০১:১৭ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৯ জুন ২০২৫

হ্যালিবার্টন: সভ্যতা হত্যাকারী যুদ্ধদানব

  • Sarakhon Report
  • ০৮:০০:২০ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ৫ অক্টোবর ২০২৪
  • 14

মোহাম্মদ মাহমুদুজ্জামান

২০০৮ সালের আমেরিকান নির্বাচনের মাত্র কিছুদিন আগে মুক্তি পায় ডাবলিউ. নামের একটি মুভি। পুরো মুভিটি তৈরি করা হয়েছে আমেরিকার সে সময়ের প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশকে নিয়ে। একজন মদ্যপ, জুয়ারি এবং অকর্মা ব্যক্তির প্রেসিডেন্ট হওয়া, তার ব্যর্থতা ও অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে অন্যের সুবিধা আদায় করে নেয়া এবং বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী দেশের সর্বোচ্চ প্রশাসন কেন্দ্র কতোটা হাস্যকরভাবে পরিচালিত হয় তার চমৎকার চিত্ররূপ ডাবলিউ.।

হিটলারের বিরুদ্ধে মুভি তৈরি করে বিখ্যাত অভিনেতা ও নির্মাতা চার্লি চ্যাপলিন হুমকির মুখে পড়েছিলেন। তারপরও তিনি ঝুঁকি নিয়েছেন। আমেরিকার জনপ্রিয় পরিচালক অলিভার স্টোন ১২ মে ২০০৮-এ তার ডাবলিউ, মুভির কাজ শুরু করেন। তখন জর্জ বুশ সর্বোচ্চ ক্ষমতা নিয়ে বসে আছেন সেই দেশেই। এসময় এ ধরনের মুভি তৈরি করা যথেষ্ট সাহসিতকার কাজ সন্দেহ নেই। অলিভার স্টোন এর আগে প্ল্যাটুন, বর্ন অফ দি ফোর্থ অফ জুলাই, জেএফকে, নিক্সন, ওয়াল স্ট্রিট, ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারসহ অনেক মুভির পরিচালনা করেছেন। হোয়াইট হাউজের রাজনীতির বিষয়টি তার মুভিতে বারবার এসেছে। ফলে তিনি যে বিষয়টিকে বাস্তব সম্মতভাবে ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেন তা সমালোচকরাও স্বীকার করেছেন। ডাবলিউ. মুভিটিতে দেখানো হয়েছে কীভাবে জর্জ বুশ ইরাক-ইরান-উত্তর কোরিয়াকে শয়তান চক্র বা এক্সিস অফ ইভিল হিসাবে বর্ণনা করছেন। সবাইকে বুশ বলছেন, হয় তোমরা আমাদের সঙ্গে আছো অথবা তোমরা সন্ত্রাসীদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছো। এই থিওরি দিয়ে সারা বিশ্বকে বিবেচনা করেছেন জর্জ বুশ। তার প্রধান মন্ত্রণাদাতা ছিলেন ভাইস প্রেসিডেন্ট ডিক চেনি। রাজনীতি বা বিশ্ব শান্তি নয়, তেলের খনি দখল করার মূল বিষয়টি মুভিটিতে নগ্নভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন পরিচালক অলিভার স্টোন।

কথায় বলে, বাস্তব গল্পের চেয়েও ঘটনাবহুল! ইরাকের তেল নেয়ার জন্য কতো কাহিনী সাজানো হয়েছে তা খুঁজতে গেলে বিস্মিত হতে হয়। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ, মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠা, উইপনস অফ মাস ডেসট্রাকশন, সাদ্দাম হোসেনের স্বৈরাচারী শাসনসহ অনেক বড় বড় কথাই বলা হয়েছে ইরাক আক্রমণের সময়। বাস্তবে মধ্যপ্রাচ্যে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা ও ইরাকের তেলের খনি দখলসহ লুটপাটের চিত্রটি ঠেকিয়ে রাখার চেষ্টা চলেছে সযতেœ এবং পরিকল্পিতভাবে।

ইরাক হামলার পেছনে অনেক লবি কাজ করেছে। যে ব্যক্তিটি প্রেসিডেন্ট বুশকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করেছেন তার নাম রিচার্ড ব্রুস ডিক চেনি। আর ইরাক যুদ্ধে সবচেয়ে লাভবান হয়েছে যে আমেরিকান তেল কম্পানি তার নাম হ্যালিবার্টন। ডিক চেনি এবং হ্যালিবার্টন এক সুতায় গাঁথা। ফলে ইরাক আক্রমণ, জুইশ লবির সঙ্গে সংযোগ কিংবা তেল ব্যবসা নিয়ে কিছু ভাবতে গেলে এই নামগুলোর সঙ্গে কিছুটা পরিচয় থাকাটা জরুরি।

আমেরিকার ৪৬তম ভাইস প্রেসিডেন্ট ডিক চেনি হলেন সেই সব সৌভাগ্যবান রাজনীতিবিদদের অন্যতম যিনি দীর্ঘদিন ক্ষমতার কেন্দ্রে অবস্থান করেছেন। ৮৩ বছর বয়সী ডিক চেনির রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শুরু হয় ২৮ বছর বয়সে ১৯৬৯ সালে। সেসময় কংগ্রেসম্যান উইলিয়াম এ স্টেগারের সহকারী হিসাবে তিনি যাত্রা শুরু করেন। তার কৌশল ও বুদ্ধিমত্তা তাকে দ্রুত আরো উপরের দিকে তুলে ধরে। তার রাজনৈতিক জীবনের বড় একটা সময় কেটেছে হোয়াইট হাউজ বা তার আশে পাশে।

