১০:২৮ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৫
টেকনাফে পাহাড়ি জমি থেকে চাকমা যুবক অপহরণ মেটার ‘বিশ্বস্ত’ সংস্থার সহায়তায় আমি নিজেই একটি প্রতারণামূলক বিজ্ঞাপন চালিয়েছি কক্সবাজারে পর্যটকের চাপ, সেবা ব্যবস্থায় চাপ বাড়ছে রাজবংশের হাতে গড়া লিংইন মন্দির শুধু দর্শনের জন্য জন্য নয় সরাসরি ইতিহাস পাঠ বন্য প্রাণীর চলাচলে জীবনরেখা ক্যানোপি সেতু, সুনগাই পিনে নতুন আশার গল্প ঘূর্ণিঝড় দিত্বাহর ধ্বংসযজ্ঞের পর শ্রীলঙ্কার পাশে বিশ্বব্যাংক গ্রুপ চীনা ঐতিহ্যেই ব্র্যান্ডের নতুন গল্প, বদলাচ্ছে বিপণনের ভাষা দুর্যোগের আগেই পাশে দাঁড়ায় যে মানবতার শক্তি, মালয়েশিয়ায় ইউনাইটেড শিখসের নীরব সেবা থাইল্যান্ড-কাম্বোডিয়া সীমান্তে উত্তেজনা থামাতে কুয়ালালামপুর বৈঠকের দিকে তাকিয়ে জাপানের পারমাণবিক প্রত্যাবর্তন ফুকুশিমার পনেরো বছর পর আবার চালু হচ্ছে বিশ্বের বৃহত্তম কেন্দ্র

দিবারাত্রির কাব্য: মানিক বন্দোপধ্যায় ( ১২ তম কিস্তি )

  • Sarakhon Report
  • ১২:০০:০১ অপরাহ্ন, বুধবার, ২০ মার্চ ২০২৪
  • 64

রবীন্দ্রনাথ পরবর্তী সময়ে বাংলা সাহিত্যে আরেকটি নতুন যুগ সৃষ্টি হয়েছিলো। ভাষাকে মানুষের মুখের ভাষার কাছে নিয়ে আসা নয়, সাহিত্যে’র বিষয়ও হয়েছিলো অনেক বিস্তৃত। সাহিত্যে উঠে এসেছিলো পরিবর্তিত মন ও সমাজের নানান প্রাঙ্গন। সময়ের পথ ধরে সে যুগটি এখন নিকট অতীত। আর সে সাহিত্যও চিরায়ত সাহিত্য। দূর অতীত ও নিকট অতীতের সকল চিরায়ত সাহিত্য মানুষকে সব সময়ই পরিপূর্ণ মানুষ হতে সাহায্য করে। চিরায়ত সাহিত্যকে জানা ছাড়া বাস্তবে মানুষ তার নিজেকে সম্পূর্ণ জানতে পারে না।

সারাক্ষণের চিরায়ত সাহিত্য বিভাগে এবারে থাকছে মানিক বন্দোপধ্যায়ের দিবারাত্রির কাব্য।

দিবারাত্রির কাব্যে’র ভূমিকায় মানিক বন্দোপধ্যায় নিজেই যা লিখেছিলেন …..

দিবারাত্রির কাব্য আমার একুশ বছর বয়সের রচনা। শুধু প্রেমকে ভিত্তি করে বই লেখার সাহস ওই বয়সেই থাকে। কয়েক বছর তাকে তোলা ছিল। অনেক পরিবর্তন করে গত বছর বঙ্গশ্রীতে প্রকাশ করি।

দিবারাত্রির কাব্য পড়তে বসে যদি কখনো মনে হয় বইখানা খাপছাড়া, অস্বাভাবিক,- তখন মনে রাখতে হবে এটি গল্পও নয় উপন্যাসও নয়, রূপক কাহিনী। রূপকের এ একটা নূতন রূপ। একটু চিন্তা করলেই বোঝা যাবে বাস্তব জগতের সঙ্গে সম্পর্ক দিয়ে সীমাবদ্ধ করে নিলে মানুষের কতগুলি অনুভূতি যা দাঁড়ায়, সেইগুলিকেই মানুষের রূপ দেওয়া হয়েছে। চরিত্রগুলি কেউ মানুষ নয়, মানুষের Projection-মানুষের এক এক টুকরো মানসিক অংশ।

দিবা রাত্রির কাব্য

মানিক বন্দোপাধ্যায়

 

অবান্তর কথা বেশীক্ষণ চলে না। আনন্দই প্রথমে আলাপকে তাদের স্তরে নামিয়ে আনল।

 

‘বাবা বললেন, আপনি কলেজে পড়ান। আপনি খুব পড়াশোনা করেন বুঝি?’

