শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৫:৪১ অপরাহ্ন

রূপের ডালি খেলা (পর্ব-৫)

  • Update Time : বৃহস্পতিবার, ২৭ জুন, ২০২৪, ৪.০০ পিএম

ইউ. ইয়াকভলেভ

রুটির ফুল

ছোট্ট কলিয়ার যতদূর মনে পড়ে, যুদ্ধের দিনগুলোয় তার কেবলি ক্ষিদে পেত। ক্ষিদে সে কিছুতেই সইতে পারত না, মানিয়ে নিতে পারত না, রাগের ঝলক ফুটত তার কোটরে ঢোকা চোখে, অনবরত খাবার খুজে বেড়াত। না-ছাঁটা এলোমেলো কালো কালো চুল আর খোঁচা খোঁচা পাঁজরায় তাকে দেখাত যেন ছোট্ট রোগাটে এক নেকড়েছানা। খাওয়ার মতো কিছু একটা পেলেই সে তা মুখে তুলত সরেল, মুখ আটকে আসা বৈ’চি, বার্ড-চেরি, কী সব শিকড়বাকড়, অসহ্য টক আর শক্ত বুনো আপেল। বাড়িতে সে পেত জলের মতো কিছু ঝোল আর রুটি। ঝাড়াই- করা জোয়ারের গুছি গাঁড়ো করে মা মেশাত ময়দার সঙ্গে, ফলে ত্রুটি হত ভারি, চ্যাটচেটে, সোঁদা সোঁদা কাদাটে গন্ধ উঠত। কিন্তু এ রুটিও কলিয়া দেখতে না দেখতে খেয়ে নিত, নাক ফুলিয়ে ফোঁস-ফোঁস করত লোভীর মতো।

সারা যুদ্ধের মধ্যে একবার সে রুটি খেয়েছিল পেট পুরে। সে রুটি জোয়ার গুছির গুঁড়োয় নয়, সত্যিকারের। তা সঙ্গে নিয়ে এসেছিল সৈন্যরা। কুটিরে তারা ঢোকে রাত্তিরে। তাদের ভারি গ্রেটকোট আর জীর্ণ হাই বুটে শাদামতো কী একটা জিনিসের প্রলেপ, আধা-অন্ধকারে চিক-চিক করছিল তা, মনে হয় যেন তুষার-কণা লেগে আছে। অথচ বাইরে তখন বৃষ্টি হচ্ছিল। স্তেপ থেকে তারা আসে নি, নেমে এসেছে খড়ি পাহাড়ের উৎরাই বেয়ে। উৎরাই-টা বেশ কঠিন, তাই খড়িমাখা হয়ে গেছে। গরম ঘরখানায় ওদের গা থেকে ভাপ উঠছিল, সঙ্গে সঙ্গে ঘর ভরে গেল তামাকের ধোঁয়া, ভেজা পা-পটি, চামড়ার বেল্ট আর রাইয়ের টাটকা চাপাটির চড়া গন্ধে। চাপাটিগুলো তারা রেখেছিল টেবিলের ওপর।

অতিথি আগমনে খুব ঘে’যাঘে’ষি হচ্ছিল ঘরে, যেন রেলের স্টেশন, ছোট্ট কলিয়ার অস্বস্তি লাগছিল। এক কোণে জড়োসড়ো হয়ে সে শঙ্কিতভাবে তাকিয়ে দেখছিল আগন্তুকদের। এই সময়ে বাঁ পায়ে খুঁড়িয়ে-চলা গাল-উ’চু এক সৈন্যের চোখে পড়ে যায় সে। হাতছানি দিয়ে কলিয়াকে ডাকে নিজের কাছে:

‘ওহে কর্তা, আয় এখানে। রুটি খাবি?’

কলিয়ার ইচ্ছে হয়েছিল চে’চিয়ে ওঠে: ‘খাবো! খাবো!’ কিন্তু গলায় ওর দলা পাকিয়ে উঠল। একটা কথাও বলতে পারল না সে, শুধু চুপ করে লালা গিলতে লাগল।

‘পেট পুরে খোঁট দিয়েছিস বুঝি?’

