০৭:১৭ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২৯ জুন ২০২৫

যেভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেই

  • Sarakhon Report
  • ১২:০১:১৭ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১৬ ডিসেম্বর ২০২৪
  • 15

সারাক্ষণ ডেস্ক

প্র: ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন এবং তার পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ সম্পর্কে আপনি কি জানেন?

উ: ১৯৭০ সালে যে নির্বাচন হয়েছিলো সেটা তো অনেক দিক থেকেই বিশিষ্টতা অর্জন করেছিলো। এই নির্বাচনের কথা বলতে গেলে পিছনের কিছু কথাও আমাকে বলতে হবে। তৎকালীন পাকিস্তানে ১৯৫৮ সালে সামরিক আইন জারি করার পর ১৯৭০ সালের আগ পর্যন্ত যে নির্বাচন হয়েছে তাতে জনগণের সম্পৃক্ততা ছিলো না। কারণ তখন পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় এবং প্রাদেশিক পার্লামেন্টের জন্য যারা এম. পি. নির্বাচিত হতেন তারা কেউই জনগণের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হননি। ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বাররাই শুধু সেই নির্বাচনে ভোট দিয়েছে।

১৯৬৫ সালের জানুয়ারি মাসে পাকিস্তানে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিলো। সেই নির্বাচনে মিসেস ফাতেমা জিন্নাহ বিরোধী দলের পক্ষ থেকে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের বিপক্ষে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। ঐ সময় আমি একজন ছাত্রী। একজন সচেতন মানুষ হিসেবে আমি ঐ নির্বাচনে অনেক কাজ করেছিলাম। বিশেষ করে মানুষ যেন তার নিজের ইচ্ছা মতো প্রার্থীকে নির্বাচিত করতে পারে সে উদ্দেশ্যে ক্যাম্পেন করা সহ একজন নারী হিসাবে, সমাজ সচেতন মানুষ হিসাবে আমি মিস ফাতেমা জিন্নাহর পক্ষে কাজ করেছিলাম। এরপর আমাদের দেশে অনেক ঘটনা ঘটলো।

এখন যেটাকে আমরা ভোটেজ এডুকেশন বলছি, সেই কাজগুলিই তখন করেছি। আমরা তারপরও নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন, জনসংযোগ, তারপর বিভিন্ন সেমিনার, আলোচনা অনুষ্ঠান, ইত্যাদির মাধ্যমে আমরা কিন্তু চেষ্টা করেছিলাম যাতে করে ১৯৭০ সালের নির্বাচনটা সত্যিকার অর্থেই জনগণের মতামত রাখার নির্বাচন হয়।

আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলাম ১৯৬৭ সালে। তখন থেকেই আমি এই কাজগুলোর সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। ছাত্র ইউনিয়ন বলে যে সংগঠনটা এখনও আছে তারা তখন এই বিষয়গুলি নিয়ে খুব চিন্তা করতো। ৬ দফার ভিত্তিতে স্বায়ত্তশাসনের বো বিষয়টি তখন আলোচনা হচ্ছিলো পূর্ব পাকিস্তানের জন্য, সেটার সঙ্গে আর কি কি দফা যুক্ত করা যায়, সেখানে জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তির বিষয়টি পরিষ্কারভাবে আছে কিনা। এ সব নিয়ে নানা আভাপ-আলোচনা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করা, সাধারণ ছাত্রছে কি না, সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের মটিভেট করা ইত্যাদি কাজ করা হতো। আমি অবশ্য তখন ছাত্র ইউনিয়নের সদস্য ছিলাম না। কিন্তু আমি ‘সংস্কৃতি সংসদ’ বলে ওদের যে সাংস্কৃতিক সংগঠন ছিলো, সেটার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলাম। এর মাধ্যমে আমি অনেক কাজ করেছি এবং এটার মাধ্যমে বিভিন্ন জায়গায় গিয়েছি। এমন কি ছাত্র ইউনিয়নের তখন যে একটা প্রোগ্রাম ছিলো মফস্বলে ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে প্রাদেশিক অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তানের বিষয়ে সচেতনতা গড়ে তোলা সেটা করেছি। নাটক করেছি, বক্তৃতা দিয়েছি বিভিন্ন জায়গায়। স্টাডি সারকেলের মাধ্যমে বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে আমরা আলোচনা করেছি যাতে করে এ বিষয়ে মানুষের একটা পরিষ্কার ধারণা জন্মায়।

যাহোক, ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে তৎকালীন পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ কেন্দ্রে এবং পূর্ব পাকিস্তানে বিজয়ী হয়। তখন পাকিস্তানের শাসন ক্ষমতায় ছিলো সামরিক বাহিনী। সামরিক শাসকরা আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা দেয়নি। ফলে, আমাদের দেশে আবার আন্দোলন শুরু হয়। ঐ আন্দোলন তুঙ্গে ওঠে ১৯৭১ সালের ১ মার্চ থেকে। কারণ সেদিন জাতীয় পরিষদের প্রস্তাবিত অধিবেশন বসার তারিখ পাকিস্তানের সামরিক শাসক বাতিল করেছিলো। এরপর ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ঢাকায় এক জনসভায় ভাষণ দেন। সেদিন যে জনসভা হয়েছিলো সেটা আজও আমার স্মৃতিতে একটা উদ্বেল করা ঘটনা। এ রকম ঘটনা বাংলাদেশে বোধহয় খুব কমই ঘটেছে। নির্বাচনের পর যে ঘটনাগুলি ঘটে চলে তাতে আমাদের শঙ্কা, উদ্বেগ, ভয় ক্রমশ বৃদ্ধি পায়। আবার ৭ মার্চের জনসভা স্বাধীনতা লাভের যে উত্তেজনা বা অনুপ্রেরণা এটা পরিষ্কারভাবেই আমাদের মনে জেগেছিলো। সেই অনুভূতি এখন আর বর্ণনা করা যাবে না। ৭ মার্চের কথা মনে হলেই আমার সবসময়ই মনে হয় যে, সমুদ্র কি এর থেকেও অনেক বেশি উত্তাল হতে পারে কিংবা এর থেকেও গভীর কখনো হতে পারে? এটা আমি নিজের সঙ্গেই আলোচনা করি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব যখন দাঁড়িয়ে বক্তৃতা দিচ্ছিলেন তখন প্রত্যেকটি মানুষকেই মনে হচ্ছিলো যে, তারা এক একজন মুক্তিযোদ্ধা। সেই মুহূর্তে যেন আমরা চাইলেই স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনতে পারি- এইরকম উদ্দীপনা সেদিন সবার মধ্যে আমি আন্দোলিত হতে দেখেছি। আমি নিজে সেদিন সেই মাঠে উপস্থিত ছিলাম এবং মাঠের এককোণায় দাঁড়িয়ে তাঁর বক্তৃতা শুনেছিলাম। স্বাধীনতার চেতনা বলতে আমি আমার মনের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর সেদিনের ভাষণটাই লালন করি।

প্র: পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ১৯৭১ সালের ২৫-২৬ মার্চের আক্রমণ সম্পর্কে আপনি কি জানেন?

উঃ ঐ সময় আমি ঢাকাতেই ছিলাম। আমার মা-বাবার যে বাড়িটা, সেই বাড়িটাতেই তখন আমরা সবাই একত্রে বসবাস করছিলাম। আমাদের বাড়িটা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়ির একই রাস্তায়। ২৫ মার্চের সকাল থেকেই ঐ রাস্তা দিয়ে মানুষের ঢল নেমেছিলো। দলে দলে মানুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়িতে আসছিলো। তারা ঐ বাড়ির সামনে কিছুক্ষণের জন্য দাঁড়িয়ে তাঁকে দেখে এবং সালাম দিয়ে আবার ফিরে যাচ্ছিলো। যারা ওখানে আসছিলো তারা অত্যন্ত দৃঢ় ও স্পষ্টভাবেই স্বাধীনতার শ্লোগান দিতে দিতেই আসছিলো। আমার মনে আছে, সেদিন আমি, আমার ছোট বোন, আমাদের কিছু বন্ধুবান্ধব এবং আমাদের বাড়ির আরো কিছু লোক বিকালবেলায় আমাদের বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে দেখার চেষ্টা করছিলাম যে, লোকজন কিভাবে আসছে এবং চলে যাচ্ছে। সেও এক অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতা। স্রোতের মতো মানুষ আসছিলো। আবার চলেও যাচ্ছিলো। এক দল যাচ্ছে আবার আরেক দল আসছে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়ির ঠিক সামনেই একটা লেক আছে। সেই লেকের অপর পারেই ধানমন্ডি গার্লস হাই স্কুল। তখন ঐ স্কুলের পাশেপাশে এখনকার মতো এত উঁচু উঁচু বাড়ি ছিলো না। বাড়িগুলো একতলাই ছিলো বেশি। আমাদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে লেকের পারে দাঁড়ালে স্কুলটা দেখা যেতো। আমরা দাঁড়িয়ে দেখলাম যে, ঐ বিকেলে স্কুলটাতে কিছু আর্মি এলো। সেখানে মেশিনগান বা ঐ জাতীয় অস্ত্র ফিট করা হচ্ছিলো। আমি ও আমার বোন তখন দাঁড়িয়ে কথা বলছিলাম। ওখানে আর্মিদের মেশিনগান ফিট করা দেখে আমরা নিজেরাও কিছুটা হাসছি এই ভেবে যে, ওরা কত আর মানুষকে মারবে! জঙ্গিভাবও আর্মিদের মধ্যে দেখলাম। একটা প্রচণ্ড সহিংসভাব লক্ষ্য করলাম তাদের মধ্যে। এরপর ঐ দিন অর্থাৎ ২৫ মার্চ সন্ধ্যাবেলায় আমি আর আমার বোন চলে গিয়েছিলাম আমাদের আরেক বন্ধু মিলিয়া আলীর বাসায়। মিলিয়া আলীর স্বামী তারিক আলী তখন বাসায়। মিলিয়া আলীর বাড়ি থেকে ফিরে এসে দেখলাম যে, আমাদের এলাকায় আর্মির সংখ্যা আরো বেড়েছে। এদিকে ঐ দিন সন্ধ্যায় আমার মাও চলে গিয়েছিলেন কোনো একটা মিটিংয়ে। খুব সম্ভবত জিগাতলা মহিলা পরিষদের সভা ছিলো সেদিন। মায়ের ফিরতে ফিরতে রাত প্রায় আটটা নয়টা হলো। তখনো লোকজন আসা যাওয়া করছে ৩২ নম্বর রাস্তায়। তখন অবশ্য ভীড়টা একটু হালকা হয়ে গেছে।

