শীতের এক গাঢ় বিকেলে বার্লিনের ঐতিহাসিক গির্জার ভেতর অর্গানের সামনে বসে শব্দের পরীক্ষা চালাচ্ছিলেন এলেন আরকব্রো। এক হাতে কর্ড চেপে ধরে অন্য হাতে বোতাম ঘোরাতে ঘোরাতে তিনি খুঁজছিলেন নিজের কল্পনায় থাকা এক বিশেষ ধ্বনি। কখনো রুপোলি ফ্লুটের ইঙ্গিত, কখনো গভীর স্ট্রিংয়ের কম্পন, আবার কখনো তীব্র রিডের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছিল বিশাল গম্বুজ জুড়ে। শেষমেশ যে শব্দটি তিনি পেলেন, তা একসঙ্গে বিষণ্ন, ব্লুজের আবেশময়, আবার অচেনা এক পবিত্রতায় ভরা।
অর্গানের সামনে দাঁড়িয়ে নতুন পথ
নিজেকে পুরোপুরি অর্গানবাদক বলে মানতে চান না এলেন আরকব্রো। হাসতে হাসতে তিনি বলেন, তিনি যেন পথ চলতে চলতেই সব বানিয়ে নিচ্ছেন। তবু সমকালীন সংগীতের জগতে অর্গানের জন্য কাজ করা সৃষ্টিশীল সুরকারদের মধ্যে তাঁকে আলাদা করে চিহ্নিত করছেন সমালোচকেরা। তাঁর সাম্প্রতিক কাজ নাইটক্লাউডস সহজ কোনো কাঠামোয় ধরা দেয় না। এখানে নেই স্পষ্ট সুর বা তাল। আছে ধীরে বদলে যাওয়া ধ্বনির স্তর, যা কখনো ফরাসি সুরকার মেসিয়াঁর স্মৃতি জাগায়, কখনো মিনিমাল ধারার দীর্ঘ শ্বাসের অনুভব দেয়।

শব্দে থেমে থাকার অভিজ্ঞতা
এই সংগীত যেন শ্রোতাকে বসতে বাধ্য করে, মন দিয়ে শুনতে শেখায়। সংগীত লেখক জেনিফার লুসি অ্যালান বলছেন, এলেনের সুর আসলে জায়গা ধরে রাখে। এটি কেবল শোনার নয়, এক ধরনের ধ্যানের অভিজ্ঞতা। মেঘের মতো এই সংগীতের কোনো স্থায়ী আকৃতি নেই, কিন্তু ধীরে ধীরে তা শ্রোতার ভেতরে ছড়িয়ে পড়ে।
স্টকহোম থেকে বার্লিনের যাত্রা
১৯৯০ সালে সুইডেনের স্টকহোমে জন্ম এলেন আরকব্রোর। বাবার পাঙ্ক আর পোস্ট পাঙ্ক রেকর্ড, কিশোর বয়সে গিটার আর পিয়ানো, এমনকি বন্ধুদের সঙ্গে স্কেট পাঙ্ক ব্যান্ড—সব মিলিয়ে তাঁর সংগীতযাত্রা ছিল বহুমুখী। গানের স্কুলে পড়ার সময় তিনি মাইক্রোটোনাল স্বরের প্রতি আকৃষ্ট হন, যেখানে কণ্ঠ বা তারের যন্ত্রে অসীম সূক্ষ্ম স্বর তৈরি করা যায়। পরে ইলেকট্রনিক সংগীত স্টুডিওতে পড়াশোনা, পরীক্ষামূলক সুরকারদের সংস্পর্শ এবং নিউইয়র্কে দীর্ঘ সময় ধরে ধীর সংগীতের দর্শন তাঁর কাজকে নতুন দিশা দেয়।

ধীরতার ভেতর গভীরতা
২০১৭ সালে প্রকাশিত তাঁর প্রথম অ্যালবাম অর্গান ও ব্রাসের জন্য লেখা কাজ। ধীরে এগোনো কর্ডের ভেতর কখনো বিষাদ, কখনো উল্লাস, আবার কখনো অস্বস্তির অনুভূতি তৈরি হয়। মধ্যযুগীয় টিউনিংয়ের অর্গান একদিকে পুরোনো সময়ের গন্ধ দেয়, আবার অন্যদিকে ভবিষ্যতের শব্দের মতো শোনায়। পরবর্তী কাজগুলোয় তিনি গিটার, সিনথেসাইজার আর নানা প্রাচীন যন্ত্রকে একসঙ্গে এনে শব্দের নতুন মানচিত্র আঁকছেন।
নিউইয়র্কে সোনিক প্রতিচ্ছবি
নিউইয়র্কে তাঁর সাম্প্রতিক আবাসিক আয়োজনকে তিনি স্মরণোৎসব বলতে চাননি। বয়স মাত্র পঁয়ত্রিশ, তাই নাম দেওয়া হয়েছে সোনিক প্রতিচ্ছবি। এখানে একক কাজের পাশাপাশি সহযোগিতামূলক প্রকল্পও রয়েছে। এলেনের মতে, এত কাজের ভিড়ে এই সময়টা তাঁর নিজের জন্যও থেমে শোনার সুযোগ। মাঝে মাঝে তিনি নিজেকেই প্রশ্ন করেন, এই জীবনে তিনি কী তৈরি করেছেন। আর তখনই হঠাৎ কিছু ঝলক আসে, যা তাঁকে আবার এগিয়ে যেতে অনুপ্রাণিত করে।


সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















