মানুষের ইতিহাসে সবচেয়ে গভীর ও দীর্ঘস্থায়ী সম্পর্কগুলোর একটি হলো মানুষ ও কুকুরের বন্ধন। প্রতিদিনের জীবনে এই সম্পর্ক এতটাই স্বাভাবিক যে আমরা খুব কমই ভেবে দেখি, কীভাবে এক সময়ের ভয়ংকর শিকারি নেকড়ে ধীরে ধীরে মানুষের ঘরের সবচেয়ে বিশ্বস্ত সঙ্গীতে পরিণত হলো। গবেষণা বলছে, এই সহাবস্থান শুধু আবেগের গল্প নয়, এটি বিবর্তন, টিকে থাকা আর পারস্পরিক প্রয়োজনের এক অসাধারণ ইতিহাস।
শুরুর গল্প যেখানে নেকড়ে আর মানুষ
আজ থেকে অন্তত চৌদ্দ হাজার বছর আগে জার্মানির বন অঞ্চলে মানুষের সঙ্গে কুকুরের একসঙ্গে কবর দেওয়ার প্রমাণ পাওয়া গেছে। তখনো মানুষ ছিল শিকারি ও সংগ্রাহক। জিনগত বিশ্লেষণ বলছে, এই সম্পর্কের শিকড় আরও গভীরে, প্রায় তেইশ হাজার বছর আগে। অন্য গৃহপালিত প্রাণী যেখানে কৃষির সঙ্গে যুক্ত হয়ে মানুষের জীবনে এসেছে, সেখানে কুকুর মানুষের সঙ্গী হয়েছে তারও বহু আগে।
কেন অন্য প্রাণী নয়, কুকুরই কেন
গরু, ছাগল বা ঘোড়া মানুষের কাজে লাগে খাদ্য বা পরিবহনের জন্য। বিড়াল ঘরে এসেছে ইঁদুর ধরার কাজে। কিন্তু কুকুর শুধু কাজের সঙ্গী নয়, বিশ্বাসের সঙ্গী। তারা পাহারা দেয়, শিকার করে, পথ দেখায়, এমনকি মানুষের আবেগও বুঝতে পারে। গবেষকদের মতে, নেকড়ের সামাজিক জীবন আর মানুষের দলবদ্ধ শিকারি জীবনের মধ্যে মিল ছিল। এই মিলই তাদের কাছাকাছি আসার পথ তৈরি করে।

খাবারের টানে গড়ে ওঠা বন্ধন
বিজ্ঞানীদের একটি ব্যাখ্যা বলছে, বরফযুগের কঠিন সময়ে মানুষ শিকার করত বেশি, কারণ তাদের চর্বি দরকার ছিল। প্রোটিনসমৃদ্ধ চর্বিহীন মাংস মানুষের জন্য অতিরিক্ত হয়ে পড়ত। সেই ফেলে দেওয়া খাবার কাছে টেনেছিল নেকড়েদের। যারা মানুষের আশপাশে থাকতে শিখেছিল, তারাই ধীরে ধীরে টিকে গেছে। এই প্রক্রিয়াকেই বলা হচ্ছে সবচেয়ে বন্ধুত্বপূর্ণদের টিকে থাকা।
বন্ধুত্বের জিন আর মন
নেকড়ে আর কুকুরের মধ্যে পার্থক্য শুধু আচরণে নয়, জিনেও। গবেষণায় দেখা গেছে, কুকুর মানুষের ইঙ্গিত, দৃষ্টি আর আবেগ দ্রুত বুঝতে পারে। মানুষের কান্না শুনে তারা কাছে আসে, শিশুর কান্নায় তাদের শরীরে চাপের লক্ষণ দেখা যায়। এমনকি কুকুরের চোখের বিশেষ ভঙ্গিও বিবর্তনের ফল, যা মানুষের মায়া জাগাতে সাহায্য করে।
কাজ থেকে ঘর, কুকুরের বদলে যাওয়া ভূমিকা
প্রাচীনকালে কুকুর ছিল শিকারি, স্লেজ টানা বা পাহারার সঙ্গী। পরে সময়ের সঙ্গে তারা বিশেষ কাজে দক্ষ হয়েছে। আজ তারা অন্ধ মানুষের পথপ্রদর্শক, অসুস্থ মানুষের মানসিক সান্ত্বনার সঙ্গী। আধুনিক সমাজে কুকুর এখন পরিবারের সদস্য। যুক্তরাষ্ট্রের অর্ধেকের বেশি পরিবারে কুকুর আছে, আর এই বন্ধুত্ব ঘিরে গড়ে উঠেছে বিশাল অর্থনীতি।
হাজার বছরের এই সম্পর্কের দিকে তাকালে স্পষ্ট হয়, কুকুরের ইতিহাস আসলে মানুষেরই ইতিহাসের অংশ। শিকারি আগুনের পাশে বসে শুরু হওয়া যে সহাবস্থান, তা আজও শেষ হওয়ার কোনো লক্ষণ দেখাচ্ছে না
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