যাহোক, সেদিন আমরা রাত দশটা সাড়ে দশটার দিকে রাতের খাবার শেষ করেছি মা, বাবা, ভাইবোন সবাই মিলে। ঐদিন সবাই আমরা বাড়িতে ছিলাম। তারপর রাত সাড়ে এগারোটা কি পৌনে বারোটার দিকে, এখন একেবারে সঠিক সময় বলতে পারবো না; চাটগাঁ থেকে আমার বড় ভগ্নীপতি টেলিফোন করলেন। তিনি তখন পাকিস্তান রেডিও-র চাটগাঁ কেন্দ্রের ডিরেক্টর ছিলেন। তিনি ফোন করে জিজ্ঞেস করলেন যে, মা বাড়িতে আছেন নাকি, তোমরা ভালো আছো নাকি? আমিই সেদিন টেলিফোনটা ধরেছিলাম। আমি বললাম যে, হ্যাঁ, আমরা ভালো আছি। উনি আরো জিজ্ঞেস করলেন যে, তোমাদের খবর কি? আমি বললাম, সব ভালো। তারপর উনি বললেন, খবর কিন্তু  খুব একটা ভালো না। এটা বলার সঙ্গে সঙ্গে টেলিফোন লাইনটা কেটে গেলো। এর কিছু সময় পরই প্রচণ্ডভাবে গোলাগুলির শব্দ হতে থাকলো। শব্দ শুনে মনে হলো, শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়িটাকে কেন্দ্র করেই গোলাগুলি শুরু হয়েছে। এর একটু পরই আমরা কিছু লোকের দৌড়াদৌড়ির শব্দ শুনলাম। আমাদের বাড়ির কাছে একটা পুল আছে। সেই পুলের উপরে বা তার কাছে আল্লা বলে কেউ চিৎকার করে উঠলো। সেই শব্দও আমরা পেলাম। এ রকম আরো দু’একটা আর্তচিৎকার আমরা শুনলাম। তখন আমাদের তো একেবারে হতভম্ব অবস্থা। কিছুই আমরা বুঝত পারছিলাম না যে কি হচ্ছে। সেদিন রাতে পুলের উপরে যিনি প্রথম মারা গিয়েছিলেন তাঁর পরিচয় আমরা পরে জেনেছি। পানাউল্লাহ সাহেব বলে একজন রাজনীতিকের ছেলে। ওর নাম খুব সম্ভবত ছিলো খোকন। উনিই আমাদের বাড়ির পার্শ্ববর্তী পুলের উপর গুলি খেয়ে মারা যান ২৫ মার্চের রাতে।

এদিকে কিছু সময় পর থেকে আমরা আরো গোলাগুলির শব্দ শুনতে পেলাম। আমাদের বাড়ির খুব কাছেই পিলখানা। সেখানে তৎকালীন ইপিআর-রা থাকতো। এখন যেটা বিডিআর হেডকোয়ার্টার। সেখান থেকেও আমরা ক্রমশ ব্যাপক গোলাগুলির শব্দ শুনতে পেলাম। তখন আমরা মনে করলাম যে, হয়তো ইপিআর বাহিনীর সাথে কেউ যুদ্ধ করছে বা কেউ তাদের উপর আক্রমণ করেছে। আমরা এ সব শুধু ভাবছি। কিন্তু আসলে কি ঘটছে সেটা জানতে পারছিলাম না। আমরা কেউ বাড়ি থেকে বেরও হতে পারছিলাম না। এর কিছু সময় পর হঠাৎ আমরা আশপাশ থেকে একটা হৈ চৈ-এর শব্দ শুনতে পেলাম। ঐ সময় পাশের বাড়ি থেকে কেউ আমাদেরকে ডেকে বললো যে, ছাদে ওঠেন, ছাদে ওঠেন, আগুন দেখা যাচ্ছে। তখন তাড়াহুড়া করে আমরা ছাদে উঠলাম। ঐ সময় আমাদের বাড়িও দোতলা হয়নি। আমরা দৌড়ে একতলার ছাদে উঠেছি। আগেও বলেছি ধানমন্ডি এলাকার বেশির ভাগ বাড়িই তখন একতলা ছিলো। দোতলা বাড়ি খুব একটা ছিলো না।

যাহোক, ছাদে উঠে আমরা চারদিক দেখার চেষ্টা করলাম। দেখলাম যে, কালো ধোঁয়া উঠছে বিশ্ববিদ্যালয়-নীলক্ষেতের কোণাটা ধরে। রাতেও সেটা বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু বুঝতে পারছি না যে, ঠিক কোথায় আগুনটা লেগেছে। শুধু এইটুকু আমাদের ধারণায় আসলো যে, নিশ্চয়ই বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার কোথাও আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। সে রাতে বাকি সময় আমরা জেগেই কাটালাম। আমরা বুঝতে পারছিলাম না কোথায় কি হচ্ছে। গোলাগুলি কেন হচ্ছে, কারা করছে, গোলাগুলিতে কে মরছে, কে বাঁচছে, কার কি অবস্থা, এ সব কিছুই জানতে পারলাম না। সত্যি বলতে কি তখন পর্যন্ত আমরা কিছুই বুঝতে পারিনি। তবে ভয়ঙ্কর একটা ঘটনা যে শুরু হয়ে গেছে সেটা বেশ বুঝতে পারছিলাম। কিন্তু তার ব্যাপকতা বুঝতে পারিনি। এভাবেই ২৭ তারিখ সকাল পর্যন্ত আমরা বাড়ির ভিতরে আটকা থাকলাম।

প্র: ২৭ তারিখে তো কারফিউ তুলে নেওয়া হলো। তখন কি আপনি সব কিছু জানার চেষ্টা করেছিলেন বা রাস্তাঘাটে বের হয়েছিলেন?

উ: হ্যাঁ, কারফিউ উঠে যাওয়ার পরই আমি এবং আমার বোন রাস্তায় বের হয়েছিলাম। আমরা বের হলাম খোঁজখবর নেওয়ার জন্য। বের হয়েই কিছু মানুষের মুখে শুনলাম যে, পাক আর্মি ঢাকার বিভিন্ন স্থানে আক্রমণ করেছে। ধানমন্ডি এলাকার কিছু কিছু বাড়িতেও নাকি পাক আর্মি গুলি চালিয়েছে। দু’টো ঘটনা তখন দেখলাম। একটা হলো, আমাদের বাড়ির পাশেই একটা বাড়িতে। বাড়িটিতে তখন কন্সট্রাকশনের কাজ চলছিলো। আমরা দেখলাম সেই বাড়ির দারোয়ানকে গুলি করে মারা হয়েছে।

দারোয়ানের মৃতদেহটা তখনও সেখানেই পড়েছিলো। ঐ বাড়ির ছাদের উপরে তখনও কালো পতাকা কিংবা বাংলাদেশের পতাকা উড়ছিলো। তখন বেশিরভাগ বাড়িতেই তো বাংলাদেশের পতাকা উড়তো। ২৫ মার্চের রাতের ঘটনার পর ২৬ মার্চ অনেকেই সে পতাকা নামিয়ে ফেলেছিলো। শুনলাম ঐ বাড়ির দারোয়ান ওটা নামাতে পারেনি। সে জন্য পাক আর্মি দারোয়ানটাকে গুলি করে মেরেছে। দেখলাম, আমাদের এলাকার রাস্তাঘাট একেবারেই জনশূন্য। আমরা বাড়ি থেকে বের হয়ে প্রথম পুলটা পার হয়ে দক্ষিণ দিকে গিয়েছিলাম। এরপর ওদিক থেকে ফিরে এসে শেখ সাহেবের বাড়ির দিকে গেলাম। যখন আমরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়ির সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি, দেখি কিছু পাক আর্মি ট্রাকে জিনিসপত্র তুলছে। প্রথম আমরা বুঝতে পারিনি যে, সেগুলো তাঁর বাড়ি থেকে আনা হচ্ছে। পরে দেখি পাক আর্মি শেখ সাহেবের বাড়ি থেকে কিছু জিনিসপত্র নিয়ে এনে ট্রাকে তুলছে। তাঁর বাড়িটা তখন বিরান ভূমি। এক পাক আর্মির হাতে দেখলাম জায়নামাজ। আমি যখন তার পাশ দিয়ে যাচ্ছি তখন সে মন্তব্য করলো, এই শালা কি মুসলমান ছিলো যে বাড়িতে জায়নামাজ রেখে দিয়েছে। এই বলে সে জায়নামাজটা অবজ্ঞাভরেই ছুঁড়ে ফেলে দিলো ট্রাকের উপরে। কথাগুলো অবশ্য সে উর্দুতেই বলেছিলো। বাড়ির সামনে আর্মি পাহারা দিচ্ছে। আমরা যখন সেখান দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি তখন তারা বলছে, জলদি চলা যাও, জলদি চলা যাও। এরপর আমরা মিরপুর রোড পর্যন্ত গেলাম। সর্বত্রই দেখি পাক আর্মি। কিছু লোকের সঙ্গেও আমাদের দেখা হলো। তখন পর্যন্ত আমরা কিন্তু অনুধাবন করতে পারি নাই যে, ঢাকায় ব্যাপক গণহত্যা হয়েছে। এরপর আমরা বাসায় ফিরে আসি। ফিরে আসতে আসতে কয়েকজনের মুখে শুনতে পেলাম যে, ইউনিভার্সিটিতে আক্রমণ হয়েছে এবং সেখানে ছাত্র-শিক্ষক অনেককে নাকি মেরে ফেলা হয়েছে। তাদের মুখে ড. মনিরুজ্জামান স্যারের নাম শুনলাম। ড. আনিসুর রহমানেরও নাম শুনলাম। তারপর আমাদের ডিপার্টমেন্টের এবং অন্যান্য আরো কয়েকজন স্যারের কথাও শুনলাম। আস্তে আস্তে তখন নামের সংখ্যা বাড়ছিলো। তখন থেকেই আমরা বুঝতে শুরু করলাম যে, পাক আর্মি নির্বিচারে গণহত্যা শুরু করেছে।

প্র: এরপর আপনি কি ঢাকাতেই থেকে গেলেন?