 

‘না। পড়া হল পরের ভাবনা ভাবা। তার চেয়ে নিজের ভাবনা ভাবতেই আমার ভাল লাগে। তুমি বুঝি বাবার কাছে আমার কথা সব জেনে নিয়েছ?’

 

‘সব। শুধু বাবার কাছে জানিনি, মা জল দিতে ডাকা পর্যন্ত ওই জানালায় দাঁড়িয়ে মা’র সঙ্গে আপনার যত কথা হয়েছে সব শুনে ফেলেছি।’

 

আনন্দ চোখ তুলল। কিন্তু এখনো সে হেরম্বের দিকে তাকাতে পারছে না।

 

‘শুনে কি মনে হল?’

 

আনন্দ হঠাৎ জবাব দিল না। নিষ্ঠুরের মতো স্ত্রীর কথা বললেন। তারপর সঙ্কোচের সঙ্গে বলল, ‘মনে হল খুব আপনার স্ত্রী কতদিন মারা গেছেন?’ হেরম্ব বলল, ‘অনেক দিন। প্রায় দেড়বছর।’

 

আনন্দ হেরম্বের জামার বোতামের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘অনেক দিন বললেন যে? দেড়বছর কি অনেক দিন?’

 

হেরম্ব বলল, ‘অনেক দিন বই কি। দেড়বছরে ক’বার সূর্য ওঠে কত

 

লোক জন্মায়, কত লোক মরে যায় খবর রাখ?’

 

আনন্দ মনে মনে একটু হিসাব করে বলল, ‘দেড়বছরে সূর্য ওঠে পাঁচশো সাতচল্লিশ বার। লোক জন্মায় কত? কত লোক মরে যায়?’

 

হেরম্ব হেসে বলল, পনের কুড়ি লাখ হবে।’

 

আনন্দও তার-চোখের দিকে চেয়ে হেসে বলল, ‘মোটে? আমি ভাবছিলাম একবছরে পৃথিবীতে বুঝি কোটি কোটি লোক জন্মায়। মা’র কাছে রোজ যে সব মেয়ে ভক্ত আসে তাদের সকলেরই বুকে একটি, কাঁখে একটি, হাত-ধরা একটি, এমনি গাদা গাদা ছেলেমেয়ে দেখি কিনা, তাই মনে হয়। পৃথিবীতে রোজ বুঝি অগুনতি ছেলেমেয়ে জন্মাচ্ছে। কিন্তু দেড়বছরে আর

 

যাই হোক, মানুষ কি বদলাতে পারে?’

 

‘পারে। এক মিনিটে পারে।’ হেরম্ব জোর দিয়ে বলল।

 

আনন্দ একটু লাল হয়ে বলল, ‘আপনার স্ত্রীর কথা ভেবে বলিনি। এমনি সাধারণভাবে বলেছি।’

 

দেড়বছরে মানুষ বদলাতে পারে কিনা প্রশ্ন করে তার মনে স্ত্রীর শোকটা কতখানি বর্তমান আছে আনব্দ তাই মাপতে চেয়েছিল হেরম্ব একথা বিশ্বাস করেনি। সে জেনেছে আনন্দের হৃদয়ে মানুষের সহজ অনুভূতিগুলি সহজ হয়েই আছে। মৃতা স্ত্রীকে কেউ ভুলে গেছে শুনলে খুশী হবার মতো হিংস্র আনন্দ নয়।

 

কিন্তু আনন্দকে মিথ্যা কথা শোনানোও হেরম্বর পক্ষে অসম্ভব।

 

