স্বদেশ রায়
মেজর জেনারেল আব্দুর রশিদের সঙ্গে পরিচয় তার অবসরকালে এসে। বিশেষ করে তিনি যখন মিডিয়ায় আসতে শুরু করলেন তখন থেকে। ঘনিষ্টতা হয় টক শো ও লেখালেখির মাধ্যমে।
কিন্তু ঘনিষ্টতা দ্রুতই খুবই গাঢ় হয়। পরে এই সম্পর্ক বাড়তে থাকে মূলত টেলিফোনে আলাপের মাধ্যমে। নানান সময়ে নানা বিষয় নিয়ে তার সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনা হতো টেলিফোনে।
ভদ্রলোকের সব থেকে বড় গুন ছিলো, যা সাধারণত বাঙালির ভেতর খুব দেখা যায় না, ভিন্নমতকে অতি সহজে সম্মান করতেন। এবং নিজের মতটা খুবই বিনয়ের সঙ্গে জানাতেন।
যেমন কওমী মাদ্রাসার ডিগ্রী নিয়ে সিদ্ধান্ত হলে, আমি মনে করেছিলাম সিদ্ধান্তটি সঠিক। কারণ, এই একটি বিশাল তরুণ গোষ্টি আমাদের সমাজে সৃষ্টি হয়েছে, এদেরকে মূল ধারায় না আনলে এরা বিপথে যাবে। আমি আমার সেই চিন্তাকে নির্ভর করে একটা লেখা লিখেছিলাম।
লেখাটা বৃহস্পতিবার প্রকাশিত হলে তিনি আমাকে শুক্রবার বিকেলে ফোন করেন। এবং অনেক দূর থেকে তিনি বলতে চাইলেন, তাহলো আমার কাছ থেকে তিনি এ ধরনের লেখা আশা করেননি।
আমি তার কাছে জানতে চাই, যদি এরা মূল ধারায় না আসে- সমাজ তো আরো বিভক্ত হয়ে যাবে।
সে সময়ে তিনি যা বলেন, তার সবটুকু লেখার পরিবশে এখনও হয়নি। তবে তার মূল কথাটি ছিলো, আসলে প্রগতির বীজ থেকে ছাড়া প্রগতিশীল সমাজ তৈরি করা যায় না।
তিনি যদিও স্পষ্ট করে বলেননি, তবে তার কথার ভেতরে থাকা অপ্রকাশিত কথায় স্পষ্ট হয়েছিলো, হয়তো এ লেখাটা না লিখলেই আমি ভালো করতাম। কারণ, লেখাটা ভিন্ন বার্তা দেবে।
মেজর জেনারেল রশিদের সঙ্গে শেষ দেখা হয় ২০২৪ এর নির্বাচনের কিছু আগে ফরেন একাডেমীতে একটা অনুষ্ঠানে। সেখানে সেদিন অনেক বক্তা এতই উত্তেজিত ছিলেন যে পারলে আমেরিকা নামক দেশ বা মহাদেশটিকে ভূমন্ডল থেকে উপড়ে ফেলে দেন।
কিন্তু এর বিপরীতে সেখানে সাবেক রাষ্ট্রদূত তারিক করিম, সাবেক রাষ্ট্রদূত ও সচিব মোহাম্মদ আব্দুল হান্নান, মেজর জেনারেল আব্দুর রশিদ সহ অনেকের বক্তব্য ছিলো গঠনমূলক ও বাস্তবতার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। চিন্তার দিক থেকে তাদের চিন্তার সঙ্গে আমার চিন্তার যোগসূত্র কাছাকাছি- তাই সংক্ষিপ্ত যা দু লাইন বলেছিলাম তা মূলত তাদের স্বরের সঙ্গে একই স্বর ছিলো।
আলোচনা অনুষ্ঠান শেষে বাইরে এসে হঠাৎ মেজর রশিদভাই আমার হাত ধরে এক পাশে নিয়ে গেলেন। তারপরে বললেন, এগুলোর অর্থ কি? কিছু কিছু গোলটেবিলও দেখি একই কাজ করছে।
