০৭:০২ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ৩০ জুন ২০২৫

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-৯৪)

  • Sarakhon Report
  • ১১:০০:৩৫ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১৬ ডিসেম্বর ২০২৪
  • 16

সন্ন্যাসী ঠাকুর

মেয়েটি হাসিয়া বলিল, “তুমি যে আমার ছেলে বাবা! ছেলের জন্য মা এত কিছু করিবে না তো কে করিবে?” সন্ন্যাসী ঠাকুর আবার জিজ্ঞাসা করিলেন, “মা! বল তো তুমি কে?”

মেয়েটি বলিল, “আমি গয়লাদের মেয়ে। পাহাড়ের ওই ধারে একটা বাড়ি দেখিতে পাইতেছ না? আমি ওইখানে থাকি।” সন্ন্যাসী ঠাকুর মেয়েটির হাত দুইখানা কপালে রাখিয়া বলিলেন, “মা, বল তো, তুমি আমাকে ছাড়িয়া যাইবে না?”

মেয়েটি বলিল, “ছি বাবা। অমন অলক্ষুনে কথা মনে করিতে নাই। মা কি কোনোদিন ছেলেকে ছাড়িয়া থাকিতে পারে? তুমি যখন ডাকিবে তখনই আমাকে পাইবে।” এমনি করিয়া দিনের পর দিন যাইতে লাগিল। রোগী এখন কিছু ভালোর দিকে। মেয়েটি এখন আর বসিয়া থাকে না। সকালে বিকালে আসিয়া সন্ন্যাসী ঠাকুরকে খাওয়াইয়া দিয়া চলিয়া যায়। সেই সময়টি সন্ন্যাসী ঠাকুরের কাছে যেন স্বর্গের মতো মনে হয়। মেয়েটি যখন আসে তখন সমস্ত পাহাড় যেন বেলি ফুলের গন্ধে ভরিয়া যায়।।

সন্ন্যাসী ঠাকুর যেদিন অন্নপথ্য করিবেন সেদিন মেয়েটি নিজ হাতে রান্না করিল। তারপর ঝরনার জল আনিয়া সন্ন্যাসী ঠাকুরকে স্নান করাইয়া আঁচল দিয়া তাঁহার গা মুছাইয়া দিল। নিজের হাতে তুলিয়া তুলিয়া সন্ন্যাসী ঠাকুরকে খাওয়াইল। সন্ন্যাসী ঠাকুর বলিলেন, “মা, তুমি নিজে খাইবে না?”

মেয়েটি বলিল, “বাবা। আমার খাইতে অনেক দেরি। স্নান করিব। পূজা-অর্চনা করিব। তবে আমার খাওয়া। এই কলসিতে জল ভরিয়া রাখিয়া গেলাম। তেষ্টা পাইলে পান করিও। আর এই ভাণ্ডের মধ্যে কিছু ছাতু রাখিলাম। ক্ষুধা পাইলে খাইও। বাবা। আমার তো দেরি হইয়া গেল। আমি এখন যাই।”

এই বলিয়া মেয়েটি চলিয়া গেল। পরদিন সারাক্ষণ পথের দিকে চাহিয়া সন্ন্যাসী ঠাকুর অপেক্ষা করিলেন। মেয়েটি আসিল না। তার পরদিনও চলিয়া গেল। মেয়েটির আর দেখা নাই। কলসির জল কলসিতে পড়িয়া রহিল। ভাণ্ডের ছাতু ভাণ্ডে পড়িয়া রহিল। কার খাওয়া কে খায়! সেই মেয়েটিকে খুঁজিয়া পাওয়া এখন সন্ন্যাসী ঠাকুরের একমাত্র কামনা। দুর্বল শরীরে যতটা পারেন এ-পাহাড় ঘুরেন। মা মা বলিয়া ডাক ছাড়েন। পাহাড়ের গায়ে সে-ডাক প্রতিধ্বনিত হইয়া তাঁহারই কানে আবার ফিরিয়া আসে। একদিন তিনি অনেক কষ্টে অদূরের গয়লা বস্তিতে যাইয়া উপস্থিত হইলেন। সেখানে এ-বাড়ি ও-বাড়ি মেয়েটির কত সন্ধান করিলেন। কেহই তাহার কোনো খোঁজ দিতে পারিল না।

