সারাক্ষণ ডেস্ক
যক্ষ্মা একটি বৈশ্বিক স্বাস্থ্য সমস্যা। বিশেষত বাংলাদেশে শিশুদের যক্ষ্মায় আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি কেননা তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা পরিপূর্নভাবে বিকশিত নয়।এছাড়াও,বাংলাদেশে বিলম্বিত রোগ নির্ণয়,অপুষ্টি এবং স্বাস্থ্যসেবার সীমিত সুবিধার কারণে যক্ষ্মার বিস্তার আরো বৃদ্ধি পায়।তাই যক্ষ্মা মোকাবেলা করার জন্য,বিশেষ করে শিশুদের মধ্যে সচেতনতা গড়ে তুলতে,আইসিডিডিআর,বি-র নেতৃত্বে ইউএসএআইডি’এস অ্যালায়েন্স ফর কমব্যাটিং টিউবারকুলোসিস ইন বাংলাদেশ (এসিটিবি) অ্যাক্টিভিটি,এবছরের মে মাসে প্রথম আলোর সাথে “স্বাস্থ্য অলিম্পিয়াড ২০২৪” শুরু করে।
গত ১৮ তারিখ জাতীয় পর্যায়ের প্রতিযোগিতার মাধ্যমে শেষ হয় স্বাস্থ্য অলিম্পিয়াডের। বিকেলে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন এবং পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের মাননীয় উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানসহ অন্যান্য অতিথিদের উপস্থিতিতে বিজয়ীদের পুরস্কৃত করা হয়। এসময় প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়া ৫৫০ জনেরও বেশি শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি তাদের শিক্ষক এবং বাবা-মা উপস্থিত ছিলেন।
এই বছরের মে মাসের শুরু হওয়া স্বাস্থ্য অলিম্পিয়াড স্কুল অ্যাক্টিভেশন সেশনের সময় রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের ১২টি জেলার ছয় হাজার স্কুলের ৯৬,০০০-এরও বেশি শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলে। ৩০ মে থেকে ৮ সেপ্টেম্বরের মধ্যে অনুষ্ঠিত জেলা-স্তরের প্রতিযোগিতায় পাঁচ হাজেরেরও বেশি শিক্ষার্থী অংশগ্রহণ করে। এসকল শিক্ষার্থী কুইজ এবং পোস্টার উপস্থাপনা প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে।
এছাড়াও, শিক্ষার্থীদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান আগ্রহকে সামঞ্জস্য করার জন্য সেপ্টেম্বর মাসে স্বাস্থ্য অলিম্পিয়াডের একটি অনলাইন সংস্করণ চালু করা হয়েছিল, যাতে সারা বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা অংশগ্রহণ করতে পারে। সমাপনী প্রতিযোগিতায় প্রায় ৩৬০জন আঞ্চলিক বিজয়ী এবং অনলাইন কুইজ থেকে ৬০জন বিজয়ী কুইজ প্রতিযোগিতায় অংশ নেয় এবং ১২০জন শিক্ষার্থী টিবি সচেতনতাকে কেন্দ্র করে একটি পোস্টার প্রতিযোগিতার মাধ্যমে তাদের সৃজনশীলতা প্রদর্শন করে।
জুলাই-অগাস্ট মাসে হওয়া ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এক মিনিট নীরবতা পালনের মধ্যে দিয়ে সমাপনী পর্ব শুরু হয়। স্বাস্থ্য অলিম্পিয়াড অনুষ্ঠিত হয়েছে প্রাথমিক, জুনিয়র ও সেকেন্ডারি—এই তিন বিভাগে। প্রতিযোগিতায় প্রাথমিকে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে বগুড়ার বিয়াম মডেল স্কুল ও কলেজের নিশাত তাসনিম, জুনিয়রে রাজশাহীর শহীদ নাজমুল হক বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের খাদিজাতুল কুবরা ও সেকেন্ডারিতে রংপুর জেলা স্কুলের মো. তৈমুর হাসান।
দলভিত্তিক দেয়ালিকা প্রতিযোগিতায় এই তিন বিভাগে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে নওগাঁর চক্রামপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, বগুড়ার আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ও রংপুর সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয় দল। প্রতিটি বিভাগের বিজয়ীরা তাদের কৃতিত্বের জন্য পদক এবং সার্টিফিকেট পেয়েছে।
