কবিগান
আমার বালককালে যাদব সরকার আর পরীক্ষিত সরকারের গান শুনিয়াছি। যাদবের ছড়া রচনায় নানারকমের সুর ও ছন্দ থাকিত। পরীক্ষিত পাল্লা করিয়া যাদবের সঙ্গে পারিত না। কিন্তু আমার মনের সমস্ত সমর্থন ছিল পরীক্ষিতের প্রতি। যেখানেই কবিগান হইত সেখানেই আমার মন দুর্বলপক্ষের প্রতি আকৃষ্ট হইত। পদ্মাপার হইতে আসিত হরিচরণ পাটনী। সে যাদবের সঙ্গে পাল্লায় পারিত না। কিন্তু আমার কেবলই মনে হইত, হরিচরণ যেন পাল্লায় জয়লাভ করে। শুধু এই কবিগানই নয়, আজীবন সাহিত্য করিতেও আমি দুর্বলপক্ষ চাষী-মজদুরদিগকে সমর্থন করিয়া আসিতেছি। যাহাদের হইয়া বলিবার কেহ নাই তাহাদের সবচাইতে বড় সমর্থক হইবার চেষ্টা করিয়াছি।
সেকালে আমাদের ফরিদপুর জেলার রাজবাড়ি অঞ্চলে ইসমাইল নামে একজন কবিয়ালের উদয় হয়। আসরে ছড়া রচনা করিতে সে পয়ার, ত্রিপদী, তোটক প্রভৃতি বহু রকমের ছন্দ ইচ্ছামতো তাহার শ্রোতাদের মধ্যে ছুড়িয়া মারিত। ছন্দে আর মিলে এত যে পারদর্শী ছিল যাদব সে-ও ইসমাইলের তুলনায় এতটুকু হইয়া যাইত। হিন্দু পৌরাণিক শাস্ত্র ছিল তাহার নখদর্পণে। তাহারই সাহায্যে সে তাহার প্রতিপক্ষকে আঘাতের পর আঘাত করিয়া একেবারে তুলা-ধুনা করিয়া ছাড়িত। হিন্দুসমাজের যেসব গোপন তত্ত্ব, যাহা শুধু গুরুপরম্পরায় শিক্ষা করিতে হয়, ইসমাইল তাহা আসরের শ্রোতাদের মধ্যে ভাঙিয়া বলিত। অনিয়মিত রাত্র জাগরণ ও অসময়ে আহারের জন্য অল্পবয়সেই তাহার মৃত্যু হইল। তাহার সমসাময়িক কবিয়ালেরা ইহার ব্যাখ্যা করিত, হিন্দু-সমাজের সাধনপথের গোপন তত্ত্বগুলি যেখানে-সেখানে বলার জন্য তাহার এরূপ অকালমৃত্যু হয়।
আমাদের বাড়ি হইতে তিন মাইল দূরে লক্ষ্মীপুর গ্রামে একবার প্রসিদ্ধ কবিয়াল হরি আচার্যের কবিগানের ব্যবস্থা হয়। আমাদের দেশের যাদব, পরীক্ষিত, গুরুচরণ প্রভৃতি কবিয়ালেরা সকলে মিলিয়া তাহার প্রতিপক্ষ রচনা করে; কিন্তু স্রোতে-ভাসা শুকনো পাতার মতো তাহারা হরি আচার্যের সরস ও তীক্ষ্ণ বাক্যচ্ছটায় ইতস্তত-বিক্ষিপ্ত হইয়া পড়ে। তখন আমার বয়স খুব অল্প। হরি আচার্য আসরে গান করিতে শ্রোতাদের মধ্যে যে অপূর্ব ভাববন্যা আনয়ন করিতেন তাহা অনুভব করিবার মন তৈরি হয় নাই। লোকমুখে শুনিয়াছি আসরে গান গাহিয়া তিনি এরূপ ভাববন্যা আনিতেন যে শ্রোতারা তাহাতে বিভোর হইয়া উঠিত। পরিণত বয়সে আমি একবার হরি আচার্য মহাশয়ের সঙ্গে দেখা করিয়াছিলাম। তখন তিনি কবিগান ছাড়িয়া দিয়া সন্ন্যাসী হইয়া ঢাকা জেলার নরসিংদিতে একটি আশ্রম প্রতিষ্ঠা করিয়াছেন। কত আদর করিয়া তিনি আমাকে গ্রহণ করিলেন। তাঁহার রচিত ‘কবির ঝংকার’ ও ‘বঙ্গে কবিগান’ নামে দুইখানি পুস্তক আমাকে উপহার দিলেন। কবির বাংকার দুই খণ্ড পুস্তকে আচার্য মহাশয়ের কবিগানগুলি প্রকাশিত হয়। ‘বঙ্গে কবিগান’ পুস্তকে তিনি সারাজীবন যেসব কবিয়ালের সংস্পর্শে আসিয়াছিলেন, তাহাদের কথা লিখিয়াছেন।
আমি তাঁহাকে বলিলাম, “আপনার রচিত নিমাই সন্ন্যাস গানটি যদি আমি আগে শুনিতাম তবে হয়তো আমার ‘কবর’ কবিতা রচনা করিতাম না। আপনার নিমাই সন্ন্যাস গান যে-আসরে গীত হয়, শ্রোতারা কাঁদিয়া বুক ভাসায়। এমন মধুর গান আপনি ছাড়িয়া দিলেন কেন?” তিনি হাসিয়া বলিলেন, “তখন যৌবনের জোর ছিল, প্রতিপক্ষকে ঠকাইয়া আনন্দ পাইতাম। আজ আমার দেবতার কাছে গান গাহিয়া নিজেকে ঠকাইয়া আনন্দ পাই।” আচার্য মহাশয়ের পুস্তকগুলি দুষ্প্রাপ্য হইয়া উঠিয়াছে। এগুলি সংগ্রহ করিয়া কোনো বড় পুস্তকাগারে রক্ষিত হইলে যাঁহারা কবিগানের ইতিবৃত্ত খুঁজিবেন তাঁহারা অনেকখানি উপকৃত হইবেন।
ইহার পরে আমি আরও বহু কবিয়ালের গান শুনিয়াছি। সুযোগ পাইলেই কবিগান গাওয়ার শখ আমাকে পাইয়া বসিত। আমাদের ফরিদপুর শহরে কালিপদ দাস নামে আমার একজন বন্ধু আছে। আমি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করি, তখনও ফরিদপুরে গেলে সুযোগমতো তাহার সঙ্গে কবির লড়াই করিয়াছি। কালিপদ হিন্দু পৌরাণিক-কাহিনী আমার চাইতে বেশি জানে। সে তাই পুরাণ হইতে কোনো কাহিনী লইয়া আমাকে প্রশ্ন করিতে ভালোবাসিত। আমি তাহাকে উপস্থিত বুদ্ধি আর রচনাশক্তি দিয়া হারাইতে চেষ্টা করিতাম।
চলবে…