এই গল্প শেষ হইলে দিদি একটি দীর্ঘনিশ্বাস ছাড়িয়া বলিলেন, “কি করিয়া বাবা এই মেয়েটির সন্ধান পাইবেন? মা কালী স্বয়ং আসিয়া বাবার সেবা-শুশ্রূষা করিয়া গেলেন।” এই বলিয়া দিদি দুইহাত জোড় করিয়া কপালে ঠেকাইলেন।

দিদি শুধু আমার কাছে সন্ন্যাসী ঠাকুরের কথাই শুনিতেন না। খুঁটিয়া খুঁটিয়া তিনি আমার বাড়িঘরের কথা, আমার মা-বাবা ভাই-বোনদের কথা জিজ্ঞাসা করিতেন। আমি যে প্রায় অধিকাংশ দিনই নুনভাত খাই তাহা শুনিয়া দিদির চোখ দুইটি অশ্রুসজল হইল। একদিন দিদি আমাকে বলিলেন, ‘জইসারে! তুই তো আমাকে আপন দিদির মতোই জানিস। যেদিন তোর ইচ্ছা হয় আমার কাছে আসিয়া খাবার চাহিস। কোনো লজ্জা করিস না।”

ইহার পর কোনো কোনো দিন এখানে-ওখানে ঘুরিয়া সময় কাটাইয়াছি। বাড়ি যাইয়া খাইবার অবসর পাই নাই। বেলা তিনটার সময় রানীদিদিকে যাইয়া বলিয়াছি, “দিদি। আপনার এখানে আমি খাইব।”

এত বেলায় সকলের খাওয়া হইয়া গিয়াছে। দিদিরা হাঁড়ি-পাতিল ধুইয়া তিন জায়ে গল্প করিতে বসিয়াছেন। দিদি আমার শুকনা মুখের দিকে চাহিয়া তৎক্ষণাৎ ঘরের বারান্দায় একটি ছোট্ট চুলায় আমার জন্য ভাত চড়াইয়া দিলেন। সুধীরলালের মা বঁটি পাতিয়া বসিয়া দুইটি পটলের ছাল ছাড়াইয়া সেই হাঁড়ির মধ্যে ফেলিয়া দিলেন। রতনের মা আনিয়া দিলেন তিন-চারটি আলু। গল্প করিতে করিতে কুড়ি মিনিটের মধ্যে রান্না শেষ হইয়া যাইত।

 

চলবে…

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-৯৪)

১১:০০:৩৫ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১৬ ডিসেম্বর ২০২৪

সন্ন্যাসী ঠাকুর

মেয়েটি হাসিয়া বলিল, “তুমি যে আমার ছেলে বাবা! ছেলের জন্য মা এত কিছু করিবে না তো কে করিবে?” সন্ন্যাসী ঠাকুর আবার জিজ্ঞাসা করিলেন, “মা! বল তো তুমি কে?”

মেয়েটি বলিল, “আমি গয়লাদের মেয়ে। পাহাড়ের ওই ধারে একটা বাড়ি দেখিতে পাইতেছ না? আমি ওইখানে থাকি।” সন্ন্যাসী ঠাকুর মেয়েটির হাত দুইখানা কপালে রাখিয়া বলিলেন, “মা, বল তো, তুমি আমাকে ছাড়িয়া যাইবে না?”

মেয়েটি বলিল, “ছি বাবা। অমন অলক্ষুনে কথা মনে করিতে নাই। মা কি কোনোদিন ছেলেকে ছাড়িয়া থাকিতে পারে? তুমি যখন ডাকিবে তখনই আমাকে পাইবে।” এমনি করিয়া দিনের পর দিন যাইতে লাগিল। রোগী এখন কিছু ভালোর দিকে। মেয়েটি এখন আর বসিয়া থাকে না। সকালে বিকালে আসিয়া সন্ন্যাসী ঠাকুরকে খাওয়াইয়া দিয়া চলিয়া যায়। সেই সময়টি সন্ন্যাসী ঠাকুরের কাছে যেন স্বর্গের মতো মনে হয়। মেয়েটি যখন আসে তখন সমস্ত পাহাড় যেন বেলি ফুলের গন্ধে ভরিয়া যায়।।

সন্ন্যাসী ঠাকুর যেদিন অন্নপথ্য করিবেন সেদিন মেয়েটি নিজ হাতে রান্না করিল। তারপর ঝরনার জল আনিয়া সন্ন্যাসী ঠাকুরকে স্নান করাইয়া আঁচল দিয়া তাঁহার গা মুছাইয়া দিল। নিজের হাতে তুলিয়া তুলিয়া সন্ন্যাসী ঠাকুরকে খাওয়াইল। সন্ন্যাসী ঠাকুর বলিলেন, “মা, তুমি নিজে খাইবে না?”