উ: হ্যাঁ, আমি আমার বাবা-মার সাথে কয়েক মাস ঢাকাতেই থেকেছি। তারপর জুন মাসে আমি ভারতে চলে যাই।

প্র: ২৫ মার্চের রাত থেকে পাকিস্তানি হামলার পরিপ্রেক্ষিতে আপনার মায়ের বাড়ি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের একটা কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠেছিলো বলে আমরা শুনেছি-এ সম্পর্কে আপনি কি জানেন?

উ: এ কাজের একটা পটভূমি আছে। ‘হেরাল্ড ট্রিবিউন’ বলে একটা পত্রিকা আছে। পত্রিকাটি আমেরিকার নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত হয়। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের পরপরই সেই পত্রিকায় বাংলাদেশের কেউ একজন খবর দিয়েছিলেন যে, ড. নীলিমা ইব্রাহীম এবং কবি সুফিয়া কামালকেও পাকিস্তান আর্মি মেরে ফেলেছে। পত্রিকাটিতে সে খবর ফলাও করে প্রকাশিত হয়। খবরটি ‘হেরাল্ড ট্রিবিউন’ পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ার পর প্রবাসী বাঙালি যারা আমেরিকায় ছিলেন তারা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। তারা তখন পাকিস্তানস্থ আমেরিকান অ্যামবেসির থ্রতে বাংলাদেশের খবর নিতে চেষ্টা করলেন যে, আসলে ঘটনা সত্যি কিনা। আমার মা তখন সোভিয়েত-পাকিস্তান মৈত্রী সমিতির চেয়ারপার্সন ছিলেন। সোভিয়েত (বর্তমানে রাশিয়া) সরকারও বিষয়টা সম্পর্কে পাকিস্তান সরকারের কাছে জানতে চাইলো। তারা এ ব্যাপারে যে ভীষণভাবে উদ্বিগ্ন সে কথাও জানালো। তারা জানতে চাইলো আমার মা আদৌ বেঁচে আছেন কি না? বেঁচে থাকলে প্রমাণসহ বিস্তারিত জানাতে বললো।

এদিকে ঐ সময় আবার আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্র থেকেও এ বিষয়ে সংবাদ পরিক্রমায় সংবাদ প্রচারিত হয়। দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায় সেই সংবাদ পরিক্রমায় বললেন যে, পাকিস্তান সেনাবাহিনী আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত সুফিয়া কামালকেও হত্যা করেছে। তাঁকে হত্যা করা মানে সব বাঙালিকেই হত্যা করা ইত্যাদি।

এ সবের প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা গেলো পাকিস্তানিদের মধ্যে। যেহেতু মা বেঁচে আছেন, তাঁর কোনো ক্ষতি হয়নি, এই সুযোগটা নিয়ে পাক সামরিক জান্তার লোকজন পরদিনই মার ছবি তুলে নিয়ে গেলো আমাদের বাড়িতে এসে। তখন ওদের কাছ থেকে যে আচরণটা আমরা পেতে লাগলাম, সেটা খুবই আয়রনিক্যাল সেই সিচুয়েশনে। তখন ওদেরই (পাকিস্তানিদের) যেন দায়িত্ব হয়ে গেলো মাকে বাঁচিয়ে রাখা। তারা মাকে সামনে রেখে এটা প্রমাণ করতে চাইলো যে, ওদের বিরুদ্ধে বুদ্ধিজীবী হত্যার যে অভিযোগ আসছে সেটা মিথ্যা। এর ফলে আমাদের বাড়িটা তখন মোটামুটি একটা ইমিউনিটি পেয়েছিলো এবং সেটার সুযোগ আমরা পুরোদমে গ্রহণ করি। সেই অর্থে যদি বলা যায় যে, আমাদের বাড়িটা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সেন্টার ছিলো, তাহলে আমি বলবো, হ্যাঁ। আমাদের বাড়ি থেকে আমরা মুক্তিযোদ্ধাদের তথ্য সরবরাহ করেছি। অর্থ সংগ্রহ করে সে অর্থ মুক্তিযুদ্ধের কাজে লাগানোর জন্য পাঠিয়ে দিয়েছি। তারপর যারা আমাদের বাড়িতে এসেছে তাদের মাধ্যমে বিভিন্ন জায়গায় আমরা খবর পাঠিয়েছি। তখন আমরা পরস্পরের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করতে শুরু করেছিলাম। যেহেতু মা তখন বিরাট পরিচিতি পেয়েছিলো, সেহেতু আমাদের ধারণা হয়ে গিয়েছিলো যে, আমাদের এখন আর ওরা কিছু করার সাহস পাবে না। এই সুযোগটা নিয়ে আমরা মাকে কেন্দ্র করে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করতে শুরু করেছিলাম।

প্র: আপনাদের বাড়িতে কারা কারা আসতেন?

উ: আমাদের বাড়িতে অনেক পরিচিত এবং নাম না জানা অনেকেই এসেছেন। তাঁরা থেকেছেন। শহীদ শহীদুল্লা কায়সার, তারপর প্রফেসর গিয়াসউদ্দীন আহমদ, প্রফেসর বোরহানউদ্দীন খান জাহাঙ্গীর, এরাও অনবরত এসে আমাদের সাথে যোগাযোগ রাখতেন এবং আমাদের মাধ্যমে অন্যদের সাথে যোগসূত্র স্থাপন করতেন। শহীদুল্লা কায়সার আর গিয়াসউদ্দীন আহমদ তো অনেক সময় ফেরিওয়ালা সেজে মুক্তিযোদ্ধা যারা দেশের ভেতরে ঢুকেছিলো শেষের দিকে অর্থাৎ অক্টোবর-নভেম্বরের দিকে তাদের জন্যে খাবার, কাপড়-চোপড় পৌছে দিয়েছেন।

প্র: ঐ সময় আপনি কি ঢাকাতে ছিলেন?

উ: না, এটা আমি পরে শুনেছি। তখন আমি ভারতে ছিলাম। আমার ছোট বোন টুলু এবং আমি ঢাকা ছেড়েছি জুনের পনেরো তারিখের দিকে। সেটারও একটা কারণ ছিলো। এপ্রিলের পর থেকে আমাদের বাড়িতে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকজনের আনাগোনা চলছিলো এবং আমরা জানতাম যে, কারা মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিচ্ছে, কারা কোথায় যাচ্ছে, কিভাবে যাচ্ছে ইত্যাদি। সেই সূত্র এবং খবরগুলি আমরা অন্যদেরকেও দিতাম। মানে যারা ইচ্ছুক ছিলো মুক্তিযুদ্ধে বা মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিতে। যেমন আমাদের বাড়ির সামনেই তখন পাকিস্তান বিমান বাহিনীর একজন ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট থাকতেন। দেশ স্বাধীনের পর উনি খুব সম্ভবত উইং কমান্ডার হিসেবে অবসর নেন। তাঁর নাম হামিদুল্লাহ। হামিদুল্লাহ ভাই মাঝে মাঝে আমাদের বাড়িতে এসে আমাদেরকে নানা কথা বলতেন। আমরা তাঁকে ভাই ডাকতাম, যেহেতু উনি আমাদের প্রতিবেশী ছিলেন। উনি মাঝে মাঝে এসে বলতেন এয়ারফোর্স থেকে অমুক অমুক অফিসারকে পাক আর্মিরা ডেকে নিয়ে গেছে। কিন্তু তাদের আর খবর পাওয়া যাচ্ছে না কিংবা তাদেরকে বিভিন্নভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। একদিন তিনি উদভ্রান্তের মতোই এসে মাকে বললেন যে, আমার ওপর একটা ভয়ানক দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। আমাকে বলা হয়েছে যে, রায়ের বাজারে যে হিন্দু এলাকাগুলি আছে সেগুলি চিহ্নিত করে কালকে ওখানে আর্মি নিয়ে যেতে হবে। এই অপারেশনে আমাকে তাদের সঙ্গী হতে হবে। কিন্তু আমি এটা তো মন থেকে কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না। আমি এখন কি করতে পারি।

তখন হামিদুল্লাহ ভাইয়ের স্ত্রী এবং তাঁর তিনটা ছোট ছোট বাচ্চা ছিলো। হামিদুল্লাহ ভাইয়ের উপস্থিতিতেই মা আমাকে আড়ালে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন যে, আমরা তাকে কিভাবে সাহায্য করতে পারি? তখন আমি বললাম যে, দেখি কি করতে পারি। কিছু করা সম্ভব হলে আমি হামিদুল্লাহ ভাইকে জানাচ্ছি। এরপর আমি একজনের সঙ্গে কথা বললাম, আমার যতদূর মনে পড়ে উনি শাহাদত চৌধুরী ছিলেন। সাপ্তাহিক বিচিত্রার যিনি সম্পাদক ছিলেন পরে। তারপর শাহাদত ভাই আমাদের বাড়িতে এসে আমাকে একটা পত্রিকা দিয়ে বলেছিলেন যে, তুমি হামিদুল্লাহকে বলো এই পত্রিকাটা হাতে নিয়ে কাল বায়তুল মোকাররমের অমুক দোকানটার সামনে অমুক সময় দাঁড়িয়ে থাকতে। তখন আমি হামিদুল্লাহ ভাইকে গিয়ে সেটা জানালাম। তাঁকে পত্রিকা দিয়ে বললাম যে, আপনি ওখানে পত্রিকাটা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবেন। তার পরদিন উনি নির্দিষ্ট সমটায় দাঁড়িয়ে থাকেন। তখন একজন মুক্তিযোদ্ধা এসে হামিদুল্লাহ ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করে এবং তাঁকে নিয়ে বোধহয় ঐ দিনই ইন্ডিয়াতে রওনা হয়ে যায়। পরে তিনি মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেন।

