আবু ইসহাক
তিন-তিনটে ডাকাতি মামলার তদন্তের ভার পড়েছে থানার সেকেন্ড অফিসার ইলিয়াসের ওপর। ডাকাতিগুলো হয়েছে একই রাতে একই গ্রমের তিন বাড়িতে পর পর। গ্রামের যে একই দলের দুষ্কর্ম তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ঝাড়া দশ দিন প্রকাশ্য ও গোপন তদন্তের পর কয়েকজন সন্দেহভাজন আসামির নাম পাওয়া গেছে। দুটি অভিযান চালিয়ে সন্দেহভাজন তিন জন আসামিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের একজনের স্বীকারোক্তি থেকে ডাকাতদলের সরদার ও আরো কয়েকজন ডাকাতের নাম পাওয়া গেছে। ঐ স্বীকারোক্তি-অনুযায়ী অন্য থানা-এলাকার এক বাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে ডাকাতির মাল-কিছু সোনার অলঙ্কার ও একটা রেডিও উদ্ধার করা হয়েছে। এর থেকে স্পষ্টই বোঝা যায়, স্বীকারোক্তিটি অবিশ্বাসযোগ্য নয়।
আসামিদের গতিবিধির গোপন খবর সংগ্রহ করে পরবর্তী দু’সপ্তাহের মধ্যে কয়েকটি ঝটিকা অভিযান চালিয়ে ইলিয়াস আরো তিন জন আসামিকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হন। কিন্তু দলের সরদার আলেফ ওরফে আলফাকে কিছুতেই পাকড়াও করা যাচ্ছে না। নির্ভরযোগ্য সূত্রের খবরে জানা গেছে, আলফা বাড়িতেই থাকে, কোথাও পালিয়ে গিয়ে গা ঢাকা দেয়নি। তাই তার বাড়িতে তিন বার ঝটিকা হামলা চালানো হয়েছে-দু’বার ভোর রাত্রে ও আরেকবার রাত দশটায়। ইলিয়াসের মনে হয় আলফার বাড়ির দুটো খেঁকি কুত্তার জন্যেই তাকে পাকড়াও করা সম্ভব হচ্ছে না। বাড়ির কাছাকাছি কোনো মানুষের আনাগোনার আওয়াজ পেলেই কুত্তা দুটো অবিরাম ঘেউঘেউ শুরু করে দেয় আর আলফা ঘর থেকে বেরিয়ে বিলের পাটখেতে উধাও হয়ে যায়। এভাবে সরাসরি হামলা চালিয়ে আলফাকে ধরা যাবে না, বুঝতে পারেন ইলিয়াস। তাই চিন্তা-ভাবনা করে তিনি অভিযানের একটা পরিকল্পনা ঠিক করে নেন।
পরিকল্পনা-অনুযায়ী পূর্ণিমার ঠিক তিন দিন পরের বিকেলবেলা ইলিয়াস তল্লাহাটি পুলিশ ফাঁড়িতে গিয়ে হাজির হন। সাথে করে নিয়ে আসেন কিছু আটা যার সাথে আটটা ঘুমের বড়ি গুঁড়ো করে মেশানো হয়েছে। ফাঁড়ির একজন কনস্টেবলকে দিয়ে তিনি দুটো রুটি বানিয়ে নেন। সন্ধ্যার কিছু আগে ফাঁড়ির হাবিলদার, দু’জন রাইফেলধারী কনস্টেবল, তিন জন লাঠিধারী কনস্টেবল, আনসার কমান্ডার এবং পাঁচ জন আনসার নিয়ে তিনি আলফার বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হন। ফাঁড়ি থেকে ডাকাত-সরদারের বাড়ি প্রায় দু’মাইল। আগের অভিযানগুলোও এখান থেকেই চালানো হয়েছিল।
আষাঢ় মাসের প্রথম সপ্তাহ। বিলে বর্ষার পানি আসতে শুরু করেছে। রাস্তা দিয়ে কিছু দূর যাওয়ার পর প্যান্টের পা গুটিয়ে জুতো খুলে নামতে হলো বিলে। ধান ও পাটক্ষেতের আল ধরে একহাঁটু-আধহাঁটু পানি ভেঙে ইলিয়াস তাঁর দলবল নিয়ে চলছেন। সন্ধ্যার বেশ কিছু পরে আলফার বাড়ির নিচে হালটে পৌঁছার সাথে সাথে কুত্তার ঘেউঘেউ শুরু হয়ে যায়। ইলিয়াস জানেন, খেঁকি কুত্তার ঘেউঘেউ সার। কাছে এসে কামড়াবার সাহস নেই খেঁকি কুত্তার।
