০২:২৫ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১৯ ডিসেম্বর ২০২৫
নির্বাচন নিয়ে ভারতের ‘নসিহতে’ বাংলাদেশের তীব্র প্রতিক্রিয়া কেন? স্যাচুরেটেড চর্বি নিয়ে বিতর্ক: স্বাস্থ্যঝুঁকি নাকি ভুল বোঝাবুঝি জরিপ: জীবনযাত্রার ব্যয় সংকট একের পর এক দেশে রাজনীতি ওলটপালট করছে জুলাইযোদ্ধাদের মৃত্যু ও নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করলেন সামান্তা শারমিন ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে ২৪০ জন হাসপাতালে, মৃত্যু ১ রাজধানীর আবাসিক হোটেল থেকে জাতীয় পার্টির নেতার মরদেহ উদ্ধার জননিরাপত্তা নিশ্চিত করেই স্বাভাবিক জীবন চলবে: পুলিশকে নির্দেশ ডিএমপি কমিশনারের বরিশালে তিন ঘণ্টায় তিন লাশ, আতঙ্কে নগরী ও আশপাশের এলাকা এনসিপি নেত্রী জান্নাতারা রুমির মৃত্যু: সুরতহাল প্রতিবেদনে পুলিশের প্রাথমিক তথ্য ঢাকায় কয়েক মিনিটের ব্যবধানে তিন ককটেল বিস্ফোরণ, নারী পথচারী আহত

জরিপ: জীবনযাত্রার ব্যয় সংকট একের পর এক দেশে রাজনীতি ওলটপালট করছে

পলিটিকো জরিপ

এই আন্তর্জাতিক জরিপে দেখা যাচ্ছে, অর্থনৈতিক চাপ ও রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া একে অপরের সঙ্গে জড়িয়ে বহু দেশের নেতৃত্বকে বড় চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে।

গত বছর বিশ্ব রাজনীতিকে নাড়িয়ে দেওয়া জীবনযাত্রার ব্যয় সংকট এখনো বিশ্বের বড় বড় গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে প্রভাব ফেলছে। ক্ষমতাসীন সরকারগুলো শাস্তি পাচ্ছে, ভেঙে পড়ছে দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক জোট।

পলিটিকোর নতুন আন্তর্জাতিক জরিপ বলছে, টানা আর্থিক চাপে ভোটারদের হতাশা এখনো তীব্র ও প্রভাবশালী। পাঁচটি বড় অর্থনীতিতে জরিপে দেখা গেছে, জীবনযাত্রার ব্যয় রাজনীতিতে গভীর প্রতিধ্বনি তৈরি করছে।

যুক্তরাষ্ট্রে, যেখানে ডোনাল্ড ট্রাম্প অর্থনৈতিক জনতাবাদের প্রতিশ্রুতি দিয়ে আবার ক্ষমতায় ফিরেছেন, প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ ভোটার, অর্থাৎ ৬৫ শতাংশ মনে করেন গত এক বছরে জীবনযাত্রার ব্যয় আরও বেড়েছে। যুক্তরাজ্যে, যেখানে ১৪ বছরের শাসনের পর ২০২৪ সালে কনজারভেটিভ পার্টি ক্ষমতা হারায়, সেখানে ৭৭ শতাংশ মানুষ একই মত দিয়েছেন। ফ্রান্সে, প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁর জনপ্রিয়তা যখন ইতিহাসের সর্বনিম্ন পর্যায়ে, সেখানে ৪৫ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক মনে করেন দেশটি সমমানের অর্থনীতির দেশগুলোর তুলনায় পিছিয়ে পড়ছে। জার্মানিতে দীর্ঘদিনের অর্থনৈতিক দ্বন্দ্বের পর সাবেক চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎসের জোট সরকার ভেঙে পড়ে। সেখানে ৭৮ শতাংশ উত্তরদাতা জানিয়েছেন, গত বছরে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে। কানাডায়, মহামারির পর সৃষ্ট ব্যয় সংকট সাবেক প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর সরকারের বিরুদ্ধে জনরোষ বাড়াতে ভূমিকা রাখে এবং এ বছর তার পদত্যাগের আগে পরিস্থিতি আরও ঘনীভূত হয়। সেখানে ৬০ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক বলেছেন, তাদের স্মৃতিতে জীবনযাত্রার ব্যয় কখনো এত খারাপ ছিল না।