‘আমার স্ত্রীর কথা ভেবে বললেও দোষ হত না আনন্দ। সংসারে কত পরিচিত লোক, কত আত্মীয় থাকে, যারা হঠাৎ আমাদের ছেড়ে চলে যায়। বেঁচে থাকবার সময় আমাদের কাছে তাদের যতটুকু দাম ছিল, মরে যাবার পর কেবল কাছে নেই বলেই তাদের সে দাম বাড়িয়ে দেওয়া উচিত নয়। দিলে মরণকে আমরা ভয় করতে আরম্ভ করব। আমাদের জীবনে মৃত্যুর ছায়া পড়বে। আমরা দুর্বল অসুস্থ হয়ে পড়ব।’

 

‘কিন্তু’ বলে আনন্দ চুপ করে গেল।

 

হেরম্ব বলল, ‘তুমি যা খুশী বলতে পার আনন্দ, কোন বাধা নেই।’

 

‘কথাগুলির মধ্যে আপনার স্ত্রী এসে পড়ছেন বলে সঙ্কোচ হচ্ছে। যাই হোক, বলি। মনের কথা চেপে রাখতে আমার বিশ্রী লাগে। আমার মনে হচ্ছে আপনার কথা ঠিক নয়। ভালবাসা থাকলে শোক হবেই। শোক মিথ্যে হলে ভালবাসাও মিথ্যে।’

 

হেরম্ব খুশী হল। প্রতিবাদ তার ভাল লাগে। প্রতিবাদ খণ্ডন করা যেন একটা জয়ের মতো।

 

‘ভালবাসা থাকলে শোক হয় আনন্দ। কিন্তু ভালবাসা কত দিনের? কতকাল স্থায়ী হয় ভালবাসা? প্রেম অসহ্য প্রাণঘাতী যন্ত্রণার ব্যাপার। প্রেম চিরকাল টিকলে মানুষকে আর টিকতে হত না। প্রেমের জন্ম আর মৃত্যুর ব্যবধান বেশী নয়। প্রেম যখন বেঁচে আছে তখন দু’জনের মধ্যে একজন মরে গেলে শোক হয়-অক্ষয় শোক হয়। প্রেমের অকালমৃত্যু নেই বলে শোকের মধ্যে প্রেম চিরন্তন হয়ে যায়। কিন্তু প্রেম যখন মরে গেছে, যখন আছে শুধু মায়া, অভ্যাস আর আত্মসান্ত্বনার খেলা, তখন যদি দু’জনের একজন মরে যায় বেশীদিন শোক হওয়া অসুস্থ মনের লক্ষণ। সেটা দুর্বলতা, আনন্দ। তুমি রোমিও জুলিয়েটের গল্প জান?’

 

‘জানি। বাবার কাছে শুনেছি।’

 

‘প্রেমের মৃত্যু হবার আগেই ওরা মরে গিয়েছিল। একসঙ্গে দু’জনে মরে না গিয়ে ওদের মধ্যে একজন যদি বেঁচে থাকত তার শোক কখনও শেষ হত না। কিন্তু কিছুকাল বেঁচে থেকে ক্রমে ক্রমে ভালবাসা মরে যাওয়ার পর ওদের মধ্যে একজন যদি স্বর্গে যেত, পৃথিবীতে যে থাকত চিরকাল তার শোকাতুর হয়ে থাকার কোন কারণ থাকত না। একটা ব্যাপার তুমি লক্ষ্য করেছ আনন্দ? রোমিও জুলিয়েটের ট্রাজেডি তাদের মৃত্যুতে নয়?’

 

‘কিসে তবে?’

 

‘ওদের প্রেমের অসমাপ্তিতে। রোমিও জুলিয়েটের কোন দাম মানুষের কাছে নেই। জগতের লক্ষ লক্ষ রোমিও জুলিয়েট মরে যাক, কিছু এসে যায় না। কিন্তু ওভাবে ভাল বাসতে বাসতে ওরা মরল কেন ভেবেই আমাদের চোখে জল আসে।’

 

আনন্দ আনমনে বলল, ‘তাই কি? তা হবে বোধহয়।’

 

হেরম্ব জোর দিয়ে বলল, ‘হবে বোধহয় নয়, তাই। ওদের অসম্পূর্ণ প্রেমকে আমরা মনে মনে সম্পূর্ণ করবার চেষ্টা করে ব্যথা পাই-রোমিও জুলিয়েটের ট্রাজেডি তাই। নইলে, ওদের জীবনে ট্রাজেডি কোথায়? ওরা দু’জনেই মরে গিয়ে সব কিছুরই অতীত হয়ে গেল-ওদের জীবনে দুঃখ সৃষ্টি হবার সুযোগও ছিল না। আমরা সমবেদনা দেব কাকে? কিসের জোরে রোমিও জুলিয়েট আমাদের একফোঁটা অশ্রু দাবি করবে? ওরা তো দুঃখ পায়নি। প্রেমের পরিপূর্ণ বিকাশের সময় ওরা দুঃখকে এড়িয়ে চলে গেছে। আমরা ওদের প্রেমের জন্য শোক করি, ওদের জন্য নয়।’

