ড. মুর্শিদা বিনতে রহমান
‘মুক্তিযুদ্ধ’ ও ‘মুক্তিযোদ্ধা’ শব্দ দুটি বর্তমান বাংলাদেশে হীনমন্যতা জাগানো দুটি শব্দ। রাষ্ট্রের বর্তমান কর্ণধারেরা যতই মুক্তিযুদ্ধকে তাদের ক্ষমতায় টিকে থাকার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছেন সাধারণ মানুষের কাছে ততই তা অনীহার বিষয় হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় যে দৈন্যদশা ছিল, যা আজও আছে, তাতে নতুন প্রজন্ম এই দুটো শব্দের মর্মার্থ অনুভব করতে শেখেনি। জীবিত মুক্তিযোদ্ধারা কিংবা মৃত মুক্তিযোদ্ধার সন্তানরা যখন দেখেন এই প্রজন্ম ‘আমি রাজাকার’ প্লাকার্ড নিয়ে রাস্তায় মিছিল করে, প্রতিবাদ জানায় তখন তাদের মধ্যে কী ঘটে রাষ্ট্র কী তা বোঝে? সরকারি চাকরি সব সময় সোনার হরিণ ছিল, কিন্তু সেখানে কবে থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের প্রতি আক্রোশ জাগানো হলো তা আমরা কেউ বুঝেও উঠতে পারিনি। সরকারি চাকুরীতে ৩০% মুক্তিযোদ্ধা কোটার তালিকায় শেষ পর্যন্ত কতজন সেখানে চাকুরী পান তার হিসেব কী কেউ রাখেন? আর এসমস্ত জায়গায় যে অনিয়মগুলো বিদ্যমান আছে সেগুলো কী মুক্তিযোদ্ধার সন্তানরা করেন না সরকারি কর্মচারী-কর্মকর্তারা করেন? বাংলাদেশের প্রতিটা সেক্টরে আজ কীভাবে কাজ হচ্ছে সাধারণ মানুষ কম বেশি সকলেই তা জানেন। কিন্তু দিন শেষে সেই চোর-ঘুষখোর-দুর্নীতিবাজদেরই দলভারী। আমরা তাদেরকেই অনুসরণ করতে মরিয়া। চুরি, দুর্নীতি করা আর ঘুষখাওয়া পদগুলো আজ নতুন প্রজন্মের কাছে বেশি আকর্ষণীয়। কোনো পাত্রের বিয়ে করার ক্ষেত্রে এখন শুধু সরকারি চাকরীই পাত্রীপক্ষের কাছে যথেষ্ট নয়, পাত্রপক্ষকে নিশ্চিত করতে হয় যে বেতনের বাইরে তার উপরি উপার্জন কত। যার উপরি যত বেশি সমাজে তার সম্মান তত বেশি, এই উপরি উপার্জন দিয়ে দামি গাড়ি-দামি বাড়ি-দামি শাড়ি-ডায়মন্ড/সোনার গহনা নিয়ে সমাজে নিজের অবস্থান তিনি ও তার স্ত্রী দৃঢ় করেন। এটাই বর্তমান সমাজের মানসিকতা।দেশের নিয়োগ বাণিজ্যের রমরমা ব্যবসার চিত্র বর্ণনাতীত।এত কিছুর মধ্যে কোটার ৩০% এর জন্য জাতির সূর্যসন্তানদের যতটা অপমান করা যায়, তাদের প্রতি যতটা ঘৃণা জাগানো যায় ততটাই মনের শান্তি। নতুন প্রজন্মের এই মনস্তাত্ত্বিক গঠনের জন্য রাষ্ট্র ব্যবস্থা সম্পূর্ণরূপে দায়ী। এই দায়ভার রাষ্ট্র এড়াতে পারে না।
বর্তমান বাংলাদেশের অবস্থা বিবেচনায় কয়েকটি প্রশ্ন মনে জাগে- মুক্তিযুদ্ধ কেন হয়েছিল এবং মুক্তিযোদ্ধা কারা তা কী মেধাবীরা বোঝেন? ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানি শোষণ থেকে মুক্তির যে আন্দোলন পরিচালিত হয়েছিল তার মর্ম আজকের মেধাবী প্রজন্ম কতটা অনুভব করেন? ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করলে তা পাকিস্তান ও তার মিত্রদের স্বার্থে কতটা আঘাত করেছিল তা এই মেধাবী প্রজন্ম কতটা জানেন? ১৬ ডিসেম্বরের পর থেকে পরাজিত শক্তি নিজেদের ধ্বংস কাটিয়ে উঠে নতুন রাষ্ট্রে নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় কীভাবে ও কতটা নিয়োজিত ছিল তা সম্পর্কে মেধাবীরা কতটা সচেতন? স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত বাংলাদেশের জাতি গঠন প্রক্রিয়ার রূপ কেমন ছিল তা মেধাবীরা কতটা অনুসন্ধানের চেষ্টা করেন? এখন বলতে পারেন আমি তো মেধাবী, ইতিহাস পড়া বা জানা আমার কাজ নয়। মেধাক্রমে যারা পেছনের সারিতে থাকে তাদের বিষয় হলো ইতিহাস। কিন্তু যে নিজের জনগণের পরিচয় জানে না কিংবা নিজের পরিচয় সম্পর্কে সচেতন নয় সে তার মেধা কার কল্যাণে নিয়োজিত করবেন? একজন মেধাবী রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা ছাড়া তো অগ্রসর হন না, তাহলে রাষ্ট্র কাঠামো সম্পর্কে না জেনে তিনি কার সেবা করবেন? যে পদের আশায় তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের ঘৃণা করছেন সে পদ তো জনগণের সেবক হওয়ার পদ। সেক্ষেত্রে তিনি যদি জনগণ সম্পর্কেই না জানেন তাহলে সেবাদানের রূপটাই বা কী হবে?ধরে নিলাম তিনি জাতীয়তাবাদী চেতনায় বিশ^াসী নন, তাহলে তো তিনি গ্লোবাল বা আন্তার্জাতিক। সেক্ষেত্রে একটি জাতীয় রাষ্ট্রের নিয়ম কানুনে তার প্রতিবাদের কোনো প্রয়োজন আছে কি? তিনি তো আন্তর্জাতিক পরিসরে নিজের অবস্থান তৈরির চেষ্টায় মনোনিবেশ করবেন।
এবার একটু বোঝার চেষ্টা করি মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থা আমরা কতটা বোঝার চেষ্টা করেছি এবং তাদের প্রতি এত ঘৃণাকেন? এই ঘৃণাটা কী নতুন প্রজন্মের মাঝেই বিদ্যমান, নাকি স্বাধীনতার শুরু থেকেই আরম্ভ হয়েছিল। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালোরাতের পর থেকেই বাংলাদেশের মানুষ তিনভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। একাংশ যুদ্ধে গিয়ে নিজের জীবনের বিনিময়ে দেশ স্বাধীনের কাজে লিপ্ত হন এবং তাদের পরিবারবর্গ মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করে বাংলাদেশকে মননে মগজে ধারণ করেন, একাংশ দোদুল্যমান- বৃষ্টি যেদিকে আসবে ছাতাটা সেদিকে ধরবে (সুবিধাবাদি) এবং শেষাংশ পাকিস্তানপন্থি। যারা জীবন বাজি রেখে যুদ্ধে গেছেন, সম্মুখ যুদ্ধ করেছেন, নিজের বন্ধু বা সহযোদ্ধাদের চোখের সামনে শহীদ হতে দেখেছেন, যুদ্ধ শেষে বিধ্বস্ত পরিবার-বিধ্বস্ত দেশ দেখেছেন তাদের পরবর্তী জীবনটা কতটা স্বাভাবিক ছিল তা কী আমরা জানা বা বোঝার চেষ্টা করেছি? তাদের মনস্তাত্ত্বিক ক্ষতটা কত গভীর তা কী মেধাবীরা বোঝেন? দেশগড়ার যে স্বপ্ন নিয়ে তারা যুদ্ধ করেছিলেন সেই স্বাধীন দেশের পরিস্থিতি তাদের কতটা স্বস্তি দিয়েছে তা কী মেধাবীরা জানেন? ব্যতিক্রমী কিছু মুক্তিযোদ্ধার ব্যক্তিগত আদর্শচ্যুতি সকল মুক্তিযোদ্ধাদের মানসে কতটা অভিঘাতের সৃষ্টি করেছে তার খোঁজ কী আমরা রাখি? মুক্তিযুদ্ধের ক্ষত মুক্তিযোদ্ধা ও তার পরিবারবর্গ কীভাবে বয়ে বেড়িয়েছেন তার খবর কী রাষ্ট্রের কাছে আছে? পরিবারের পিতা মুক্তিযুদ্ধের ক্ষত বয়ে বেড়ালে সেই পরিবার কতটা নাজুক