০৭:৪৯ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৭ জুন ২০২৫

দিবারাত্রির কাব্য: মানিক বন্দোপধ্যায় ( ৬ কিস্তি )

  • Sarakhon Report
  • ১২:০০:১৫ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৪ মার্চ ২০২৪
  • 20

রবীন্দ্রনাথ পরবর্তী সময়ে বাংলা সাহিত্যে আরেকটি নতুন যুগ সৃষ্টি হয়েছিলো। ভাষাকে মানুষের মুখের ভাষার কাছে নিয়ে আসা নয়, সাহিত্যে’র বিষয়ও হয়েছিলো অনেক বিস্তৃত। সাহিত্যে উঠে এসেছিলো পরিবর্তিত মন ও সমাজের নানান প্রাঙ্গন। সময়ের পথ ধরে সে যুগটি এখন নিকট অতীত। আর সে সাহিত্যও চিরায়ত সাহিত্য। দূর অতীত ও নিকট অতীতের সকল চিরায়ত সাহিত্য মানুষকে সব সময়ই পরিপূর্ণ মানুষ হতে সাহায্য করে। চিরায়ত সাহিত্যকে জানা ছাড়া বাস্তবে মানুষ তার নিজেকে সম্পূর্ণ জানতে পারে না।

 

সারাক্ষণের চিরায়ত সাহিত্য বিভাগে এবারে থাকছে মানিক বন্দোপধ্যায়ের দিবারাত্রির কাব্য।

দিবারাত্রির কাব্যে’র ভূমিকায় মানিক বন্দোপধ্যায় নিজেই যা লিখেছিলেন …..

 

দিবারাত্রির কাব্য আমার একুশ বছর বয়সের রচনা। শুধু প্রেমকে ভিত্তি করে বই লেখার সাহস ওই বয়সেই থাকে। কয়েক বছর তাকে তোলা ছিল। অনেক পরিবর্তন করে গত বছর বঙ্গশ্রীতে প্রকাশ করি।

 

দিবারাত্রির কাব্য পড়তে বসে যদি কখনো মনে হয় বইখানা খাপছাড়া, অস্বাভাবিক,- তখন মনে রাখতে হবে এটি গল্পও নয় উপন্যাসও নয়, রূপক কাহিনী। রূপকের এ একটা নূতন রূপ। একটু চিন্তা করলেই বোঝা যাবে বাস্তব জগতের সঙ্গে সম্পর্ক দিয়ে সীমাবদ্ধ করে নিলে মানুষের কতগুলি অনুভূতি যা দাঁড়ায়, সেইগুলিকেই মানুষের রূপ দেওয়া হয়েছে। চরিত্রগুলি কেউ মানুষ নয়, মানুষের Projection-মানুষের এক এক টুকরো মানসিক অংশ।

 

 

দিবা রাত্রির কাব্য

মানিক বন্দোপাধ্যায়

 

 

‘দশ-পনের দিন। ঠিক নেই।’

‘ভালই হল।’

হেরম্ব কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘কিসের ভাল হল?’ মালতী হাসল।

‘তোমাকে দেখে আনন্দ হচ্ছে। তাই বললাম। ছেলেদের তুমি কি পড়াও বললে?’

হেরম্ব হেসে বলল, ‘কবিতা পড়াই। ভাল ভাল ইংরেজ কবির বাছা বাছা

খারাপ কবিতা। বেঁচে থেকে সুখ নেই মালতী-বৌদি।’ আকস্মিক দার্শনিক মন্তব্যে মালতী হাসল। গলার শ্লেষ্মা সাফ করে বলল, ‘সুখ? নাইবা রইল সুখ! সুখ দিয়ে কি হবে? সুখ তো শুঁটকি মাছ!

জিভকে ছোটলোক না করলে স্বাদ মেলে না। সুখ স্থান জুড়ে নেই, প্রেম দিয়ে ভরে নাও, আনন্দ দিয়ে পূর্ণ কর। সুবিধা কত! মদ নেই যদি, মদের নেশা সুধায় মেটাও। ব্যস, আর কি চাই?’