এ ভাবেই আমরা কাজ করতাম। এরপর আমরা একদিন জানতে পারলাম যে, হামিদুল্লাহ ভাইয়ের বাড়ির একজন কাজের লোককে আর্মিরা ধরে নিয়ে গেছে। তখন আমরা সবাই একটু শঙ্কিত হয়ে পড়লাম। আমরা মনে করলাম ওর মুখ থেকে যদি বেরিয়ে যায় যে, হামিদুল্লাহ ভাই আমাদের বাসায় আসতেন, যোগাযোগ রাখতে যদি তাহলে হয়তো আমাদের বাসায় এসে তারা খোঁজখবর করবে। মনে করলাম কোনো কারণে যদি আমাদেরকে ধরে তাহলে একটা পুরা চেইন ধরা পড়ে যেতে পারে। এই অবস্থায় তখনই আমরা সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম যে, আমার এবং আমার ছোট বোনের ঢাকায় থাকা উচিত হবে না। এরপরই আমরা দু’জন ধানমন্ডিতেই আরেকটা বাড়িতে চলে গেলাম। এটা পুরাতন ছাব্বিশ নম্বর রোডে। সেখানেও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকজন আসতো। আতিয়া হক বলে একজন ভদ্রমহিলা, তাঁর বাড়িতে। কবি সিকান্দার আবু জাফরের ছেলে সমু সেখানে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতো। তারপর মাহমুদুর রহমান বেণু, মিলিয়া এরাও যোগাযোগ রাখতো। আতিয়া হক আবার মিলিয়াদের আত্মীয় ছিলো। আমরা সবাই মিলে সেখানটায় প্রায়ই একত্রিত হতাম। ওখান থেকেই আমরা পনেরোই জুন ভারতের পথে রওনা দেই। তখন হামিদুল্লাহ ভাইয়ের পরিবার, বেণু, তারপর মিলিয়া আমাদের সঙ্গে ছিলো। বেণু ভাই আমাদেরকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলো। বেণু ভাই কিন্তু তখন ভারতে নিয়মিত আসাযাওয়া করতেন। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকজনদের আনা-নেওয়ার ব্যাপারে এবং সংবাদ আদান-প্রদানের ব্যাপারে উনি সহযোগিতা করতেন। এছাড়া উনি আরো কিছু কাজ করতেন। মাহমুদুর রহমান বেণু গানের শিল্পীদের নিয়ে একটি টিম করেছিলেন। তিনি সেটার টিম লিডার ছিলেন। এই টিম বিভিন্ন জায়গায় সঙ্গীত পরিবেশন করে বেড়াতো। মিলিয়ার ছোটবোন সোনিয়াও আমাদের সঙ্গে গিয়েছিলো। এখন আওয়ামী লীগের একজন এম. পি. ইমরান আহমেদ, তাঁর স্ত্রী শিলু, সেও আমাদের সঙ্গে গিয়েছিলো। তার মা তখন আওয়ামী লীগে ছিলেন। ১৯৭০ সালে মহিলা এম.এন. এ. নির্বাচিত হয়েছিলেন। ওর মায়ের নাম বদরুন্নেসা আহমেদ। শিলু আমাদের বন্ধু। আমরা সবাই কিন্তু একসঙ্গেই কাজ করতাম। আমরা মোটামুটি ঠিক করলাম যে, আমরা সবাই ভারতেই চলে যাবো। ওখানে যেয়ে মুক্তিযুদ্ধের কাজ করবো। এরপর আমরা ঢাকা থেকে কুমিল্লার চান্দিনা বলে একটা জায়গায় ট্যাক্সি করে গেলাম। যাওয়ার সময় আমরা এমন ভাব করছিলাম যে, কুমিল্লায় আমাদের এক বোনের বিয়ে, সেখানে যাচ্ছি বিয়ে খেতে। ওইরকমভাবেই পোশাক আশাক এবং গয়নাগাটি পরেছিলাম। চাকচিক্যময় একটা ভাব নিয়ে ওয়েল-ড্রেসড্ হয়ে আমরা কুমিল্লার চান্দিনায় চলে গেলাম।

প্র: আপনারা পথে পাক আর্মির সামনে পড়েননি?

উ: কুমিল্লার পথে কয়েক জায়গায় তখন তো ফেরী ছিলো। এক জায়গায় ফেরীতে আমরা যখন নদী পার হচ্ছি তখন এক গাড়ি ভর্তি আর্মি বিপরীত দিক থেকে ঘাটে আসছে। তারা আমাদের দেখে জিজ্ঞেস করলো যে, কোথায় যাচ্ছি আমরা। আমিই তখন গলা বার করে উর্দুতে বললাম যে, মেরা বোহিনকা শাদী হ্যায় কুমিল্লামে। এটা শুনে তারা বললো, আচ্ছা, ঠিক হ্যায়, ঠিক হ্যায়, চলা যাও। আর কিছু বলেনি। তারপরে আমরা নদী পার হয়ে চান্দিনাতে এসে গাড়ি থেকে নেমে রিকসা নিয়ে সীমান্ত পর্যন্ত গিয়ে সোনামুড়া দিয়ে ভারতে প্রবেশ করি। নির্বিঘ্নেই পৌঁছে গেলাম।

প্র: ভারতে গিয়ে আপনি কি করলেন?

উ: আমরা যেতে যেতেই বলাবলি করছিলাম যে, কে কোথায় যাবো, কি করবো। আমাদের একেকজনের একেক ধরনের কাজ করার পরিকল্পনা আগে থেকেই ছিলো। শিলুর স্বামী ভারতে গিয়েছিলো আগেই। কিন্তু শিলুর স্বামীর বাবা ছিলেন পাঞ্জাবি। উনি তখন বাংলাদেশে বসবাস করতেন। শিলুর স্বামীর পরিবারের সবাই বাঙালিদেরই মতো ছিলো। বিশেষত আচার-আচরণের দিক থেকে। শিলু খবর পেয়েছিলো যে, ওর স্বামীকে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ আটক করে রেখেছে। শিলুর প্রথম কাজটা ছিলো ওর স্বামীকে আটক অবস্থা থেকে বের করে আনা। মিলিয়ারা ঠিক করেছিলো যে, কলকাতায় গিয়ে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে যোগ দেবে কিংবা সাংস্কৃতিক স্কোয়াডে যোগ দেবে। আমি আর আমার ছোটবোন ঠিক করলাম যে, আমরা সীমান্ত এলাকাতেই থেকে যাবো এবং চেষ্টা করবো মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিতে। সরাসরি যুদ্ধের ট্রেনিং নেবো- এই প্রতিজ্ঞা নিয়েই আমি ভারতে গিয়েছিলাম।

এদিকে ভারতে যাওয়ার সময় পথে আমাদের সঙ্গে দেখা হলো ফতেহ চৌধুরীর সঙ্গে। সে শাহাদত চৌধুরীর ছোট ভাই। সে ততোদিনে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিয়েছে। ফতেহ মূলত খবর আদান-প্রদান করতো বিভিন্ন জায়গায় এসে। রেকি করা যাকে বলে আর্মির ভাষায়। বাংলাদেশের ভিতরে এসে রেকি করে যেতো সে। আমরা যখন সীমান্তে র কাছাকাছি তখন ফতেহ চৌধুরী বর্ডার পার হয়ে বাংলাদেশের দিকে আসছিলো। ওর সঙ্গে যখন দেখা হয় তখন আমি আর আমার ছোটবোন টুলু তাকে বলেছিলাম যে, আমরা কিন্তু কলকাতায় যাবো না। আমরা আগরতলাতেই থাকতে চাই। তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম ওখানে কি করতে পারি, কে কে আছে ওখানে এই সব। তখন ফতেহ চৌধুরী বললো যে, তোরা যে আসবি সে খবর আমরা পেয়েছি। ওখানে লে. আকতার আছেন। তোরা তাঁর সাথে কাজ করতে পারিস। আকতার আর্মির ডাক্তার ছিলেন। আমরা ভারতে যাওয়ার আগেই শুনেছিলাম যে, উনি ছোট্ট একটা চিকিৎসা কেন্দ্রের মতোন করেছেন এবং একাই সেখানে কাজ করছেন।

তাই আমরা সেখানে পৌঁছেই প্রথমে আকতার ভাইকে খোঁজ করলাম। তাঁর সঙ্গে দেখা হওয়ার পর তাঁকে বললাম যে, আকতার ভাই আমরা কলকাতায় যাবো না, আমরা এখানেই থাকবো। আমরা মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিতে চাই। আকতার ভাই বললেন যে, নিশ্চয় তোমরা এখানেই থাকবে। কিন্তু আপাতত তোমরা আমার কাছেই থাকো। মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিতে হলে খালেদ মোশাররফের সঙ্গে আগে কথা বলতে হবে। খালেদ মোশাররফ দিল্লীতে গেছেন। উনি এলেই আমি এ ব্যাপারে একটা ব্যবস্থা করবো। তার পর থেকে আমরা আগরতলাতেই থেকে গেলাম এবং আকতার ভাইয়ের সঙ্গে কাজ করতে শুরু করলাম। এর মধ্যে খালেদ মোশাররফ ফিরে এলেন। তাঁর সঙ্গে আমরা কথা বলার পর তিনি বললেন যে, হ্যাঁ অবশ্যই তোমরা এখানে থাকবে। আমি খুব খুশি হয়েছি যে, তোমরা এসেছো। আমরা চিন্তা করছি এখানে একটা ছোটখাটো হাসপাতাল তৈরি করবো। কারণ যেভাবে বাংলাদেশ থেকে আহত লোকজন এখানে আসছে তাতে তাদের চিকিৎসার জন্য আমাদের একটা হাসপাতালের ভীষণ প্রয়োজন। তোমরা যদি রাজি হও তো আমরা সেটা বড় আকারে করতে পারি। তখন আমি বললাম যে, আমরা আহতদের সেবা করতেও রাজি আছি। কিন্তু আমরা মুক্তিবাহিনীতেও যোগ দিতে চাই। খালেদ মোশাররফ বললেন, ঠিক আছে। এর আগে কিন্তু আমরা জিয়াউর রহমানের সঙ্গেও দেখা করেছিলাম। তিনি তখন আগরতলায় কি এক কাজে এসেছিলেন। আমরা আবার সেদিন বেরিয়েছিলাম ওষুধ সংগ্রহ করতে। সেই সময় আর্টস অ্যান্ড ক্রাফট হোস্টেলে তাঁর সঙ্গে আমাদের দেখা হয়েছিলো। তখন তাঁকেও আমি বলেছিলাম যে, আমরা মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিতে চাই। তখন জিয়াউর রহমান সাহেব আমাকে আর টুলুকে বলেছিলেন যে, আপনারা যদি পাঁচজন মেয়ে একত্র হতে পারেন তাহলে আমি আপনাদের ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করতে পারি। পাঁচজনের কম হলে এটা হবে না। আপনারা পাঁচজন হলে আমাকে জানাবেন, আমি আপনাদের ট্রেনিং দেওয়ার ব্যবস্থা করবো। যাহোক, তারপর থেকে আমরা হাসপাতালেই কাজ করতে লাগলাম। যদিও সব সময়ই আমাদের ইচ্ছা ছিলো যে, আমরা আর্মস ট্রেনিং নেবো। এটা আর পরবর্তীতে হয়ে ওঠেনি নানা কারণে।