প্রধান অতিথি হিসেবে সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে বলেন, ‘নাগরিকেরা সুস্থ না হলে জাতি সুস্থ হবে না। এ জন্য শৈশব থেকেই স্বাস্থ্যবিষয়ক জ্ঞানার্জন জরুরি। সমাজকে পরিবর্তনের জন্য সম্মিলিত প্রয়াস দরকার। এসব কারণে এই স্বাস্থ্য অলিম্পিয়াড খুবই গুরুত্বপূর্ণ আয়োজন। ইতিমধ্যে তোমরা দেশ গড়ার সংগ্রামে অংশ নিয়েছ।’
আইসিডিডিআর,বি-র নির্বাহী পরিচালক ড. তাহমিদ আহমেদ বলেন, যক্ষ্মা সংক্রামক রোগ। কফ–কাশির মাধ্যমে ছড়ায়। যত্রতত্র থুতু, কফ কাশি ফেলা যাবে না। এসব শিষ্টাচার মেনে চলতে হবে।
জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির প্রোগ্রাম ব্যবস্থাপক ডাঃ মো. জাহাঙ্গীর কবির বলেন, যক্ষ্মা প্রতিরোধে সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন সংস্থা কাজ করছে। ২০৩৫ সালের মধ্যে যক্ষ্মায় মৃত্যুর সংখ্যা ৯৫ শতাংশ কমিয়ে আনার লক্ষ্য রয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডাঃ নাজমুল হোসেন যক্ষ্মাকে একটি প্রাচীন রোগ এবং এটি একটি প্রধান স্বাস্থ্য উদ্বেগ হিসাবে রয়ে গেছে বলে মন্তব্য করেন। বর্তমানে রোগটি দ্রুত নির্ণয় করা যায় এবং অনেক কার্যকরী চিকিৎসা পাওয়া যায়। দেশের প্রতিটি উপজেলা এবং অনেক ইউনিয়ন পর্যায়ের স্বাস্থ্যকেন্দ্র বিনামূল্যে যক্ষ্মা পরীক্ষা করে থাকে।
ইউএসএআইডির আইডি টিম লিড ড. সামিনা চৌধুরী বলেন, শুধু মানুষকে নয়, সব সৃষ্টি জীব, পরিবেশ, প্রকৃতি সবাইকে ভালোবাসতে হবে। তাহলে নিজে আলোকিত হওয়া যাবে, সমাজও আলোকিত হবে।
ড. সায়েরা বানু, সিনিয়র সায়েন্টিস্ট এবং আইসিডিডিআর,বি-তে ইমার্জিং ইনফেকশন প্রোগ্রামের প্রধান, উল্লেখ করেন যে দেশের স্বাস্থ্য খাতে যক্ষ্মা একটি উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জ। প্রতি বছর প্রায় তিন লাখ নতুন সংক্রমণ হয়, যার ফলে প্রায় ৪২ হাজার জন মারা যায়। তিনি আরো বলেন যে দেশে যক্ষ্মা কোভিড-১৯ এর চেয়ে বেশি জীবন কেড়ে নেয়। তবে, তিনি জানয়েছেন যে এই রোগটি নিরাময়যোগ্য এবং এই প্রতিযোগিতা থেকে অর্জত জ্ঞান শিক্ষার্থীদের মাঝে সচেতনতা বাড়ানোর পাশাপাশি তাদের সহপাঠী এমনকি তাদের প্রতিবেশীদেরও এ রোগ বিষয়ে সচেতন করতে উৎসাহিত করবে।
একজন টিবি সারভাইভার প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান, অনুষ্ঠানে যক্ষ্মা বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে তার প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেন।
এছাড়াও অনুষ্ঠানে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, ন্যাশনাল টিবি কন্ট্রোল প্রোগ্রাম, ইউএসএআইডি, আইসিডিডিআর,বি এবং প্রথম আলোর প্রতিনিধিরাও অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। তাঁরা যক্ষ্মা মোকাবেলায় সহযোগিতামূলক প্রচেষ্টার গুরুত্বের ওপর জোর দেন।
স্বাস্থ্য অলিম্পিয়াড শুধুমাত্র একটি প্রতিযোগিতা নয়; বরং এটি একটি সামাজিক আন্দোলন যার উদ্দেশ্য শিক্ষার্থীদের টিবি এর কারণ, লক্ষণ এবং প্রতিরোধ সম্পর্কে শিশুদের শিক্ষা প্রদান করা যেন তারা তাদের সহপাঠী এমনকি তাদের প্রতিবেশীদেরও এ রোগ বিষয়ে সচেতন করতে পারে। সচেতনতা বৃদ্ধির এই উদ্যোগ দেশব্যাপী যক্ষ্মার প্রকোপ কমাতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।