পাকিস্তানের রাজনীতিতে আবারও সেনাবাহিনীর প্রভাব বিস্তারের দৃশ্য স্পষ্ট হয়ে উঠছে। সাম্প্রতিক আইনগত পরিবর্তন ও নতুন একটি শীর্ষ পদ সৃষ্টির মধ্য দিয়ে দেশটির সেনাপ্রধান জেনারেল আসিম মুনির এমন ক্ষমতার কেন্দ্রে পৌঁছেছেন, যা গত দেড় দশকে দেখা যায়নি। বিশ্লেষকদের মতে, এই পরিবর্তন পাকিস্তানের বেসামরিক ও সামরিক সম্পর্কের দীর্ঘদিনের ভারসাম্যকে নতুন প্রশ্নের মুখে ফেলেছে।
নতুন পদে ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ
চলতি মাসে জেনারেল আসিম মুনিরকে দেশের সব প্রতিরক্ষা বাহিনীর প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এটি একটি নতুন সৃষ্ট পদ, যা তাঁকে সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর ওপর সর্বোচ্চ কর্তৃত্ব দেয়। সামরিক শাসক পারভেজ মোশাররফের বিদায়ের পর এই মাত্রার ক্ষমতা আর কোনো সেনা কর্মকর্তার হাতে কেন্দ্রীভূত হয়নি বলে মনে করছেন সমালোচকেরা। একই সঙ্গে আজীবন আইনি সুরক্ষা পাওয়ায় তাঁর ওপর অসামরিক সরকারের নজরদারি কার্যত সীমিত হয়ে পড়েছে।

দুর্বল বিরোধিতা ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট
এই ক্ষমতা বৃদ্ধির সময়টাতে পাকিস্তানের প্রধান বিরোধী দল কঠিন অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের দল সাম্প্রতিক উপনির্বাচনে ধাক্কা খেয়েছে এবং সংসদের গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান থেকেও সরে যেতে হয়েছে। ইমরান খান নিজে ২০২৩ সাল থেকে কারাগারে, তাঁর স্ত্রী বুশরা বিবিও বন্দি। নতুন একটি মামলায় তাঁদের দীর্ঘ কারাদণ্ড ঘোষিত হলেও তাঁরা সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। দলের ঘনিষ্ঠ অনেক নেতা গ্রেপ্তার বা রাজনীতি থেকে কার্যত বিচ্ছিন্ন।
বিশ্লেষকদের সতর্কবার্তা
পাকিস্তানে সেনাবাহিনী বরাবরই রাজনীতির শেষ বিচারক হিসেবে বিবেচিত। তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, জেনারেল মুনিরের ক্ষমতা বিস্তার সেই অদৃশ্য সীমা ছাড়িয়ে যেতে পারে, যা এতদিন সামরিক ও বেসামরিক নেতৃত্ব কে পাশাপাশি টিকিয়ে রেখেছিল। রাজনৈতিক মেরুকরণ বাড়ছে এবং নিরাপত্তা কাঠামোর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন জোরালো হচ্ছে। সমঝোতার প্রয়োজনীয়তা এখন আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি বলে মত অনেকের।

জাতীয়তাবাদ ও জনমতের পরিবর্তন
ইমরান খানের গ্রেপ্তারের পর একসময় সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ক্ষোভ ও বিক্ষোভ দেখা গেলেও সাম্প্রতিক মাসগুলোতে পরিস্থিতি বদলেছে। ভারতের সঙ্গে সীমিত সামরিক সংঘাতের পর দেশজুড়ে জাতীয়তাবাদী আবেগ বেড়েছে, যা সেনাবাহিনীর ভাবমূর্তি কিছুটা শক্ত করেছে। এই আবহেই জেনারেল মুনিরের পদোন্নতি ও আনুষ্ঠানিক সম্মান তুলনামূলক কম সমালোচনার মুখে পড়ে।
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা
আন্তর্জাতিক পরিসরে পরিবর্তনের ইঙ্গিত মিলছে। জেনারেল মুনিরের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ব্যক্তিগত যোগাযোগ তৈরি হয়েছে বলে জানা যায়। হোয়াইট হাউসে তাঁদের বৈঠক ছিল ব্যতিক্রমী ঘটনা। এর ফলে পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক পশ্চাদপসরণ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভাব্য চাপ কমতে পারে বলে ধারণা করছেন কূটনৈতিক মহলের একাংশ।
ভিতরের চাপ ও ভবিষ্যৎ ঝুঁকি

তবে ইসলামাবাদের ভেতরে অনেকেই মনে করছেন, ক্ষমতার এই বিস্তার ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সেনাবাহিনী জনসমর্থন হারানোর অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে, যা দেশটির ইতিহাসে বিরল। আবারও অতিরিক্ত প্রভাব বিস্তার সেই ক্ষোভকে উসকে দিতে পারে। সেনাবাহিনী প্রকাশ্যে নিজেদের অরাজনৈতিক বলেই দাবি করছে এবং বলছে, এই সংস্কার কেবল সমন্বয় ও কার্যকারিতা বাড়ানোর জন্য।
প্রদেশ ও জন আন্দোলনের বাস্তবতা
এদিকে ইমরান খানের মুক্তির দাবিতে বিক্ষোভ থামেনি। বিশেষ করে খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও নিরাপত্তা সংকট একসঙ্গে চাপ তৈরি করছে। সেখানে জরুরি অবস্থা জারির আলোচনা জনমনে আরও ক্ষোভের আশঙ্কা তৈরি করেছে। আঞ্চলিক নেতারা স্পষ্ট করে জানিয়েছেন, এমন পদক্ষেপ নিলে প্রতিক্রিয়া হবে তীব্র।
এই প্রেক্ষাপটে পাকিস্তান দাঁড়িয়ে আছে এক সন্ধিক্ষণে। সেনাবাহিনীর শক্ত অবস্থান স্বল্পমেয়াদে স্থিতিশীলতা আনতে পারে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে অসামরিক রাজনীতির জায়গা সংকুচিত হলে নতুন অস্থিরতার বীজ বপন হতে পারে বলেই আশঙ্কা বিশ্লেষকদের।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