জর্জ বুশের বাবা সিনিয়র জর্জ বুশের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ছিলেন ডোনাল্ট রামসফেল্ড। তার সঙ্গে চেনি কাজ করেছেন তার ক্যারিয়ারের প্রায় শুরু থেকে। ১৯৬৯ থেকে ১৯৭০ পর্যন্ত রামসফেল্ড ছিলেন আমেরিকান সরকারের ইকোনমিক অপরচুনিটি অফিসের ডিরেক্টর। সেখানে রামসফেল্ডের সহকারী ছিলেন ডিক চেনি। ১৯৭১ সালে তিনি হোয়াইট হাউজের স্টাফ অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসাবে নিয়োগ পান। ১৯৭১ থেকে ১৯৭৩ পর্যন্ত কস্ট অফ লিভিং কাউন্সিলের সহকারী পরিচালক হন। প্রেসিডেন্ট জেরার্ল্ড ফোর্ডের সময়ে ১৯৭৪ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত ডেপুটি অ্যাসিস্ট্যান্ট টু দি প্রেসিডেন্ট হন। ফোর্ডের নির্বাচনী প্রচারণায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন ডিক চেনি। ১৯৭৮ সালে তিনি হোয়াইট হাউজ চিফ অফ স্টাফ হন। প্রেসিডেন্ট বুশ সিনিয়রের সময় প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসাবে ইরাকের কুয়েত দখলকে ঘিরে আমেরিকার যুদ্ধযাত্রা ও ডেজার্ট স্ট্রম পরিচালনা, পানামায় নরিয়েগার বিরুদ্ধে আমেরিকান হামলাসহ অনেক ঘটনার সঙ্গে ডিক চেনি সরাসরি জড়িত ছিলেন। সর্বশেষ তিনি জর্জ বুশ জুনিয়রের ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসাবে ছিলেন। অনেকে বলেন, পর্দার আড়াল থেকে ডিক চেনিই আমেরিকার শাসন পরিচালনা করতেন। এসময়টিতেই আফগানিস্তানে হামলা, ইরাক হামলাসহ বিশ্ব জুড়ে শুরু হয় চরম অস্থিরতা।

ডেমক্রেট প্রার্থী বিল ক্লিনটন ক্ষমতায় বসার পর কিছুদিনের জন্য তিনি হোয়াইট হাউজের বাইরে আসেন এবং এসময় তিনি প্রকাশ্যে তেল কম্পানি হেলিবার্টনের জন্য কাজ করেন। তিনি কম্পানিটির চেয়ারম্যান ও সিইও-র পদ পান। যে ব্যক্তির সমস্ত জীবন কেটেছে দাপ্তরিক কাজ করে তেমন এক ব্যক্তিকে একটি শীর্ষ তেল কম্পানির প্রধান পদে কীভাবে দেয়া হলো এটা অনেকের মাথায় প্রশ্ন আসতে পারে। তার উত্তর হলো, ক্যাপিটল হিল এবং পেন্টাগন দুই জায়গাতেই ডিক চেনির ছিল অবাধ যাতায়াত। একটি মাত্র উদাহরণ দিয়ে দেখা যেতে পারে যে তিনি যখন হ্যালিবার্টনের প্রধানের দায়িত্ব নেন সে সময় আমদানি রফতানি খাতে কম্পানিটি সরকারি ঋণ পেতো একশ মিলিয়ন ডলার বা এক বিলিয়ন ডলার।

এটাকে তিনি পরিণত করেন দেড় বিলিয়ন ডলারে। সরকারি কন্ট্রাক্ট পাওয়ার পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় এক দশমিক দুই বিলিয়ন ডলার থেকে দুই দশমিক তিন বিলিয়ন ডলারে। সরকারের কন্ট্রাক্ট পাওয়া প্রতিষ্ঠানের তালিকায় হ্যালিবার্টনকে ৭৩ থেকে ১৮ নাম্বারে নিয়ে আসেন ডিক চেনি।

পরবর্তী সময়ে ভাইস প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হলে হ্যালিবার্টনে থাকার সময় ডিক চেনির বিপুল আর্থিক সম্পদের বিষয়ে প্রশ্ন করেন তার প্রতিদ্বন্দ্বী জো লিবারম্যান। গর্ব এবং অহংকার নিয়ে ডিক চেনি বলেছিলেন, সরকার কিছুই করতে পারবে না।

হ্যালিবার্টন প্রতিষ্ঠানটির জন্ম হয় ১৯১৯ সালে। আর্ল হ্যালিবার্টন এটি প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ছিলেন পরিশ্রমী, প্রচারবিমুখ এবং ভদ্রলোক। তিনি কখনোই চাইতেন না তার প্রতিষ্ঠান রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত বা ব্যবহৃত হোক। নির্মম পরিহাসের বিষয় হলো হ্যালিবার্টন কম্পানি রাজনীতিতে একটি অবিচ্ছেদ্য নামে পরিণত হয়েছে। বর্তমানে সারা পৃথিবীতে ৭০টি দেশে ৩০০-এর বেশি শাখা বা প্রতিনিধি আছে হ্যালিবার্টনের।

ইরাক যুদ্ধের পর তেল খনিগুলোর নিয়ন্ত্রণ লাভ শুধু নয়, ১৯৯১ সালে কুয়েতে ৩২০টি জলন্ত তেল খনির নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব পায় তারা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ও সুযোগের পূর্ণ ব্যবহার করতে ভুল করেনি হ্যালিবার্টন কম্পানি।