হেরম্ব মালতীর দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, ‘দিন সুধা।’

‘আমি দেব?’ মালতী জোরে হেসে উঠল, ‘আমার কি আর সে বয়স আছে!’

‘তবে একটু জল দিন। তেষ্টা পেয়েছে।’

‘তা বরং দিতে পারি।’ বলে মালতী ডাকল, ‘আনন্দ, আনন্দ! একবার

বাইরে শুনে যাও!’

‘আনন্দ কে?’ হেরম্ব জিজ্ঞাসা করল।

‘আমার অনন্ত আনন্দ! মনে নেই? মধুপুরে দেখেছিলে! চুমু খেয়ে কাঁদিয়ে ছেড়েছিলে।’

‘ওঃ আপনার সেই মেয়ে। তার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম।’

‘ভুলে গিয়েছিলে? তুমি অবাক্ মানুষ হেরম্ব! সে কি আমার ভুলবার মতো মেয়ে?’

হেরম্ব বলল, ‘ছোট ছোট ছেলে-মেয়েদের কথা আমার মনে থাকে না মালতী-বৌদি। আপনার মেয়ে তখন খুব ছোটই ছিল নিশ্চয়?’ মালতী স্বীকার করে বলল, ‘নিশ্চয় ছোট ছিল। ছোট না থাকলে চুমু খেয়ে তাকে কাঁদাতে কি করে তুমি! তাছাড়া, তখন ছোট না থাকলে মেয়ে তো আমার এ্যাদ্দিনে বুড়ী হয়ে যেত!’

তারপর এল আনন্দ।

আনন্দকে দেখে হেরম্ব হঠাৎ অত্যন্ত বিচলিত হয়ে পড়ল। আনন্দ অপ্সরী নয়, বিদ্যাধরী নয়, তিলোত্তমা নয়, মোহিনী নয়। তাকে চোখে দেখেই মুগ্ধ হওয়া যায়, উত্তেজিত হয়ে ওঠার কোন কারণ থাকে না। কিন্তু হেরম্বের কথা আলাদা। এই মালতীকে নয়, সত্যবাবুর মেয়ে মালতীকে সে আজও ভুলতে পারেনি। এই স্মৃতির সঙ্গে তার মনে বারোবছর বয়সের খানিকটা ছেলেমানুষী, খানিকটা কাঁচা ভাবপ্রবণতা আজও আটকে রয়ে গিয়েছে। আনন্দকে দেখে তার মনে হল সেই মালতীই যেন বিশ্ব-শিল্পীর কারখানা থেকে সংস্কৃত ও রূপান্তরিত হয়ে, গত বিশ বছর ধরে প্রকৃতির মধ্যে, নারীর মধ্যে, বোবা পশু ও পাখির মধ্যে, ভোরের শিশির আর সন্ধ্যাতারার মধ্যে রূপ, রেখা ও আলোর অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে, তাকে তৃপ্ত করার যোগ্যতা অর্জন করে তার সামনে এসে দাড়িয়েছে। শীতকালের ঝরা শুকনো পাতাকে হঠাৎ একসময় বসন্তের বাতাস এসে যে ভাবে নাড়া দিয়ে যায়, আনন্দের আবির্ভাবও হেরম্বের জীর্ণ পুরাতন মনকে তেমনিভাবে নাড়া দিল।

বিস্মিত ও অভিভূত হয়ে সে আনন্দকে দেখতে লাগল। তার মনের উপর দিয়ে কুড়ি বছর ধরে যে সময়ের স্রোত বয়ে গেছে, তাই যেন কয়েকটি মুহূর্তের মধ্যে ঘনীভূত হয়ে এসেছে।

 