অবস্থার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়েছে তা কী মেধাবীরা জানেন? মেধাবীরা কী এই প্রশ্নগুলো কখনো ভেবেছেন? পরিস্থিতি বলছে ভাবেননি। আপনাদের ভবিষ্যৎ গড়তে তারা তাদের সময়টা উৎসর্গ করেছেন, তাদের পরিবারের সুখ শান্তি বিসর্জন দিয়েছেন, আপনাদের মতো অনেক মেধাবী দেশ গড়তে গিয়ে নিজের ও পরিবারের লাভ-ক্ষতির কোনো হিসেবই করেন নি,তার বিনিময়ে আপনারা তাদের ও তাদের সন্তানদের ঘৃণা উপহার দিচ্ছেন! এখানেই আপনাদের মেধার কৃতিত্ব! জয় হোক আপনাদের মেধার, জয় হোক মুক্তিযোদ্ধাদের ঘৃণাকারীদের!
প্রকৃতপক্ষে মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের পরিবারের প্রতি ঘৃণা জানায় পাকিস্তানপন্থিরা, সুবিধাবাদীরা ও তাদের সন্তানেরা। ১৬ ডিসেম্বরের পর থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি এ দুটি শ্রেণীর যে ক্ষোভ জন্ম হয়েছিল তা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বহমান। পাকিস্তানপন্থিরা মুক্তিযোদ্ধাদের ঘৃণা করবে এটাই স্বাভাবিক, সুবিধাবাদিরা কেন ঘৃণা করবে? কারণ যুদ্ধের সময় যেখানে কিশোর বয়সীরা যুদ্ধে গেছে সেখানে পাকিস্তানপন্থিরা ছাড়া কেবল সুবিধাবাদীরাই চুপ করে অবস্থা অবলোকন করেছে। অবরুদ্ধ দেশে পালিয়ে বেরিয়েছে। যুদ্ধে যাবার সাহস তারা দেখাতে পারেনি, পাকিস্তান সরকারের প্রতি তারা ছিল নতজানু। এই শ্রেণীটাই স্বাধীনতার পর মুক্তিযোদ্ধাদের গর্ব আর অহংকারকে মেনে নিতে পারেনি। ১৬ ডিসেম্বর তো তাদের একাংশ দেশ স্বাধীন হয়েছে দেখে মুক্তিযোদ্ধাদের কাতারে গিয়ে দাঁড়িয়ে গেছে, যারা ষোড়শ বাহিনী নামে খ্যাত। তাদের নেতৃত্বে চলেছে স্বাধীন দেশে লুটপাট আর হত্যাযজ্ঞ, কলঙ্কিত করা হয়েছে মুক্তিযোদ্ধাদের। আর যারা সেখানেও যেতে পারেন নি তাদের মধ্যে তৈরি হয়েছে হীনমন্যতা। এই হীনমন্যতা লুকাতে মুক্তিযোদ্ধাদের তারা সবসময় নানা কারণে প্রশ্নবিদ্ধ করেন, মুক্তিযোদ্ধাদের ইতিবাচক কোনো কিছু বা রাষ্ট্রীয় সুযোগ সুবিধাকে তারা মেনে নিতে পারেন না। তাদের সন্তানদের মাঝেও এই বিষ তারা বপন করে চলেছেন। মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে কেউ কেউ আবার ব্যবসা করেন, ক্ষমতায় টিকে থাকায় কৌশল হিসেবে অবলম্বন করেন। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদেরপ্রকৃত অবস্থা তুলে ধরার মতো কেউ নেই। মুক্তিযোদ্ধারা নিজেরা তো আর নিজেদের অবস্থান ব্যাখ্যা করার মানসিকতায় নেই। তাদের কী রাষ্ট্র প্রকৃতপক্ষে সহজ জীবন নিশ্চিত করতে পেরেছে? এখনও তারা কতটা সংকটময় জীবন অতিবাহিত করছেন তার খোঁজ কী রাষ্ট্র রাখে? মাস শেষে বিশ হাজার টাকার ভাতাকে যারা অনেক বড় করে দেখেন, সমালোচনায় মুখর হয়ে থাকেন একবার ভেবে দেখেছেন কী, আপনাদের আরাম আয়েশের বা ধান্দাবাজির জন্য যে দেশটাকে মুক্তিযোদ্ধারা স্বাধীন করেছেন তার বিপরীতে এই টাকাটা কী অনেক কিছু? এর বিপরীতে পাকিস্তানপন্থি ও সুবিধাবাদীরা দেশে চুরি, দুর্নীতি আর ঘুষখেয়ে যে হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ হাতিয়ে নিচ্ছে তা সম্পর্কে মেধাবীদের কোনো চেতনা আছে? চোখের সামনে ৩০% মুক্তিযোদ্ধা কোটা আর মাস শেষে বিশ হাজার টাকার ভাতা এ দুটো সুবিধা পুরো জাতির ঘৃণার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যারা হাজার হাজার কোটি টাকা লুট করছে তাদের বেলায় মেধাবীরা নীরব। বরং যেখানে লুটের সুবিধা বেশি সে স্থানের প্রতি আগ্রহও বেশি। যেই মেধা মানুষ, জাতি, রাষ্ট্রের স্বার্থে কাজে লাগে না, শুধু ব্যক্তিস্বার্থে সেই মেধার চর্চা ব্যক্তিকেই কতটা সুখ দিতে পারে? ঔপনিবেশিক প্রভুরা আমাদের যে শিক্ষায় শিক্ষিত করে গেছে তা হলো ব্যক্তি ভাবনা, শুধু নিজেকে নিয়ে ভাবা। আর তাদের দেখানো পথে আমরা হাটছি তাদের সংস্কৃতি উন্নত সংস্কৃতির আখ্যা দিয়ে। কিন্তু কলোনিয়াল দাসরা কখনো কলোনিয়াল প্রভুদের স্থান নিতে পারে না। হীনমন্যতাবোধ নিয়েই তাদের জীবন অতিবাহিত হয়। আর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি আজকের এই ঘৃণাও হীনমন্যতাবোধের অংশ।
মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধ করেছিলেন বাঙালি জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র (সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা) ও গণতন্ত্র এই চারটি নীতির ভিত্তিতে বাংলাদেশ গড়তে। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার সঙ্গে সঙ্গে হত্যা করা হয়েছে এই চার মূলনীতিকে। বর্তমান রাষ্ট্রে এই চার মূলনীতির একটিও বিদ্যমান নেই। তাই ‘মুক্তিযুদ্ধ’ এবং ‘মুক্তিযোদ্ধা’ দুটো শব্দই এখন খুব অপ্রাসঙ্গিক, আর ঘৃণাটাও সে কারণেই প্রাসঙ্গিক। জানি না মৃতরা শুনতে পান কি না, আমাদের দেখতে পান কি না। আমার বাবা পরকালে চলে গেছেন পনেরো বছর হলো, এরপরও আমি প্রতি মুহূর্তে অনুভব করি আমার বাবা আমায় দেখতে পান, আমায় শুনতে পান। যদি তাই হয় তাহলে শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা বর্তমান বাংলাদেশের মেধাবীদের মানসিকতা দেখে তারা কী অনুভব করছেন জানি না। কিন্তু যারা জীবিত আছেন তারা কী অনুভব করছেন? তাদেরকে আর কতটা অপমান করা হলে রাষ্ট্রের বোধদয় হবে এ বিষয়ে? এমনিতেই তো রাষ্ট্র ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের স্বীকৃতি দিয়ে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানে কুঠারাঘাত করেছে, তার ওপর বিভিন্ন সময় এই কোটা নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের অপমান করার কৌশল থেকে রাষ্ট্র তাদের মুক্তি দিচ্ছে না।