আলফাকে ঘরে পাওয়া যাবে না জেনেও ইলিয়াস তিনটে বড় টর্চ জ্বালিয়ে ঘরে তল্লাশি চালান। তারপর বেরিয়ে হাবিলদার, আনসার কমান্ডার, রাইফেলধারী দু’জন কনস্টেবল ও আরো কয়েকজনকে নিয়ে পুবের ভিটির ঘরের বারান্দায় গিয়ে মাদুরের ওপর বসেন। এ ঘরে থাকে এক প্রৌঢ়া বিধবা। তার একমাত্র ছেলে রোজ সন্ধ্যার আগে চলে যায় পদ্মায় এবং বাড়ি ফিরে আসে পরের দিন ভোরে। সে বড়শি দিয়ে মাছ ধরে বিক্রি করে। এই রোজগারেই কষ্টেসৃষ্টে চলে মা ও ছেলের পেট। এই বিধবা মা এবং মহল্লার অন্যান্য সবাই আলফার দুষ্কর্মের ঘোর বিরোধী। কিন্তু ওর ভয়ে কেউ কিছু বলতে পারে না। আগের অভিযানের সময় এসব তথ্য ইলিয়াস সংগ্রহ করেছিলেন। প্রৌঢ়া তাঁকে একটা অবিশ্বাস্য খবরও দিয়েছিল, ওরে আপনেরা ধরতে পারবেন না। ও মন্তর জানে। মন্তর পইড়্যা ও পিঁপড়া অইতে পারে, ইন্দুর অইতে পারে। ইলিয়াস তিনটে দশ টাকার নোট পৌঢ়ার হাতে গুঁজে দিয়ে বলেন, চাচি, আজ
রাতটা আমরা কয়েকজন আপনার বারান্দায় বসে থাকব। আপনি কুপিটা নিয়ে ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে শুয়ে থাকুন। প্রৌঢ়ার সন্ত্রস্ত চোখ মুখের দিকে তাকিয়ে ইলিয়াস আবার বলেন, আপনার কোনো ভয় নেই, শয়তানটা কিচ্ছু করতে পারবে না আপনার। ও জানতেই পারবে না আপনি আমাদের জায়গা দিয়েছেন। ১৯৫২ সালের ত্রিশ টাকার তখন অনেক দাম। এখনকার চালের দাম ধরে হিসাব করলে প্রায় একহাজার টাকা আর সোনার দাম ধরে হিসেব করলে প্রায় তিন হাজার টাকা। টাকা পেয়ে ভয়কে জয় করে সে কুপিটা নিয়ে ঘরে গিয়ে খিল এঁটে দেয়।
কৃষ্ণপক্ষের জমাট অন্ধকার। কুত্তাদুটোর ক্রুদ্ধ ঘেউঘেউ চলছে তো চলছেই। আনসার কমান্ডার ও রাইফেলধারী কনস্টেবল দু’জনকে নিয়ে ইলিয়াস চুপচাপ বসে থাকেন দরমার বেড়ায় ঘেরা বাতিহীন বারান্দায়। আর অন্যান্যদের নিয়ে হাবিলদার ফাঁড়ির দিকে রওনা হয়ে যায়। ইলিয়াসের নির্দেশে তারা এমন ডাকাডাকি হইচই করতে করতে যাচ্ছিল যে কুত্তাদুটো ছাড়া পাড়ার সবাই মনে করল, যারা আলফাকে ধরতে এসেছিল তারা সবাই চলে গেছে।
কুত্তা দুটো বারান্দার উত্তরদিকের বেড়ার কাছে এসে ঘেউঘেউ করছে। ইলিয়াস পকেট থেকে রুটি দুটো বের করে বেড়ার তলা দিয়ে ওগুলো বাইরে ফেলে দেন। অন্ধকারে কিছু দেখা না গেলেও হঠাৎ ঘেউঘেউ থেমে যাওয়ায় তিনি বুঝতে পারেন কুত্তাদুটো রুটি খাচ্ছে।
কিছুক্ষণ পরে আবার ঘেউঘেউ শোনা যায়। কিন্তু তা মাত্র অল্পক্ষণের জন্যে। ঘেউঘেউ ক্রমে ক্ষীণতর হয়ে ঘেঘে-গোগো করতে করতে অবশেষে স্তব্ধ হয়ে যায়। ইলিয়াস বুঝতে পারেন, ঘুমের বড়ির প্রভাবে কুত্তা দুটো গভীর ঘুমে অচেতন হয়ে পড়েছে। ওদের এ ঘুম আদৌ ভাঙবে কি না কে জানে।