এই উচ্ছ্বসিত আবেগ হেরম্বের মনে প্রশ্রয় পায়। আবেগ আরও তীব্র হয়ে উঠলেই সে যেন তৃপ্তি পেত। তার বন্দী কল্পনা দীর্ঘকাল পরে হঠাৎ যেন আজ মুক্তি পায়। তার সবগুলি ইন্দ্রিয় অসহ্য উত্তেজনায় অসংযত প্রাণ সঞ্চয় করে। চারিদিকের তরুলতা তার কাছে অবিলম্বে জীবন্ত হয়ে ওঠে। শেষ অপরাহ্ণের রঙীন সূর্যালোককে তার মনে হয় চারিদিকে ছড়িয়ে-পড়া রঙীন স্পন্দমান জীবন।

 

বাড়ির দরজা থেকে কাছে এসে দাঁড়ানো পর্যন্ত আনন্দ হেরম্বকে নিবিড় মনোযোগের সঙ্গে দেখেছিল। সে এসে দাঁড়ানো মাত্র হেরম্ব তার চোখের দিকে তাকাল। কৌতূহল অস্তাহত হয়ে আনন্দের চোখে তথন ঘনিয়ে এল ভাব ও ভয়। হেরম্ব এটা লক্ষ্য করেছে। সে জানে এই ভয় ভীরুতার লক্ষণ নয়, মোহের পরিচয়। আনন্দের চোখে যে প্রশ্ন ছিল, হেরম্বের নির্বাক নিষ্ক্রিয় জবাবটা তাকে মুগ্ধ করে দিয়েছে।

 

সুপ্রিয়াকে ত্যাগ করে এসে হেরম্বর যা হয়নি, এখন তাই হল। নিজের কাছে নিজের মূল্য তার অসম্ভব বেড়ে গেল। সে জটিল জীবনযাপনে অভ্যস্ত। সাধারণ সুস্থ মানুষ সে নয়। মন তার সর্বদা অপরাধী, অহরহ তাকে আত্মসমর্থন করে চলতে হয়। জীবনে সে এত বেশী পাক খেয়েছে যে মাথা তার সর্বদাই ঘোরে। আনন্দ, পুলক ও উল্লাস সংগ্রহ করা আজ তার পক্ষে অত্যন্ত কঠিন কাজ। কিন্তু আনন্দ আজ তাকে আর তার দৃষ্টিকে দেখে মুগ্ধ হয়ে, বিচলিত হয়ে তাকে ছেলেমানুষের মতো উল্লসিত করে দিয়েছে। তার দেহমন হঠাৎ হাল্কা হয়ে গিয়েছে। তার মনে ভাষার মতো স্পষ্ট হয়ে এই প্রার্থনা জেগে উঠেছে, আনন্দ যেন চলে যাবার আগে আর একবার তার চোখের দিকে এমনিভাবে তাকিয়ে যায়।

 

‘ডাকলে কেন মা?’ আনন্দ মৃদুস্বরে জিজ্ঞাসা করল।

‘এ’কে এক গেলাস জল এনে দে।’

আনন্দ জল আনতে চলে গেলে হেরম্ব যেন অসুস্থ হয়ে ঝিমিয়ে পড়ল। অনেকদিন আগে অস্ত্রোপচারের জন্য তাকে একবার ক্লোরোফর্ম করা হয়েছিল।

 

সেই সময়কার অবর্ণনীয় অনুভূতি যেন ফিরে এসেছে। মালতী নীচু গলায় জিজ্ঞাসা করল, ‘কি রকম দেখলে আমার আনন্দকে?’ ‘বেশ, মালতী-বৌদি।’

 

‘আঠার বছর আগে ওকে কোলে পেয়েছিলাম হেরম্ব। জীবনে আমার দুটি স্থদিন এসেছে। প্রথমে তোমার মাস্টারমশায় যেদিন দাদাকে পড়াতে এলেন, অন্দরের জানালায় অন্ধকারে ঠায় দাড়িয়ে আমি লোকটাকে দেখলাম, সেদিন। আর যেদিন আনন্দ কোলে এল। প্রসববেদনা কেমন জানো?’

 

হেরম্ব জোর দিয়ে বলল, ‘জানি।’

‘জানো! পাগল নাকি, তুমি কি করে জানবে!’ ‘আমি এককালে কবিতা লিখতাম যে মালতী-বৌদি!’

