ক্যারিবীয় সাগরের নীল জল কেটে এগিয়ে চলে এক ভাসমান শহর। বাইরে চোখে পড়ে বিশাল জলপার্ক, সুইমিং পুল আর বরফের রিঙ্ক। কিন্তু এই ঝলমলে বিনোদনের আড়ালে প্রতিদিন চলে এক নিরবচ্ছিন্ন লড়াই। সেটি খাবারের লড়াই। বিশ্বের সবচেয়ে বড় প্রমোদতরী স্টার অব দ্য সিজে প্রতিদিন প্রায় এক লাখ খাবার তৈরি, পরিবেশন আর পরিষ্কারের দায়িত্ব সামলায় এক বিশাল রান্নাঘর। এই অসম্ভব দায়িত্বের নেতৃত্বে আছেন প্রধান রাঁধুনি গ্যারি থমাস।
রান্নাঘরের ভেতরের চাপা উত্তেজনা
দিনের বেলায় রেস্তোরাঁগুলো অনেকটাই ফাঁকা থাকে। কিন্তু সন্ধ্যা নামতেই পরিস্থিতি বদলে যায়। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই হাজার হাজার যাত্রী একসঙ্গে খেতে বসেন। শুধু একটি জায়গায় নয়, পুরো জাহাজজুড়ে ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য খাবারের স্থানে একযোগে শুরু হয় ব্যস্ততা। কয়েক শ রাঁধুনি আর হাজারের বেশি পরিবেশনকর্মী মিলেই এই বিশাল কর্মযজ্ঞ সামলান। ঢেউয়ের দোলের মধ্যেই চলে মাছ পরিষ্কার, মাংস কাটানো, রুটি বানানো আর ডিম ভাজার কাজ। সবকিছুই তৈরি হয় জাহাজের ভেতরে।
ভাসমান শহরের বিশাল দায়িত্ব
স্টার অব দ্য সিজে একসঙ্গে সাত হাজারের বেশি যাত্রী আর দুই হাজারের বেশি কর্মী থাকতে পারেন। আকারে এটি যেন একেকটি স্থাপনার সমান। এই বিশাল কাঠামো সচল রাখতে প্রতিদিন প্রয়োজন হয় হাজার হাজার কেজি চাল, মাছ, মাংস, দুধ আর সবজি। রান্নাঘরের প্রতিটি ফ্রিজ আর গুদাম কঠোর নিয়মে পরিষ্কার রাখা হয়। সামান্য অসতর্কতা পুরো জাহাজে অসুস্থতা ছড়িয়ে দিতে পারে বলেই স্বাস্থ্যবিধি এখানে সবচেয়ে বড় শর্ত।

শৃঙ্খলাই সফলতার চাবিকাঠি
এই রান্নাঘর কোনো সাধারণ রান্নাঘর নয়। এখানে প্রতিটি কাজ ভাগ করা, প্রতিটি দায়িত্ব নির্দিষ্ট। কেউ শুধু মাছ কাটেন, কেউ মাংস প্রস্তুত করেন, কেউ আবার ডেজার্টের দায়িত্বে। এই শৃঙ্খলাবদ্ধ পদ্ধতির ভিত্তি বহু আগেই তৈরি হয়েছিল। সময়ের সঙ্গে প্রযুক্তির সহায়তায় সেই পদ্ধতিই এখন আরও নিখুঁত হয়েছে, যাতে একসঙ্গে এত মানুষের খাবার ঠিক সময়ে প্রস্তুত করা যায়।
অঙ্কে চলে খাবারের পরিকল্পনা
কতটা খাবার লাগবে, তার হিসাব আগেভাগেই করা হয়। যাত্রায় শিশু বেশি থাকলে আলুর ব্যবহার বাড়ে, ইউরোপীয় যাত্রী বেশি হলে সবজি আর পাস্তার চাহিদা বেড়ে যায়। এসব তথ্য বিশ্লেষণ করেই সপ্তাহখানেক আগে অর্ডার দেওয়া হয়। প্রতিদিন কোন খাবার কতটা রান্না হবে, তা ঠিক হয় আগের অভিজ্ঞতা আর তথ্য বিশ্লেষণের মাধ্যমে।
অপচয় কমানোর লড়াই
এত বড় পরিসরে খাবার পরিবেশন করলে কিছু অপচয় হয়ই। বুফেতে কেউ বেশি তুলে নিলে সব শেষ করা সম্ভব হয় না। স্বাস্থ্যবিধির কারণে নির্দিষ্ট সময়ের পর খাবার ফেলে দিতে হয়। সেই খাবার বিশেষ প্রক্রিয়ায় নষ্ট করা হয়, কিছু অংশ জ্বালানিতে রূপান্তরিত করা হয়। তবু লক্ষ্য থাকে যতটা সম্ভব অপচয় কমানো।
নীরব পরিশ্রমে সচল হৃদস্পন্দন
যাত্রীরা যখন সমুদ্রের দৃশ্য আর বিনোদনে মগ্ন থাকেন, তখন নিচের তলায় ভোর থেকেই কাজ শুরু হয়ে যায়। সূর্য ওঠার আগেই গুদাম খুলে যায়, খাবার ওঠানামা হয়, শুরু হয় নতুন দিনের প্রস্তুতি। এই নীরব পরিশ্রমেই সচল থাকে বিশ্বের সবচেয়ে বড় জাহাজের হৃদস্পন্দন।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