এই প্রক্রিয়ায় কেবিআর নামের অরেকটি প্রতিষ্ঠানের কথা আলোচনায় চলে আসে। কেলোগ ব্রাউন অ্যান্ড রুট কম্পানি হ্যালিবার্টনের সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসাবে ৪৪ বছর সার্ভিস দিয়েছে। যদিও ২০০৭ সালে হ্যালিবার্টন বলেছে তাদের সঙ্গে এখন কেবিআরের ব্যবসায়িক সম্পর্ক নেই। এই কম্পানির মাধ্যমে হ্যালিবার্টন অনেক দুর্নীতির জন্ম দিয়েছে। কেবিআর আগে বিআর নামে পরিচিত ছিল। এই প্রতিষ্ঠানকে পেন্টাগন আট দশমিক পাঁচ মিলিয়ন ডলারের একটি জরিপ কাজ দিয়েছিল। তাদের বলা হয়েছিল, যুদ্ধক্ষেত্রে আমেরিকার সেনা বাহিনীর সঙ্গে প্রাইভেট বাহিনীকে জুড়ে দিলে কেমন ফল আসবে। এই জরিপের কাজটি পাইয়ে দিয়েছিলেন সেই সময়ের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ডিক চেনি। ফলে পরে তাকে চেয়ারম্যান বা সিইও বানাতে হ্যালিবার্টনের মতো দুর্নীতিবাজ প্রতিষ্ঠানের কোনো সমস্যা হয় নি। এই জরিপ রিপোর্টের পর কাজের পুরষ্কার হিসাবে পেন্টাগন পাঁচ বছরের জন্য কেবিআর প্রতিষ্ঠানটিকে ইউএস আর্মির ইঞ্জিনিয়ার কোরের যাবতীয় লজিস্টিক সাপোর্ট দেয়ার কন্ট্রাক্ট দেয়। এই চুক্তির ফলে শুধু বলকান এলাকা থেকে প্রতিষ্ঠানটির আয় হয় দুই দশমিক দুই বিলিয়ন ডলার। কেবিআর নিজেদের সম্পর্কে এখন বলে, কেবিআর আমেরিকান আর্মির সবচেয়ে বড় কন্ট্রাকটর শুধু নয় বা আমেরিকার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের কন্ট্রাক্ট পাওয়া শীর্ষ দশ কম্পানির অন্যতম শুধু নয়, তারা এখন বিশ্বের সবচেয়ে বড় ডিফেন্স সার্ভিস প্রোভাইডার।

এসব কারণে অনেকে হ্যালিবার্টন-ডিক চেনি এবং কেবিআরকে জর্জ বুশের ইরান-ইরাক-উত্তর কোরিয়াকে দেয়া নামের অনুসরণে বলছেন, এক্সিস অফ ইভিল!

লিবিয়া, কসোভো, আফগানিস্তান, ইরাক, অ্যাঙ্গোলা, নাইজেরিয়া, উজবেকিস্তান, অস্ট্রেলিয়া, মালয়শিয়া, বার্মাসহ অসংখ্য দেশে বাণিজ্যের নামে কালো হাত বিস্তার করে হ্যালিবার্টন কম্পানি। ১৯৯৭ সালের একটি রিপোর্ট থেকে দেখা যায়, আমেরিকান সরকারি প্রতিষ্ঠান দি ওভারসিস প্রাইভেট ইনভেস্টমেন্ট কর্পরেশন একটি দেশের প্রাকৃতিক গ্যাস উন্নয়ন কাজ করার জন্য হ্যালিবার্টনকে প্রায় দুইশ মিলিয়ন ডলারের পলিটিকাল রিস্ক ইন্সুরেন্স পাইয়ে দেয়। দেশটির নাম বাংলাদেশ!

হ্যালিবার্টন প্রচুর সরকারি সুবিধা পাওয়ার পরও সরকারের কাছ থেকে লাভ করতে দ্বিধা করে নি। কংগ্রেসের হিসাব বিভাগ জেনারেল অ্যাকাউন্টিং অফিস (জিএও) জানায়, কসোভোতে সেনা সহায়তায় বিদ্যুৎ সরবরাহ ও অন্যান্য খাতে হ্যালিবার্টন অনেক বেশি বিল করে। যে প্লাইউড তারা প্রায় ১৪ ডলারে কিনে সেটার বিল ধরে ৮৬ ডলার। এতো কিছুর পরও প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হয়নি এর পেছনে ডিক চেনির মতো প্রভাবশালী ব্যক্তি ও গোষ্ঠির সরাসরি সংযোগ থাকার কারণে।

কোনো কম্পানি কখনো যে একটি রাষ্ট্রের চেয়েও প্রভাবশালী এবং শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে তার উদাহরণ হ্যালিবার্টন। একটি দেশকে কীভাবে এবং কতোভাবে শোষণ করা যায় তার সম্প্রতিকতম উদাহরণ হতে পারে ইরাক। এই ইরাকে প্রথম গালফ যুদ্ধের পরও সাদ্দাম সরকারের সময় ব্যবসায়িক কাজ করে হ্যালিবার্টন। আবার সাদ্দাম সরকারকে উচ্ছেদ করে সে দেশের তেল সম্পদ দখল করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে কম্পানিটি। সাম্প্রতিক সময়ে সারা বিশ্বে বিশেষ করে আমেরিকায় চরম অর্থনৈতিক দুর্দশার মধ্যে অন্তত একটি কম্পানি ব্যাপকভাবে লাভবান হয়। সেটি হ্যালিবার্টন। টেক্সাসের রাজধানী হিউস্টনে এক অভিজাত হোটেলে হ্যালিবার্টন তার শেয়ার হোল্ডার ও উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের কাছে ঘোষণা দেয় যে ২০০৮-এ তারা চার বিলিয়ন ডলার লাভ করেছে। এর প্রায় পুরোটাই হলো যুদ্ধকালীন লাভ। তাই বিভিন্ন দেশে যুদ্ধ না বাঁধানোর কারণ নেই হ্যালিবার্টনের মতো কম্পানিগুলোর। ভিয়েতনাম যুদ্ধেও তারা অঙ্গসংগঠনের মাধ্যমে প্রচুর অর্থ আয় করে।