 

আনন্দ বলল, ‘প্রেম কতদিন বাঁচে?’ হেরম্ব হেসে বলল, ‘কি করে বলব আনন্দ। দিন গুণে বলা যায় না। তবে বেশীদিন নয়। এক দিন, এক সপ্তাহ, বড়জোর এক মাস।’

 

শুনে আনন্দ যেন ভীতা হয়ে উঠল।

 

‘মোটে।’

 

হেরম্ব আবার হেসে বলল, ‘মোটে হল? একমাসের বেশী প্রেম কারো সহ্য হয়? মরে যাবে আনন্দ-একমাসের বেশী হৃদয়ে প্রেমকে পুষে রাখতে হলে মানুষ মরে যাবে। মানুষ একদিন কি দু’দিন মাতাল হয়ে থাকতে পারে। জলের সঙ্গে মদের যে সম্পর্ক মদের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক তাই-প্রেম এত তেজী নেশা।’

 

আনন্দ হঠাৎ কথা খুঁজে পেল না। মুখ থেকে সে চুলগুলি পিছনে ঠেলে দিল। ডান হাতের ছোট আঙুলটির ডগা দাঁতে কামড়ে ধরে এক পায়ের আঙুল দিয়ে অন্য পায়ের নখ থেকে ধুলো মুছে দিতে লাগল। তার মনে প্রবল আঘাত লেগেছে বুঝে হেরম্ব দুঃখ বোধ করল। দিয়ে তার উপায় ছিল না। আনন্দের কাছে সত্য কিন্তু এ আঘাত না গোপন করার ক্ষমতা তার নেই। তাছাড়া, প্রেম চিরকাল বাঁচে কোনদিন কোন অবস্থাতে কোন মানুষকেই এ শিক্ষা দিতে নেই। হেরম্ব বিশ্বাস করে পৃথিবী থেকে যত

 

তাড়াতাড়ি এ বিশ্বাস দূর হয়ে যায় ততই মঙ্গল। আনন্দ হঠাৎ জিজ্ঞাসা করল, ‘প্রেম মরে গেলে কি থাকে?’

 

‘প্রেম ছাড়া আর সব থাকে। সুখে শান্তিতে ঘরকন্না করবার জন্য যা যা দরকার। তাছাড়া খোকা অথবা খুকী থাকে-আরও একটা প্রেমের সম্ভাবনা। ওরা তুচ্ছ নয়।’

জনপ্রিয় সংবাদ

টেকনাফে পাহাড়ি জমি থেকে চাকমা যুবক অপহরণ

দিবারাত্রির কাব্য: মানিক বন্দোপধ্যায় ( ১২ তম কিস্তি )

১২:০০:০১ অপরাহ্ন, বুধবার, ২০ মার্চ ২০২৪

রবীন্দ্রনাথ পরবর্তী সময়ে বাংলা সাহিত্যে আরেকটি নতুন যুগ সৃষ্টি হয়েছিলো। ভাষাকে মানুষের মুখের ভাষার কাছে নিয়ে আসা নয়, সাহিত্যে’র বিষয়ও হয়েছিলো অনেক বিস্তৃত। সাহিত্যে উঠে এসেছিলো পরিবর্তিত মন ও সমাজের নানান প্রাঙ্গন। সময়ের পথ ধরে সে যুগটি এখন নিকট অতীত। আর সে সাহিত্যও চিরায়ত সাহিত্য। দূর অতীত ও নিকট অতীতের সকল চিরায়ত সাহিত্য মানুষকে সব সময়ই পরিপূর্ণ মানুষ হতে সাহায্য করে। চিরায়ত সাহিত্যকে জানা ছাড়া বাস্তবে মানুষ তার নিজেকে সম্পূর্ণ জানতে পারে না।

সারাক্ষণের চিরায়ত সাহিত্য বিভাগে এবারে থাকছে মানিক বন্দোপধ্যায়ের দিবারাত্রির কাব্য।

দিবারাত্রির কাব্যে’র ভূমিকায় মানিক বন্দোপধ্যায় নিজেই যা লিখেছিলেন …..