মেয়েটি বলিল, “বাবা। আমার খাইতে অনেক দেরি। স্নান করিব। পূজা-অর্চনা করিব। তবে আমার খাওয়া। এই কলসিতে জল ভরিয়া রাখিয়া গেলাম। তেষ্টা পাইলে পান করিও। আর এই ভাণ্ডের মধ্যে কিছু ছাতু রাখিলাম। ক্ষুধা পাইলে খাইও। বাবা। আমার তো দেরি হইয়া গেল। আমি এখন যাই।”

এই বলিয়া মেয়েটি চলিয়া গেল। পরদিন সারাক্ষণ পথের দিকে চাহিয়া সন্ন্যাসী ঠাকুর অপেক্ষা করিলেন। মেয়েটি আসিল না। তার পরদিনও চলিয়া গেল। মেয়েটির আর দেখা নাই। কলসির জল কলসিতে পড়িয়া রহিল। ভাণ্ডের ছাতু ভাণ্ডে পড়িয়া রহিল। কার খাওয়া কে খায়! সেই মেয়েটিকে খুঁজিয়া পাওয়া এখন সন্ন্যাসী ঠাকুরের একমাত্র কামনা। দুর্বল শরীরে যতটা পারেন এ-পাহাড় ঘুরেন। মা মা বলিয়া ডাক ছাড়েন। পাহাড়ের গায়ে সে-ডাক প্রতিধ্বনিত হইয়া তাঁহারই কানে আবার ফিরিয়া আসে। একদিন তিনি অনেক কষ্টে অদূরের গয়লা বস্তিতে যাইয়া উপস্থিত হইলেন। সেখানে এ-বাড়ি ও-বাড়ি মেয়েটির কত সন্ধান করিলেন। কেহই তাহার কোনো খোঁজ দিতে পারিল না।

এই গল্প শেষ হইলে দিদি একটি দীর্ঘনিশ্বাস ছাড়িয়া বলিলেন, “কি করিয়া বাবা এই মেয়েটির সন্ধান পাইবেন? মা কালী স্বয়ং আসিয়া বাবার সেবা-শুশ্রূষা করিয়া গেলেন।” এই বলিয়া দিদি দুইহাত জোড় করিয়া কপালে ঠেকাইলেন।

দিদি শুধু আমার কাছে সন্ন্যাসী ঠাকুরের কথাই শুনিতেন না। খুঁটিয়া খুঁটিয়া তিনি আমার বাড়িঘরের কথা, আমার মা-বাবা ভাই-বোনদের কথা জিজ্ঞাসা করিতেন। আমি যে প্রায় অধিকাংশ দিনই নুনভাত খাই তাহা শুনিয়া দিদির চোখ দুইটি অশ্রুসজল হইল। একদিন দিদি আমাকে বলিলেন, ‘জইসারে! তুই তো আমাকে আপন দিদির মতোই জানিস। যেদিন তোর ইচ্ছা হয় আমার কাছে আসিয়া খাবার চাহিস। কোনো লজ্জা করিস না।”

ইহার পর কোনো কোনো দিন এখানে-ওখানে ঘুরিয়া সময় কাটাইয়াছি। বাড়ি যাইয়া খাইবার অবসর পাই নাই। বেলা তিনটার সময় রানীদিদিকে যাইয়া বলিয়াছি, “দিদি। আপনার এখানে আমি খাইব।”

এত বেলায় সকলের খাওয়া হইয়া গিয়াছে। দিদিরা হাঁড়ি-পাতিল ধুইয়া তিন জায়ে গল্প করিতে বসিয়াছেন। দিদি আমার শুকনা মুখের দিকে চাহিয়া তৎক্ষণাৎ ঘরের বারান্দায় একটি ছোট্ট চুলায় আমার জন্য ভাত চড়াইয়া দিলেন। সুধীরলালের মা বঁটি পাতিয়া বসিয়া দুইটি পটলের ছাল ছাড়াইয়া সেই হাঁড়ির মধ্যে ফেলিয়া দিলেন। রতনের মা আনিয়া দিলেন তিন-চারটি আলু। গল্প করিতে করিতে কুড়ি মিনিটের মধ্যে রান্না শেষ হইয়া যাইত।

 

চলবে…