কান খাড়া করে বাঁশের বেড়ার ছিদ্রপথে ইলিয়াস ও তাঁর সঙ্গীরা তাকিয়ে আছেন আলফার ঘরের দরজার দিকে। ওখানে কারো আনাগোনা হলে এ অন্ধকারেও তার কিছুটা আভাস পাওয়া যেতে পারে। এক সময়ে টুপির আড়ালে টর্চ জ্বেলে হাতঘড়ি দেখেন ইলিয়াস। রাত সাড়ে দশটা। আর কিছুক্ষণ পরেই উঠবে কৃষ্ণপক্ষের চাঁদ। রাত এগারোটার দিকে অন্ধকার কিছুটা তরল হয়। ইলিয়াস বুঝতে পারেন, পুব আকাশে চাঁদ উঁকি দিয়েছে। কালো অন্ধকার ক্রমশ ফিকে হয়ে আসছে। এখন স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে আলফার ঘরটা।
রাত বারোটার কিছু পরে একটা ছায়ামূর্তি আলফার ঘরের দরজার কাছে এসে টোকা দেয়। কয়েকবার টোকা দেয়ার পর কপাট খোলে কেউ। ছায়ামূর্তিটা যে আলফা তাতে সন্দেহ নেই ইলিয়াসের। সে ঘরে ঢুকলে কপাট বন্ধ হয়ে যায়।
ইলিয়াস ও তাঁর সঙ্গীরা চুপচাপ বসে থাকে আরো অনেকক্ষণ। লোকটা ঘুমিয়ে পড়ার পর যা করার করা যাবে। হাবিলদারকে তার লোকলশকর নিয়ে রাত চারটায় এখানে আসতে বলে দিয়েছেন ইলিয়াস।
ঘড়ি দেখে তিনটার সময় ইলিয়াস ও তাঁর সঙ্গীরা অতি সাবধানে বারান্দার কপাট খুলে পরিকল্পনা অনুসারে নিঃশব্দ পায়ে চটপট নিজেদের নির্ধারিত অবস্থানে গিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে যান। পুবদিকের দরজা ছাড়া ঘরটির আরো একটি দরজা আছে উত্তরদিকে। ঘরের সাথে যুক্ত রান্নাঘর ও ঢেঁকিঘর দিয়ে বেরুবার দরজা এটি। সদা- সতর্ক ও সদা-প্রস্তুত দুই কনস্টেবল রাইফেল নিয়ে দুটো দরজা পাহারা দিচ্ছে। ডাকাতটা টের পেয়ে গেলে হয়ত দরজা খুলে হঠাৎ দৌড়ে পালাবার চেষ্টা করতে পারে। সে অবস্থায় রাইফেলের বাট দিয়ে বাড়ি মেরে তাকে কুপোকাত করতে হবে। ইলিয়াস ঘরের দক্ষিণ ও পুবদিকটায় আর আনসার কমান্ডার উত্তর ও পশ্চিমদিকটায় ঘুরে ঘুরে পাহারা দিচ্ছেন। ঘরের বেড়া কেটে পালাবার চেষ্টা করাও কিছু অসম্ভব নয় আলফার পক্ষে।
রাত চারটে বাজার দশ মিনিট আগেই হালিদার পাঁচজন কনস্টেবল ও পাঁচ জন আনসার নিয়ে হাজির হয় সেখানে। সবাইকে ঘরের চারদিকে মোতায়েন করে ইলিয়াস ভোর হওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন।
ভোর ছ’টার পর পুব দিকের দরজায় খটখট দেয় হাবিলদার। বেশ কিছুক্ষণ খটখটানির পর দরজা খোলে আলফার বউ। তাকে একপাশে সরে যেতে বলে আনসার কমান্ডার, হাবিলদার ও একজন রাইফেলধারী কনস্টেবলকে নিয়ে ঘরে ঢোকেন ইলিয়াস। কিন্তু সারা ঘর খুঁজেও আলফাকে পাওয়া যায় না। তবে কি সে ‘আফার’-এ অর্থাৎ চালার নিচের মাচার ওপর উঠে লুকিয়ে আছে? হাবিলদার ও কনস্টেবলকে আফারে উঠতে বলেন ইলিয়াস। হাবিলদার রাইফেলের নল সামনে এগিয়ে ধরে আফারে ওঠে। তার পেছনে ওঠে কনস্টেবল। কিন্তু সেখানেও আলফাকে পাওয়া যায় না। জলজ্যান্ত মানুষটাকে ঘরে ঢুকতে দেখেছেন ইলিয়াস। সে যাবে কোথায়? আলফার বউকে জিজ্ঞেস করেন ইলিয়াস, তোমার সোয়ামি তো ঘরেই ছিল। সে গেল কোথায়?