পলিটিকো ও পাবলিক ফার্স্টের প্রথম যৌথ আন্তর্জাতিক জরিপের এই ফলাফল দেখাচ্ছে, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতা একসঙ্গে সামলাতে গিয়ে বিশ্বনেতারা কতটা কঠিন পথ পাড়ি দিচ্ছেন। করোনাভাইরাস মহামারি বিশ্ব অর্থনীতিকে নাড়িয়ে দেওয়ার পাঁচ বছর পর, যুদ্ধ-বিগ্রহ ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দ্রুত উত্থানের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা এবং ইউরোপের বড় অর্থনীতিগুলোর বিপুল সংখ্যক মানুষ জীবনযাত্রার ব্যয়কে আজকের বিশ্বের অন্যতম বড় সমস্যা হিসেবে দেখছেন।

অনেকে মনে করেন, জীবনযাত্রার ব্যয় কমাতে নেতারা আরও অনেক কিছু করতে পারতেন, কিন্তু তা করছেন না। ফলে ক্ষমতাসীন সরকারগুলো ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক আতঙ্ক ও তার রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে। একই সঙ্গে বিরোধী দলগুলোর জন্য অর্থনৈতিক ইস্যুতে আক্রমণের সুযোগ তৈরি হয়েছে।

ইউরোপিয়ান পলিসি সেন্টারের নীতিবিশ্লেষক হাভিয়ের কার্বোনেল বলেন, ক্ষমতাসীনদের জন্য এই মঞ্চে প্রচার চালানো খুবই কঠিন। আজ কেন্দ্র-বাম ও কেন্দ্র-ডান দলগুলোকে মানুষ ক্ষমতার অংশ হিসেবেই দেখছে এবং দোষও তাদের ওপরই চাপাচ্ছে।

জীবনযাত্রার ব্যয় নিয়ে ভোটারদের হতাশা

পাঁচটি দেশেই অর্থনীতি নিয়ে ব্যাপক হতাশা দেখা যাচ্ছে। ফ্রান্সে ৮২ শতাংশ, জার্মানিতে ৭৮ শতাংশ, যুক্তরাজ্যে ৭৭ শতাংশ এবং কানাডায় ৭৯ শতাংশ মানুষ বলেছেন, গত এক বছরে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে। অধিকাংশ মানুষ আরও এক ধাপ এগিয়ে বলেছেন, এই সংকট আগে কখনো এত খারাপ ছিল না।

জরিপের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, অনেকেই এটিকে ব্যক্তিগত নয়, বরং কাঠামোগত সমস্যা হিসেবে দেখছেন। বেশিরভাগ মানুষের মতে, সমস্যা কম বেতন নয়, বরং পণ্যের উচ্চ মূল্য।

যুক্তরাজ্যে প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ মনে করেন দেশের অর্থনীতি খারাপ হয়েছে, যা ব্যক্তিগত আর্থিক অবস্থার অবনতির হার থেকেও বেশি। ফ্রান্স, কানাডা ও জার্মানিতেও একই চিত্র দেখা যায়। অর্থাৎ মানুষ নিজের জীবনের বাইরে গিয়ে সামগ্রিক অর্থনীতি ও ব্যয় নিয়ে উদ্বিগ্ন।

ইউরোপীয় ইউনিয়নের অর্থনীতি ২০২৫ সালে ১ দশমিক ৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধির পথে থাকলেও জার্মানির অর্থনীতি গত দুই বছর ধরে দুর্বল এবং চলতি বছর স্থবির থাকার আশঙ্কা রয়েছে। ফ্রান্সে জীবনযাত্রার ব্যয় কমাতে নেওয়া একের পর এক সরকারি নীতির ফলে জাতীয় ঋণ বেড়ে প্রায় চার ট্রিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে।

Keir Starmer becomes UK prime minister with a sensational victory | AP News

 

যুক্তরাজ্যে ধীরগতির প্রবৃদ্ধির মধ্যে প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার ভোটারদের বোঝাতে হিমশিম খাচ্ছেন যে তার মধ্য-বাম লেবার পার্টি ব্যয় কমাতে পারবে। কানাডায় সরকারি পরিসংখ্যানও উদ্বেগের ইঙ্গিত দিচ্ছে। নভেম্বর মাসে ভোক্তা মূল্যসূচক আগের বছরের তুলনায় ২ দশমিক ২ শতাংশ বেড়েছে, যা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের লক্ষ্যের কাছাকাছি।

অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দিচ্ছে রাজনীতি

ভোটারদের অর্থনৈতিক উদ্বেগ রাজনীতিতে বড় ঢেউ তুলছে। ২০২৪ সালে ট্রাম্প নিজে অর্থনীতি পরিচালনা না করেও ব্যয় সংকটকে কেন্দ্র করে প্রচার চালান। কিন্তু সাম্প্রতিক মাসগুলোতে অর্থনীতি পরিচালনায় তার ভূমিকা নিয়ে ভোটারদের অসন্তোষ বাড়ছে, যা দেখাচ্ছে এই সংকটের মধ্যে উন্নতির গল্প শোনানো কতটা কঠিন।

ইউরোপে এই পিছিয়ে পড়ার অনুভূতি আরও তীব্র। জার্মানি, ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্যের প্রায় অর্ধেক মানুষ মনে করেন, তাদের দেশ সমমানের অর্থনীতির দেশগুলোর তুলনায় পিছিয়ে যাচ্ছে।

এই হতাশা অনেককে রাজনীতি থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে, কারণ পরিবর্তনের আশা তারা দেখছেন না। আবার অন্যদের ক্ষেত্রে এটি বিকল্প রাজনৈতিক পথ খোঁজার তাগিদ তৈরি করছে। জার্মানিতে চ্যান্সেলর ফ্রিডরিখ মারৎস অর্থনীতি ঢেলে সাজানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু ক্ষমতায় এসে তিনি বাণিজ্য যুদ্ধ ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধসহ ভূরাজনৈতিক ইস্যুতে বেশি মনোযোগ দিয়েছেন। এতে তার সমালোচকরা সুযোগ পেয়েছে। কট্টর ডানপন্থী দল আফডি এখন জরিপে শীর্ষে এবং মারৎসকে জনগণের চাহিদা উপেক্ষার অভিযোগ তুলে তাকে ‘পররাষ্ট্রনীতির চ্যান্সেলর’ বলেও ডাকছে।

ফ্রান্সে সরকার ব্যয় সংকট মোকাবিলায় নেওয়া কিছু নীতি ফিরিয়ে নেওয়ার কথা ভাবছে, যা ব্যয়ের চাপে থাকা জনগণের মধ্যে অজনপ্রিয় হতে পারে এবং ডান ও বাম উভয় দিকের সরকারবিরোধী শক্তিকে উসকে দিতে পারে।

কানাডার জরিপ বিশ্লেষক ডেভিড কোলেত্তো বলেন, ব্যয় সংকট কোনো প্রান্তিক উদ্বেগ নয়, এটি মানুষের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতার কেন্দ্রবিন্দু, যা সরকারের কর্মদক্ষতা ও নেতৃত্ব মূল্যায়নে বড় ভূমিকা রাখছে।

আসন্ন নির্বাচনে কেন্দ্রীয় ইস্যু হবে ব্যয় সংকট

আগামী বছর বিশ্বজুড়ে নির্বাচনে জীবনযাত্রার ব্যয় বড় ইস্যু হয়ে উঠবে। যুক্তরাষ্ট্রে ডেমোক্র্যাট প্রার্থীরা ইতোমধ্যে ব্যয় কমানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রচার শুরু করেছেন। যুক্তরাজ্যে স্টারমার সরকারও সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে ব্যয় নিয়ে আরও স্পষ্ট অবস্থান নিচ্ছে। জার্মানি ও ফ্রান্সে আসন্ন আঞ্চলিক ও স্থানীয় নির্বাচনেও এই বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে, বিশেষ করে বড় শহরগুলোতে, যেখানে মূল্যচাপ সবচেয়ে বেশি।

প্যারিসে পরিবেশবান্ধব উদ্যোগের জন্য বর্তমান প্রশাসন প্রশংসা পেলেও মেয়র প্রার্থী ডেভিড বেলিয়ার্ড বলেন, মানুষের মাস শেষ করার সংগ্রামে সহায়তার দিকে আরও মনোযোগ দেওয়া দরকার।