 

‘কবিতা লেখা আর প্রসববেদনা কি এক? মাথা খারাপ না হলে কেউ এমন কথা বলে! তোমাতে আর ভগবান লক্ষ্মীছাড়াতে তাহলে আর কোন প্রভেদ থাকত না বাপু। আমরা প্রসব করি ভগবানের কবিতাকে, তার তুলনায় তোমাদের কবিতা ইয়ার্কি ছাড়া আর কি! যাই হোক, আনন্দকে দেখে আমি সেদিন প্রসববেদনা ভুলে গেলাম হেরম্ব।’ ‘

 

সব মা-ই তাই যায়, মালতী-বৌদি।’

মালতী রাগ করে বলল, ‘তুমি বড় রূঢ় কথা বলো হেরম্ব।’

আনন্দ জল আনলে গেলাস হাতে নিয়ে হেরম্ব বলল, ‘বোসো আনন্দ।’ আনন্দ অনুমতির জন্য মালতীর মুখের দিকে তাকাল।

 

মালতী বলল, ‘বোস লো ছুড়ি, বোস। এ ঘরের লোক। কেমন ঘরের লোক জানিস? আমার ছেলেবেলার ভালবাসার লোক। ওর যখন বারো বছর বয়স আমাকে বিয়ে করার জন্য ক্ষেপে উঠেছিল। রোজ সন্দেশ-টন্দেস থাইয়ে কত কষ্টে যে ভুলিয়ে রাখতাম, সে কেবল আমিই জানি। হাসিস ক্যানো লো! একি হাসির কথা? বিশ বছর ধরে খুঁজে খুঁজে তোর বাপকে খুন করতে এসেছে, তা জানিস্ ?’

 

আনন্দ বলল, ‘কি সব বলছ মা? এর মধ্যেই…’

‘এর মধ্যেই কি লো? বল না, এর মধ্যেই কি বলছিস্!’

‘কিছু না মা। চুপ কর।’

 

দিবারাত্রির কাব্য: মানিক বন্দোপধ্যায় ( ৬ কিস্তি )

১২:০০:১৫ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৪ মার্চ ২০২৪

রবীন্দ্রনাথ পরবর্তী সময়ে বাংলা সাহিত্যে আরেকটি নতুন যুগ সৃষ্টি হয়েছিলো। ভাষাকে মানুষের মুখের ভাষার কাছে নিয়ে আসা নয়, সাহিত্যে’র বিষয়ও হয়েছিলো অনেক বিস্তৃত। সাহিত্যে উঠে এসেছিলো পরিবর্তিত মন ও সমাজের নানান প্রাঙ্গন। সময়ের পথ ধরে সে যুগটি এখন নিকট অতীত। আর সে সাহিত্যও চিরায়ত সাহিত্য। দূর অতীত ও নিকট অতীতের সকল চিরায়ত সাহিত্য মানুষকে সব সময়ই পরিপূর্ণ মানুষ হতে সাহায্য করে। চিরায়ত সাহিত্যকে জানা ছাড়া বাস্তবে মানুষ তার নিজেকে সম্পূর্ণ জানতে পারে না।

 

সারাক্ষণের চিরায়ত সাহিত্য বিভাগে এবারে থাকছে মানিক বন্দোপধ্যায়ের দিবারাত্রির কাব্য।

দিবারাত্রির কাব্যে’র ভূমিকায় মানিক বন্দোপধ্যায় নিজেই যা লিখেছিলেন …..