২০০৪ সালে হিউস্টন শহরেই তারা যখন ইরাকে যুদ্ধ বিষয়ক বানোয়াট বিল পাশ করিয়ে নেয় তখন হোটেলের বাইরে প্রায় তিনশ প্রতিবাদকারী অবস্থান করছিলেন। তাদের বাধা দিতে পুলিশ অবস্থান নিয়েছিল বাইরে। এবার কেউ প্রতিবাদ করতে আসেনি। শুধু সরকারি নিরাপত্তা বাহিনী নয়। প্রয়োজনে প্রাইভেট বাহিনীও নিয়োগ করে হ্যালিবার্টন। ইরাকসহ বিভিন্ন জায়গায় হ্যালিবার্টন যে প্রাইভেট বাহিনীর সহায়তা নেয় তার নাম ব্ল্যাক ওয়াটার। কমপক্ষে নয় ডিভিশন সৈন্য আছে এই বাহিনীর। ইরাকের আকাশে ব্ল্যাক ওয়াটারের হেলিকপ্টার ঘুরে বেড়ানোর দৃশ্য প্রায়ই দেখা যেত। আমেরিকান সরকার অনুমোদিত এই প্রাইভেট বাহিনীর কাছে এমন অস্ত্র আছে যা অনেক দেশের নিয়মিত সেনা বাহিনীর কাছেও নেই।

ইরাকে বেকারত্বের হার যখন শতকরা সত্তর ভাগ ছিল তখনও হ্যালিবার্টনের সহযোগী কেবিআরের বাংলোয় আমেরিকানদের জন্য ছিল অনেক কাজের সুযোগ। বিশেষ করে সে ব্যক্তিটি যদি টেক্সাসের হয়। ইরাকে কম্পানিটিতে অন্তত চব্বিশ হাজার কর্মীর বড় অংশই আমেরিকান। হ্যালিবার্টনের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা স্বীকার করেন যে, প্রতি মাসে ইরাক থেকে তারা কমপক্ষে এক বিলিয়ন ডলার আয় করেছে। হ্যালিবার্টন বুশ প্রশাসনের সময়ে দশ বছরের জন্য ইরাকে কাজের অনুমোদন পায়।

পরিচালক রবার্ট গ্রিনওয়ার্ল্ড ৭৫ মিনিটের একটি তথ্যচিত্র তৈরি করেন ইরাক ফর সেল: দি ওয়ার প্রফিটিয়ারস নামে। সেখানে হ্যালিবার্টনসহ প্রাইভেট বাহিনী ব্ল্যাক ওয়াটার এবং দুটি আইটি প্রতিষ্ঠান সিএসিআই এবং এলথ্রি টাইটান ইরাকে কীভাবে আর্থিকভাবে লাভবান হয়েছে সে বিষয়টি তুলে ধরা হয়।

ইরাকে হ্যালিবার্টন শুধু অর্থ আয় করছে না তারা নানাভাবে অনৈতিকতা ও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। একজন একাধিক সন্তানের মা অভিযোগ করেন সেখানে চাকরির জন্য গেলে তাকে ধর্ষণ করা হয়। তবে সবচেয়ে আলোচিত মামলাটি করেন হ্যালিবার্টনের এক আমেরিকান নারী কর্মী। তিনি অভিযোগ করেন যে ইরাকে কাজ করার সময় তার সহকর্মীরা তাকে গণধর্ষণ করে।

সারা বিশ্ব জুড়ে যুদ্ধের পেছনে হ্যালিবার্টন-এর মতো কম্পানিগুলোর কোনো না কোনো ভূমিকা থাকে। আমেরিকায় দেখা যায় অধিকাংশ অস্ত্র কম্পানি, তেল কম্পানি এবং ‘জাতির বিবেক’ হিসাবে পরিচিত মিডিয়া কম্পানিগুলো পারস্পরিক সম্পর্কীত। এসব কম্পানিগুলোর মালিক বা প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তারা কোনো না কোনোভাবে পারস্পরিক স্বার্থ রক্ষা করে চলেন। অনেক ক্ষেত্রে এদের মালিকও অভিন্ন হয়ে থাকেন। অনুগত মিডিয়া প্রথমে যুদ্ধের পক্ষে মতামত তৈরিতে কৌশলে বা প্রকাশ্যে বিশাল ভূমিকা রাখে। ‘আমেরিকা আক্রান্ত হবে’ বা ‘বিশ্ব মানবতা হুমকির মুখে’ জাতীয় সংবাদ অবিরাম পরিবেশন করে সাধারণ মানুষের সমর্থন নিয়ে নেয় তারা। অস্ত্র কম্পানিগুলো যুদ্ধের জন্য অস্ত্র বিক্রি শুরু করে। অনেক সময় যুদ্ধরত দুই পক্ষের কাছেই অস্ত্র বিক্রি করা হয়। কারণ এখানে যুদ্ধে কী হলো, কারা জিতলো সেটা মূখ্য নয়। যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হলে অস্ত্র সরবরাহ নিশ্চিত থাকবে। ফলে লাভ হবে। এরপর যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশকে পুর্নগঠনের নামে হ্যালিবার্টনের মতো কম্পানিগুলো কাজ নেয়। তারা কীভাবে পুনর্গঠন করে সেটা ইরাকের উদাহরণ দিয়েই দেখা যায়। এই চক্রে আরো অনেক উপাদান ও ব্যক্তি গোষ্ঠি জড়িত।

একই খেলা তারা নানা নামে ও ঢঙ্গে খেলে চলেছে। নীরব দর্শক হিসাবে তা দেখতে ও অত্যাচার সহ্য করতে হয় সারা পৃথিবীর সাধারণ মানুষকে।

 

