১১:৪৭ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ৩০ জুন ২০২৫

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-৮৭)

  • Sarakhon Report
  • ১১:০০:৪৫ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ৮ ডিসেম্বর ২০২৪
  • 18

সন্ন্যাসী ঠাকুর

ঢাকা জেলার বিক্রমপুর অঞ্চলে কোনো এক গ্রামে তাঁহার বাড়ি ছিল। নাটরের পাগলা মহারাজার সঙ্গে ঘোড়ায় চড়িয়া সন্ন্যাসী ঠাকুর এখানে-ওখানে ঘুরিয়া বেড়াইতেন। মহারাজার মতোই সকলে তাঁহাকে সম্মান করিত। তাঁহার স্ত্রী ছিলেন অসামান্য সুন্দরী। দুই-তিনটি শিশুপুত্র রাখিয়া তিনি পরলোকবাসিনী হইলেন। তখন চলিল কিছুদিন তাঁহার শোকের অগ্নিদাহনে নিজেকে তিলে তিলে দহন করার কঠোর তপস্যা। সেই বহ্নিমান শোক-যজ্ঞে ধীরে ধীরে তিনি বিলাস, ব্যসন, খ্যাতি, মান সমস্ত কিছু বিসর্জন দিয়া একদিন সন্ন্যাসীর গেরুয়া, কমণ্ডলু ধারণ করিয়া গৃহ হইতে বাহির হইয়া গেলেন। তারপর লোকনাথ ব্রহ্মচারী, বামাখ্যাপা প্রভৃতি বহু সন্ন্যাসীর শিষ্য হইয়া ভারতের বহু তীর্থস্থান পরিভ্রমণ করিলেন। কখনও অমানিশার ঘোর কুটি-অন্ধকারে শ্মশানের শবের উপর বসিয়া, কখনও হিংস্রজন্তু-অধ্যুষিত হিমাচলের দুর্ভেদ্য গুহার গহিন কুহরে বসিয়া চলিল তাঁহার কঠোর তপস্যা।

তারপর শত শত সন্ন্যাসীর সঙ্গে কেদারবদরি পার হইয়া লছমোনঝোলা অতিক্রম করিয়া সেই সুদূর বাঘগোহা, সেখান হইতে মানস-সরোবর। এত পথের স্মরণ-চিহ্ন খুলিয়া খুলিয়া তিনি তাঁর শ্রোতাদের মধ্যে বিতরণ করিতে লাগিলেন। আমার বালকমন ফুলের মতো জীবন-বৃক্ষ হইতে ঝরিয়া তাঁহার পায়ে লুটাইয়া পড়িল। সেইদিন হইতে আমার শয়নে-স্বপনে এই সন্ন্যাসী ঠাকুরের কথা মনে আসিতে লাগিল।

আমাদের ঘরে নানা অভাব, সেই অভাব অবলম্বন করিয়া নানা কলহ। সেখান হইতে কে যেন আমাকে বংশীধ্বনির আকর্ষণ করিয়া এই সন্ন্যাসী ঠাকুরের কাছে টানিয়া আনিত। এখানে আসিলে ভালোবাসা, স্নেহ, মমতা, শান্তি। সুযোগ পাইলে আমি সন্ন্যাসী ঠাকুরের কাছে আসিয়া বসিয়া থাকিতাম। তাঁহার মুখের দিকে চাহিয়া থাকিতাম। এমন মানুষ যেন আর কোথাও হয় না। আর কোথায় হইবেও না। আমার প্রাণের মানুষ-আমার মনের মানুষ। সন্ন্যাসী ঠাকুরও যেন আমাকে না দেখিলে থাকিতে পারিতেন না। শহর হইতে তাঁহার ভক্তমণ্ডলী ভারে ভারে মিষ্টি, ফলমূল, আরও কতরকমের খাবার আনিয়া তাঁহাকে ভেট দিত। সেইসব খাবার তিনি নিজের হাতে তুলিয়া আমাকে খাইতে দিতেন।