 

দিবারাত্রির কাব্য আমার একুশ বছর বয়সের রচনা। শুধু প্রেমকে ভিত্তি করে বই লেখার সাহস ওই বয়সেই থাকে। কয়েক বছর তাকে তোলা ছিল। অনেক পরিবর্তন করে গত বছর বঙ্গশ্রীতে প্রকাশ করি।

 

দিবারাত্রির কাব্য পড়তে বসে যদি কখনো মনে হয় বইখানা খাপছাড়া, অস্বাভাবিক,- তখন মনে রাখতে হবে এটি গল্পও নয় উপন্যাসও নয়, রূপক কাহিনী। রূপকের এ একটা নূতন রূপ। একটু চিন্তা করলেই বোঝা যাবে বাস্তব জগতের সঙ্গে সম্পর্ক দিয়ে সীমাবদ্ধ করে নিলে মানুষের কতগুলি অনুভূতি যা দাঁড়ায়, সেইগুলিকেই মানুষের রূপ দেওয়া হয়েছে। চরিত্রগুলি কেউ মানুষ নয়, মানুষের Projection-মানুষের এক এক টুকরো মানসিক অংশ।

 

 

দিবা রাত্রির কাব্য

মানিক বন্দোপাধ্যায়

 

 

‘দশ-পনের দিন। ঠিক নেই।’

‘ভালই হল।’

হেরম্ব কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘কিসের ভাল হল?’ মালতী হাসল।

‘তোমাকে দেখে আনন্দ হচ্ছে। তাই বললাম। ছেলেদের তুমি কি পড়াও বললে?’

হেরম্ব হেসে বলল, ‘কবিতা পড়াই। ভাল ভাল ইংরেজ কবির বাছা বাছা

খারাপ কবিতা। বেঁচে থেকে সুখ নেই মালতী-বৌদি।’ আকস্মিক দার্শনিক মন্তব্যে মালতী হাসল। গলার শ্লেষ্মা সাফ করে বলল, ‘সুখ? নাইবা রইল সুখ! সুখ দিয়ে কি হবে? সুখ তো শুঁটকি মাছ!

জিভকে ছোটলোক না করলে স্বাদ মেলে না। সুখ স্থান জুড়ে নেই, প্রেম দিয়ে ভরে নাও, আনন্দ দিয়ে পূর্ণ কর। সুবিধা কত! মদ নেই যদি, মদের নেশা সুধায় মেটাও। ব্যস, আর কি চাই?’

হেরম্ব মালতীর দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, ‘দিন সুধা।’

‘আমি দেব?’ মালতী জোরে হেসে উঠল, ‘আমার কি আর সে বয়স আছে!’

‘তবে একটু জল দিন। তেষ্টা পেয়েছে।’

‘তা বরং দিতে পারি।’ বলে মালতী ডাকল, ‘আনন্দ, আনন্দ! একবার

বাইরে শুনে যাও!’

‘আনন্দ কে?’ হেরম্ব জিজ্ঞাসা করল।

‘আমার অনন্ত আনন্দ! মনে নেই? মধুপুরে দেখেছিলে! চুমু খেয়ে কাঁদিয়ে ছেড়েছিলে।’

‘ওঃ আপনার সেই মেয়ে। তার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম।’

‘ভুলে গিয়েছিলে? তুমি অবাক্ মানুষ হেরম্ব! সে কি আমার ভুলবার মতো মেয়ে?’

হেরম্ব বলল, ‘ছোট ছোট ছেলে-মেয়েদের কথা আমার মনে থাকে না মালতী-বৌদি। আপনার মেয়ে তখন খুব ছোটই ছিল নিশ্চয়?’ মালতী স্বীকার করে বলল, ‘নিশ্চয় ছোট ছিল। ছোট না থাকলে চুমু খেয়ে তাকে কাঁদাতে কি করে তুমি! তাছাড়া, তখন ছোট না থাকলে মেয়ে তো আমার এ্যাদ্দিনে বুড়ী হয়ে যেত!’