জরিপ সম্পর্কে

পলিটিকো জরিপটি পরিচালনা করেছে পাবলিক ফার্স্ট। ১৮ থেকে ২১ অক্টোবরের মধ্যে অনলাইনে যুক্তরাষ্ট্রের ২ হাজার ৫১ জন প্রাপ্তবয়স্ককে জরিপ করা হয়। বয়স, জাতিগোষ্ঠী, লিঙ্গ, ভৌগোলিক অবস্থান ও শিক্ষাগত যোগ্যতার ভিত্তিতে ফলাফল সমন্বয় করা হয়েছে। মোট ত্রুটির সীমা প্লাস-মাইনাস ২ দশমিক ২ শতাংশ।

 

জনপ্রিয় সংবাদ

নির্বাচন নিয়ে ভারতের ‘নসিহতে’ বাংলাদেশের তীব্র প্রতিক্রিয়া কেন?

জরিপ: জীবনযাত্রার ব্যয় সংকট একের পর এক দেশে রাজনীতি ওলটপালট করছে

১১:৫৫:১২ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৮ ডিসেম্বর ২০২৫

পলিটিকো জরিপ

এই আন্তর্জাতিক জরিপে দেখা যাচ্ছে, অর্থনৈতিক চাপ ও রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া একে অপরের সঙ্গে জড়িয়ে বহু দেশের নেতৃত্বকে বড় চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে।

গত বছর বিশ্ব রাজনীতিকে নাড়িয়ে দেওয়া জীবনযাত্রার ব্যয় সংকট এখনো বিশ্বের বড় বড় গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে প্রভাব ফেলছে। ক্ষমতাসীন সরকারগুলো শাস্তি পাচ্ছে, ভেঙে পড়ছে দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক জোট।

পলিটিকোর নতুন আন্তর্জাতিক জরিপ বলছে, টানা আর্থিক চাপে ভোটারদের হতাশা এখনো তীব্র ও প্রভাবশালী। পাঁচটি বড় অর্থনীতিতে জরিপে দেখা গেছে, জীবনযাত্রার ব্যয় রাজনীতিতে গভীর প্রতিধ্বনি তৈরি করছে।

যুক্তরাষ্ট্রে, যেখানে ডোনাল্ড ট্রাম্প অর্থনৈতিক জনতাবাদের প্রতিশ্রুতি দিয়ে আবার ক্ষমতায় ফিরেছেন, প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ ভোটার, অর্থাৎ ৬৫ শতাংশ মনে করেন গত এক বছরে জীবনযাত্রার ব্যয় আরও বেড়েছে। যুক্তরাজ্যে, যেখানে ১৪ বছরের শাসনের পর ২০২৪ সালে কনজারভেটিভ পার্টি ক্ষমতা হারায়, সেখানে ৭৭ শতাংশ মানুষ একই মত দিয়েছেন। ফ্রান্সে, প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁর জনপ্রিয়তা যখন ইতিহাসের সর্বনিম্ন পর্যায়ে, সেখানে ৪৫ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক মনে করেন দেশটি সমমানের অর্থনীতির দেশগুলোর তুলনায় পিছিয়ে পড়ছে। জার্মানিতে দীর্ঘদিনের অর্থনৈতিক দ্বন্দ্বের পর সাবেক চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎসের জোট সরকার ভেঙে পড়ে। সেখানে ৭৮ শতাংশ উত্তরদাতা জানিয়েছেন, গত বছরে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে। কানাডায়, মহামারির পর সৃষ্ট ব্যয় সংকট সাবেক প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর সরকারের বিরুদ্ধে জনরোষ বাড়াতে ভূমিকা রাখে এবং এ বছর তার পদত্যাগের আগে পরিস্থিতি আরও ঘনীভূত হয়। সেখানে ৬০ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক বলেছেন, তাদের স্মৃতিতে জীবনযাত্রার ব্যয় কখনো এত খারাপ ছিল না।

পলিটিকো ও পাবলিক ফার্স্টের প্রথম যৌথ আন্তর্জাতিক জরিপের এই ফলাফল দেখাচ্ছে, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতা একসঙ্গে সামলাতে গিয়ে বিশ্বনেতারা কতটা কঠিন পথ পাড়ি দিচ্ছেন। করোনাভাইরাস মহামারি বিশ্ব অর্থনীতিকে নাড়িয়ে দেওয়ার পাঁচ বছর পর, যুদ্ধ-বিগ্রহ ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দ্রুত উত্থানের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা এবং ইউরোপের বড় অর্থনীতিগুলোর বিপুল সংখ্যক মানুষ জীবনযাত্রার ব্যয়কে আজকের বিশ্বের অন্যতম বড় সমস্যা হিসেবে দেখছেন।