অসহায়ের মতো চোখ পিট-পিট করলে কলিয়া আর গাল-উঁচু সৈন্যটি তার থলে খুলে তার হাতে গুঁজে দিলে মস্তো এক টুকরো রুটি। মাথা ঘুরে উঠল ক্ষুধিত ছেলেটির। খচমচ করে সে উঠে পড়ল চুল্লির ওপরকার মাচায়, জড়িয়ে ধরলে রুটিটা। রুটির গন্ধ নিলে সে, আদর করলে, হাত আর গালে চেপে গরম করে তুলল সেটা।

কখনো সে কামড় দেয় তার শাঁসে, কখনো বা উত্তেজিত আহহ্লাদে চিবিয়ে যায় তার চটা, সারা গায়ে ছড়িয়ে পড়ে একটা শান্ত পরিতৃপ্তি। রুটিতে তার মন ভিজে উঠল যেভাবে মাঝে মাঝে বড়োরা দিলখুশ হয়ে ওঠে নেশায়। মনে হল তার, চারিপাশের সবকিছুই যেন রুটি-ময়: শুয়ে আছে সে রুটির ওপর, মাথার নিচে নরম রুটি, গা- ঢাকা দিয়ে আছে গরম রুটিতে। ঘুমিয়ে পড়ল সে। আর সারা রাতই কেবল স্বপ্ন দেখল রুটির।

….যুদ্ধ যখন শেষ হয়ে আসছে, মা তখন তাদের ঘরোয়া ক্ষেতের এক ফালি মাটিতে গম বোনে। অচিরেই মাটি ফাড়ে মাথা তুললে ভীরু-ভীরু অংকুর। দেখতে ঘাসের মতো। সে ঘাস চিবিয়ে দেখল কলিয়া মোটেই তাতে রুটির স্বাদ নেই, ঘাস যেমন হয় তেমনি। আদপেই হয়ত কোনো রুটি হবে না এতে। কিন্তু শিগগিরই ঘাসগুলো নলের মতো হয়ে উঠল।

‘এবার মঞ্জরী ধরবে,’ বললে মা।

দিন গুণতে লাগল সবাই, কলিয়াও; মনে পড়ত তার সেই টাটকা চাপাটি আর রুটি-ময় সেই রাতটার কথা, যা হয়ত বা বাস্তব, হয়ত স্বপ্ন। কলিয়া ভাবত নীল-নীল ফুল কিংবা আলতা রঙের মুকুল ফুটবে তাতে। অথবা চেরি গাছের মতো ছেয়ে যাবে শাদা শাদা গুচ্ছে। কী ভাবে ফুল ফুটল সেটা কিন্তু তার চোখেই পড়ল না- দেখা দিল বড়ো বড়ো দানার মঞ্জরী, একটু নীলচে, ভেজা-ভেজা। তারপর জায়গাটা হয়ে উঠল খড়-রঙা।

প্রথম ফসল ওঠার আনন্দে দিদিমা প্রকাণ্ড সূর্যমুখী ফুলের মতো দুটি চাপাটি বানালে। লালচে-লালচে রঙ, ঝলমলে তার গন্ধ। মাখনের প্রলেপ দিয়ে দিদিমা ভাঙা কাঁচের মতো বড়ো বড়ো নূন ছিটিয়ে দিলে তাতে। ভাপ উঠছিল চাপাটি থেকে, জল-জ্বল করছিল যেন দুটি ছোট্ট নোনতা সূর্য’।

টেবিলের কাছে বসে ছিল কলিয়া, খালে ঢোকা চোখ তার চাপাটি দুটোর ওপর নিবন্ধ। অপেক্ষা করছিল কখন ওকে খেতে দেবে, বুক ভরে টানছিল সে’কা রুটির তপ্ত গন্ধ। প্রাণপণে সে ঠেকালে যাতে হাত না বাড়ায়, ঈর্ষণীয় খাদ্যটা সে না নেয় বিনা অনুমতিতে। শেষ পর্যন্ত দিদিমা এসে বললে।

‘নে বাছা, খেয়ে দেখ আমার চাপাটি।’

কোন একটা গোপন প্রীত যেন কাজ করে গেল তার মধ্যে, নিমেষে হাত এগিয়ে গেল রুটির দিকে, আঙুঙুলগুলো সজোরে তা চেপে টেনে আনল মুখের কাছে। ঠোঁটে ছ্যাকা লাগছিল, জিভ পুড়ে যাচ্ছিল নুনে, রুচিকর গন্ধটা যাতে ফসকে না যায়, তার জন্যে স্ফীত হয়ে উঠল নাকের ফুটো। না, সৈনিকের ত্রুটির চেয়েও চাপাটিটা খেতে অনেক ভালো, কিন্তু মুখের মধ্যে তা মিলিয়ে যেতে লাগল খুবই চটপট, শিগগিরই