প্র: হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য কাদেরকে বেশি নিয়ে আসা হতো?

উ: আমরা গেলাম জুন মাসে। তখন তো আমরা ছিলাম একদম সীমান্ত বরাবর। সেখানে আমরা প্রথম দিকে যে আহতদেরকে পেতাম তাদের অধিকাংশই সাধারণ গ্রামবাসী। কারণ সীমান্ত এলাকায় প্রায় দিনই হঠাৎ হঠাৎ পাক আর্মি এসে আক্রমণ করতো। তাদের আক্রমণে প্রায়ই কিছু না কিছু লোক হতাহত হতো। যারা মারা যায়নি, বেঁচে গেছে কিন্তু বেশ আহত তাদেরকে মুক্তিযোদ্ধা ছেলেরাই আবার নিয়ে যেতো সীমান্তের ওপারে। সেই সময় আমরা কিছু আহত ছাত্রকেও পেয়েছি। এরা দেশের ভিতরে বিভিন্ন ধরনের কাজ করতো। যেমন ফতেহ চৌধুরী যে কাজগুলি করতো। এই ছেলেগুলোও ফতেহ চৌধুরীর মতো দেশের ভেতরে ঢুকেছিলো জায়গা চিহ্নিত করতে। তখন পর্যন্ত কিন্তু মুক্তিবাহিনী অফেনসিভে যায়নি। আর্মির ভাষায় তারা আক্রমণ শুরু করেনি। এই আক্রমণটা তারা শুরু করেছে জুলাইয়ের দিক থেকে, এটা আমি দেখেছি। ঐ সময় বর্ষাটাও এসে গিয়েছিলো। তখন তাদের ট্রেনিংটাও মোটামুটি একটা পর্যায়ে পৌঁছেছে। জুলাই পরবর্তী আমরা যে আহতদেরকে পেয়েছি তারা বেশিরভাগই কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা কিংবা যারা সেনাবাহিনী থেকে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিয়েছে তারা। এখানে ছাত্র, সাধারণ কৃষক, শ্রমিক বা গ্রামবাসী, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছে তারা আসতো চিকিৎসার জন্য। যখন আমরা পুরোপুরি কাজ শুরু করেছি তখন মুক্তিযোদ্ধাদেরই আমরা বেশি পেয়েছি।

আর একটি কথা, এটা হয়তো এখানে প্রাসঙ্গিক হবে না, তবু বলতে চাই। সেটা হলো- এই এলাকা সেক্টর টু-এর অধীনে ছিলো। এই সেক্টরেই সবচেয়ে বড় গেরিলা বাহিনী ছিলো। এই গেরিলা বাহিনীতে যারা যোগ দিয়েছিলো তারা কিন্তু বিভিন্ন রাজনৈতিক পটভূমি থেকে এসেছিলো। কেউ ছাত্র লীগের ছিলো, কেউ ছাত্র ইউনিয়নের ছিলো। অনেকে আবার সরাসরি কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্য ছিলো না। কিন্তু উদ্বুদ্ধ হয়েই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলো। তাদের মধ্যে রাজনৈতিক ব্যাপারে বিরোধ থাকলেও একটা বিষয়ে খুবই সাযুজ্য ছিলো- প্রত্যেকেই মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপারে অসম্ভব রকমের আন্তরিক ছিলো। এ ব্যাপারে তাদের মধ্যে কোনো রকম অবিশ্বাস বা বিরোধিতা আমি দেখতে পাইনি। আরেকটা দল যারা ছিলো তারা রেগুলার আর্মির লোক। এরা একটা বিষয়ে নিজেদের মধ্যে কোনো সময় হয়তো হাসির ছলে, কখনো ঠাট্টার ছলে, আলোচনা করেছে যে, যুদ্ধটা কি রেগুলার আর্মিই করবে না গেরিলা বাহিনী করবে। কোন যুদ্ধটা বেশি ফলপ্রসূ তা নিয়ে ওখানে কথাবার্তা হতো। যারা সরাসরি সেনাবাহিনী থেকে এসেছিলো তাদের মধ্যে আবার অন্য রকম একটা ভাব ছিলো। তারা মনে করতো যুদ্ধটা তাদেরই ব্যাপার এবং সরাসরি যুদ্ধ ছাড়া পাকিস্তান বাহিনীকে পরাজিত করা যাবে না। অন্যদিকে যারা গেরিলা বাহিনীতে ছিলো তারা মনে করতো সরাসরি যুদ্ধ করে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মতোন একটা শক্তিশালী বাহিনীকে হয়তো পরাজিত করা যাবে না। ট্রেইন্ড আর্মির সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধ করে কখনোই পারা যাবে না। তাদেরকে নাস্তানাবুদ বা কাবু করতে হবে গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে। এইগুলি নিয়ে ওদের মধ্যে আলোচনা হতো, তর্ক হতো। কিন্তু এই দ্বন্দ্ব খুব প্রকট হয়ে দেখা দেয় নাই। আমরা অনেক সময় নিজেদের মধ্যেও এই ব্যাপারগুলো নিয়ে আলোচনা করতাম। এর পাশাপাশি খালেদ মোশাররফ, যিনি আমাদের সেক্টর কমান্ডার ছিলেন, তাঁর মধ্যে তখন একটা উদ্বেগ আমি অনেক সময় লক্ষ্য করেছি। তাঁর ভাবনায় যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর আমাদের মধ্যে যে ইউনিটিটা আছে সেই ইউনিটিটা পরবর্তীতে কতখানি বজায় থাকবে বা এই ইউনিটিটা শেষ পর্যন্ত কতখানি ধরে রাখা যাবে।

প্র: আপনি হাসপাতালে কি ধরনের কাজ করতেন?

উ: আমি হাসপাতালে বিভিন্ন পর্যায়ের কাজ করেছি। প্রথম তো হাসপাতাল ছিলো

সোনামুড়ায়। এরপর দারোগাবাগিচা বলে একটা জায়গায় সেই হাসপাতাল পুনঃস্থাপন করা হয়। সেখানে আমরা তাঁবু গেড়ে কাজ করতে শুরু করি। কারণ সোনামুড়াটা তখন বেশি পরিচিত হয়ে গিয়েছিলো পাকিস্তান আর্মির কাছে। তারা প্রায়ই সেখানে মর্টার শেলিং করতো এবং তার ফলে সেখানকার জনজীবন বিপর্যন্ত হচ্ছিলো। আমাদের হাসপাতালটাও পাক আর্মিদের লক্ষ্যবস্তু ছিলো। তার ফলে আমরা তখন দারোগাবাগিচায় কিছুদিনের জন্যে চলে যাই।

এদিকে তার আগে থেকেই বাংলাদেশ সরকারের অনুমোদনক্রমে ওখানে ষাট শয্যার একটা হাসপাতাল তৈরি করার স্কিম নেওয়া হয়েছিলো। পরবর্তীতে সেই হাসপাতালটি ওখানে স্থাপন করা হয়েছিলো। আগরতলা থেকে ষাট মাইল দূরে একটা জায়গায় হাবুল ব্যানার্জী বলে এক ভদ্রলোকের ফলের বাগান ছিলো। সেই বাগানটা উনি ঐ হাসপাতাল করার জন্য ছেড়ে দিয়েছিলেন। জায়গাটার নাম বিশ্রামগঞ্জ। আমরা পরে ঐ বিশ্রামগঞ্জে চলে যাই। সেখানেই ঘাট শয্যার হাসপাতালটা হয়। পরবর্তীতে ঐ হাসপাতালের শয্যা আরো বাড়ানো হয়। সেখানটায় আমরা কাজ শুরু করি জুলাইয়ের শেষ থেকে। আমাদের প্রায় পনেরো জনের একটা টিম হয়েছিলো। আসমা, রেশমা, জাকিয়া, নীলিমা, পদ্মা, তারপরে মিনু এরা সবাই এসে সেখানে যোগ দেয়। ওরা যোগ দিয়েছিলো একটা বিশেষ পরিপ্রেক্ষিতে। জাহানারা ইমামের ছেলে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা রুমির কথা অনেকেই জানে। এই রুমি এবং তাঁর দলবল যেমন আবুল বারক আলভী, সে এখন আর্ট কলেজের শিক্ষক, তারপর আলতাফ ভাই, কাজী কামাল, এরা কিন্তু পাক আর্মির হাতে ধরা পড়েছিলো অগাস্টের শেষের দিকে। মিনু, আসমা, রেশমা তারপর এদের সবচেয়ে ছোটবোন শাহনাজ, এরা কিন্তু এদের অস্ত্র এবং গুলিটুলি লুকিয়ে রাখতো। আলভীসহ কয়েকজন অস্ত্র এবং অ্যামুনেশন লুকিয়ে রাখতো আলতাফ ভাইয়ের বাড়িতে। পাক আর্মি কিভাবে খবর পেয়ে হঠাৎ ঐ বাড়িতে হামলা করে অস্ত্রগুলি উদ্ধার করে। আলভীকে বাঁচাতে যেয়ে আলতাফ ভাই ধরা পড়েন। ঐ অবস্থায় আলতাফ ভাই সম্পূর্ণ দায়িত্বটা নিজের কাঁধে নিয়েছিলেন। আলভী-আলতাফ ভাই ধরা পড়ার পর মিনু, আসমা, রেশমা ভারতে পালিয়ে এসে ঐ হাসপাতালে যোগ দেয়। এরা আসার পর আমরা ১৫ জনের একটা টিম হয়ে যাই। আমরা সবাই মিলে তখন কাজ করতে থাকি। নভেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত আমরা ঐ হাসপাতালের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম।

প্র: তখন কি ক্যাপ্টেন ডা. সিতারা বেগম ওখানে ছিলেন?