অনেকে মনে করেন, জীবনযাত্রার ব্যয় কমাতে নেতারা আরও অনেক কিছু করতে পারতেন, কিন্তু তা করছেন না। ফলে ক্ষমতাসীন সরকারগুলো ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক আতঙ্ক ও তার রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে। একই সঙ্গে বিরোধী দলগুলোর জন্য অর্থনৈতিক ইস্যুতে আক্রমণের সুযোগ তৈরি হয়েছে।

ইউরোপিয়ান পলিসি সেন্টারের নীতিবিশ্লেষক হাভিয়ের কার্বোনেল বলেন, ক্ষমতাসীনদের জন্য এই মঞ্চে প্রচার চালানো খুবই কঠিন। আজ কেন্দ্র-বাম ও কেন্দ্র-ডান দলগুলোকে মানুষ ক্ষমতার অংশ হিসেবেই দেখছে এবং দোষও তাদের ওপরই চাপাচ্ছে।

জীবনযাত্রার ব্যয় নিয়ে ভোটারদের হতাশা

পাঁচটি দেশেই অর্থনীতি নিয়ে ব্যাপক হতাশা দেখা যাচ্ছে। ফ্রান্সে ৮২ শতাংশ, জার্মানিতে ৭৮ শতাংশ, যুক্তরাজ্যে ৭৭ শতাংশ এবং কানাডায় ৭৯ শতাংশ মানুষ বলেছেন, গত এক বছরে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে। অধিকাংশ মানুষ আরও এক ধাপ এগিয়ে বলেছেন, এই সংকট আগে কখনো এত খারাপ ছিল না।

জরিপের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, অনেকেই এটিকে ব্যক্তিগত নয়, বরং কাঠামোগত সমস্যা হিসেবে দেখছেন। বেশিরভাগ মানুষের মতে, সমস্যা কম বেতন নয়, বরং পণ্যের উচ্চ মূল্য।

যুক্তরাজ্যে প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ মনে করেন দেশের অর্থনীতি খারাপ হয়েছে, যা ব্যক্তিগত আর্থিক অবস্থার অবনতির হার থেকেও বেশি। ফ্রান্স, কানাডা ও জার্মানিতেও একই চিত্র দেখা যায়। অর্থাৎ মানুষ নিজের জীবনের বাইরে গিয়ে সামগ্রিক অর্থনীতি ও ব্যয় নিয়ে উদ্বিগ্ন।

ইউরোপীয় ইউনিয়নের অর্থনীতি ২০২৫ সালে ১ দশমিক ৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধির পথে থাকলেও জার্মানির অর্থনীতি গত দুই বছর ধরে দুর্বল এবং চলতি বছর স্থবির থাকার আশঙ্কা রয়েছে। ফ্রান্সে জীবনযাত্রার ব্যয় কমাতে নেওয়া একের পর এক সরকারি নীতির ফলে জাতীয় ঋণ বেড়ে প্রায় চার ট্রিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে।

Keir Starmer becomes UK prime minister with a sensational victory | AP News

 

যুক্তরাজ্যে ধীরগতির প্রবৃদ্ধির মধ্যে প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার ভোটারদের বোঝাতে হিমশিম খাচ্ছেন যে তার মধ্য-বাম লেবার পার্টি ব্যয় কমাতে পারবে। কানাডায় সরকারি পরিসংখ্যানও উদ্বেগের ইঙ্গিত দিচ্ছে। নভেম্বর মাসে ভোক্তা মূল্যসূচক আগের বছরের তুলনায় ২ দশমিক ২ শতাংশ বেড়েছে, যা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের লক্ষ্যের কাছাকাছি।

অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দিচ্ছে রাজনীতি

ভোটারদের অর্থনৈতিক উদ্বেগ রাজনীতিতে বড় ঢেউ তুলছে। ২০২৪ সালে ট্রাম্প নিজে অর্থনীতি পরিচালনা না করেও ব্যয় সংকটকে কেন্দ্র করে প্রচার চালান। কিন্তু সাম্প্রতিক মাসগুলোতে অর্থনীতি পরিচালনায় তার ভূমিকা নিয়ে ভোটারদের অসন্তোষ বাড়ছে, যা দেখাচ্ছে এই সংকটের মধ্যে উন্নতির গল্প শোনানো কতটা কঠিন।