এইভাবে দিনে দিনে আমি সন্ন্যাসী ঠাকুরের ভক্তগোষ্ঠীর একজন হইয়া পড়িলাম। তিনি যেমন আমাকে ভালোবাসিতেন তাঁহার ভক্তেরাও তেমনি আমাকে স্নেহের সঙ্গে দেখিতে লাগিলেন।

শহরের ভক্তেরা সন্ন্যাসী ঠাকুরের জন্য শ্মশানেরই একপাশে একখানা ঘর তৈরি করিয়া দিলেন। চারিধারের পাঁচ-ছয়টি আমগাছের মধ্যে ছোট্ট একখানা কুঁড়েঘর। সামনে একটি ছোট বারান্দা। তারপরে প্রকাণ্ড উঠান। উঠানের পরে ফুলের বাগান। সেখানে নানারকমের ফুলের চারা সদ্য রোপিত হইয়াছে। প্রতিদিন সকালে উঠিয়া সন্ন্যাসী ঠাকুর নিজেই এই বাগানের তম্বির-তালাশি করিতেন। আমি আর তাঁহার খাসভক্ত অশ্বিনীদাদা বাগানের গাছগুলিতে পানি দিতাম। তারপর ঘরদোর ঝ্যাঁট দিয়া গোবর-পানি দিয়া লেপিয়া দিতাম। এসব কাজ করিতে আমার মোটেই পরিশ্রম লাগিত না। আমাদের বাড়ির সাংসারিক কাজে আমি একখানি কুটোও টানিয়া দুইখানি করিতাম না। কিন্তু সন্ন্যাসী ঠাকুরের কাছে আসিয়া তাঁহার সমস্ত ঘর-গেরস্থালির কাজ করিতে আমার এতটুকুও কষ্ট বোধ হইত না। ইতিপূর্বে বাড়িতে ফুলের বাগান করিবার শখ মিটাইতে পারি নাই।

 

চলবে…

 

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-৮৭)

১১:০০:৪৫ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ৮ ডিসেম্বর ২০২৪

সন্ন্যাসী ঠাকুর

ঢাকা জেলার বিক্রমপুর অঞ্চলে কোনো এক গ্রামে তাঁহার বাড়ি ছিল। নাটরের পাগলা মহারাজার সঙ্গে ঘোড়ায় চড়িয়া সন্ন্যাসী ঠাকুর এখানে-ওখানে ঘুরিয়া বেড়াইতেন। মহারাজার মতোই সকলে তাঁহাকে সম্মান করিত। তাঁহার স্ত্রী ছিলেন অসামান্য সুন্দরী। দুই-তিনটি শিশুপুত্র রাখিয়া তিনি পরলোকবাসিনী হইলেন। তখন চলিল কিছুদিন তাঁহার শোকের অগ্নিদাহনে নিজেকে তিলে তিলে দহন করার কঠোর তপস্যা। সেই বহ্নিমান শোক-যজ্ঞে ধীরে ধীরে তিনি বিলাস, ব্যসন, খ্যাতি, মান সমস্ত কিছু বিসর্জন দিয়া একদিন সন্ন্যাসীর গেরুয়া, কমণ্ডলু ধারণ করিয়া গৃহ হইতে বাহির হইয়া গেলেন। তারপর লোকনাথ ব্রহ্মচারী, বামাখ্যাপা প্রভৃতি বহু সন্ন্যাসীর শিষ্য হইয়া ভারতের বহু তীর্থস্থান পরিভ্রমণ করিলেন। কখনও অমানিশার ঘোর কুটি-অন্ধকারে শ্মশানের শবের উপর বসিয়া, কখনও হিংস্রজন্তু-অধ্যুষিত হিমাচলের দুর্ভেদ্য গুহার গহিন কুহরে বসিয়া চলিল তাঁহার কঠোর তপস্যা।