লেখক পরিচিতি: সাংবাদিক ও গবেষক

 

হ্যালিবার্টন: সভ্যতা হত্যাকারী যুদ্ধদানব

০৮:০০:২০ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ৫ অক্টোবর ২০২৪

মোহাম্মদ মাহমুদুজ্জামান

২০০৮ সালের আমেরিকান নির্বাচনের মাত্র কিছুদিন আগে মুক্তি পায় ডাবলিউ. নামের একটি মুভি। পুরো মুভিটি তৈরি করা হয়েছে আমেরিকার সে সময়ের প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশকে নিয়ে। একজন মদ্যপ, জুয়ারি এবং অকর্মা ব্যক্তির প্রেসিডেন্ট হওয়া, তার ব্যর্থতা ও অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে অন্যের সুবিধা আদায় করে নেয়া এবং বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী দেশের সর্বোচ্চ প্রশাসন কেন্দ্র কতোটা হাস্যকরভাবে পরিচালিত হয় তার চমৎকার চিত্ররূপ ডাবলিউ.।

হিটলারের বিরুদ্ধে মুভি তৈরি করে বিখ্যাত অভিনেতা ও নির্মাতা চার্লি চ্যাপলিন হুমকির মুখে পড়েছিলেন। তারপরও তিনি ঝুঁকি নিয়েছেন। আমেরিকার জনপ্রিয় পরিচালক অলিভার স্টোন ১২ মে ২০০৮-এ তার ডাবলিউ, মুভির কাজ শুরু করেন। তখন জর্জ বুশ সর্বোচ্চ ক্ষমতা নিয়ে বসে আছেন সেই দেশেই। এসময় এ ধরনের মুভি তৈরি করা যথেষ্ট সাহসিতকার কাজ সন্দেহ নেই। অলিভার স্টোন এর আগে প্ল্যাটুন, বর্ন অফ দি ফোর্থ অফ জুলাই, জেএফকে, নিক্সন, ওয়াল স্ট্রিট, ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারসহ অনেক মুভির পরিচালনা করেছেন। হোয়াইট হাউজের রাজনীতির বিষয়টি তার মুভিতে বারবার এসেছে। ফলে তিনি যে বিষয়টিকে বাস্তব সম্মতভাবে ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেন তা সমালোচকরাও স্বীকার করেছেন। ডাবলিউ. মুভিটিতে দেখানো হয়েছে কীভাবে জর্জ বুশ ইরাক-ইরান-উত্তর কোরিয়াকে শয়তান চক্র বা এক্সিস অফ ইভিল হিসাবে বর্ণনা করছেন। সবাইকে বুশ বলছেন, হয় তোমরা আমাদের সঙ্গে আছো অথবা তোমরা সন্ত্রাসীদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছো। এই থিওরি দিয়ে সারা বিশ্বকে বিবেচনা করেছেন জর্জ বুশ। তার প্রধান মন্ত্রণাদাতা ছিলেন ভাইস প্রেসিডেন্ট ডিক চেনি। রাজনীতি বা বিশ্ব শান্তি নয়, তেলের খনি দখল করার মূল বিষয়টি মুভিটিতে নগ্নভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন পরিচালক অলিভার স্টোন।

কথায় বলে, বাস্তব গল্পের চেয়েও ঘটনাবহুল! ইরাকের তেল নেয়ার জন্য কতো কাহিনী সাজানো হয়েছে তা খুঁজতে গেলে বিস্মিত হতে হয়। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ, মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠা, উইপনস অফ মাস ডেসট্রাকশন, সাদ্দাম হোসেনের স্বৈরাচারী শাসনসহ অনেক বড় বড় কথাই বলা হয়েছে ইরাক আক্রমণের সময়। বাস্তবে মধ্যপ্রাচ্যে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা ও ইরাকের তেলের খনি দখলসহ লুটপাটের চিত্রটি ঠেকিয়ে রাখার চেষ্টা চলেছে সযতেœ এবং পরিকল্পিতভাবে।

ইরাক হামলার পেছনে অনেক লবি কাজ করেছে। যে ব্যক্তিটি প্রেসিডেন্ট বুশকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করেছেন তার নাম রিচার্ড ব্রুস ডিক চেনি। আর ইরাক যুদ্ধে সবচেয়ে লাভবান হয়েছে যে আমেরিকান তেল কম্পানি তার নাম হ্যালিবার্টন। ডিক চেনি এবং হ্যালিবার্টন এক সুতায় গাঁথা। ফলে ইরাক আক্রমণ, জুইশ লবির সঙ্গে সংযোগ কিংবা তেল ব্যবসা নিয়ে কিছু ভাবতে গেলে এই নামগুলোর সঙ্গে কিছুটা পরিচয় থাকাটা জরুরি।

আমেরিকার ৪৬তম ভাইস প্রেসিডেন্ট ডিক চেনি হলেন সেই সব সৌভাগ্যবান রাজনীতিবিদদের অন্যতম যিনি দীর্ঘদিন ক্ষমতার কেন্দ্রে অবস্থান করেছেন। ৮৩ বছর বয়সী ডিক চেনির রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শুরু হয় ২৮ বছর বয়সে ১৯৬৯ সালে। সেসময় কংগ্রেসম্যান উইলিয়াম এ স্টেগারের সহকারী হিসাবে তিনি যাত্রা শুরু করেন। তার কৌশল ও বুদ্ধিমত্তা তাকে দ্রুত আরো উপরের দিকে তুলে ধরে। তার রাজনৈতিক জীবনের বড় একটা সময় কেটেছে হোয়াইট হাউজ বা তার আশে পাশে।