উ: হ্যাঁ, ক্যাপ্টেন ডা. সিতারা আমাদের হাসপাতালে এসে যোগ দেন সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে। তিনি আর্মির ডাক্তার ছিলেন। ঐ সময় আরো কিছু মেয়ে, যারা গোবরা ক্যাম্পে নার্সিং ট্রেনিং নিয়েছিলো, তারাও এসে তখন কিন্তু যোগ দেয়। এদিকে আমরা যারা প্রথমদিকে এই হাসপাতালটা তৈরির সঙ্গে যুক্ত ছিলাম তারা নভেম্বর পর্যন্ত ওখানে ছিলাম। নভেম্বরের মাঝামাঝি ওখান থেকে আমরা কলকাতায় চলে যাই। কলকাতায় গিয়ে মৈয়েত্রী দেবীসহ আরো ক’জনের সঙ্গে যোগাযোগ হয় আমাদের। কিন্তু সেই সময় ওখানে নতুন কোনো কাজ করার আর স্কোপ ছিলো না। ওখানে সবাই যার যার কাজ তখন করে যাচ্ছিলো। এদিকে তখন যুদ্ধও প্রায় শেষের দিকে চলে এসেছে। যুদ্ধের ব্যাপারটা নিয়েই তখন অনেক বেশি কথাবার্তা চলছে। এই অবস্থায় আমরা তখন কিছু বুদ্ধিজীবীর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে বাংলাদেশ সম্পর্কে জনমত গঠনের কাজই করেছি। এর বেশি আর কিছু কলকাতায় আমি করিনি।

প্র: আপনি কোন সময় ঢাকায় ফিরে আসলেন?

উ: আমি তো ঢাকায় ফিরে আসি জানুয়ারি মাসের চার তারিখে। আমরা কলকাতা থেকে জানুয়ারির দুই তারিখে রওনা হয়ে চার তারিখে ঢাকায় পৌঁছাই। আসার সময় আমরা তখন এমন কোনো ব্রিজ দেখি নাই যেটা ভাঙা না। বড় একটা ব্রিজও ছিলো না। নদী পার হতে গেলে নৌকা ডেকে আনতে হয়েছে। সব জায়গায় আবার নৌকার মাঝি পাওয়া যায়নি। পথে বাস পড়ে আছে কিন্তু বাসের চালক নেই। রাস্তাঘাট ভাঙা, ব্রিজ নেই, নদীর ঘাটে নৌকা নেই। তবু মানুষের মনে একটা স্বস্তির ভাব, যে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে।

যাহোক, দেশে ফিরে দেখি আমার মা অত্যন্ত মন খারাপ করে বসে আছেন। আমাদের পরিবারে একটা শোকের আবহাওয়া চলছে। কারণ আমার বড় ভগ্নিপতিকে মেরে ফেলা হয়েছে। কয়দিন পর বিশ্ববিদ্যালয়ে গেলাম। তখন আমরা বন্ধুবান্ধবরা কেউ কারো মুখের দিকে তাকাতে পারছি না। ঐ অবস্থার মধ্যে থেকেও সঙ্গে সঙ্গে আবার প্রতিজ্ঞাও নিলাম যে, দেশটার জন্যে যা কিছু করা যায় আমাকে সেটা করতেই হবে। আমার মাকে তখন নারী পুনর্বাসন বোর্ডের সভাপতি করা হয়েছিলো। আমি তখন মার

সঙ্গে থেকে কিছু কাজ করতে শুরু করলাম। সেই সূত্রে আমি তখন নারী পুনর্বাসন কেন্দ্রের উনিশ জন মেয়ের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। সেটা ছিলো রিহ্যাভিলিটেশন প্রোগ্রামে, তাদের কি অবস্থান হবে না হবে, কতদূর সাহায্য দিতে হবে না হবে ইত্যাদি বিষয়ে। কিছু ইন্টারভিউ নিতে হচ্ছিলো। এদের মধ্যে অন্তত সাত-আটজনকে আমি পেয়েছিলাম যারা পাকিস্তানি সেনাদের অত্যাচারে গর্ভবতী হয়ে পড়েছিলো। এরা পাক আর্মির বিভিন্ন ক্যাম্পে আটক ছিলো। এদের উপর প্রচণ্ড নির্যাতন করা হয়েছিলো।

তাদেরকে ধর্ষণ করা হয়েছিলো। শুধু ধর্ষণই না তাদেরকে আরো নানাভাবে অত্যাচার করা হয়েছিলো। কিছু কিছু মহিলাকে দেখেছি যে, তারা গর্ভবতী অবস্থাতেই সেখানে এসেছিলেন।

প্র: এ সব মহিলাদের সঙ্গে আপনার এখন যোগাযোগ আছে কি?

উ: না। যোগাযোগ খুব বেশিদিন আমি ব্যক্তিগতভাবে তাদের সাথে আর রাখতে পারি নাই। কারণ আমার পড়াশুনার তখনও একটা অংশ বাকি ছিলো। আমি তখন এম. এ. ক্লাশের ছাত্রী ছিলাম। কিছুদিন পর আমার পরীক্ষার তারিখ পড়ে গেলো। তখন আমি পড়াশুনা করতে ফিরে গিয়েছিলাম। কিন্তু আমি জানি যে, রিহ্যাভিলিটেশন প্রোগ্রামের মাধ্যমে এদের পরবর্তীতে কোথাও না কোথাও রিহ্যাভিলিটেড করা হয়েছে। যারা গর্ভবতী মহিলা ছিলেন তাদেরকে ক্লিনিক্যাল সার্ভিস দেওয়া হয়েছিলো। কয়েকজন আবার নিজেদের পরিবারেই ফিরে গেছেন। তাদের সঙ্গে আমার পরবর্তীতে আর যোগাযোগ রাখা সম্ভব হয়নি।

প্র: মুক্তিযুদ্ধের সময় আপনার পরিবারের কেউ শহীদ হয়েছেন কি?

উ: আমাদের পরিবারে সরাসরি কেউ শহীদ হননি। আমার বড় ভগ্নিপতি তখন চট্টগ্রামে কর্মরত ছিলেন। তিনি চট্টগ্রামে পাকিস্তান রেডিওর পরিচালক ছিলেন। ২৫ মার্চের পর আমার ভগ্নিপতি মুক্তিযোদ্ধাদেরকে বলে দিয়েছিলেন যে, তোমরা চাটগাঁ বেতার কেন্দ্রে কাজ করতে পারবে না। কারণ এখানে সিকিউরিটি অত্যন্ত বেশি। তোমরা বরং কালুরঘাটে চলে যাও। আমি জানি সেখানে তেমন সিকিউরিটি নাই। যাহোক, পরবর্তীতে কোনো একটা কারণে তাকে হত্যা করা হয়। মুক্তিবাহিনী দাবি করে যে, তারাই রেডিওর ডিরেক্টর হিসাবে তাকে হত্যা করেছে। কিন্তু আমরা খোঁজ-খবর নিয়ে জানতে পেরেছিলাম যে, আসলে ঘটনাটা সেরকম ছিলো না। ঘটনাক্রমে তার উপর আক্রমণ হয় এবং তাঁকে ভুল করেই তখন হত্যা করা হয়। আমাদের পরিবারের একমাত্র তিনিই মুক্তিযুদ্ধের সময় নিহত হয়েছিলেন।

 

নাম: সুলতানা কামাল, সাবেক উপদেষ্টা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও মানবাধিকার নেত্রী।

পিতা: কামালউদ্দীন আহমদ খান

মা: কবি সুফিয়া কামাল

গ্রাম/মহল্লা: বাড়ি ১৫ (সাঁঝের মায়া), সড়ক: ১১ (পুরাতন ৩২)

ধানমন্ডি আবাসিক এলাকা

ইউনিয়ন/পৌরসভা: ঢাকা সিটি করপোরেশন

থানা: ধানমন্ডি (মেট্রোপলিটন থানা), জেলা: ঢাকা

শিক্ষাগত যোগ্যতা: এম. এ.

১৯৭১ সালে বয়স: ২২

১৯৭১ সালে পেশা: ছাত্রী

 

সাক্ষাৎকার গ্রহণকারীর নাম: সাঈদা খানম

সাক্ষাৎকার গ্রহণের তারিখ: জানুয়ারি ০৬, ১৯৯৭

যেভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেই

১২:০১:১৭ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১৬ ডিসেম্বর ২০২৪

সারাক্ষণ ডেস্ক

প্র: ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন এবং তার পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ সম্পর্কে আপনি কি জানেন?

