সারাক্ষন ডেস্ক
প্রাচীন মায়ান শহর চিচেন ইতজা, যা দীর্ঘদিন ধরে মানব বলিদানের স্থান হিসাবে পরিচিত। বিশ্বের লাখ লাখ দর্শনার্থী এই স্থান দেখে মুগ্ধ হয়। কিন্তু নতুন গবেষণায় প্রকাশিত হয়েছে দক্ষিণ-পূর্ব মেক্সিকোর এই অবস্থানে বেশ কিছু যুবকও বালককে সমাহিত করা হয়েছিল। তাদের কিছু আত্মীয় এখনও বেঁচে আছে।
গবেষকরা চিচেন ইতজার পবিত্র সেনোটের নিকটস্থ একটি বৃহৎ সমাধিস্থল থেকে পাওয়া কয়েক ডজন শিশুর জেনোম বিশ্লেষণ করেছেন। এই বিশাল সিংকহোলটি চিচেন ইতজার ধর্মীয় কেন্দ্রের একটি অংশ যেখানে অন্যান্য মানব বলিদানগুলি পূর্বে আবিষ্কৃত হয়েছিল। গবেষণায় দেখা গেছে যে সকল ব্যক্তি পুরুষ এবং তাদের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক লোক ঘনিষ্ঠ আত্মীয় ছিলো, যার মধ্যে দুটি জোড়া যমজ ভাইও ছিল। বিজ্ঞানীরা জানতে পেরেছেন প্রাচীন মায়ান মিথোলজিতে যমজদের একটা আলাদা গুরুত্বের ছিল।
বর্তমানের এই গবেষণার ফল মূলত সেখানকার প্রচলিত বিশ্বাসের বিপরীত। এখানে প্রচলিত আছে এই সাইটে মধ্যে প্রধানত যুবতী এবং বালিকাদের বলিদান করা হতো । নতুন গবেষণাপত্রের প্রধান লেখক রদ্রিগো বার্কেরা এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন যে এই আবিষ্কারটি “একটি যুগান্তকারী”। এটি মেক্সিকো, মেসোআমেরিকা বা মায়া সংস্কৃতির মধ্যে প্রথম পুরুষ শিশু সমাধিস্থলের উদাহরণ। বার্কেরা জার্মানির লেইপজিগের ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইন্সটিটিউট ফর ইভোলিউশনারি অ্যানথ্রোপলজির একজন পোস্টডক্টরাল গবেষক।
গত সপ্তাহে নেচার জার্নালে প্রকাশিত গবেষণাটি পবিত্র সেনোটের কাছাকাছি একটি সিস্টার্ন থেকে ১৯৬৭ সালের এপ্রিল থেকে জুনের মধ্যে একটি নতুন বিমানবন্দর রানওয়ে নির্মাণের সময় পুনরুদ্ধার করা ১০০ টিরও বেশি শিশুর অবশিষ্ট জিনোমের বিশ্লেষণ করেছেন গবেষকরা। গবেষকদের মতে, সিস্টার্ন বা চুলতুন জল, বৃষ্টি এবং শিশু বলিদানের সাথে দীর্ঘকাল ধরে যুক্ত ছিল, এবং ভূগর্ভস্থ কাঠামোগুলি আন্ডারওয়ার্ল্ডের প্রবেশপথ হিসাবে বিশ্বাস করা হতো। বিষয়টি নিশ্চিত করতে যে কোনও অবশিষ্ট জিনোমএকাধিকবার পরীক্ষা করা হয়নি, দলটি প্রতিটি খুলি থেকে একটি নির্দিষ্ট হাড় সংগ্রহ করেছে – কিন্তু যেহেতু এর বেশিভাগ অক্ষত ছিল না, তাই শুধুমাত্র ৬৪ টি পরীক্ষা করা হয়েছিল। গবেষকরা রেডিওকার্বন ডেটিং ব্যবহার করে নির্ধারণ করেন যে শিশুরা, যাদের অর্ধেক ৩ থেকে ৬ বছর বয়সী ছিল- এরা ৫০০ বছরেরও বেশি আগে মারা গিয়েছিল। তাদের মৃত্যুকাল ১২ শতকের মাঝামাঝি সময়। দুটি যমজ জোড়ার পাশাপাশি, দলটি দেখতে পেয়েছে যে পরীক্ষা করা অবশেষের এক চতুর্থাংশের সিস্টার্নে ঘনিষ্ঠ আত্মীয় ছিল, এটা ইঙ্গিত দেয় যে বলিদান করা শিশুদের ঘনিষ্ঠ জৈবিক আত্মীয়তার জন্য বিশেষভাবে নির্বাচিত করা হয়েছিল।
যেহেতু সমস্ত জিনোম পরীক্ষা করা যায়নি, তারপরেও গবেষকরা বলেন যে সাইটে পাওয়া শিশুদের মধ্যে রক্তের সম্পর্কের শিশুর সংখ্যা হয়তো আরো বেশি ছিল । তারা আরও আবিষ্কার করেছে যে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত শিশুরা একই ধরনের খাদ্য খেতো্ যা আরো প্রমান করে যে শিশুরা মারা যাওয়ার সময় একই বয়সী ছিল, এবং তারা একই অনুষ্ঠানে বলিদান করার জন্য নির্বাচিত হয়েছিল। গবেষকরা ঘনিষ্ঠ শিশু আত্মীয়দের বলিদান করার অনুশীলনকে একটি পবিত্র মায়ান পাঠ্যের সাথে যুক্ত করেছেন, পপোল ভুহ, যা একটি বলগেমে দেবতাদের কাছে পরাজিত হওয়ার পরে একটি যমজ জোড়ার বলিদানের বর্ণনা দেয়। পাঠ্য অনুসারে, ভাইদের একজনের যমজ পুত্র, হিরো টুইনস নামে পরিচিত, তাদের নিহত আত্মীয়দের প্রতিশোধ নিতে গিয়েছিল।
