০৮:২৩ অপরাহ্ন, রবিবার, ২১ ডিসেম্বর ২০২৫
প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারে হামলা মতপ্রকাশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে আঘাত: মাইকেল মিলার দিল্লিতে বাংলাদেশ হাইকমিশনের সামনে ‘হিন্দু চরমপন্থীদের’ বিক্ষোভ – কী ঘটেছিল ১১ মাসে মাত্র ২৫ দিন ক্লাসে উপস্থিত: পরীক্ষার অযোগ্য ঘোষণায় শিক্ষককে হাতুড়ি দিয়ে মারধর বিএনপি কার্যালয়ে হামলার অভিযোগ, আহত চার নেতা-কর্মী পত্রিকা অফিসে হামলার আগাম গোয়েন্দা তথ্য ছিল, তবু গুরুত্ব দেওয়া হয়নি: সালাহউদ্দিন আহমদ হাদি হত্যাকাণ্ড: ঘাতকের অবস্থান এখনও অজানা চট্টগ্রামে চিকুনগুনিয়া সংক্রমণ বাড়ছে, সতর্কতা জারি ভালুকায় পোশাক শ্রমিক হত্যা: ১০ জন গ্রেপ্তার সাভারে ৫০৮ লিটার অবৈধ মদ উদ্ধার, গ্রেপ্তার ১ রাঙামাটির পুরাতন বাস টার্মিনালে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড, পুড়লো তিনটি বাস

বিদেশি সহায়তা কমায় বিপর্যস্ত রোহিঙ্গা শিশুদের জীবন: পাচার, নির্যাতন আর বাল্যবিবাহের ফাঁদে হারিয়ে যাচ্ছে শৈশব

বাংলাদেশের কক্সবাজারে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা প্রায় বারো লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীর মধ্যে শিশুদের জীবন সবচেয়ে বড় আঘাত পেয়েছে বিদেশি সহায়তা হঠাৎ কমে যাওয়ায়। চলতি বছরে যুক্তরাষ্ট্রসহ কয়েকটি দেশের সহায়তা কমানোর ফলে শিশু সুরক্ষা, শিক্ষা ও কিশোর উন্নয়ন কর্মসূচি প্রায় ভেঙে পড়েছে। এর সরাসরি প্রভাব পড়েছে শরণার্থী শিবিরের স্কুল ও প্রশিক্ষণকেন্দ্রগুলোর ওপর, যার ফলে হাজার হাজার শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে।

শিক্ষা বন্ধ, বাড়ছে ঝুঁকি
সহায়তা কমে যাওয়ায় অসংখ্য অস্থায়ী স্কুল ও শেখার কেন্দ্র বন্ধ হয়ে পড়েছে। এর ফলে শিশুরা পড়াশোনার পাশাপাশি নিরাপদ পরিবেশ থেকেও বঞ্চিত হয়েছে। শিক্ষা ও সুরক্ষার এই শূন্যতা তাদেরকে মানবপাচার, শিশুশ্রম, বাল্যবিবাহ ও যৌন নির্যাতনের মতো ভয়াবহ ঝুঁকির দিকে ঠেলে দিচ্ছে। কাজ বা পড়াশোনার সুযোগ না থাকায় অনেক শিশু সহজেই পাচারকারীদের ফাঁদে পড়ছে।

এক কিশোরীর হারানো স্বপ্ন
সতেরো বছরের হাসিনা মনে করেন, স্কুলই ছিল তার একমাত্র আশ্রয়, যা তাকে জোরপূর্বক বিয়ে ও নির্যাতন থেকে রক্ষা করত। কিন্তু জুন মাসে তার স্কুলের তহবিল বন্ধ হয়ে গেলে পড়াশোনা থেমে যায়। এরপর তাকে বিয়ে দেওয়া হয়। বিয়ের পর স্বামীর শারীরিক ও যৌন নির্যাতনে তার শৈশব আর শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। হাসিনার ভাষায়, স্কুল বন্ধ না হলে তাকে এমন জীবনে আটকে পড়তে হতো না।

শিশু নির্যাতন ও অপরাধ বেড়েই চলেছে
শিশু সুরক্ষা সংস্থাগুলোর তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরে শিবিরগুলোতে শিশু নির্যাতন ও শোষণের ঘটনা ভয়াবহভাবে বেড়েছে। অপহরণ ও জোর করে তুলে নেওয়ার ঘটনা আগের বছরের তুলনায় চার গুণ বেড়ে পাঁচ শতাধিক ছাড়িয়েছে। সশস্ত্র গোষ্ঠীর সঙ্গে জড়িত হওয়া বা ব্যবহার হওয়া শিশুর সংখ্যাও উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। বাল্যবিবাহ ও শিশুশ্রমের ঘটনাও আগের বছরের তুলনায় অনেক বেশি, যদিও প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

