শ্রী নিখিলনাথ রায়
ক্রমে ক্রমে মৃত্যুর করাল ছায়া আলিবদ্দীকে অভিভূত করিয়া ফেলিল। তিনি ১১৬৯ হিজরীর ৯ই রজব তারিখে (১৭৫৬ খৃঃ অব্দের ৯ই এপ্রেল) চিরদিনের জন্য চক্ষু মুদিত করিলেন। বাঙ্গলার আদর্শ নবাব হিন্দুর পরম মিত্র, মহারাষ্ট্রীয় ও আফগানদিগের দর্পচূর্ণকারী, মহামহিমান্বিত আলিবন্দী খাঁ মহবংজঙ্গ অনন্তকালের জন্য মর্ত্যধাম পরিত্যাগ করিয়া, কোন্ অজ্ঞাত প্রদেশে চলিয়া গেলেন। তাঁহার অবসানে মুসলমান রাজলক্ষ্মীর কিরীট শিথিল হইতে আরম্ভ হইল এবং ইংরেজ রাজলক্ষ্মীর জ্যোতিঃ সহসা ভারতাকাশে বিকীর্ণ হইয়া পড়িল।
অনেক দিন হইতে ইংরেজেরা স্বর্ণপ্রসবিনী ভারতভূমির প্রতি যে আশায় সতৃষ্ণনয়নে দৃষ্টিপাত করিতেছিলেন, এতদিনে সে আশা ফলবতী হইতে চলিল। হতভাগ্য সিরাজ বুঝিতে পারিলেন না যে, তাঁহার ভাগ্যাকাশ: ঘোর অন্ধকারময় হইয়া উঠিতেছে! আলিবর্দ্দদীর মৃত্যুতে সমস্ত :বঙ্গরাজ্যের প্রজারা হাহাকার করিতে লাগিল; মহারাষ্ট্রীয় ও আফগান দস্যুভয়ে তাহাদের হৃদয় কম্পিত হইয়া উঠিল, সমগ্র বঙ্গরাজ্যে যেন কেমন একটা বিবাদের ছায়া ঘনীভূত হইতে লাগিল।
নবাবের মৃত্যুর অব্যবহিত পরে, তাঁহার আত্মীয় স্বজন ও অনুচরবর্গ সমবেত হইয়া, তাঁহার মৃতদেহ পবিত্রীকৃত করার পর, বস্ত্রদ্বারা আচ্ছাদিত করিয়া, রাত্রির অন্ধকার খাকিতে থাকিতে খোশবাগের সমাধিকাননে তাঁহার মাতার পদতলে আনিয়া উপস্থিত করে; পরে তথা হইতে যথাস্থানে সমাহিত করা হয়।আলিবদ্দীর সমাধির অব্যবহিত পূর্ব্বভাগে তাঁহার প্রিয়তম দৌহিত্র বাঙ্গালীর সুপরিচিত, নবাব সিরাজউদ্দৌলা শারিত রহিয়াছেন। তাঁহার বর্তমান সমাধি একরূপ মাটির সহিত মিশিয়াই আছে। তাহার উপর কোন প্রস্তরখণ্ড নাই, কেবল বিলাতী মৃত্তিকা দ্বারা তাহা লেপিত হইয়াছে।
সিরাজের শোচনীয় মৃত্যুর কথা বিশেষ করিয়া বলিবার প্রয়োজন নাই; কারণ বঙ্গবাসী মাত্রেই তাহা সবিশেষ অবগত আছেন। তথাপি সে সম্বন্ধে দুই চারিটি কথা বলা যাইতেছে।পলাশীযুদ্ধে পরাজিত হইয়া সিরাজ, বেগম লুৎফ উন্নেসার সহিত মুর্শিদাবাদ হইতে পলায়ন করেন এবং রাজমহলের নিকট ধৃত হইয়া পুন- রায় মুর্শিদাবাদে আনীত হন। তাহার পর হিজরী ১১৭০ অব্দের ১৫ই শওয়াল (১৭৫৭ খৃঃ অব্দের ৩রা জুলাই) তাঁহার শোচনীয় হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়।