দিবারাত্রির কাব্য আমার একুশ বছর বয়সের রচনা। শুধু প্রেমকে ভিত্তি করে বই লেখার সাহস ওই বয়সেই থাকে। কয়েক বছর তাকে তোলা ছিল। অনেক পরিবর্তন করে গত বছর বঙ্গশ্রীতে প্রকাশ করি।

দিবারাত্রির কাব্য পড়তে বসে যদি কখনো মনে হয় বইখানা খাপছাড়া, অস্বাভাবিক,- তখন মনে রাখতে হবে এটি গল্পও নয় উপন্যাসও নয়, রূপক কাহিনী। রূপকের এ একটা নূতন রূপ। একটু চিন্তা করলেই বোঝা যাবে বাস্তব জগতের সঙ্গে সম্পর্ক দিয়ে সীমাবদ্ধ করে নিলে মানুষের কতগুলি অনুভূতি যা দাঁড়ায়, সেইগুলিকেই মানুষের রূপ দেওয়া হয়েছে। চরিত্রগুলি কেউ মানুষ নয়, মানুষের Projection-মানুষের এক এক টুকরো মানসিক অংশ।

দিবা রাত্রির কাব্য

মানিক বন্দোপাধ্যায়

 

অবান্তর কথা বেশীক্ষণ চলে না। আনন্দই প্রথমে আলাপকে তাদের স্তরে নামিয়ে আনল।

 

‘বাবা বললেন, আপনি কলেজে পড়ান। আপনি খুব পড়াশোনা করেন বুঝি?’

 

‘না। পড়া হল পরের ভাবনা ভাবা। তার চেয়ে নিজের ভাবনা ভাবতেই আমার ভাল লাগে। তুমি বুঝি বাবার কাছে আমার কথা সব জেনে নিয়েছ?’

 

‘সব। শুধু বাবার কাছে জানিনি, মা জল দিতে ডাকা পর্যন্ত ওই জানালায় দাঁড়িয়ে মা’র সঙ্গে আপনার যত কথা হয়েছে সব শুনে ফেলেছি।’

 

আনন্দ চোখ তুলল। কিন্তু এখনো সে হেরম্বের দিকে তাকাতে পারছে না।

 

‘শুনে কি মনে হল?’

 

আনন্দ হঠাৎ জবাব দিল না। নিষ্ঠুরের মতো স্ত্রীর কথা বললেন। তারপর সঙ্কোচের সঙ্গে বলল, ‘মনে হল খুব আপনার স্ত্রী কতদিন মারা গেছেন?’ হেরম্ব বলল, ‘অনেক দিন। প্রায় দেড়বছর।’

 

আনন্দ হেরম্বের জামার বোতামের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘অনেক দিন বললেন যে? দেড়বছর কি অনেক দিন?’

 

হেরম্ব বলল, ‘অনেক দিন বই কি। দেড়বছরে ক’বার সূর্য ওঠে কত

 

লোক জন্মায়, কত লোক মরে যায় খবর রাখ?’

 

আনন্দ মনে মনে একটু হিসাব করে বলল, ‘দেড়বছরে সূর্য ওঠে পাঁচশো সাতচল্লিশ বার। লোক জন্মায় কত? কত লোক মরে যায়?’

 

হেরম্ব হেসে বলল, পনের কুড়ি লাখ হবে।’

 

আনন্দও তার-চোখের দিকে চেয়ে হেসে বলল, ‘মোটে? আমি ভাবছিলাম একবছরে পৃথিবীতে বুঝি কোটি কোটি লোক জন্মায়। মা’র কাছে রোজ যে সব মেয়ে ভক্ত আসে তাদের সকলেরই বুকে একটি, কাঁখে একটি, হাত-ধরা একটি, এমনি গাদা গাদা ছেলেমেয়ে দেখি কিনা, তাই মনে হয়। পৃথিবীতে রোজ বুঝি অগুনতি ছেলেমেয়ে জন্মাচ্ছে। কিন্তু দেড়বছরে আর

 

যাই হোক, মানুষ কি বদলাতে পারে?’