কলিয়ার হাতে রইল কেবল সরু একফালি চাঁদের মতো। অচিরেই সেটাও আর রইল না… ঠোঁট চাটলে কলিয়া, আঙুলগুলো চাটলে, তারপর দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললে। আর লালচে, অটুট, হয়ত-বা আরো বেশি সুস্বাদু দ্বিতীয় চাপাটিটা কিন্তু তখনো টেবিলেই, সারা মুখে হাসি ফুটিয়ে তা ডাক দিচ্ছে।

‘এই চাপাটিটা নিয়ে যা দাদুর জন্যে,’ বললে দিদিমা।

‘বেশ, নিয়ে যাচ্ছি,’ দমে-যাওয়া গলায় বললে কলিয়া।

দাদু খুবেই বুড়ো, থাকে মৌমাছি খামারে। বাড়ি আসে সে কালে-ভদ্রে, যখন সব্জী-ভাইয়ে গরম করা হয় কুলকালিমাখা, বে’কে-যাওয়া, স্নানের চালাঘরটা। সারা মুখে তার খোঁচা-খোঁচা দাড়ি, যেন খৃতনি থেকে গাল পর্যন্ত উ’চিয়ে আছে অসংখ্য লোহার পেরেক। কলিয়া তার কাছে ঘে’খতে ভয় পেত, খোঁচা লাগবে বলে।

গরম চাপাটিটা দিদিমা চওড়া বার্ডক পাতায় মুড়ে এগিয়ে দিলে কলিয়ার দিকে। এই অমূল্য সম্পদটি কলিয়া প্রথমে হাতে করেই নিয়ে যাচ্ছিল। তারপর পাতাটা ফেলে দিয়ে চাপাটিটা লুকিয়ে রাখতে হল কামিজের ভেতর যাতে ছেলে- পিলেরা কেড়ে না নেয়। চাপাটিটা গরম, চামড়ায় ছ্যাঁকা লাগছিল, ছ্যাঁকা-খাওয়া জায়গাটা জ্বলছিল বড়ো বড়ো নুনের দানায়। কলিয়ার মনে হচ্ছিল কোনো এক হিংস্র জন্তুর বাচ্চা সে নিয়ে যাচ্ছে কোলে করে, বাচ্চাটা কামড়াচ্ছে তার পেটে। কিন্তু সহ্য করে গেল কলিয়া। ছেলেগুলোর পাশ দিয়েই গেল, কী চমৎকার খাবার তার জামার তলে লুকনো, সেটা তারা সন্দেহও করলে না।

নাতির আসার শব্দ দাদুর কানে যায় নি। মৌমাছিদের জল খাওয়ানোর জায়গায় যেখানে নালা দিয়ে জল বইছে, তার সামনে বসে ছিল সে। নালাটায় গিজ-গিজ করছে মৌমাছি, ঠাণ্ডা জলে শুড় নামিয়ে জল খাচ্ছে। হাত পাতলে দাদু নালায়, জল গড়িয়ে এল তার অঞ্জলিতে, হাত ভরে সে মৌমাছিদের জল তুললে মুখে- সে জল মধুতে মিষ্টি-মিষ্টি। মৌমাছিরা নড়ে-চড়ে বেড়াচ্ছিল দাদুর কাঁধে, মাথায়, ঢুকে পড়ছিল কানের ফুটোয়, কিন্তু কামড়াচ্ছিল না। দাদুকে ওরা জানে ওদেরই একজন বলে।

খুশি হয়ে উঠল দাদু। চাপাটিটা হাতে নাড়াচাড়া করে সে তার গন্ধ শকেলে। আর বুড়োর সামনে কলিয়া দাঁড়িয়ে রইল বুক-ভরা এই আশা নিয়ে যে দাদু আধা-

আধি ভাগ করবে চাপাটিটা।

‘খাসা চাপাটি,’ বললে দাদু।

‘ভারি সুন্দর,’ চট করেই সায় দিলে কলিয়া।

‘জার্মানরা সরে যেতেই মাটিও ভালো ফলন দিচ্ছে!’ রুটি-ধরা হাতটা নামালে

দাদু, ‘আর তোর দিদিমা আছে কেমন? হে’টে হাঁটে বেড়াচ্ছে?’ ‘বেড়াচ্ছে,’ দীর্ঘশ্বাস ফেললে কলিয়া, আর চাপাটির কথা যাতে বেশি ভাবতে না

হয়, তাই জিজ্ঞেস করলে, ‘আচ্ছা দাদু, জার্মানদের সঙ্গে তুমি যে লড়লে, তার জন্যে

তোমায় মেডেল দেবে?” ‘মেডেলের কী দরকার?’ বললে দাদু, ‘তবিয়ং বহাল থাকলেই আমার হল।’