সেখানে মৃদু হাসি দেয়া ছাড়া আর কি বা উত্তর থাকে।
তারপরে দুজনের মধ্যে যে আলোচনা হয় তার সারমর্ম ছিলো, আসলে যারা উত্তেজিত, তারা কেন যে বুঝতে পারছে না, এই উপমহাদেশে বিশেষ করে ভারত মহাসাগর, বঙ্গোপসাগর নিয়ে আমেরিকা ও ভারতের সম্পর্কটি সিকিউরিটি ঘিরে। এ এলাকার বিষয়টি তো পেন্টাগনের আর সিকিউরিটি কাউন্সিলের। অতএব বাংলাদেশের নির্বাচন ঘিরে ভারত ও আমেরিকার সম্পর্কের মধ্যে দিয়েই শেষ সিদ্ধান্তটি আসবে।
এর পরে তিনি ভিন্ন একটি বিষয়ে কথা বলেন, তিনি জানতে চান, যাদের বিরুদ্ধে এতদিন কথা বলেছি, যাদের বিরুদ্ধে রাজপথে যুদ্ধ করেছি, আজ তারা আমাদের সামনে কেন? এখানেও মৃদু হাসি ছাড়া উত্তর ছিলো না।
এর পরে যেদিন ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ দূতাবাসে আমাদের প্রধানমন্ত্রী ও জ্যাক সুলেভানের মিটিং হয় সেদিন তিনিই আমাকে ফোন করেন। এবং সেদিনের আমাদের গল্পের কথা বলেন।পাশাপাশি সেদিন যারা খুব উত্তেজিত ছিলেন তাদের নিয়ে বেশ উচ্চ স্বরে হেসে ওঠেন।
জীবন- জীবিকার তাড়নায় কাজের চাপে ব্যস্ত থাকায় বা্স্তবে জানতাম না গত দুই মাস হলো তিনি অসুস্থ। যা ভেবে সত্যি নিজেকে অপরাধী লাগছে। মাত্র দুই সপ্তাহ হলো The Present world এর একটি জিও পলিটিকালও সিকিউরিটি ইস্যু বের করবো বলে তাকে লেখার জন্যে একটা অফার লেটার পাঠাই। সাধারণত এসব ক্ষেত্রে সব সময়ই তার কাছ থেকে দ্রুত উত্তর পাই। অথচ চিঠি পাঠানোর পনের দিনের মধ্যেও তার কাছ থেকে কোন সাড়া পায়নি। মনে করেছিলাম দেশে ফিরে তাকে ফোন করবো এবং গল্ফ ক্লাবে গিয়ে দেখা করবো। এর ভেতর দেশে ফেরার আগেই গত রাতে তার মৃত্যু সংবাদ পেয়ে আর কেন যেন ঘুমাতে পারেনি। কারণ, এমন কোন বয়স তার হয়নি।
তার এই সত্তরে চলে যাওয়া থেকে একটি বিষয় হয়তো ভাবার সময় এসেছে, বায়ু দুষণের পাশাপাশি সমাজে যে চিন্তার দূষণ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে এটাকে দ্রুত দূর না করতে পারলে এমনি অনেক চিন্তাশীল মেজর জেনারেল আব্দুর রশিদ অকালে চলে যাবেন। কারণ, ফরেন একাডেমির ওই চত্তরে সেদিন তিনি অনেক কথা বলেছিলেন। যা এখন প্রকাশ সম্ভব নয়। তবে কোনটাতে তার কোন স্বার্থ ছিলো না। স্বার্থটি দেশের।আর যে জন্য তাকে বেশ হতাশও মনে হয়েছিলো। বাস্তবে এ ধরনের হতাশাগুলো মানুষকে কুরে কুরে শেষ করে দেয়।
লেখক: জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত সাংবাদিক, সম্পাদক সারাক্ষণ ও The Present World.