 

‘পারে। এক মিনিটে পারে।’ হেরম্ব জোর দিয়ে বলল।

 

আনন্দ একটু লাল হয়ে বলল, ‘আপনার স্ত্রীর কথা ভেবে বলিনি। এমনি সাধারণভাবে বলেছি।’

 

দেড়বছরে মানুষ বদলাতে পারে কিনা প্রশ্ন করে তার মনে স্ত্রীর শোকটা কতখানি বর্তমান আছে আনব্দ তাই মাপতে চেয়েছিল হেরম্ব একথা বিশ্বাস করেনি। সে জেনেছে আনন্দের হৃদয়ে মানুষের সহজ অনুভূতিগুলি সহজ হয়েই আছে। মৃতা স্ত্রীকে কেউ ভুলে গেছে শুনলে খুশী হবার মতো হিংস্র আনন্দ নয়।

 

কিন্তু আনন্দকে মিথ্যা কথা শোনানোও হেরম্বর পক্ষে অসম্ভব।

 

‘আমার স্ত্রীর কথা ভেবে বললেও দোষ হত না আনন্দ। সংসারে কত পরিচিত লোক, কত আত্মীয় থাকে, যারা হঠাৎ আমাদের ছেড়ে চলে যায়। বেঁচে থাকবার সময় আমাদের কাছে তাদের যতটুকু দাম ছিল, মরে যাবার পর কেবল কাছে নেই বলেই তাদের সে দাম বাড়িয়ে দেওয়া উচিত নয়। দিলে মরণকে আমরা ভয় করতে আরম্ভ করব। আমাদের জীবনে মৃত্যুর ছায়া পড়বে। আমরা দুর্বল অসুস্থ হয়ে পড়ব।’

 

‘কিন্তু’ বলে আনন্দ চুপ করে গেল।

 

হেরম্ব বলল, ‘তুমি যা খুশী বলতে পার আনন্দ, কোন বাধা নেই।’

 

‘কথাগুলির মধ্যে আপনার স্ত্রী এসে পড়ছেন বলে সঙ্কোচ হচ্ছে। যাই হোক, বলি। মনের কথা চেপে রাখতে আমার বিশ্রী লাগে। আমার মনে হচ্ছে আপনার কথা ঠিক নয়। ভালবাসা থাকলে শোক হবেই। শোক মিথ্যে হলে ভালবাসাও মিথ্যে।’

 

হেরম্ব খুশী হল। প্রতিবাদ তার ভাল লাগে। প্রতিবাদ খণ্ডন করা যেন একটা জয়ের মতো।

 

‘ভালবাসা থাকলে শোক হয় আনন্দ। কিন্তু ভালবাসা কত দিনের? কতকাল স্থায়ী হয় ভালবাসা? প্রেম অসহ্য প্রাণঘাতী যন্ত্রণার ব্যাপার। প্রেম চিরকাল টিকলে মানুষকে আর টিকতে হত না। প্রেমের জন্ম আর মৃত্যুর ব্যবধান বেশী নয়। প্রেম যখন বেঁচে আছে তখন দু’জনের মধ্যে একজন মরে গেলে শোক হয়-অক্ষয় শোক হয়। প্রেমের অকালমৃত্যু নেই বলে শোকের মধ্যে প্রেম চিরন্তন হয়ে যায়। কিন্তু প্রেম যখন মরে গেছে, যখন আছে শুধু মায়া, অভ্যাস আর আত্মসান্ত্বনার খেলা, তখন যদি দু’জনের একজন মরে যায় বেশীদিন শোক হওয়া অসুস্থ মনের লক্ষণ। সেটা দুর্বলতা, আনন্দ। তুমি রোমিও জুলিয়েটের গল্প জান?’

 

‘জানি। বাবার কাছে শুনেছি।’

 

‘প্রেমের মৃত্যু হবার আগেই ওরা মরে গিয়েছিল। একসঙ্গে দু’জনে মরে না গিয়ে ওদের মধ্যে একজন যদি বেঁচে থাকত তার শোক কখনও শেষ হত না। কিন্তু কিছুকাল বেঁচে থেকে ক্রমে ক্রমে ভালবাসা মরে যাওয়ার পর ওদের মধ্যে একজন যদি স্বর্গে যেত, পৃথিবীতে যে থাকত চিরকাল তার শোকাতুর হয়ে থাকার কোন কারণ থাকত না। একটা ব্যাপার তুমি লক্ষ্য করেছ আনন্দ? রোমিও জুলিয়েটের ট্রাজেডি তাদের মৃত্যুতে নয়?’