জর্জ বুশের বাবা সিনিয়র জর্জ বুশের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ছিলেন ডোনাল্ট রামসফেল্ড। তার সঙ্গে চেনি কাজ করেছেন তার ক্যারিয়ারের প্রায় শুরু থেকে। ১৯৬৯ থেকে ১৯৭০ পর্যন্ত রামসফেল্ড ছিলেন আমেরিকান সরকারের ইকোনমিক অপরচুনিটি অফিসের ডিরেক্টর। সেখানে রামসফেল্ডের সহকারী ছিলেন ডিক চেনি। ১৯৭১ সালে তিনি হোয়াইট হাউজের স্টাফ অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসাবে নিয়োগ পান। ১৯৭১ থেকে ১৯৭৩ পর্যন্ত কস্ট অফ লিভিং কাউন্সিলের সহকারী পরিচালক হন। প্রেসিডেন্ট জেরার্ল্ড ফোর্ডের সময়ে ১৯৭৪ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত ডেপুটি অ্যাসিস্ট্যান্ট টু দি প্রেসিডেন্ট হন। ফোর্ডের নির্বাচনী প্রচারণায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন ডিক চেনি। ১৯৭৮ সালে তিনি হোয়াইট হাউজ চিফ অফ স্টাফ হন। প্রেসিডেন্ট বুশ সিনিয়রের সময় প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসাবে ইরাকের কুয়েত দখলকে ঘিরে আমেরিকার যুদ্ধযাত্রা ও ডেজার্ট স্ট্রম পরিচালনা, পানামায় নরিয়েগার বিরুদ্ধে আমেরিকান হামলাসহ অনেক ঘটনার সঙ্গে ডিক চেনি সরাসরি জড়িত ছিলেন। সর্বশেষ তিনি জর্জ বুশ জুনিয়রের ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসাবে ছিলেন। অনেকে বলেন, পর্দার আড়াল থেকে ডিক চেনিই আমেরিকার শাসন পরিচালনা করতেন। এসময়টিতেই আফগানিস্তানে হামলা, ইরাক হামলাসহ বিশ্ব জুড়ে শুরু হয় চরম অস্থিরতা।

ডেমক্রেট প্রার্থী বিল ক্লিনটন ক্ষমতায় বসার পর কিছুদিনের জন্য তিনি হোয়াইট হাউজের বাইরে আসেন এবং এসময় তিনি প্রকাশ্যে তেল কম্পানি হেলিবার্টনের জন্য কাজ করেন। তিনি কম্পানিটির চেয়ারম্যান ও সিইও-র পদ পান। যে ব্যক্তির সমস্ত জীবন কেটেছে দাপ্তরিক কাজ করে তেমন এক ব্যক্তিকে একটি শীর্ষ তেল কম্পানির প্রধান পদে কীভাবে দেয়া হলো এটা অনেকের মাথায় প্রশ্ন আসতে পারে। তার উত্তর হলো, ক্যাপিটল হিল এবং পেন্টাগন দুই জায়গাতেই ডিক চেনির ছিল অবাধ যাতায়াত। একটি মাত্র উদাহরণ দিয়ে দেখা যেতে পারে যে তিনি যখন হ্যালিবার্টনের প্রধানের দায়িত্ব নেন সে সময় আমদানি রফতানি খাতে কম্পানিটি সরকারি ঋণ পেতো একশ মিলিয়ন ডলার বা এক বিলিয়ন ডলার।

এটাকে তিনি পরিণত করেন দেড় বিলিয়ন ডলারে। সরকারি কন্ট্রাক্ট পাওয়ার পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় এক দশমিক দুই বিলিয়ন ডলার থেকে দুই দশমিক তিন বিলিয়ন ডলারে। সরকারের কন্ট্রাক্ট পাওয়া প্রতিষ্ঠানের তালিকায় হ্যালিবার্টনকে ৭৩ থেকে ১৮ নাম্বারে নিয়ে আসেন ডিক চেনি।

পরবর্তী সময়ে ভাইস প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হলে হ্যালিবার্টনে থাকার সময় ডিক চেনির বিপুল আর্থিক সম্পদের বিষয়ে প্রশ্ন করেন তার প্রতিদ্বন্দ্বী জো লিবারম্যান। গর্ব এবং অহংকার নিয়ে ডিক চেনি বলেছিলেন, সরকার কিছুই করতে পারবে না।

হ্যালিবার্টন প্রতিষ্ঠানটির জন্ম হয় ১৯১৯ সালে। আর্ল হ্যালিবার্টন এটি প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ছিলেন পরিশ্রমী, প্রচারবিমুখ এবং ভদ্রলোক। তিনি কখনোই চাইতেন না তার প্রতিষ্ঠান রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত বা ব্যবহৃত হোক। নির্মম পরিহাসের বিষয় হলো হ্যালিবার্টন কম্পানি রাজনীতিতে একটি অবিচ্ছেদ্য নামে পরিণত হয়েছে। বর্তমানে সারা পৃথিবীতে ৭০টি দেশে ৩০০-এর বেশি শাখা বা প্রতিনিধি আছে হ্যালিবার্টনের।

ইরাক যুদ্ধের পর তেল খনিগুলোর নিয়ন্ত্রণ লাভ শুধু নয়, ১৯৯১ সালে কুয়েতে ৩২০টি জলন্ত তেল খনির নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব পায় তারা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ও সুযোগের পূর্ণ ব্যবহার করতে ভুল করেনি হ্যালিবার্টন কম্পানি।

