পলাশী
পলাশী-এই নাম করিতে ইংলণ্ডীয় নরনারীগণের কণ্ঠ মহানন্দে অবরুদ্ধ হইয়া আইসে, -এই নাম শ্রবণে বিরাট্ আটলান্টিকের নীল হৃদয়ে মহ। তুফানের সৃষ্টি হয়, ইহার প্রতিধ্বনিতে ব্রিটনের বায়ুস্তর কম্পিত হইয়া ইউরোপের অন্যান্য জাতির মনে আঘাত করিতে থাকে। পলাশী-এই অমর নাম ভারতবিজেতা ক্লাইবের উপাধির সহিত চির- বিজড়িত হইয়া আছে। • ইংরেজের গৌরব ভিত্তি ফোর্ট উইলিয়মের তোরণদ্বার পলাশী নাম মস্তকে বহন করিতেছে। পলাশী প্রান্তরের বিজয়- স্তম্ভে অক্ষয় অক্ষরে এই নাম ক্ষোদিত রহিয়াছে। পলাশী-আবার এই নামের স্মরণ করিতে সেই অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগের চিত্র আসিয়া মানসনেত্রের সম্মুখে উপস্থিত হয়!
সেই আলুলায়িতকেশা, স্নানকান্তি, চ্যুতকিরীটিনী মুসলমান-রাজলক্ষ্মীর ছবি মনে পড়ে- তাঁহার মুকুট হইতে একে একে সমস্ত রত্নগুলি বিচ্যুত হইয়া পড়িতেছে এবং উদীয়মান ভাস্করকান্তি আর একটি জ্যোতির্ময়ী রমণী সেই গুলি ধীরে ধীরে সংগ্রহ করিয়া স্বীয় মুকুটে বিভাস করিতেছেন। মনে পড়ে-পলাশীযুদ্ধের দিন বিশ্বাসঘাতকদিগের অধীনতায় সহস্র সহস্র নবাবসৈঞ্জ অর্দ্ধচন্দ্রাকারে বহুদূরব্যাপী প্রান্তর বেষ্টন করিয়া, চিত্রপুত্তলিকার ন্যায় দণ্ডায়মান রহি- য়াছে এবং নবাবের দুই এক জন বিশ্বাসী সেনাপতির রণকৌশলে ইংরেজসৈন্য আম্রকুঞ্জমধ্যে চিরবিশ্রাম লাভ করিবার জন্য বাধ্য হই- তেছে।
আবার হতভাগ্য চঞ্চলমতি চতুর্বিংশতিবর্ষবয়স্ক যুবক নবাব সেই বিরাট, বিশ্বাসঘাতকের পদতলে উষ্ণীষ রক্ষা করিয়া প্রাণ ভিক্ষা করিতেছেন। সঙ্গে সঙ্গে আম্রকুঞ্জ হইতে বহির্গত ইংরেজ সৈন্যগণের বিনাযুদ্ধে পলাশীবিজয়বার্তা এবং রোরুগ্মমান নবাবের যুদ্ধক্ষেত্র হইতে পলায়ন প্রভৃতিও মনে পড়িয়া যায়। নিদাঘশুল্কা ভাগীরথীর আকুলধ্বনি, মেঘাবরণে তপনের বদনাচ্ছাদন, এইরূপ আরও অনেক কথার স্মরণ হয়। অবশেষে মনে হয়, বাঙ্গলার সিংহাসন মুসলমানের নিকট হইতে স্খলিত হইয়া পড়িতেছিল, অমনি ইংরেজ অগ্রসর হইয়া বাহু প্রসারণ পূর্ব্বক তাহা ধরিয়া ফেলিল! ফরাসী ও অন্যান্য ইউরোপীয় জাতি অবাক্ হইয়া চাহিয়া রহিল! এই পলাশী নামের সহিত কত স্মৃতি ও কত কথা যে জড়িত রহিয়াছে, কে তাহার ইয়ত্তা করিবে?
পলাশী প্রান্তরে বাঙ্গলার অথবা সমগ্র ভারতবর্ষের ভাগ্যপরিবর্তন ঘটে। এই স্থানে মুসল্যান-ভাগ্য-চন্দ্রমা অস্তমিত ও ব্রিটিশ গৌরব- সূর্য্যের অভ্যুদয় হয়। যে শক্তি ধীরে ধীরে দক্ষিণাপথের পূর্ব্বসাগরতীরে আপনার বিস্ময়করী ক্রীড়া দেখাইতেছিল, পলাশীপ্রান্তরে সেই শক্তি আসিয়া কেন্দ্রস্থ হয়। অবশেষে তাহার প্রবল প্রবাহে সমগ্র বঙ্গরাজ্য প্লাবিত হইয়া আসমুদ্র হিমালয় ভারতবর্ষ ভাসিতে থাকে। পলাশী- প্রান্তরে যে কেবল মুসলমান রাজলক্ষ্মী মুচ্ছিতা হইয়া পড়িয়াছিলেন, এমন নহে; ভারতে তৎকালে আবার যে হিন্দু রাজরাজেশ্বরী মূর্তির অস্ফুট ছায়া ধীরে ধীরে বিকাশ পাইতেছিল, তাহাও অবশেষে প্রকৃত ছায়াতেই পৰ্য্যবসিত হইয়া যায়! ভারতে ব্রিটিশ ক্ষমতা সুদৃঢ় হওয়ায়, মহারষ্ট্রীয় শক্তি চূর্ণ বিচূর্ণ হইয়া পড়ে।
Leave a Reply