কবিগান
রাজেন সরকারের দুই শিষ্য বিজয় আর নিশিকান্ত এখন নামকরা কবিয়াল। উভয় বঙ্গে তাঁহারা কবিগানের বায়না পাইয়া থাকেন। বহুদিন উঁহাদের সঙ্গে দেখা হয় না। মাঝে মাঝে দেশীয় গ্রাম্য গায়কদের মুখে বিজয়ের রচিত বিচ্ছেদ গান শুনিয়া পাগল হই। এমন সুন্দর সুর বুঝি কেহই রচনা করিতে পারে না। ছাপাখানা বা রেডিও গ্রামোফোনের সাহায্য ব্যতিরেকে বিজয়ের নতুন সুরের গানগুলি গ্রামবাংলার সর্বস্তরে ছড়াইয়া পড়িতেছে।
আগেকার দিনে কবির আসরে দোহারদের মুখে যেসব সখী-সংবাদ, ভোর, মান, বিরহ, ডাক প্রভৃতি গান শুনিয়াছি, এখনকার কবিয়ালেরা তাহা জানে না। সেই পরীক্ষিত, যাদব, ইসমাইল, হরি আচার্যের তিরোধানের পর তাঁহাদের শ্রোতারাও আজ ধীরে ধীরে নাট্য-মঞ্চ হইতে প্রস্থান করিতেছে।
এইভাবে নানা কবিগানের আসরে যাইয়া আমি নানা ছন্দে ছড়া তৈরি করিবার শিক্ষালাভ করিলাম। নানা সুরের ধুয়ার সঙ্গে পদ যোজনা করিতে করিতে আমার নানা ছন্দের ছড়া রচনার অভ্যাস হইল। কয়েকটি ধুয়া এখনও মনে আছে, প্রতিপক্ষকে চাপান দিতে নিম্নলিখিত ধুয়াগুলি আগেকার কবিয়ালেরা ব্যবহার করিত:
১। মরি হায়রে হায় এই ছিল কপালে,
লক্ষ টাকার বাগান খাইল পাঁচ সিকের ছাগলে!
২। ও তুই যাইস নারে, যাইস না কবির দলে, রাত পোহালে মঙ্গলবার ধুতুম ডাকে চালে।
৩। তেনে তেনে তেনে নেনে নাচেরে চান্দের কণা মামাশ্বশুর হও গোবিন্দ ভাবে গেল জানা।
৪। গোঁসাই লেজ নাড়ে আর খাজুর খায়, গোঁসাইরে নি দেখছ গাছতলায়।
কতকগুলি গীতিধর্মী ধুয়াও গাহিতাম:
১। রে অবোধ মন! অবোধ মন!
পূর্বের কথা নাইরে তোর মনে?
২। পরের জন্য কান্দেরে আমার মন,
আমি পর পর করে পরকাল খোয়াইলামরে; আমার সেই পরে দেয় জ্বালাতন।
৩। আমার কৃষ্ণ ভক্তের পাগলা নাও, শুকনা দিয়ে বায়া যাও,
কাঁটা গোঁজা মানে না।
৪। বড় ভাব লাগায়ে দিলি মনেরে, বড় ভাব লাগায়ে দিলি মনে।
এইসব ধুয়ার সঙ্গে পদ রচনা করিতে করিতে আপনা হইতেই নানা ছন্দে কবিতা রচনা করিবার অভ্যাস লাভ করিলাম। কিন্তু তখনও আমি জানিতাম না, আমার এই উপস্থিত-রচিত বোলগুলি আমারই অগোচরে কবিতা হইয়া যাইতেছে। তখনও আমার বিশ্বাস ছিল পাঠ্যবই-এর কবিতাগুলি আকাশ-মাটি-পৃথিবীর মতো চিরকাল হইতেই আছে অথবা খোদা স্বয়ং রচনা করিয়া দিয়াছেন। মানুষ এগুলি রচনা করিতে পারে না।
চলবে…