শিশুশ্রমে ঠেলে দেওয়া জীবন
দশ বছরের মোহাম্মদ আরফান এখন স্কুলের বদলে রাস্তায় নাস্তা বিক্রি করে দিন কাটায়। তেরো বছরের রহমত উল্লাহ নর্দমা থেকে প্লাস্টিক কুড়িয়ে সামান্য আয়ের চেষ্টা করছে, যাতে কোনোভাবে পড়াশোনা চালাতে পারে। দুজনেই পড়াশোনা করে ভালো ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখে, কিন্তু সহায়তা কমে যাওয়ার বাস্তবতা তাদের সেই স্বপ্নকে প্রতিদিন দূরে ঠেলে দিচ্ছে।

ভবিষ্যৎ আরও অনিশ্চিত
সহায়তা সংস্থাগুলো আশঙ্কা করছে, আগামী বছরে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে। অনেক সংস্থা তাদের প্রয়োজনীয় তহবিলের মাত্র অল্প অংশই নিশ্চিত করতে পেরেছে। এর ফলে হাজার হাজার শিশু আবারও শিক্ষা থেকে ছিটকে পড়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। কিছু শেখার কেন্দ্র সীমিত আকারে চালু করা হলেও অধিকাংশ স্কুল এখনো বন্ধই রয়ে গেছে।

ক্ষুধা, অসুস্থতা আর পাচারের ফাঁদ
সহায়তা কমে যাওয়ায় শিবিরে খাদ্য সংকট, স্বাস্থ্যঝুঁকি ও অনিরাপদ পরিবেশ আরও তীব্র হয়েছে। বেঁচে থাকার তাগিদে অনেক পরিবার সন্তানদের বিপজ্জনক পথে বিদেশে পাঠাতে বাধ্য হচ্ছে, যেখানে পাচারকারীরা তাদের সহজ শিকার বানাচ্ছে। এক ঘটনায়, এক বাবার তেরো বছরের ছেলেকে পাচারকারীরা মালয়েশিয়ায় নিয়ে যায়, পরে মুক্তিপণের টাকা জোগাড় করতে পরিবারকে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়।

হারিয়ে যাওয়া শৈশবের আর্তনাদ
সহায়তা কমে যাওয়ার এই সিদ্ধান্ত শুধু তহবিলের হিসাব নয়, অসংখ্য রোহিঙ্গা শিশুর জীবন ও ভবিষ্যৎ ধ্বংস করে দিয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। যে স্কুলগুলো একসময় শিশুদের সুরক্ষার ঢাল ছিল, সেগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তারা এখন শিশুশ্রম, পাচার ও জোরপূর্বক বিয়ের অন্ধকার বাস্তবতায় আটকে পড়েছে। শিক্ষা ও নিরাপত্তায় ফেরার আশা দিন দিন ক্ষীণ হয়ে আসছে।

জনপ্রিয় সংবাদ

প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারে হামলা মতপ্রকাশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে আঘাত: মাইকেল মিলার

বিদেশি সহায়তা কমায় বিপর্যস্ত রোহিঙ্গা শিশুদের জীবন: পাচার, নির্যাতন আর বাল্যবিবাহের ফাঁদে হারিয়ে যাচ্ছে শৈশব

০৬:৫৪:১৭ অপরাহ্ন, রবিবার, ২১ ডিসেম্বর ২০২৫

বাংলাদেশের কক্সবাজারে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা প্রায় বারো লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীর মধ্যে শিশুদের জীবন সবচেয়ে বড় আঘাত পেয়েছে বিদেশি সহায়তা হঠাৎ কমে যাওয়ায়। চলতি বছরে যুক্তরাষ্ট্রসহ কয়েকটি দেশের সহায়তা কমানোর ফলে শিশু সুরক্ষা, শিক্ষা ও কিশোর উন্নয়ন কর্মসূচি প্রায় ভেঙে পড়েছে। এর সরাসরি প্রভাব পড়েছে শরণার্থী শিবিরের স্কুল ও প্রশিক্ষণকেন্দ্রগুলোর ওপর, যার ফলে হাজার হাজার শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে।

শিক্ষা বন্ধ, বাড়ছে ঝুঁকি
সহায়তা কমে যাওয়ায় অসংখ্য অস্থায়ী স্কুল ও শেখার কেন্দ্র বন্ধ হয়ে পড়েছে। এর ফলে শিশুরা পড়াশোনার পাশাপাশি নিরাপদ পরিবেশ থেকেও বঞ্চিত হয়েছে। শিক্ষা ও সুরক্ষার এই শূন্যতা তাদেরকে মানবপাচার, শিশুশ্রম, বাল্যবিবাহ ও যৌন নির্যাতনের মতো ভয়াবহ ঝুঁকির দিকে ঠেলে দিচ্ছে। কাজ বা পড়াশোনার সুযোগ না থাকায় অনেক শিশু সহজেই পাচারকারীদের ফাঁদে পড়ছে।