উ: ১৯৭০ সালে যে নির্বাচন হয়েছিলো সেটা তো অনেক দিক থেকেই বিশিষ্টতা অর্জন করেছিলো। এই নির্বাচনের কথা বলতে গেলে পিছনের কিছু কথাও আমাকে বলতে হবে। তৎকালীন পাকিস্তানে ১৯৫৮ সালে সামরিক আইন জারি করার পর ১৯৭০ সালের আগ পর্যন্ত যে নির্বাচন হয়েছে তাতে জনগণের সম্পৃক্ততা ছিলো না। কারণ তখন পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় এবং প্রাদেশিক পার্লামেন্টের জন্য যারা এম. পি. নির্বাচিত হতেন তারা কেউই জনগণের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হননি। ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বাররাই শুধু সেই নির্বাচনে ভোট দিয়েছে।

১৯৬৫ সালের জানুয়ারি মাসে পাকিস্তানে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিলো। সেই নির্বাচনে মিসেস ফাতেমা জিন্নাহ বিরোধী দলের পক্ষ থেকে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের বিপক্ষে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। ঐ সময় আমি একজন ছাত্রী। একজন সচেতন মানুষ হিসেবে আমি ঐ নির্বাচনে অনেক কাজ করেছিলাম। বিশেষ করে মানুষ যেন তার নিজের ইচ্ছা মতো প্রার্থীকে নির্বাচিত করতে পারে সে উদ্দেশ্যে ক্যাম্পেন করা সহ একজন নারী হিসাবে, সমাজ সচেতন মানুষ হিসাবে আমি মিস ফাতেমা জিন্নাহর পক্ষে কাজ করেছিলাম। এরপর আমাদের দেশে অনেক ঘটনা ঘটলো।

এখন যেটাকে আমরা ভোটেজ এডুকেশন বলছি, সেই কাজগুলিই তখন করেছি। আমরা তারপরও নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন, জনসংযোগ, তারপর বিভিন্ন সেমিনার, আলোচনা অনুষ্ঠান, ইত্যাদির মাধ্যমে আমরা কিন্তু চেষ্টা করেছিলাম যাতে করে ১৯৭০ সালের নির্বাচনটা সত্যিকার অর্থেই জনগণের মতামত রাখার নির্বাচন হয়।

আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলাম ১৯৬৭ সালে। তখন থেকেই আমি এই কাজগুলোর সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। ছাত্র ইউনিয়ন বলে যে সংগঠনটা এখনও আছে তারা তখন এই বিষয়গুলি নিয়ে খুব চিন্তা করতো। ৬ দফার ভিত্তিতে স্বায়ত্তশাসনের বো বিষয়টি তখন আলোচনা হচ্ছিলো পূর্ব পাকিস্তানের জন্য, সেটার সঙ্গে আর কি কি দফা যুক্ত করা যায়, সেখানে জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তির বিষয়টি পরিষ্কারভাবে আছে কিনা। এ সব নিয়ে নানা আভাপ-আলোচনা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করা, সাধারণ ছাত্রছে কি না, সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের মটিভেট করা ইত্যাদি কাজ করা হতো। আমি অবশ্য তখন ছাত্র ইউনিয়নের সদস্য ছিলাম না। কিন্তু আমি ‘সংস্কৃতি সংসদ’ বলে ওদের যে সাংস্কৃতিক সংগঠন ছিলো, সেটার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলাম। এর মাধ্যমে আমি অনেক কাজ করেছি এবং এটার মাধ্যমে বিভিন্ন জায়গায় গিয়েছি। এমন কি ছাত্র ইউনিয়নের তখন যে একটা প্রোগ্রাম ছিলো মফস্বলে ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে প্রাদেশিক অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তানের বিষয়ে সচেতনতা গড়ে তোলা সেটা করেছি। নাটক করেছি, বক্তৃতা দিয়েছি বিভিন্ন জায়গায়। স্টাডি সারকেলের মাধ্যমে বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে আমরা আলোচনা করেছি যাতে করে এ বিষয়ে মানুষের একটা পরিষ্কার ধারণা জন্মায়।

যাহোক, ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে তৎকালীন পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ কেন্দ্রে এবং পূর্ব পাকিস্তানে বিজয়ী হয়। তখন পাকিস্তানের শাসন ক্ষমতায় ছিলো সামরিক বাহিনী। সামরিক শাসকরা আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা দেয়নি। ফলে, আমাদের দেশে আবার আন্দোলন শুরু হয়। ঐ আন্দোলন তুঙ্গে ওঠে ১৯৭১ সালের ১ মার্চ থেকে। কারণ সেদিন জাতীয় পরিষদের প্রস্তাবিত অধিবেশন বসার তারিখ পাকিস্তানের সামরিক শাসক বাতিল করেছিলো। এরপর ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ঢাকায় এক জনসভায় ভাষণ দেন। সেদিন যে জনসভা হয়েছিলো সেটা আজও আমার স্মৃতিতে একটা উদ্বেল করা ঘটনা। এ রকম ঘটনা বাংলাদেশে বোধহয় খুব কমই ঘটেছে। নির্বাচনের পর যে ঘটনাগুলি ঘটে চলে তাতে আমাদের শঙ্কা, উদ্বেগ, ভয় ক্রমশ বৃদ্ধি পায়। আবার ৭ মার্চের জনসভা স্বাধীনতা লাভের যে উত্তেজনা বা অনুপ্রেরণা এটা পরিষ্কারভাবেই আমাদের মনে জেগেছিলো। সেই অনুভূতি এখন আর বর্ণনা করা যাবে না। ৭ মার্চের কথা মনে হলেই আমার সবসময়ই মনে হয় যে, সমুদ্র কি এর থেকেও অনেক বেশি উত্তাল হতে পারে কিংবা এর থেকেও গভীর কখনো হতে পারে? এটা আমি নিজের সঙ্গেই আলোচনা করি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব যখন দাঁড়িয়ে বক্তৃতা দিচ্ছিলেন তখন প্রত্যেকটি মানুষকেই মনে হচ্ছিলো যে, তারা এক একজন মুক্তিযোদ্ধা। সেই মুহূর্তে যেন আমরা চাইলেই স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনতে পারি- এইরকম উদ্দীপনা সেদিন সবার মধ্যে আমি আন্দোলিত হতে দেখেছি। আমি নিজে সেদিন সেই মাঠে উপস্থিত ছিলাম এবং মাঠের এককোণায় দাঁড়িয়ে তাঁর বক্তৃতা শুনেছিলাম। স্বাধীনতার চেতনা বলতে আমি আমার মনের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর সেদিনের ভাষণটাই লালন করি।

প্র: পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ১৯৭১ সালের ২৫-২৬ মার্চের আক্রমণ সম্পর্কে আপনি কি জানেন?

উঃ ঐ সময় আমি ঢাকাতেই ছিলাম। আমার মা-বাবার যে বাড়িটা, সেই বাড়িটাতেই তখন আমরা সবাই একত্রে বসবাস করছিলাম। আমাদের বাড়িটা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়ির একই রাস্তায়। ২৫ মার্চের সকাল থেকেই ঐ রাস্তা দিয়ে মানুষের ঢল নেমেছিলো। দলে দলে মানুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়িতে আসছিলো। তারা ঐ বাড়ির সামনে কিছুক্ষণের জন্য দাঁড়িয়ে তাঁকে দেখে এবং সালাম দিয়ে আবার ফিরে যাচ্ছিলো। যারা ওখানে আসছিলো তারা অত্যন্ত দৃঢ় ও স্পষ্টভাবেই স্বাধীনতার শ্লোগান দিতে দিতেই আসছিলো। আমার মনে আছে, সেদিন আমি, আমার ছোট বোন, আমাদের কিছু বন্ধুবান্ধব এবং আমাদের বাড়ির আরো কিছু লোক বিকালবেলায় আমাদের বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে দেখার চেষ্টা করছিলাম যে, লোকজন কিভাবে আসছে এবং চলে যাচ্ছে। সেও এক অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতা। স্রোতের মতো মানুষ আসছিলো। আবার চলেও যাচ্ছিলো। এক দল যাচ্ছে আবার আরেক দল আসছে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়ির ঠিক সামনেই একটা লেক আছে। সেই লেকের অপর পারেই ধানমন্ডি গার্লস হাই স্কুল। তখন ঐ স্কুলের পাশেপাশে এখনকার মতো এত উঁচু উঁচু বাড়ি ছিলো না। বাড়িগুলো একতলাই ছিলো বেশি। আমাদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে লেকের পারে দাঁড়ালে স্কুলটা দেখা যেতো। আমরা দাঁড়িয়ে দেখলাম যে, ঐ বিকেলে স্কুলটাতে কিছু আর্মি এলো। সেখানে মেশিনগান বা ঐ জাতীয় অস্ত্র ফিট করা হচ্ছিলো। আমি ও আমার বোন তখন দাঁড়িয়ে কথা বলছিলাম। ওখানে আর্মিদের মেশিনগান ফিট করা দেখে আমরা নিজেরাও কিছুটা হাসছি এই ভেবে যে, ওরা কত আর মানুষকে মারবে! জঙ্গিভাবও আর্মিদের মধ্যে দেখলাম। একটা প্রচণ্ড সহিংসভাব লক্ষ্য করলাম তাদের মধ্যে। এরপর ঐ দিন অর্থাৎ ২৫ মার্চ সন্ধ্যাবেলায় আমি আর আমার বোন চলে গিয়েছিলাম আমাদের আরেক বন্ধু মিলিয়া আলীর বাসায়। মিলিয়া আলীর স্বামী তারিক আলী তখন বাসায়। মিলিয়া আলীর বাড়ি থেকে ফিরে এসে দেখলাম যে, আমাদের এলাকায় আর্মির সংখ্যা আরো বেড়েছে। এদিকে ঐ দিন সন্ধ্যায় আমার মাও চলে গিয়েছিলেন কোনো একটা মিটিংয়ে। খুব সম্ভবত জিগাতলা মহিলা পরিষদের সভা ছিলো সেদিন। মায়ের ফিরতে ফিরতে রাত প্রায় আটটা নয়টা হলো। তখনো লোকজন আসা যাওয়া করছে ৩২ নম্বর রাস্তায়। তখন অবশ্য ভীড়টা একটু হালকা হয়ে গেছে।