চাপাটিটা দাদু খেলে না, নিয়ে গেল তার চালাটায়। ইস্, কী লোভী দাদুটা। ওর ওই মৌমাছিগুলোর সঙ্গে থেকে থেকে একেবারে বুনো হয়ে উঠেছে। ইচ্ছে করেই চাপাটি লুকিয়ে রাখল ভাগ দিতে যাতে না হয়, পরে নিশ্চিন্তে মধু মাখিয়ে চিবুবে।

ফিরে আসছিল কলিয়া। কিন্তু শেষ মুহূর্তে দাদু যখন নোংরা জামা-কাপড়ের একটা পার্টলি এগিয়ে দিয়ে বললে, ‘দিদিমাকে বলিস কেচে দিতে।’ তখন কেমন যেন চমকে উঠল কলিয়া, আর একটু হলেই দাদুর কাছ থেকে এক টুকরো চাপাটি চেয়ে বসত সে। কিন্তু মুহূর্তের দুর্বলতাটা সে জয় করলে। কোনো কথা বললে না। বাড়ি ফিরল ধাঁরে সুস্থে, পোঁটলাটা দোলাতে দোলাতে, ভাবছিল যুদ্ধ যখন শেষ হবে, বাড়িতে ময়দা থাকবে অনেক, তখন সকাল দুপুর সন্ধে সবসময়ই চাপাটি খাবে সে। এখন চাপাটিটা খাচ্ছে দাদুই, কলিয়াও তো তার নিজেরটা খেয়েছে। দাদুর ছবিটা ভেসে উঠল কলিয়ার সামনে: ফোকলা মুখে বহুক্ষণ ধরে চিবিয়েই চলেছে সে’কা চটাটা। বুড়ো তো, নিশ্চয় স্বাদও কিছু টের পায় না। বাড়িতে পার্টলিটা দিদিমাকে দিয়ে গজ-গজ করলে:

‘দাদু কেচে দেবার জন্যে দিয়েছে।’

‘আছে কেমন সে? অসুখ-বিসুখ করে নি তো?’ শঙ্কিত হয়ে উঠল দিদিমা। ‘অসুখ করবার কাঁ আছে?’ বললে কলিয়া, ‘মৌমাছি পালছে।’

চুপ করে দিদিমা ময়লা কাপড়-চোপড়গুলো বের করে রাখতে লাগল মাচায়, দেখতে লাগল কোথায় রিপু করতে হবে, কোথায় মারতে হবে তালি। পুটলির তলায় দেখা গেল পরিষ্কার ন্যাকড়ায় বাঁধা একটা মোড়ক। অবাধ্য আঙুলে দিদিমা ধীরে সুস্থে খুললে মোড়কটা। ন্যাকড়ায় দেখা গেল সেই চাপাটিটা। কিছুই বললে না সে। অপ্রত্যাশিত খাদ্যটা সে রাখলে নাতির সামনে।

ঘন করে নূন্ন ছিটানো লালচে সূর্যটায় চোখ ধাঁধিয়ে গেল কলিয়ার। চোখে ওর ঝিলিক দিলে আনন্দের ছটা। স্বাদটা মনে হতেই মুখ ওর লালায় ভরে উঠল, হাত বাড়িয়ে দিলে চাপাটির দিকে। কিন্তু কী একটা অচেনা হৃদয়াবেগে হাত ওর থেমে গেল। দেখা গেল সেটা ক্ষিদের চেয়েও জোরালো, রুটির চেয়েও জরুরী। তার মানে দাদু চিবোয় নি চাপাটিটা, মধু মাখায় নি, খেয়েছে শুধু ঐ মিষ্টি-মিষ্টি জল, ক্ষিদে যাতে মরে আসে, আর মৌমাছিগুলো নড়ে-চড়ে বেড়াচ্ছে তার কাঁধে… আর ফ্যাসিস্টদের সঙ্গে যুদ্ধ করেছে সে, কিন্তু মেডেল সে চায় না…

বেন্ডি থেকে নেমে চলে গেল কলিয়া… কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই বাড়ি ফিরে এল সে। ঠান্ডা চাপাটিটা সে টেবিল থেকে নিয়ে পরিপাটী করে মুড়লে পরিষ্কার ন্যাকড়া দিয়ে। তারপর দাদুর যে-বাক্সটায় থাকে তার পুরনো হাই বুট, টুপি, ঘরোয়া তামাকের বটুয়া, আর গত যুদ্ধের সম্ভীন, সেইখানে তা রেখে দিলে।

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024