এই প্রক্রিয়ায় কেবিআর নামের অরেকটি প্রতিষ্ঠানের কথা আলোচনায় চলে আসে। কেলোগ ব্রাউন অ্যান্ড রুট কম্পানি হ্যালিবার্টনের সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসাবে ৪৪ বছর সার্ভিস দিয়েছে। যদিও ২০০৭ সালে হ্যালিবার্টন বলেছে তাদের সঙ্গে এখন কেবিআরের ব্যবসায়িক সম্পর্ক নেই। এই কম্পানির মাধ্যমে হ্যালিবার্টন অনেক দুর্নীতির জন্ম দিয়েছে। কেবিআর আগে বিআর নামে পরিচিত ছিল। এই প্রতিষ্ঠানকে পেন্টাগন আট দশমিক পাঁচ মিলিয়ন ডলারের একটি জরিপ কাজ দিয়েছিল। তাদের বলা হয়েছিল, যুদ্ধক্ষেত্রে আমেরিকার সেনা বাহিনীর সঙ্গে প্রাইভেট বাহিনীকে জুড়ে দিলে কেমন ফল আসবে। এই জরিপের কাজটি পাইয়ে দিয়েছিলেন সেই সময়ের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ডিক চেনি। ফলে পরে তাকে চেয়ারম্যান বা সিইও বানাতে হ্যালিবার্টনের মতো দুর্নীতিবাজ প্রতিষ্ঠানের কোনো সমস্যা হয় নি। এই জরিপ রিপোর্টের পর কাজের পুরষ্কার হিসাবে পেন্টাগন পাঁচ বছরের জন্য কেবিআর প্রতিষ্ঠানটিকে ইউএস আর্মির ইঞ্জিনিয়ার কোরের যাবতীয় লজিস্টিক সাপোর্ট দেয়ার কন্ট্রাক্ট দেয়। এই চুক্তির ফলে শুধু বলকান এলাকা থেকে প্রতিষ্ঠানটির আয় হয় দুই দশমিক দুই বিলিয়ন ডলার। কেবিআর নিজেদের সম্পর্কে এখন বলে, কেবিআর আমেরিকান আর্মির সবচেয়ে বড় কন্ট্রাকটর শুধু নয় বা আমেরিকার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের কন্ট্রাক্ট পাওয়া শীর্ষ দশ কম্পানির অন্যতম শুধু নয়, তারা এখন বিশ্বের সবচেয়ে বড় ডিফেন্স সার্ভিস প্রোভাইডার।

এসব কারণে অনেকে হ্যালিবার্টন-ডিক চেনি এবং কেবিআরকে জর্জ বুশের ইরান-ইরাক-উত্তর কোরিয়াকে দেয়া নামের অনুসরণে বলছেন, এক্সিস অফ ইভিল!

লিবিয়া, কসোভো, আফগানিস্তান, ইরাক, অ্যাঙ্গোলা, নাইজেরিয়া, উজবেকিস্তান, অস্ট্রেলিয়া, মালয়শিয়া, বার্মাসহ অসংখ্য দেশে বাণিজ্যের নামে কালো হাত বিস্তার করে হ্যালিবার্টন কম্পানি। ১৯৯৭ সালের একটি রিপোর্ট থেকে দেখা যায়, আমেরিকান সরকারি প্রতিষ্ঠান দি ওভারসিস প্রাইভেট ইনভেস্টমেন্ট কর্পরেশন একটি দেশের প্রাকৃতিক গ্যাস উন্নয়ন কাজ করার জন্য হ্যালিবার্টনকে প্রায় দুইশ মিলিয়ন ডলারের পলিটিকাল রিস্ক ইন্সুরেন্স পাইয়ে দেয়। দেশটির নাম বাংলাদেশ!

হ্যালিবার্টন প্রচুর সরকারি সুবিধা পাওয়ার পরও সরকারের কাছ থেকে লাভ করতে দ্বিধা করে নি। কংগ্রেসের হিসাব বিভাগ জেনারেল অ্যাকাউন্টিং অফিস (জিএও) জানায়, কসোভোতে সেনা সহায়তায় বিদ্যুৎ সরবরাহ ও অন্যান্য খাতে হ্যালিবার্টন অনেক বেশি বিল করে। যে প্লাইউড তারা প্রায় ১৪ ডলারে কিনে সেটার বিল ধরে ৮৬ ডলার। এতো কিছুর পরও প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হয়নি এর পেছনে ডিক চেনির মতো প্রভাবশালী ব্যক্তি ও গোষ্ঠির সরাসরি সংযোগ থাকার কারণে।

কোনো কম্পানি কখনো যে একটি রাষ্ট্রের চেয়েও প্রভাবশালী এবং শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে তার উদাহরণ হ্যালিবার্টন। একটি দেশকে কীভাবে এবং কতোভাবে শোষণ করা যায় তার সম্প্রতিকতম উদাহরণ হতে পারে ইরাক। এই ইরাকে প্রথম গালফ যুদ্ধের পরও সাদ্দাম সরকারের সময় ব্যবসায়িক কাজ করে হ্যালিবার্টন। আবার সাদ্দাম সরকারকে উচ্ছেদ করে সে দেশের তেল সম্পদ দখল করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে কম্পানিটি। সাম্প্রতিক সময়ে সারা বিশ্বে বিশেষ করে আমেরিকায় চরম অর্থনৈতিক দুর্দশার মধ্যে অন্তত একটি কম্পানি ব্যাপকভাবে লাভবান হয়। সেটি হ্যালিবার্টন। টেক্সাসের রাজধানী হিউস্টনে এক অভিজাত হোটেলে হ্যালিবার্টন তার শেয়ার হোল্ডার ও উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের কাছে ঘোষণা দেয় যে ২০০৮-এ তারা চার বিলিয়ন ডলার লাভ করেছে। এর প্রায় পুরোটাই হলো যুদ্ধকালীন লাভ। তাই বিভিন্ন দেশে যুদ্ধ না বাঁধানোর কারণ নেই হ্যালিবার্টনের মতো কম্পানিগুলোর। ভিয়েতনাম যুদ্ধেও তারা অঙ্গসংগঠনের মাধ্যমে প্রচুর অর্থ আয় করে।

