০২:২৭ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ০১ জুলাই ২০২৫

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-৭২)

  • Sarakhon Report
  • ১১:০০:৩৩ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৯ নভেম্বর ২০২৪
  • 19

কবিগান

ফরিদপুর শহরের নানা স্থান হইতে কবিগান গাওয়ার জন্য আমাদের নিমন্ত্রণ আসিত। একবার আমি ও কালিপদ রাতদুপুরে রাজকুমার চৌধুরীর বাড়ির সামনের মাঠে কবিগান গাহিতেছি। কালিপদ মুরারী গুপ্তের পাঠ লইয়া আমাকে গৌরাঙ্গ করিয়া প্রশ্ন করিতে আরম্ভ করিল। ইতিপূর্বে আমি যত কবির পাল্লা শুনিয়াছি ইত্যাকার পাঠ লইয়া কোথাও কবিগান হইতে দেখি নাই। তাই কালিপদ আমাকে নানা প্রশ্ন করিয়া একেবারে ঘায়েল করিয়া তুলিল। শ্রোতাদের মধ্যে যে প্রসিদ্ধ কবিয়াল মনোহর বিশ্বাসও একজন ছিলেন তাহা আমি জানিতাম না। আমার বিপদ দেখিয়া মনোহরবাবু আসিয়া আমার হইয়া কালিপদকে তার প্রশ্নের উত্তর দিতে নানারকম চাপান দিয়া তাহাকে একেবারেই ঘায়েল করিয়া তুলিলেন। মুরারী গুপ্ত ত্রেতা-যুগে হনুমান ছিল। কালিপদ গান গাহিতে মাজা নাচাইতেছিল। মনোহরবাবু তাহাকে চাপান দিয়া বলিলেন, “কলি-যুগে তোমার লেজ নাই, তবু লেজুর নাড়ার অভ্যাসটা ছাড়িতে পার নাই।” প্রায় ঘণ্টাখানেক তিনি ছড়া বলিয়া উপস্থিত শ্রোতৃমণ্ডলীকে মন্ত্রমুগ্ধ করিয়া তুলিলেন।

তাঁহার গানের পর কালিপদ আর পাল্টা আসরে গান গাহিতে সাহস করিল না।

পরে পরিচয় লইয়া জানিলাম, মনোহরবাবু আমার বিশেষ বন্ধু ব্যারিস্টার কবি সুরেশ বিশ্বাসের পিতা। গোপালগঞ্জ অঞ্চলের ওড়াকান্দি গ্রামে হরিবর আর মনোহর দুই ভাই কবিগান করিতেন। তাঁহারা কবিগানকে বর্তমান যুগের চাহিদা অনুসারে ঢালিয়া সাজাইয়া লইয়াছিলেন। আগেকার দিনে বড় বড় গায়কেরা গ্রাম-অঞ্চলেই বাস করিতেন। স্থানীয় কোনো যাত্রা বা কবিগানের দলে গান করিয়া যৎসামান্য যাহা পাইতেন, তাহাই সৌভাগ্য বলিয়া মনে করিতেন। প্রচুর অর্থ না পাইলেও জনসাধারণকে আনন্দ দিয়াই তাঁহারা খুশি থাকিতেন।