তারপর শত শত সন্ন্যাসীর সঙ্গে কেদারবদরি পার হইয়া লছমোনঝোলা অতিক্রম করিয়া সেই সুদূর বাঘগোহা, সেখান হইতে মানস-সরোবর। এত পথের স্মরণ-চিহ্ন খুলিয়া খুলিয়া তিনি তাঁর শ্রোতাদের মধ্যে বিতরণ করিতে লাগিলেন। আমার বালকমন ফুলের মতো জীবন-বৃক্ষ হইতে ঝরিয়া তাঁহার পায়ে লুটাইয়া পড়িল। সেইদিন হইতে আমার শয়নে-স্বপনে এই সন্ন্যাসী ঠাকুরের কথা মনে আসিতে লাগিল।

আমাদের ঘরে নানা অভাব, সেই অভাব অবলম্বন করিয়া নানা কলহ। সেখান হইতে কে যেন আমাকে বংশীধ্বনির আকর্ষণ করিয়া এই সন্ন্যাসী ঠাকুরের কাছে টানিয়া আনিত। এখানে আসিলে ভালোবাসা, স্নেহ, মমতা, শান্তি। সুযোগ পাইলে আমি সন্ন্যাসী ঠাকুরের কাছে আসিয়া বসিয়া থাকিতাম। তাঁহার মুখের দিকে চাহিয়া থাকিতাম। এমন মানুষ যেন আর কোথাও হয় না। আর কোথায় হইবেও না। আমার প্রাণের মানুষ-আমার মনের মানুষ। সন্ন্যাসী ঠাকুরও যেন আমাকে না দেখিলে থাকিতে পারিতেন না। শহর হইতে তাঁহার ভক্তমণ্ডলী ভারে ভারে মিষ্টি, ফলমূল, আরও কতরকমের খাবার আনিয়া তাঁহাকে ভেট দিত। সেইসব খাবার তিনি নিজের হাতে তুলিয়া আমাকে খাইতে দিতেন।

এইভাবে দিনে দিনে আমি সন্ন্যাসী ঠাকুরের ভক্তগোষ্ঠীর একজন হইয়া পড়িলাম। তিনি যেমন আমাকে ভালোবাসিতেন তাঁহার ভক্তেরাও তেমনি আমাকে স্নেহের সঙ্গে দেখিতে লাগিলেন।

শহরের ভক্তেরা সন্ন্যাসী ঠাকুরের জন্য শ্মশানেরই একপাশে একখানা ঘর তৈরি করিয়া দিলেন। চারিধারের পাঁচ-ছয়টি আমগাছের মধ্যে ছোট্ট একখানা কুঁড়েঘর। সামনে একটি ছোট বারান্দা। তারপরে প্রকাণ্ড উঠান। উঠানের পরে ফুলের বাগান। সেখানে নানারকমের ফুলের চারা সদ্য রোপিত হইয়াছে। প্রতিদিন সকালে উঠিয়া সন্ন্যাসী ঠাকুর নিজেই এই বাগানের তম্বির-তালাশি করিতেন। আমি আর তাঁহার খাসভক্ত অশ্বিনীদাদা বাগানের গাছগুলিতে পানি দিতাম। তারপর ঘরদোর ঝ্যাঁট দিয়া গোবর-পানি দিয়া লেপিয়া দিতাম। এসব কাজ করিতে আমার মোটেই পরিশ্রম লাগিত না। আমাদের বাড়ির সাংসারিক কাজে আমি একখানি কুটোও টানিয়া দুইখানি করিতাম না। কিন্তু সন্ন্যাসী ঠাকুরের কাছে আসিয়া তাঁহার সমস্ত ঘর-গেরস্থালির কাজ করিতে আমার এতটুকুও কষ্ট বোধ হইত না। ইতিপূর্বে বাড়িতে ফুলের বাগান করিবার শখ মিটাইতে পারি নাই।

 

চলবে…