তারপর এল আনন্দ।

আনন্দকে দেখে হেরম্ব হঠাৎ অত্যন্ত বিচলিত হয়ে পড়ল। আনন্দ অপ্সরী নয়, বিদ্যাধরী নয়, তিলোত্তমা নয়, মোহিনী নয়। তাকে চোখে দেখেই মুগ্ধ হওয়া যায়, উত্তেজিত হয়ে ওঠার কোন কারণ থাকে না। কিন্তু হেরম্বের কথা আলাদা। এই মালতীকে নয়, সত্যবাবুর মেয়ে মালতীকে সে আজও ভুলতে পারেনি। এই স্মৃতির সঙ্গে তার মনে বারোবছর বয়সের খানিকটা ছেলেমানুষী, খানিকটা কাঁচা ভাবপ্রবণতা আজও আটকে রয়ে গিয়েছে। আনন্দকে দেখে তার মনে হল সেই মালতীই যেন বিশ্ব-শিল্পীর কারখানা থেকে সংস্কৃত ও রূপান্তরিত হয়ে, গত বিশ বছর ধরে প্রকৃতির মধ্যে, নারীর মধ্যে, বোবা পশু ও পাখির মধ্যে, ভোরের শিশির আর সন্ধ্যাতারার মধ্যে রূপ, রেখা ও আলোর অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে, তাকে তৃপ্ত করার যোগ্যতা অর্জন করে তার সামনে এসে দাড়িয়েছে। শীতকালের ঝরা শুকনো পাতাকে হঠাৎ একসময় বসন্তের বাতাস এসে যে ভাবে নাড়া দিয়ে যায়, আনন্দের আবির্ভাবও হেরম্বের জীর্ণ পুরাতন মনকে তেমনিভাবে নাড়া দিল।

বিস্মিত ও অভিভূত হয়ে সে আনন্দকে দেখতে লাগল। তার মনের উপর দিয়ে কুড়ি বছর ধরে যে সময়ের স্রোত বয়ে গেছে, তাই যেন কয়েকটি মুহূর্তের মধ্যে ঘনীভূত হয়ে এসেছে।

 

এই উচ্ছ্বসিত আবেগ হেরম্বের মনে প্রশ্রয় পায়। আবেগ আরও তীব্র হয়ে উঠলেই সে যেন তৃপ্তি পেত। তার বন্দী কল্পনা দীর্ঘকাল পরে হঠাৎ যেন আজ মুক্তি পায়। তার সবগুলি ইন্দ্রিয় অসহ্য উত্তেজনায় অসংযত প্রাণ সঞ্চয় করে। চারিদিকের তরুলতা তার কাছে অবিলম্বে জীবন্ত হয়ে ওঠে। শেষ অপরাহ্ণের রঙীন সূর্যালোককে তার মনে হয় চারিদিকে ছড়িয়ে-পড়া রঙীন স্পন্দমান জীবন।

 

বাড়ির দরজা থেকে কাছে এসে দাঁড়ানো পর্যন্ত আনন্দ হেরম্বকে নিবিড় মনোযোগের সঙ্গে দেখেছিল। সে এসে দাঁড়ানো মাত্র হেরম্ব তার চোখের দিকে তাকাল। কৌতূহল অস্তাহত হয়ে আনন্দের চোখে তথন ঘনিয়ে এল ভাব ও ভয়। হেরম্ব এটা লক্ষ্য করেছে। সে জানে এই ভয় ভীরুতার লক্ষণ নয়, মোহের পরিচয়। আনন্দের চোখে যে প্রশ্ন ছিল, হেরম্বের নির্বাক নিষ্ক্রিয় জবাবটা তাকে মুগ্ধ করে দিয়েছে।

 

সুপ্রিয়াকে ত্যাগ করে এসে হেরম্বর যা হয়নি, এখন তাই হল। নিজের কাছে নিজের মূল্য তার অসম্ভব বেড়ে গেল। সে জটিল জীবনযাপনে অভ্যস্ত। সাধারণ সুস্থ মানুষ সে নয়। মন তার সর্বদা অপরাধী, অহরহ তাকে আত্মসমর্থন করে চলতে হয়। জীবনে সে এত বেশী পাক খেয়েছে যে মাথা তার সর্বদাই ঘোরে। আনন্দ, পুলক ও উল্লাস সংগ্রহ করা আজ তার পক্ষে অত্যন্ত কঠিন কাজ। কিন্তু আনন্দ আজ তাকে আর তার দৃষ্টিকে দেখে মুগ্ধ হয়ে, বিচলিত হয়ে তাকে ছেলেমানুষের মতো উল্লসিত করে দিয়েছে। তার দেহমন হঠাৎ হাল্কা হয়ে গিয়েছে। তার মনে ভাষার মতো স্পষ্ট হয়ে এই প্রার্থনা জেগে উঠেছে, আনন্দ যেন চলে যাবার আগে আর একবার তার চোখের দিকে এমনিভাবে তাকিয়ে যায়।

