ ডিসেম্বর ২০২৫

নিউজিল্যান্ডের গ্রামীণ জীবন যেন ধীরে ধীরে ফুরিয়ে আসছে। পাহাড় আর কলকারখানাকে ঘিরে গড়ে ওঠা রুয়াপেহু অঞ্চলে একের পর এক শিল্পপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ায় মানুষ কাজ হারাচ্ছে, পরিবার ভেঙে যাচ্ছে, আর গ্রাম ছেড়ে শহর কিংবা বিদেশে পাড়ি দিচ্ছে। একসময়ের কর্মচঞ্চল এই অঞ্চল এখন দেশজুড়ে গ্রামীণ জনশূন্যতার প্রতীক হয়ে উঠছে ।

রুয়াপেহু অঞ্চলের প্রাণ ছিল দুটি কেন্দ্র। একটি হলো মাউন্ট রুয়াপেহু পাহাড়, যেখানে শীতকালীন পর্যটন আর নানা কাজের সুযোগ মানুষকে টানত। অন্যটি ছিল মিল বা কারখানা, বিশেষ করে উইনস্টোন পাল্প পরিচালিত কাগজকল, যা প্রজন্মের পর প্রজন্মকে কাজ দিয়েছে। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে পাহাড়ে তুষারপাত কমে যাওয়ায় পর্যটন মৌসুম ছোট হয়েছে, কর্মী ছাঁটাই হয়েছে। তার ওপর ২০২৩ সালে প্রায় একশ বছরের পুরোনো শাতো টোঙ্গারিরো হোটেল বন্ধ হয়ে যায়। শেষ আঘাত আসে ২০২৪ সালের অক্টোবরে, যখন উচ্চ বিদ্যুৎমূল্যের অজুহাতে দুইটি বড় মিল বন্ধের ঘোষণা দেয় কর্তৃপক্ষ।

ওহাকুনে ও রায়তিহি শহরের শত শত মানুষ একদিনে কর্মহীন হয়ে পড়ে। স্থানীয় উদ্যোক্তা জ্যানেল ফিঞ্চ বলেন, মিল বন্ধ হওয়া ছিল হৃদয়ে ছুরিকাঘাতের মতো। বন্ধুস্বজনরা শহর ছাড়তে বাধ্য হয়েছে, যার প্রভাব পড়েছে পুরো সমাজে। নভেম্বরের শেষ দিকে এলাকায় গেলে দেখা যায়, সারি সারি দোকান বন্ধ, বাড়ির সামনে বিক্রির সাইনবোর্ড ঝুলছে।

এই সংকট শুধু রুয়াপেহুতেই সীমাবদ্ধ নয়। ২০২৩ সালের পর থেকে দেশজুড়ে একাধিক গ্রাম ও ছোট শহরে মিল ও কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে, যার ফলে অন্তত এক হাজার মানুষ চাকরি হারিয়েছে। কোম্পানিগুলোর ভাষ্য, জ্বালানি ব্যয় বেড়ে যাওয়া, চাহিদা কমে যাওয়া আর উৎপাদন খরচ বাড়ার কারণেই এই সিদ্ধান্ত।

অনেকে এখনো এলাকায় টিকে থাকার চেষ্টা করছেন, আবার অনেকে বাধ্য হয়ে চলে যাচ্ছেন। রায়তিহির শিশু যত্নকেন্দ্রের ব্যবস্থাপক ব্রেন্ডা বার্নার্ড ২৫ বছর পর এলাকা ছেড়ে যাচ্ছেন। তাঁর স্বামী মিলের চাকরি হারিয়ে আগেই অন্য শহরে চলে গেছেন। তিনি বলেন, এই অঞ্চলের সঙ্গে তাদের শারীরিক ও মানসিক বন্ধন আছে, কিন্তু সামনে তাকানো ছাড়া উপায় নেই।

রুয়াপেহুর প্রায় অর্ধেক মানুষ মাওরি জনগোষ্ঠীর। আদিবাসী অনেক শ্রমিকের জন্য এই চলে যাওয়া আরও বেদনাদায়ক। স্থানীয় নগাতি রাঙ্গি গোষ্ঠীর প্রধান নির্বাহী হেলেন লিহি জানান, হাজার বছরের উত্তরাধিকার ছেড়ে যেতে হচ্ছে অনেক পরিবারকে। মিল বন্ধের পর প্রায় দশ থেকে পনের শতাংশ শ্রমিক পরিবারসহ অস্ট্রেলিয়ায় চলে গেছে। গোষ্ঠীটি এখন দক্ষতা উন্নয়ন ও কর্মপ্রশিক্ষণের মাধ্যমে মানুষকে এলাকায় ধরে রাখার চেষ্টা করছে।

সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত এক বছরে নিউজিল্যান্ডের ১৬ অঞ্চলের মধ্যে সাতটিতে আগমনের চেয়ে প্রস্থান বেশি হয়েছে। সমাজবিজ্ঞানীরা সতর্ক করছেন, দেশটির জনসংখ্যা এক নতুন পর্যায়ে প্রবেশ করছে, যেখানে উত্তর দ্বীপের বড় শহরগুলোতে মানুষ জমা হবে, আর গ্রাম ও প্রান্তিক অঞ্চল ক্রমেই ফাঁকা হয়ে যাবে।

গত অক্টোবর পর্যন্ত এক বছরে ৭১ হাজারের বেশি মানুষ নিউজিল্যান্ড ছেড়েছে, যার প্রায় ৬০ শতাংশই গেছে অস্ট্রেলিয়ায়। অর্থনীতিবিদদের মতে, শক্তিশালী অর্থনীতি ও বড় শ্রমবাজার মানুষকে টেনে নিচ্ছে। সরকার বলছে, অর্থনীতি চাঙা হলেই এই প্রবণতা কমবে। কিন্তু রুয়াপেহুর বাসিন্দাদের অভিযোগ, গ্রামীণ শিল্প রক্ষায় সরকার যথেষ্ট ভূমিকা রাখেনি।

তবু সব হতাশার মাঝেও কিছু মানুষ এখনো একসঙ্গে লড়াইয়ের কথা বলছেন। স্থানীয় ব্যবসায়ী অস্টিন হবসন বলেন, কঠিন সময়ে সবাই একে অপরের পাশে আছে, আর এই পারস্পরিক সহায়তাই এলাকাকে এখনো বাঁচিয়ে রেখেছে।