ওয়াশিংটনে নতুন রাষ্ট্রপতির শপথের দিনটি বরাবরই ক্ষমতা ও ঐতিহ্যের প্রদর্শনী। তবে চলতি দশকের সেই দিনে মঞ্চের আড়ালে ঘটে যায় আরেক বিপ্লব। অচেনা এক চীনা প্রতিষ্ঠানের নতুন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মডেল বিশ্ববাজারে আলোড়ন তোলে। ঠিক পরদিনই যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ প্রযুক্তি নেতারা শত শত বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ ঘোষণা করেন। এই দুই দিনই যেন ইঙ্গিত দিয়েছিল সামনে কী আসছে। বিশ্বজুড়ে প্রতিযোগিতা, নজিরবিহীন উদ্ভাবন, বিপুল অর্থের ঢল এবং রাষ্ট্র ও বেসরকারি শক্তির এক নতুন সমীকরণ।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার উত্থানের বছর
এই বছরেই স্পষ্ট হয়ে যায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার পূর্ণ সম্ভাবনা। চিকিৎসা গবেষণা থেকে উৎপাদনশীলতা, অসম্ভব মনে হওয়া কাজগুলো বাস্তব হতে শুরু করে। খবরের কাগজ, টেলিভিশন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম—সবখানেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অগ্রগতির গল্প। ব্যবসায়ী, শিক্ষক, অভিভাবক—কারও পক্ষেই এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না। কয়েক সপ্তাহের ব্যবধানে জানা যায়, এই প্রযুক্তি তিমির সঙ্গে যোগাযোগে সহায়তা করতে পারে, বহু বছরের অমীমাংসিত গণিত সমস্যার সমাধান দিতে পারে এবং ঘূর্ণিঝড় পূর্বাভাসে পুরোনো মডেল কে ছাপিয়ে যাচ্ছে। অল্প সময়ে মানুষের ঘণ্টার কাজ এখন যন্ত্র করছে মুহূর্তে।
ক্ষমতা, আশঙ্কা আর বৈষম্যের প্রশ্ন
এই অগ্রগতির সঙ্গে এসেছে নতুন উদ্বেগ। বিপুল বিদ্যুৎ খরচ, চাকরি হারানোর শঙ্কা, ভুয়া তথ্যের বিস্তার এবং সাইবার ঝুঁকি বেড়েছে। কয়েকজন প্রযুক্তি নেতার হাতে ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন অনেককে মনে করিয়ে দিচ্ছে পুরনো স্বর্ণযুগের বৈষম্য। ইতিহাস বলছে, এমন সময়ে যেমন বড় অগ্রগতি আসে, তেমনি বাড়ে অসমতা।
নেতৃত্বের মুখগুলো
এই রূপান্তরের কেন্দ্রে আছেন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার স্থপতিরা। যাঁরা চিপ তৈরি করেছেন, মডেল গড়েছেন, অবকাঠামো দাঁড় করিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে অন্যতম এক চিপ নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের প্রধান, যাঁর নেতৃত্বে সংস্থাটি বিশ্ববাজারে সবচেয়ে মূল্যবান হয়ে উঠেছে। একসময়ের গেমের গ্রাফিক্স কার্ড নির্মাতা আজ বৈশ্বিক রাজনীতি ও অর্থনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে। রাষ্ট্রপ্রধানদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ, কূটনীতি ও প্রযুক্তির মেলবন্ধনে তাঁর ভূমিকা নতুন মাত্রা পেয়েছে।

চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিযোগিতা
এই বছর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা হয়ে ওঠে বৈশ্বিক শক্তি প্রতিযোগিতার প্রধান অস্ত্র। চীনের নতুন মডেল প্রমাণ করে দেয়, ব্যবধান দ্রুত ঘুচছে। যুক্তরাষ্ট্র দ্রুত নীতি বদলে বিশাল তথ্যকেন্দ্র, চিপ কারখানা ও গবেষণায় বিনিয়োগ বাড়ায়। একই সঙ্গে নিয়ন্ত্রণ শিথিল করে গতি বাড়ানোর বার্তা দেয়। অন্যদিকে চীন নিজস্ব প্রযুক্তি ও উৎপাদন সক্ষমতার ওপর জোর দিয়ে এগোয়।
অর্থনীতি ও কর্মসংস্থানের দ্বন্দ্ব
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা একদিকে উৎপাদনশীলতা বাড়াচ্ছে, অন্যদিকে বহু চাকরি বিলুপ্তির আশঙ্কা তৈরি করছে। কিছু শিল্পে কাজ কমলেও নতুন ধরনের কাজের সম্ভাবনার কথাও শোনা যাচ্ছে। কেউ বলছেন, যন্ত্র মানুষের কাজ কেড়ে নেবে। আবার কেউ বলছেন, যন্ত্র মানুষকে আরও দক্ষ করে তুলবে। সত্যটা হয়তো এই দুইয়ের মাঝামাঝি।
ব্যক্তিগত জীবনেও প্রভাব
এই প্রযুক্তি শুধু করপোরেট দুনিয়ায় নয়, ব্যক্তিগত জীবনেও ঢুকে পড়েছে। ছোট ব্যবসা থেকে শুরু করে শিক্ষার্থী, শিল্পী, একাকী মানুষ—অনেকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে সহায়ক, সঙ্গী কিংবা সৃজনশীলতার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছেন। তবে মানসিক স্বাস্থ্যের ঝুঁকি, অতিনির্ভরতার মতো বিষয়ও সামনে এসেছে।
কেন বছরের মানুষ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার স্থপতিরা
এই সব কারণেই চলতি বছরটি চিহ্নিত হয়েছে চিন্তাশীল যন্ত্রের যুগের সূচনা হিসেবে। যারা এই প্রযুক্তি কল্পনা করেছে, নির্মাণ করেছে এবং বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে দিয়েছে, তারাই বছরের সবচেয়ে প্রভাবশালী শক্তি। মানবজাতি এখন এমন এক ভবিষ্যতের দিকে এগোচ্ছে, যেখানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এড়ানোর নয়, বরং বোঝার ও দায়িত্বের সঙ্গে ব্যবহারের বিষয়।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