এক কিশোরীর হারানো স্বপ্ন
সতেরো বছরের হাসিনা মনে করেন, স্কুলই ছিল তার একমাত্র আশ্রয়, যা তাকে জোরপূর্বক বিয়ে ও নির্যাতন থেকে রক্ষা করত। কিন্তু জুন মাসে তার স্কুলের তহবিল বন্ধ হয়ে গেলে পড়াশোনা থেমে যায়। এরপর তাকে বিয়ে দেওয়া হয়। বিয়ের পর স্বামীর শারীরিক ও যৌন নির্যাতনে তার শৈশব আর শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। হাসিনার ভাষায়, স্কুল বন্ধ না হলে তাকে এমন জীবনে আটকে পড়তে হতো না।

শিশু নির্যাতন ও অপরাধ বেড়েই চলেছে
শিশু সুরক্ষা সংস্থাগুলোর তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরে শিবিরগুলোতে শিশু নির্যাতন ও শোষণের ঘটনা ভয়াবহভাবে বেড়েছে। অপহরণ ও জোর করে তুলে নেওয়ার ঘটনা আগের বছরের তুলনায় চার গুণ বেড়ে পাঁচ শতাধিক ছাড়িয়েছে। সশস্ত্র গোষ্ঠীর সঙ্গে জড়িত হওয়া বা ব্যবহার হওয়া শিশুর সংখ্যাও উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। বাল্যবিবাহ ও শিশুশ্রমের ঘটনাও আগের বছরের তুলনায় অনেক বেশি, যদিও প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

শিশুশ্রমে ঠেলে দেওয়া জীবন
দশ বছরের মোহাম্মদ আরফান এখন স্কুলের বদলে রাস্তায় নাস্তা বিক্রি করে দিন কাটায়। তেরো বছরের রহমত উল্লাহ নর্দমা থেকে প্লাস্টিক কুড়িয়ে সামান্য আয়ের চেষ্টা করছে, যাতে কোনোভাবে পড়াশোনা চালাতে পারে। দুজনেই পড়াশোনা করে ভালো ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখে, কিন্তু সহায়তা কমে যাওয়ার বাস্তবতা তাদের সেই স্বপ্নকে প্রতিদিন দূরে ঠেলে দিচ্ছে।

ভবিষ্যৎ আরও অনিশ্চিত
সহায়তা সংস্থাগুলো আশঙ্কা করছে, আগামী বছরে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে। অনেক সংস্থা তাদের প্রয়োজনীয় তহবিলের মাত্র অল্প অংশই নিশ্চিত করতে পেরেছে। এর ফলে হাজার হাজার শিশু আবারও শিক্ষা থেকে ছিটকে পড়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। কিছু শেখার কেন্দ্র সীমিত আকারে চালু করা হলেও অধিকাংশ স্কুল এখনো বন্ধই রয়ে গেছে।

ক্ষুধা, অসুস্থতা আর পাচারের ফাঁদ
সহায়তা কমে যাওয়ায় শিবিরে খাদ্য সংকট, স্বাস্থ্যঝুঁকি ও অনিরাপদ পরিবেশ আরও তীব্র হয়েছে। বেঁচে থাকার তাগিদে অনেক পরিবার সন্তানদের বিপজ্জনক পথে বিদেশে পাঠাতে বাধ্য হচ্ছে, যেখানে পাচারকারীরা তাদের সহজ শিকার বানাচ্ছে। এক ঘটনায়, এক বাবার তেরো বছরের ছেলেকে পাচারকারীরা মালয়েশিয়ায় নিয়ে যায়, পরে মুক্তিপণের টাকা জোগাড় করতে পরিবারকে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়।

হারিয়ে যাওয়া শৈশবের আর্তনাদ
সহায়তা কমে যাওয়ার এই সিদ্ধান্ত শুধু তহবিলের হিসাব নয়, অসংখ্য রোহিঙ্গা শিশুর জীবন ও ভবিষ্যৎ ধ্বংস করে দিয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। যে স্কুলগুলো একসময় শিশুদের সুরক্ষার ঢাল ছিল, সেগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তারা এখন শিশুশ্রম, পাচার ও জোরপূর্বক বিয়ের অন্ধকার বাস্তবতায় আটকে পড়েছে। শিক্ষা ও নিরাপত্তায় ফেরার আশা দিন দিন ক্ষীণ হয়ে আসছে।