 

‘ডাকলে কেন মা?’ আনন্দ মৃদুস্বরে জিজ্ঞাসা করল।

‘এ’কে এক গেলাস জল এনে দে।’

আনন্দ জল আনতে চলে গেলে হেরম্ব যেন অসুস্থ হয়ে ঝিমিয়ে পড়ল। অনেকদিন আগে অস্ত্রোপচারের জন্য তাকে একবার ক্লোরোফর্ম করা হয়েছিল।

 

সেই সময়কার অবর্ণনীয় অনুভূতি যেন ফিরে এসেছে। মালতী নীচু গলায় জিজ্ঞাসা করল, ‘কি রকম দেখলে আমার আনন্দকে?’ ‘বেশ, মালতী-বৌদি।’

 

‘আঠার বছর আগে ওকে কোলে পেয়েছিলাম হেরম্ব। জীবনে আমার দুটি স্থদিন এসেছে। প্রথমে তোমার মাস্টারমশায় যেদিন দাদাকে পড়াতে এলেন, অন্দরের জানালায় অন্ধকারে ঠায় দাড়িয়ে আমি লোকটাকে দেখলাম, সেদিন। আর যেদিন আনন্দ কোলে এল। প্রসববেদনা কেমন জানো?’

 

হেরম্ব জোর দিয়ে বলল, ‘জানি।’

‘জানো! পাগল নাকি, তুমি কি করে জানবে!’ ‘আমি এককালে কবিতা লিখতাম যে মালতী-বৌদি!’

 

‘কবিতা লেখা আর প্রসববেদনা কি এক? মাথা খারাপ না হলে কেউ এমন কথা বলে! তোমাতে আর ভগবান লক্ষ্মীছাড়াতে তাহলে আর কোন প্রভেদ থাকত না বাপু। আমরা প্রসব করি ভগবানের কবিতাকে, তার তুলনায় তোমাদের কবিতা ইয়ার্কি ছাড়া আর কি! যাই হোক, আনন্দকে দেখে আমি সেদিন প্রসববেদনা ভুলে গেলাম হেরম্ব।’ ‘

 

সব মা-ই তাই যায়, মালতী-বৌদি।’

মালতী রাগ করে বলল, ‘তুমি বড় রূঢ় কথা বলো হেরম্ব।’

আনন্দ জল আনলে গেলাস হাতে নিয়ে হেরম্ব বলল, ‘বোসো আনন্দ।’ আনন্দ অনুমতির জন্য মালতীর মুখের দিকে তাকাল।

 

মালতী বলল, ‘বোস লো ছুড়ি, বোস। এ ঘরের লোক। কেমন ঘরের লোক জানিস? আমার ছেলেবেলার ভালবাসার লোক। ওর যখন বারো বছর বয়স আমাকে বিয়ে করার জন্য ক্ষেপে উঠেছিল। রোজ সন্দেশ-টন্দেস থাইয়ে কত কষ্টে যে ভুলিয়ে রাখতাম, সে কেবল আমিই জানি। হাসিস ক্যানো লো! একি হাসির কথা? বিশ বছর ধরে খুঁজে খুঁজে তোর বাপকে খুন করতে এসেছে, তা জানিস্ ?’

 

আনন্দ বলল, ‘কি সব বলছ মা? এর মধ্যেই…’

‘এর মধ্যেই কি লো? বল না, এর মধ্যেই কি বলছিস্!’

‘কিছু না মা। চুপ কর।’