ইউরোপে এই পিছিয়ে পড়ার অনুভূতি আরও তীব্র। জার্মানি, ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্যের প্রায় অর্ধেক মানুষ মনে করেন, তাদের দেশ সমমানের অর্থনীতির দেশগুলোর তুলনায় পিছিয়ে যাচ্ছে।

এই হতাশা অনেককে রাজনীতি থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে, কারণ পরিবর্তনের আশা তারা দেখছেন না। আবার অন্যদের ক্ষেত্রে এটি বিকল্প রাজনৈতিক পথ খোঁজার তাগিদ তৈরি করছে। জার্মানিতে চ্যান্সেলর ফ্রিডরিখ মারৎস অর্থনীতি ঢেলে সাজানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু ক্ষমতায় এসে তিনি বাণিজ্য যুদ্ধ ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধসহ ভূরাজনৈতিক ইস্যুতে বেশি মনোযোগ দিয়েছেন। এতে তার সমালোচকরা সুযোগ পেয়েছে। কট্টর ডানপন্থী দল আফডি এখন জরিপে শীর্ষে এবং মারৎসকে জনগণের চাহিদা উপেক্ষার অভিযোগ তুলে তাকে ‘পররাষ্ট্রনীতির চ্যান্সেলর’ বলেও ডাকছে।

ফ্রান্সে সরকার ব্যয় সংকট মোকাবিলায় নেওয়া কিছু নীতি ফিরিয়ে নেওয়ার কথা ভাবছে, যা ব্যয়ের চাপে থাকা জনগণের মধ্যে অজনপ্রিয় হতে পারে এবং ডান ও বাম উভয় দিকের সরকারবিরোধী শক্তিকে উসকে দিতে পারে।

কানাডার জরিপ বিশ্লেষক ডেভিড কোলেত্তো বলেন, ব্যয় সংকট কোনো প্রান্তিক উদ্বেগ নয়, এটি মানুষের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতার কেন্দ্রবিন্দু, যা সরকারের কর্মদক্ষতা ও নেতৃত্ব মূল্যায়নে বড় ভূমিকা রাখছে।

আসন্ন নির্বাচনে কেন্দ্রীয় ইস্যু হবে ব্যয় সংকট

আগামী বছর বিশ্বজুড়ে নির্বাচনে জীবনযাত্রার ব্যয় বড় ইস্যু হয়ে উঠবে। যুক্তরাষ্ট্রে ডেমোক্র্যাট প্রার্থীরা ইতোমধ্যে ব্যয় কমানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রচার শুরু করেছেন। যুক্তরাজ্যে স্টারমার সরকারও সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে ব্যয় নিয়ে আরও স্পষ্ট অবস্থান নিচ্ছে। জার্মানি ও ফ্রান্সে আসন্ন আঞ্চলিক ও স্থানীয় নির্বাচনেও এই বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে, বিশেষ করে বড় শহরগুলোতে, যেখানে মূল্যচাপ সবচেয়ে বেশি।

প্যারিসে পরিবেশবান্ধব উদ্যোগের জন্য বর্তমান প্রশাসন প্রশংসা পেলেও মেয়র প্রার্থী ডেভিড বেলিয়ার্ড বলেন, মানুষের মাস শেষ করার সংগ্রামে সহায়তার দিকে আরও মনোযোগ দেওয়া দরকার।

জরিপ সম্পর্কে

পলিটিকো জরিপটি পরিচালনা করেছে পাবলিক ফার্স্ট। ১৮ থেকে ২১ অক্টোবরের মধ্যে অনলাইনে যুক্তরাষ্ট্রের ২ হাজার ৫১ জন প্রাপ্তবয়স্ককে জরিপ করা হয়। বয়স, জাতিগোষ্ঠী, লিঙ্গ, ভৌগোলিক অবস্থান ও শিক্ষাগত যোগ্যতার ভিত্তিতে ফলাফল সমন্বয় করা হয়েছে। মোট ত্রুটির সীমা প্লাস-মাইনাস ২ দশমিক ২ শতাংশ।