কালক্রমে শহর তার সর্বগ্রাসী আকর্ষণ বিস্তার করিয়া গ্রাম-অঞ্চল হইতে গুণী লোকদিগকে নিজের অঙ্কে টানিয়া লইল। গ্রামোফোন, থিয়েটার-বায়োস্কোপ, বেতার প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানে প্রচুর অর্থ উপার্জনের সুবিধা পাইয়া দেশের গুণী গায়কেরা শহরে চলিয়া গেল। যাহারা রহিল তাহাদের গান শুনিয়া আর আসরের লোকেরা খুশি হয় না। এইসব গায়কেরা কবিগানের দোহার হইয়া কানে আঙুল দিয়া বিলম্বিত লয়ের যেসব ভোর বা ডাকগান গাহিত তাহা শুধু শ্রোতা-সাধারণের উপহাসই আনয়ন করিত। সেইজন্য হরিবর আর মনোহর দোহারের বিলম্বিত লয়ের গানগুলি বর্জন করিয়া কবিগানকে ছড়াসর্বস্ব করিয়া তোলেন। পূর্বকালের কবিগানে সতীর সঙ্গে যমরাজার অথবা কৃষ্ণের সঙ্গে মহাদেবের পাল্টা বর্জন করিয়া তাহারা বিবেকানন্দের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের, বিজয় গোস্বামীর সঙ্গে কেশব সেনের পাল্টা প্রবর্তন করেন। হরিবর আর মনোহর দুই ভাই বিরাট প্রতিভাপন্ন লোক ছিলেন। যতদিন জীবিত ছিলেন ততদিন তাঁহারা জনসাধারণের তারিফই পাইয়াছিলেন। তাঁদেরই অনুকরণে দেশের অন্যান্য কবি-গানের দলও জুড়ির গান বর্জন করিয়া কবিগানকে ছড়াসর্বস্ব করিয়া সাজাইলেন। কিন্তু যে শিক্ষিত সমাজের জন্য তাঁহারা কবিগানকে ঢালিয়া সাজাইলেন, নিজেদের গান দিয়া তাঁহাদের মনোরঞ্জন করিতে পারিলেন না। তাঁহারা শহরের থিয়েটার, রেডিও, বায়োস্কোপ প্রভৃতি লইয়া মশগুল রহিলেন।

কবির লড়াইর স্থান শহরের বিতর্কসভাগুলি দখল করিল। পক্ষান্তরে গ্রাম-জীবনের যে একটি বিরাট অংশ কবিগানের রসপিপাসু ছিলেন, তাঁহারাও হরিবর-মনোহরের এই রূপান্তরিত কবিগান হইতে সরিয়া গেলেন। হরিবর-মনোহরের পরে যাঁহারা তাঁহাদের অনুকরণে কবিগান প্রচারে নামিলেন, তাঁহারা আর ওই পথে বিশেষ কিছু করিয়া যাইতে পারিলেন না।

চলবে…

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-৭২)

১১:০০:৩৩ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৯ নভেম্বর ২০২৪

কবিগান

ফরিদপুর শহরের নানা স্থান হইতে কবিগান গাওয়ার জন্য আমাদের নিমন্ত্রণ আসিত। একবার আমি ও কালিপদ রাতদুপুরে রাজকুমার চৌধুরীর বাড়ির সামনের মাঠে কবিগান গাহিতেছি। কালিপদ মুরারী গুপ্তের পাঠ লইয়া আমাকে গৌরাঙ্গ করিয়া প্রশ্ন করিতে আরম্ভ করিল। ইতিপূর্বে আমি যত কবির পাল্লা শুনিয়াছি ইত্যাকার পাঠ লইয়া কোথাও কবিগান হইতে দেখি নাই। তাই কালিপদ আমাকে নানা প্রশ্ন করিয়া একেবারে ঘায়েল করিয়া তুলিল। শ্রোতাদের মধ্যে যে প্রসিদ্ধ কবিয়াল মনোহর বিশ্বাসও একজন ছিলেন তাহা আমি জানিতাম না। আমার বিপদ দেখিয়া মনোহরবাবু আসিয়া আমার হইয়া কালিপদকে তার প্রশ্নের উত্তর দিতে নানারকম চাপান দিয়া তাহাকে একেবারেই ঘায়েল করিয়া তুলিলেন। মুরারী গুপ্ত ত্রেতা-যুগে হনুমান ছিল। কালিপদ গান গাহিতে মাজা নাচাইতেছিল। মনোহরবাবু তাহাকে চাপান দিয়া বলিলেন, “কলি-যুগে তোমার লেজ নাই, তবু লেজুর নাড়ার অভ্যাসটা ছাড়িতে পার নাই।” প্রায় ঘণ্টাখানেক তিনি ছড়া বলিয়া উপস্থিত শ্রোতৃমণ্ডলীকে মন্ত্রমুগ্ধ করিয়া তুলিলেন।