স্বাধীনতার ৫২ বছর পর সরকারি চাকুরিতে ৫৬% কোটা ব্যবস্থা থাকাটা অস্বাভাবিক। চারদিকে জীবনযাত্রার মূল্যবৃদ্ধি এবং অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে মানুষ আজ চরম হতাশাগ্রস্ত। শিক্ষক-ছাত্র কেউ আজ ক্লাসে নেই, সকলেই আন্দোলনে। দু’পক্ষের দাবিকেই রাষ্ট্রপক্ষ ‘অযৌক্তিক’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। আসলে রাষ্ট্র বধির হয়ে গেছে, নয়তো সমাজের পরিবর্তনটা তারা শুনেও না শোনার ভান করছে। আজ যে মেধাবী রাজপথে আন্দোলনরত তারা স্পষ্ট জানিয়েছে যে রাষ্ট্র ব্যবস্থা কিংবা আদালত কোনো কিছুর ওপর তাদের কোনো আস্থা নেই। রাষ্ট্রের অবস্থান কতটা তলানীতে পৌঁছেছে তা বোঝার চেষ্টা করুন। আজ যে মেধাবী রাস্তায় কাল সে প্রশাসক হবে। রাষ্ট্র ব্যবস্থায় তার আস্থা না থাকলে রাষ্ট্র চলবে কী করে? চলছে তো- সরকারও তো নির্ভর করছে প্রশাসনের ওপর। এখানে মেধাবীদের কোনো দোষ নেই। সিস্টেমটাই তাদের এ পথে চালিত করছে। রাষ্ট্রপক্ষের কাছে সবিনয় অনুরোধ আপনারা মুক্তিযোদ্ধাদের আর অপমানিত হওয়ার পথ তৈরি করে দেবেন না। আজ যে মেধাবীরা মুক্তিযোদ্ধা কোটার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে এটা একটা মাইন্ডসেট। সেখান থেকে তাদের সরানো যাবে না। চারদিকে আজ পাকিস্তানপন্থি আর সুবিধাবাদীদের অট্টহাসি শুনতে পাই, দেখতে পাই। দেশের সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্রের নেতৃত্বস্থানে, অন্যান্য বড় বড় পদগুলোতে বসে আসে তারা। মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের পরিবার কতটা যন্ত্রণা এই স্বাধীন দেশে ভোগ করেছে এবং করছে তা সম্পর্কে যদি আপনাদের এতটুকু জ্ঞান থাকে তাহলে বন্ধ করুন কোটা নামক এই প্রহসন। তাদেরকে অন্তত এইটুকু সম্মান দেখান। আপনারা বোঝার চেষ্টা করুন বাংলাদেশে জিতে গেছে পাকিস্তানপন্থিরা, সুবিধাবাদীরা এবং আপনারা তাদের হাত ধরে পাশাপাশি চলছেন। এই সেদিনই তো পিলাখানায় মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সন্তানদের টার্গেটে এনে একাত্তোরের অনুরূপভাবে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে। এটাই বাংলাদেশের বাস্তবতা, এটাই মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের পরিবারির প্রতি মেধাবী তথা আপনাদের দৃষ্টিভঙ্গি। মুক্তিযোদ্ধাদের স্বপ্নের বাংলাদেশ এটা না, বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা এটা না। তাই মুক্তিযোদ্ধাদের ‘মেধাবীরা’ ঘৃণাই জানাবে। যেই শাহবাগে আন্দোলন হয়েছে যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে সেই শাহবাগেই আন্দোলন হয়েছে মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারের সদস্যদের প্রাপ্ত সুবিধার বিরুদ্ধে। সমীকরণটা আপনারা বোঝেন কি না জানি না, আমরা বুঝি। মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান রক্ষার্থে, তাদের ও তাদের পরিবারের সদস্যদের মানসিকভাবে মুক্তি দিন। আপনারা সংস্কৃতির যেই হাইব্রিডিটিকে সমর্থন জানিয়েছেন এবং অগ্রসর করে নিচ্ছেন সেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের মূল্যবোধের স্থান নেই। তাদের মুক্তি দিন, ঘৃণার বিস্তার রোধ করুন।
ড. মুর্শিদা বিন্তে রহমান
অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান
ইতিহাস বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়