 

‘কিসে তবে?’

 

‘ওদের প্রেমের অসমাপ্তিতে। রোমিও জুলিয়েটের কোন দাম মানুষের কাছে নেই। জগতের লক্ষ লক্ষ রোমিও জুলিয়েট মরে যাক, কিছু এসে যায় না। কিন্তু ওভাবে ভাল বাসতে বাসতে ওরা মরল কেন ভেবেই আমাদের চোখে জল আসে।’

 

আনন্দ আনমনে বলল, ‘তাই কি? তা হবে বোধহয়।’

 

হেরম্ব জোর দিয়ে বলল, ‘হবে বোধহয় নয়, তাই। ওদের অসম্পূর্ণ প্রেমকে আমরা মনে মনে সম্পূর্ণ করবার চেষ্টা করে ব্যথা পাই-রোমিও জুলিয়েটের ট্রাজেডি তাই। নইলে, ওদের জীবনে ট্রাজেডি কোথায়? ওরা দু’জনেই মরে গিয়ে সব কিছুরই অতীত হয়ে গেল-ওদের জীবনে দুঃখ সৃষ্টি হবার সুযোগও ছিল না। আমরা সমবেদনা দেব কাকে? কিসের জোরে রোমিও জুলিয়েট আমাদের একফোঁটা অশ্রু দাবি করবে? ওরা তো দুঃখ পায়নি। প্রেমের পরিপূর্ণ বিকাশের সময় ওরা দুঃখকে এড়িয়ে চলে গেছে। আমরা ওদের প্রেমের জন্য শোক করি, ওদের জন্য নয়।’

 

আনন্দ বলল, ‘প্রেম কতদিন বাঁচে?’ হেরম্ব হেসে বলল, ‘কি করে বলব আনন্দ। দিন গুণে বলা যায় না। তবে বেশীদিন নয়। এক দিন, এক সপ্তাহ, বড়জোর এক মাস।’

 

শুনে আনন্দ যেন ভীতা হয়ে উঠল।

 

‘মোটে।’

 

হেরম্ব আবার হেসে বলল, ‘মোটে হল? একমাসের বেশী প্রেম কারো সহ্য হয়? মরে যাবে আনন্দ-একমাসের বেশী হৃদয়ে প্রেমকে পুষে রাখতে হলে মানুষ মরে যাবে। মানুষ একদিন কি দু’দিন মাতাল হয়ে থাকতে পারে। জলের সঙ্গে মদের যে সম্পর্ক মদের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক তাই-প্রেম এত তেজী নেশা।’

 

আনন্দ হঠাৎ কথা খুঁজে পেল না। মুখ থেকে সে চুলগুলি পিছনে ঠেলে দিল। ডান হাতের ছোট আঙুলটির ডগা দাঁতে কামড়ে ধরে এক পায়ের আঙুল দিয়ে অন্য পায়ের নখ থেকে ধুলো মুছে দিতে লাগল। তার মনে প্রবল আঘাত লেগেছে বুঝে হেরম্ব দুঃখ বোধ করল। দিয়ে তার উপায় ছিল না। আনন্দের কাছে সত্য কিন্তু এ আঘাত না গোপন করার ক্ষমতা তার নেই। তাছাড়া, প্রেম চিরকাল বাঁচে কোনদিন কোন অবস্থাতে কোন মানুষকেই এ শিক্ষা দিতে নেই। হেরম্ব বিশ্বাস করে পৃথিবী থেকে যত

 

তাড়াতাড়ি এ বিশ্বাস দূর হয়ে যায় ততই মঙ্গল। আনন্দ হঠাৎ জিজ্ঞাসা করল, ‘প্রেম মরে গেলে কি থাকে?’

 

‘প্রেম ছাড়া আর সব থাকে। সুখে শান্তিতে ঘরকন্না করবার জন্য যা যা দরকার। তাছাড়া খোকা অথবা খুকী থাকে-আরও একটা প্রেমের সম্ভাবনা। ওরা তুচ্ছ নয়।’