২০০৪ সালে হিউস্টন শহরেই তারা যখন ইরাকে যুদ্ধ বিষয়ক বানোয়াট বিল পাশ করিয়ে নেয় তখন হোটেলের বাইরে প্রায় তিনশ প্রতিবাদকারী অবস্থান করছিলেন। তাদের বাধা দিতে পুলিশ অবস্থান নিয়েছিল বাইরে। এবার কেউ প্রতিবাদ করতে আসেনি। শুধু সরকারি নিরাপত্তা বাহিনী নয়। প্রয়োজনে প্রাইভেট বাহিনীও নিয়োগ করে হ্যালিবার্টন। ইরাকসহ বিভিন্ন জায়গায় হ্যালিবার্টন যে প্রাইভেট বাহিনীর সহায়তা নেয় তার নাম ব্ল্যাক ওয়াটার। কমপক্ষে নয় ডিভিশন সৈন্য আছে এই বাহিনীর। ইরাকের আকাশে ব্ল্যাক ওয়াটারের হেলিকপ্টার ঘুরে বেড়ানোর দৃশ্য প্রায়ই দেখা যেত। আমেরিকান সরকার অনুমোদিত এই প্রাইভেট বাহিনীর কাছে এমন অস্ত্র আছে যা অনেক দেশের নিয়মিত সেনা বাহিনীর কাছেও নেই।

ইরাকে বেকারত্বের হার যখন শতকরা সত্তর ভাগ ছিল তখনও হ্যালিবার্টনের সহযোগী কেবিআরের বাংলোয় আমেরিকানদের জন্য ছিল অনেক কাজের সুযোগ। বিশেষ করে সে ব্যক্তিটি যদি টেক্সাসের হয়। ইরাকে কম্পানিটিতে অন্তত চব্বিশ হাজার কর্মীর বড় অংশই আমেরিকান। হ্যালিবার্টনের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা স্বীকার করেন যে, প্রতি মাসে ইরাক থেকে তারা কমপক্ষে এক বিলিয়ন ডলার আয় করেছে। হ্যালিবার্টন বুশ প্রশাসনের সময়ে দশ বছরের জন্য ইরাকে কাজের অনুমোদন পায়।

পরিচালক রবার্ট গ্রিনওয়ার্ল্ড ৭৫ মিনিটের একটি তথ্যচিত্র তৈরি করেন ইরাক ফর সেল: দি ওয়ার প্রফিটিয়ারস নামে। সেখানে হ্যালিবার্টনসহ প্রাইভেট বাহিনী ব্ল্যাক ওয়াটার এবং দুটি আইটি প্রতিষ্ঠান সিএসিআই এবং এলথ্রি টাইটান ইরাকে কীভাবে আর্থিকভাবে লাভবান হয়েছে সে বিষয়টি তুলে ধরা হয়।

ইরাকে হ্যালিবার্টন শুধু অর্থ আয় করছে না তারা নানাভাবে অনৈতিকতা ও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। একজন একাধিক সন্তানের মা অভিযোগ করেন সেখানে চাকরির জন্য গেলে তাকে ধর্ষণ করা হয়। তবে সবচেয়ে আলোচিত মামলাটি করেন হ্যালিবার্টনের এক আমেরিকান নারী কর্মী। তিনি অভিযোগ করেন যে ইরাকে কাজ করার সময় তার সহকর্মীরা তাকে গণধর্ষণ করে।

সারা বিশ্ব জুড়ে যুদ্ধের পেছনে হ্যালিবার্টন-এর মতো কম্পানিগুলোর কোনো না কোনো ভূমিকা থাকে। আমেরিকায় দেখা যায় অধিকাংশ অস্ত্র কম্পানি, তেল কম্পানি এবং ‘জাতির বিবেক’ হিসাবে পরিচিত মিডিয়া কম্পানিগুলো পারস্পরিক সম্পর্কীত। এসব কম্পানিগুলোর মালিক বা প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তারা কোনো না কোনোভাবে পারস্পরিক স্বার্থ রক্ষা করে চলেন। অনেক ক্ষেত্রে এদের মালিকও অভিন্ন হয়ে থাকেন। অনুগত মিডিয়া প্রথমে যুদ্ধের পক্ষে মতামত তৈরিতে কৌশলে বা প্রকাশ্যে বিশাল ভূমিকা রাখে। ‘আমেরিকা আক্রান্ত হবে’ বা ‘বিশ্ব মানবতা হুমকির মুখে’ জাতীয় সংবাদ অবিরাম পরিবেশন করে সাধারণ মানুষের সমর্থন নিয়ে নেয় তারা। অস্ত্র কম্পানিগুলো যুদ্ধের জন্য অস্ত্র বিক্রি শুরু করে। অনেক সময় যুদ্ধরত দুই পক্ষের কাছেই অস্ত্র বিক্রি করা হয়। কারণ এখানে যুদ্ধে কী হলো, কারা জিতলো সেটা মূখ্য নয়। যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হলে অস্ত্র সরবরাহ নিশ্চিত থাকবে। ফলে লাভ হবে। এরপর যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশকে পুর্নগঠনের নামে হ্যালিবার্টনের মতো কম্পানিগুলো কাজ নেয়। তারা কীভাবে পুনর্গঠন করে সেটা ইরাকের উদাহরণ দিয়েই দেখা যায়। এই চক্রে আরো অনেক উপাদান ও ব্যক্তি গোষ্ঠি জড়িত।

একই খেলা তারা নানা নামে ও ঢঙ্গে খেলে চলেছে। নীরব দর্শক হিসাবে তা দেখতে ও অত্যাচার সহ্য করতে হয় সারা পৃথিবীর সাধারণ মানুষকে।

 

লেখক পরিচিতি: সাংবাদিক ও গবেষক