তাঁহার গানের পর কালিপদ আর পাল্টা আসরে গান গাহিতে সাহস করিল না।

পরে পরিচয় লইয়া জানিলাম, মনোহরবাবু আমার বিশেষ বন্ধু ব্যারিস্টার কবি সুরেশ বিশ্বাসের পিতা। গোপালগঞ্জ অঞ্চলের ওড়াকান্দি গ্রামে হরিবর আর মনোহর দুই ভাই কবিগান করিতেন। তাঁহারা কবিগানকে বর্তমান যুগের চাহিদা অনুসারে ঢালিয়া সাজাইয়া লইয়াছিলেন। আগেকার দিনে বড় বড় গায়কেরা গ্রাম-অঞ্চলেই বাস করিতেন। স্থানীয় কোনো যাত্রা বা কবিগানের দলে গান করিয়া যৎসামান্য যাহা পাইতেন, তাহাই সৌভাগ্য বলিয়া মনে করিতেন। প্রচুর অর্থ না পাইলেও জনসাধারণকে আনন্দ দিয়াই তাঁহারা খুশি থাকিতেন।

কালক্রমে শহর তার সর্বগ্রাসী আকর্ষণ বিস্তার করিয়া গ্রাম-অঞ্চল হইতে গুণী লোকদিগকে নিজের অঙ্কে টানিয়া লইল। গ্রামোফোন, থিয়েটার-বায়োস্কোপ, বেতার প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানে প্রচুর অর্থ উপার্জনের সুবিধা পাইয়া দেশের গুণী গায়কেরা শহরে চলিয়া গেল। যাহারা রহিল তাহাদের গান শুনিয়া আর আসরের লোকেরা খুশি হয় না। এইসব গায়কেরা কবিগানের দোহার হইয়া কানে আঙুল দিয়া বিলম্বিত লয়ের যেসব ভোর বা ডাকগান গাহিত তাহা শুধু শ্রোতা-সাধারণের উপহাসই আনয়ন করিত। সেইজন্য হরিবর আর মনোহর দোহারের বিলম্বিত লয়ের গানগুলি বর্জন করিয়া কবিগানকে ছড়াসর্বস্ব করিয়া তোলেন। পূর্বকালের কবিগানে সতীর সঙ্গে যমরাজার অথবা কৃষ্ণের সঙ্গে মহাদেবের পাল্টা বর্জন করিয়া তাহারা বিবেকানন্দের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের, বিজয় গোস্বামীর সঙ্গে কেশব সেনের পাল্টা প্রবর্তন করেন। হরিবর আর মনোহর দুই ভাই বিরাট প্রতিভাপন্ন লোক ছিলেন। যতদিন জীবিত ছিলেন ততদিন তাঁহারা জনসাধারণের তারিফই পাইয়াছিলেন। তাঁদেরই অনুকরণে দেশের অন্যান্য কবি-গানের দলও জুড়ির গান বর্জন করিয়া কবিগানকে ছড়াসর্বস্ব করিয়া সাজাইলেন। কিন্তু যে শিক্ষিত সমাজের জন্য তাঁহারা কবিগানকে ঢালিয়া সাজাইলেন, নিজেদের গান দিয়া তাঁহাদের মনোরঞ্জন করিতে পারিলেন না। তাঁহারা শহরের থিয়েটার, রেডিও, বায়োস্কোপ প্রভৃতি লইয়া মশগুল রহিলেন।

কবির লড়াইর স্থান শহরের বিতর্কসভাগুলি দখল করিল। পক্ষান্তরে গ্রাম-জীবনের যে একটি বিরাট অংশ কবিগানের রসপিপাসু ছিলেন, তাঁহারাও হরিবর-মনোহরের এই রূপান্তরিত কবিগান হইতে সরিয়া গেলেন। হরিবর-মনোহরের পরে যাঁহারা তাঁহাদের অনুকরণে কবিগান প্রচারে নামিলেন, তাঁহারা আর ওই পথে বিশেষ কিছু করিয়া যাইতে পারিলেন না।

চলবে…