মাহমুদুল হককে বাদ দিয়ে বাংলা উপন্যাসকে ভাবা ভুল হবে। বাংলাদেশে কেন মাহমুদুল হক বহু পঠিত নয় বা তাঁকে নিয়ে কম আলোচনা হয় এ সত্যিই এক প্রশ্ন।
মাহমুদুল হকের সাহিত্য নিসন্দেহে স্থান নিয়েছে চিরায়ত সাহিত্যের সারিতে।
তার উপন্যাস জীবন আমার বোন শুধু সময়ের চিত্র নয়, ইতিহাসকে গল্পের মধ্যে দিয়ে আনা নয় সেখানে রয়ে গেছে আরো অনেক কিছু।
তরুণ প্রজম্মের পাঠকের কাজে তাই তুলে দেয়া হলো মাহমুদুল হকের এই অনবদ্য উপন্যাস জীবন আমার বোন। আর আগের প্রজম্ম নিশ্চয়ই নতুন করে আরেকবার গ্রহন করুক এক অমৃত সাহিত্য। – সম্পাদক
মাহমুদুল হক
‘আমার নিজের কথা এখনো শেষ হয়নি, ভালো না লাগলে আজ থাক–‘
‘ভালো লাগছে, তুমি বলতে থাকো’ খোকা চেষ্টা করলো স্বাভাবিকভাবে উত্তর দেবার, কিন্তু প্রবল বিতৃষ্ণা তার কথাগুলোকে অগোচরে দুমড়ে দিলো।
‘যেদিন তুমি বললে, আমার জন্যে তোমার মন কাঁদে, না দেখে থাকতে পারো না, সেদিন দুলে উঠলো আমার ভিতরটা, সেকথা তো আগেই বলেছি। সত্যি বলছি, তোমার ওই স্বীকারোক্তিতে আমার মনের সব বাঁধন একেবারে আলগা হ’য়ে খসে পড়েছিলো। একটা স্রোত এসে ধাক্কা দিচ্ছিলো সেখানে।
মনে হচ্ছিলো সেই গোঁয়ার স্রোতের মুখে আমার ঘরবাড়ি বাগান সবকিছু হুড়মুড় ক’রে ভেঙে পড়বে, প্রাণপণে চেষ্টা ক’রেও নিজেকে সামাল দিতে পারবো না। কিন্তু কেন, কেন এমন হ’লো আমার? বিশ্বাস করবে, আজ থেকে সেই তেরো বছর আগে তোমার রাজীব ভাইও ওই একই কথা বলেছিলো আমাকে, এবং তার যে কি প্রতিক্রিয়া হয়েছিলো তা-তো বুঝতেই পারছো আমাকে এই সংসারে দেখে!’
‘একেই বলে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি-‘ ‘একই কথায় যখন তেরো বছর বাদে ঠিক একই প্রতিক্রিয়া হ’লো আমার, তখন বুঝলাম আমি মোটেই ওর পিছনে প’ড়ে নেই। সংসার কেন, কোনো কিছুই আমাকে ছোবল দিতে পারেনি। নিজেকে নতুন ক’রে আবার আবিষ্কার করলাম। একটা সোনার প্রদীপ হাত ফস্কে প’ড়ে গিয়েছিলো দীঘির গভীরে, তুমি আমার সেই রাজকুমার ব্যাঙ, তুলে দিয়েছো তুমি; এখন আর শুধু শুধু ঘর অন্ধকার ক’রে ব’সে থাকা কেন?’
‘শেষ পর্যন্ত ব্যাঙ বানিয়ে তবে ছাড়লে, একেই বলে সামরিক শাসনের কুফল! তা থামলে কেন? আরো কিছু?’
‘আজ এই পর্যন্তই-‘
‘অর্থাৎ খেল খতম, পয়সা হজম, এই গানের বই গানের বই গানের ‘কিছুটা আছে আরো। এতক্ষণ যা যা বললাম এর সবই তোমার রাজীব ভাইয়ের জানা। ও সবই বোঝে, সবই আন্দাজ করতে পারে। আর পারবে না-ই-বা কেন, আজ তেরো বছর এক সঙ্গে ঘর করলাম, হাবাকালা তো আর নয়। তোমার কথা শুনে কি বলেছে জানো? বলেছে, খোকার ভিতরে নিজের অগোচরে আমার অতীতকে খুঁজে বেড়াচ্ছো তুমি, ওটা আর কিছু নয়, আজীবন আমাকে ভালবেসে যাবার একটা পাগলামি তোমার; শুনে আমি হেসেছি।’
‘হাসবেই তো, অমন হাসির কথায় না হেসে পারা যায়।’
‘চটেছো মনে হচ্ছে?’
‘ছেড়ে দেওয়া গরু যখন পরের ক্ষেতে ধান খাচ্ছে, তখন ক্ষেত- টাকে পৈতৃক সম্পত্তি ধ’রে নিতে পারলে আপদ চুকে যায়। এতো বকতেও পারো। প্রার্থনা করি নাকের জলে চোখের জলে এক হয়ে ফ্যাঁৎ ফোঁৎ ক’রে এতক্ষণ যত কথা বললে তার বিন্দু-বিসর্গও যেন আমার বিশ্বাস হয়। মুখ ব্যথা করে না তোমার, এত কপচাও কি ক’রে? আজ আর আমার ধৈর্য নেই, আমি উঠবো-‘ ‘অত তড়িঘড়ি করার কি আছে, চা খেয়ে তবে উঠবে।’ ‘গুলি মারো! চুলোয় যাক তোমার চা! আমার মাথা দপদপ করছে।