“২০ শতকের গোড়ার দিকের বিবরণগুলি মিথ্যাভাবে সাইটে যুবতী এবং মেয়েদের বলিদানের ভয়ঙ্কর কাহিনী উপস্থাপন করে সেই ধারনা জনপ্রিয় করেছিল বলে বলেন, গবেষণার সহ-লেখক এবং হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান অধ্যাপক ক্রিস্টিনা ওয়ারিনার। তার মতে এই গবেষণাটি, একটি ঘনিষ্ঠ আন্তর্জাতিক সহযোগিতা হিসাবে পরিচালিত হয়েছে, এবং অতীতের মিথকে উল্টে দিয়েছে এবং পবিত্র মায়া পাঠ্যে বর্ণিত মানব মৃত্যুর এবং পুনর্জন্মের চক্রের সাথে আনুষ্ঠানিক বলিদানের গভীর সংযোগছিলো সেটাও প্রকাশ করেছে।
প্রাচীন চিচেন ইতজা শহর, যা মায়ান যুগের বৃহত্তম পিরামিডগুলির মধ্যে একটি, প্রথমে খ্রিস্টাব্দ ৬০০ তেপ্রসিদ্ধি লাভ করেছিল। ইউনেস্কোর মতে, ১৫ শতকে সাইটটি ক্ষয়প্রাপ্ত হতে শুরু করে – কিন্তু গবেষকরা বলেন যে এটি ঔপনিবেশিক যুগ এবং তার পরেও মায়ান তীর্থযাত্রীদের জন্য একটি জনপ্রিয় স্থান ছিল। ১৯৮৮ সালে এটি ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে মনোনীত হয়।
বার্কেরা স্বীকার করেছেন যে সাইটে পাওয়া অবশেষ গুলি “শিশুদের এবং তাদের বলিদান করা হয়েছিল” বুঝতে পেরে অনেকেই হতবাক হতে পারে। “কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে যে মৃত্যুর ধারণা মেসো-আমেরিকান সংস্কৃতির জন্য সম্পূর্ণ ভিন্ন। … মৃত্যুকে একটি খারাপ বিষয় হিসাবে দেখা হয় না। অবশ্যই, আমাদের দৃষ্টিকোণ থেকে তাদের এ ধারনা ভুল। কিন্তু তখন, এবং তাদের মিথ এবং তাদের বিশ্বাস অনুসারে, তারা যা করছিল তা সঠিক বলে বিবেচিত হয়েছিল, তাই আমরা আমাদের আধুনিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করতে পারি না তারা কী করেছিল।” সমাধিস্থলের বয়স এবং বছরের পর বছর ধরে এর ব্যবহার দেখায় যে মায়ান আচারগুলি যে শুধুমাত্র দেবতাদের জিনিসগুলি নিবেদন করার জন্য ছিল না তার কারণ, তাদের বিশ্বাস ছিলো দেবতার অনুগ্রহ দরকারে বা কখনও দেবতার কাছে তাদেরকে ক্ষমা চাইতে হবে, । ইতজার প্রাচীন ইতিহাস উন্মোচন করার ভেতরই শুধু গবেষণাটি সীমাবদ্ধ ছিল না।
গবেষণায় প্রাচীন সাইট থেকে প্রায় ২৫ মাইল দূরে টিক্সক্যাকালটিউবের ৬৮ জন আধুনিক বাসিন্দার কাছ থেকে নেওয়া রক্তের নমুনার সাথে খুলিগুলির ডিএনএও তুলনা করা হয়েছে এবং আবিষ্কার করা হয়েছে যে তারা সিস্টার্নে পাওয়া শিশুদের সাথে সম্পর্কিত, এটি নির্দেশ করে যে সেখানে যে শিশুদের অবশেষ জিনোম পাওয়া গেছে তা প্রাচীন মায়ান সম্প্রদায়গুলি থেকে নেওয়া হয়েছিল। বার্কেরা বলেন যে টিক্সক্যাকালটিউব বাসিন্দারা তাদের সাইটের সাথে তাদের যোগসূত্রের খবর শুনে “খুব খুশি” হয়েছিল এবং বলেছিল যে তারা বিশ্বাস করে যে এই আবিষ্কারগুলি তাদেরকে পর্যটকদের সাথে আরও ভালভাবে যোগাযোগ করতে এবং সম্মানের সঙ্গে কথোপকথন করার জন্য সহায়তা করবে।
তাদের বক্তব্য, যে পর্যটকরা যান তারা জানেন, তিনি এই প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানগুলিতে এসেছেন, তারা আশ্চর্যজনক কাঠামোগুলি তৈরি করা লোকদের প্রশংসা করেন, এবং তারপর তারা প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান থেকে বেরিয়ে আসেন এবং স্থানীয় জনগণের সাথে খারাপ আচরণ করেন,। কিন্তু এই গবেষনার পর এখন নিশ্চয়ই তাদের ধারনা পাল্টাবে। তারা এখন বুঝবে এগুলো আমাদের পূর্বপুরুষদের তৈরি। তাই যারা এখানে আসছেন, আমরাও তাদের মত উন্নত। একারণে তারা আমাদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার না করে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আমাদের সঙ্গে কথা বলতে পারে।
গত বছর, সাইটটি, যা একসময় আধুনিক বিশ্বের সাতটি বিস্ময়ের একটি হিসাবে নামকরণ করা হয়েছিল,এখানে রেকর্ড সংখ্যক অর্থাত্ ২.৩ মিলিয়ন দর্শনার্থী এসেছিলেন ।