-হ, উনি ঘরেই আছিল। ডাকাতের বউয়ের নির্ভীক উত্তর। তার চোখেমুখেও কণ্ঠস্বরে ভয়ের লেশমাত্র নেই।
-ঘরে ছিল, তারপর কোথায় গেল সে?
-উনি মন্তর জানে। ইন্দুর অইয়া কোন গর্তে ঢুইক্যা গেছে কে জানে?
-স্যার ঐ তো একটা ইন্দুরের গর্ত! ঘরের কোণের একটা ইন্দুরের গর্ত দেখিয়ে বলে একজন কনস্টেবল, স্যার গর্তে পানি ঢাললে ইন্দুর বাইর অইয়া আইব। কনস্টেবলের কথায় বিন্দুমাত্র আগ্রহ না দেখিয়ে ইলিয়াস ঘরের চারদিকে আর একবার চোখ বুলিয়ে ঘরের উত্তর দিককার বারান্দায় গিয়ে ঢোকেন। এদিকে দু’জন অতি উৎসাহী কনস্টেবল বালতি ভরে পানি এনে বদনা দিয়ে ঢালতে শুরু করেছে ইঁদুরের গর্তে।
বারান্দার একপাশে রান্নার জায়গা আর একপাশে ঢেঁকি। ঢেঁকিটা একটা হোগলা দিয়ে ঢাকা। ইলিয়াসের চোখ নিবদ্ধ হয় হোগলাটার ওপর। তিনি পাশের এক কনস্টেবলের লাঠি নিজের হাতে নিয়ে হাবিলদারকে চোখের ইশারায় হোগলাটা ওঠাতে বলেন। হোগলা ওঠাতেই ঢেঁকির কাঠের নিচুতে পিঠ ঠেকিয়ে চার হাত-পায়ে চতুস্পদ জন্তুর মতো দাঁড়ানো আলফা তার হাতের কাছে রাখা রামদা নিয়ে বেরুবার চেষ্টা করে। কিন্তু ইলিয়াসের লাঠির ঘায়ে তার হাত থেকে রামদাটা পড়ে যায়। সাথে সাথে হাবিলদার ঝাপিয়ে পড়ে তার ওপর। আর যায় কোথা?
দু’হাত পিঠমোড়া করে বেঁধে মাজায় রশি লাগিয়ে আলফাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে থানায়। পথ চলতে চলতে হাবিলদার ও কনস্টেবলদের উদ্দেশে ইলিয়াস বলেন, ওর বউ মন্তরের কথা বলে পুলিশকে বিভ্রান্ত করতে চেয়েছিল, ধোঁকা দিতে চেয়েছিল। ওর কথা বিশ্বাস করলে আজ পণ্ড হতো সব পরিশ্রম। মন্ত্রতন্ত্র, ভূতপেত্নী ও আলৌকিক কোনো কিছু বিশ্বাস করা একেবারেই উচিত নয় পুলিশের। যারা বিশ্বাস করে তারা ধোঁকা খায়, মিথ্যের পেছনে অকারণ ঘুরে ব্যর্থ হয়।