যাহোক, সেদিন আমরা রাত দশটা সাড়ে দশটার দিকে রাতের খাবার শেষ করেছি মা, বাবা, ভাইবোন সবাই মিলে। ঐদিন সবাই আমরা বাড়িতে ছিলাম। তারপর রাত সাড়ে এগারোটা কি পৌনে বারোটার দিকে, এখন একেবারে সঠিক সময় বলতে পারবো না; চাটগাঁ থেকে আমার বড় ভগ্নীপতি টেলিফোন করলেন। তিনি তখন পাকিস্তান রেডিও-র চাটগাঁ কেন্দ্রের ডিরেক্টর ছিলেন। তিনি ফোন করে জিজ্ঞেস করলেন যে, মা বাড়িতে আছেন নাকি, তোমরা ভালো আছো নাকি? আমিই সেদিন টেলিফোনটা ধরেছিলাম। আমি বললাম যে, হ্যাঁ, আমরা ভালো আছি। উনি আরো জিজ্ঞেস করলেন যে, তোমাদের খবর কি? আমি বললাম, সব ভালো। তারপর উনি বললেন, খবর কিন্তু  খুব একটা ভালো না। এটা বলার সঙ্গে সঙ্গে টেলিফোন লাইনটা কেটে গেলো। এর কিছু সময় পরই প্রচণ্ডভাবে গোলাগুলির শব্দ হতে থাকলো। শব্দ শুনে মনে হলো, শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়িটাকে কেন্দ্র করেই গোলাগুলি শুরু হয়েছে। এর একটু পরই আমরা কিছু লোকের দৌড়াদৌড়ির শব্দ শুনলাম। আমাদের বাড়ির কাছে একটা পুল আছে। সেই পুলের উপরে বা তার কাছে আল্লা বলে কেউ চিৎকার করে উঠলো। সেই শব্দও আমরা পেলাম। এ রকম আরো দু’একটা আর্তচিৎকার আমরা শুনলাম। তখন আমাদের তো একেবারে হতভম্ব অবস্থা। কিছুই আমরা বুঝত পারছিলাম না যে কি হচ্ছে। সেদিন রাতে পুলের উপরে যিনি প্রথম মারা গিয়েছিলেন তাঁর পরিচয় আমরা পরে জেনেছি। পানাউল্লাহ সাহেব বলে একজন রাজনীতিকের ছেলে। ওর নাম খুব সম্ভবত ছিলো খোকন। উনিই আমাদের বাড়ির পার্শ্ববর্তী পুলের উপর গুলি খেয়ে মারা যান ২৫ মার্চের রাতে।

এদিকে কিছু সময় পর থেকে আমরা আরো গোলাগুলির শব্দ শুনতে পেলাম। আমাদের বাড়ির খুব কাছেই পিলখানা। সেখানে তৎকালীন ইপিআর-রা থাকতো। এখন যেটা বিডিআর হেডকোয়ার্টার। সেখান থেকেও আমরা ক্রমশ ব্যাপক গোলাগুলির শব্দ শুনতে পেলাম। তখন আমরা মনে করলাম যে, হয়তো ইপিআর বাহিনীর সাথে কেউ যুদ্ধ করছে বা কেউ তাদের উপর আক্রমণ করেছে। আমরা এ সব শুধু ভাবছি। কিন্তু আসলে কি ঘটছে সেটা জানতে পারছিলাম না। আমরা কেউ বাড়ি থেকে বেরও হতে পারছিলাম না। এর কিছু সময় পর হঠাৎ আমরা আশপাশ থেকে একটা হৈ চৈ-এর শব্দ শুনতে পেলাম। ঐ সময় পাশের বাড়ি থেকে কেউ আমাদেরকে ডেকে বললো যে, ছাদে ওঠেন, ছাদে ওঠেন, আগুন দেখা যাচ্ছে। তখন তাড়াহুড়া করে আমরা ছাদে উঠলাম। ঐ সময় আমাদের বাড়িও দোতলা হয়নি। আমরা দৌড়ে একতলার ছাদে উঠেছি। আগেও বলেছি ধানমন্ডি এলাকার বেশির ভাগ বাড়িই তখন একতলা ছিলো। দোতলা বাড়ি খুব একটা ছিলো না।

যাহোক, ছাদে উঠে আমরা চারদিক দেখার চেষ্টা করলাম। দেখলাম যে, কালো ধোঁয়া উঠছে বিশ্ববিদ্যালয়-নীলক্ষেতের কোণাটা ধরে। রাতেও সেটা বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু বুঝতে পারছি না যে, ঠিক কোথায় আগুনটা লেগেছে। শুধু এইটুকু আমাদের ধারণায় আসলো যে, নিশ্চয়ই বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার কোথাও আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। সে রাতে বাকি সময় আমরা জেগেই কাটালাম। আমরা বুঝতে পারছিলাম না কোথায় কি হচ্ছে। গোলাগুলি কেন হচ্ছে, কারা করছে, গোলাগুলিতে কে মরছে, কে বাঁচছে, কার কি অবস্থা, এ সব কিছুই জানতে পারলাম না। সত্যি বলতে কি তখন পর্যন্ত আমরা কিছুই বুঝতে পারিনি। তবে ভয়ঙ্কর একটা ঘটনা যে শুরু হয়ে গেছে সেটা বেশ বুঝতে পারছিলাম। কিন্তু তার ব্যাপকতা বুঝতে পারিনি। এভাবেই ২৭ তারিখ সকাল পর্যন্ত আমরা বাড়ির ভিতরে আটকা থাকলাম।

প্র: ২৭ তারিখে তো কারফিউ তুলে নেওয়া হলো। তখন কি আপনি সব কিছু জানার চেষ্টা করেছিলেন বা রাস্তাঘাটে বের হয়েছিলেন?

উ: হ্যাঁ, কারফিউ উঠে যাওয়ার পরই আমি এবং আমার বোন রাস্তায় বের হয়েছিলাম। আমরা বের হলাম খোঁজখবর নেওয়ার জন্য। বের হয়েই কিছু মানুষের মুখে শুনলাম যে, পাক আর্মি ঢাকার বিভিন্ন স্থানে আক্রমণ করেছে। ধানমন্ডি এলাকার কিছু কিছু বাড়িতেও নাকি পাক আর্মি গুলি চালিয়েছে। দু’টো ঘটনা তখন দেখলাম। একটা হলো, আমাদের বাড়ির পাশেই একটা বাড়িতে। বাড়িটিতে তখন কন্সট্রাকশনের কাজ চলছিলো। আমরা দেখলাম সেই বাড়ির দারোয়ানকে গুলি করে মারা হয়েছে।

দারোয়ানের মৃতদেহটা তখনও সেখানেই পড়েছিলো। ঐ বাড়ির ছাদের উপরে তখনও কালো পতাকা কিংবা বাংলাদেশের পতাকা উড়ছিলো। তখন বেশিরভাগ বাড়িতেই তো বাংলাদেশের পতাকা উড়তো। ২৫ মার্চের রাতের ঘটনার পর ২৬ মার্চ অনেকেই সে পতাকা নামিয়ে ফেলেছিলো। শুনলাম ঐ বাড়ির দারোয়ান ওটা নামাতে পারেনি। সে জন্য পাক আর্মি দারোয়ানটাকে গুলি করে মেরেছে। দেখলাম, আমাদের এলাকার রাস্তাঘাট একেবারেই জনশূন্য। আমরা বাড়ি থেকে বের হয়ে প্রথম পুলটা পার হয়ে দক্ষিণ দিকে গিয়েছিলাম। এরপর ওদিক থেকে ফিরে এসে শেখ সাহেবের বাড়ির দিকে গেলাম। যখন আমরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়ির সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি, দেখি কিছু পাক আর্মি ট্রাকে জিনিসপত্র তুলছে। প্রথম আমরা বুঝতে পারিনি যে, সেগুলো তাঁর বাড়ি থেকে আনা হচ্ছে। পরে দেখি পাক আর্মি শেখ সাহেবের বাড়ি থেকে কিছু জিনিসপত্র নিয়ে এনে ট্রাকে তুলছে। তাঁর বাড়িটা তখন বিরান ভূমি। এক পাক আর্মির হাতে দেখলাম জায়নামাজ। আমি যখন তার পাশ দিয়ে যাচ্ছি তখন সে মন্তব্য করলো, এই শালা কি মুসলমান ছিলো যে বাড়িতে জায়নামাজ রেখে দিয়েছে। এই বলে সে জায়নামাজটা অবজ্ঞাভরেই ছুঁড়ে ফেলে দিলো ট্রাকের উপরে। কথাগুলো অবশ্য সে উর্দুতেই বলেছিলো। বাড়ির সামনে আর্মি পাহারা দিচ্ছে। আমরা যখন সেখান দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি তখন তারা বলছে, জলদি চলা যাও, জলদি চলা যাও। এরপর আমরা মিরপুর রোড পর্যন্ত গেলাম। সর্বত্রই দেখি পাক আর্মি। কিছু লোকের সঙ্গেও আমাদের দেখা হলো। তখন পর্যন্ত আমরা কিন্তু অনুধাবন করতে পারি নাই যে, ঢাকায় ব্যাপক গণহত্যা হয়েছে। এরপর আমরা বাসায় ফিরে আসি। ফিরে আসতে আসতে কয়েকজনের মুখে শুনতে পেলাম যে, ইউনিভার্সিটিতে আক্রমণ হয়েছে এবং সেখানে ছাত্র-শিক্ষক অনেককে নাকি মেরে ফেলা হয়েছে। তাদের মুখে ড. মনিরুজ্জামান স্যারের নাম শুনলাম। ড. আনিসুর রহমানেরও নাম শুনলাম। তারপর আমাদের ডিপার্টমেন্টের এবং অন্যান্য আরো কয়েকজন স্যারের কথাও শুনলাম। আস্তে আস্তে তখন নামের সংখ্যা বাড়ছিলো। তখন থেকেই আমরা বুঝতে শুরু করলাম যে, পাক আর্মি নির্বিচারে গণহত্যা শুরু করেছে।

প্র: এরপর আপনি কি ঢাকাতেই থেকে গেলেন?

উ: হ্যাঁ, আমি আমার বাবা-মার সাথে কয়েক মাস ঢাকাতেই থেকেছি। তারপর জুন মাসে আমি ভারতে চলে যাই।

প্র: ২৫ মার্চের রাত থেকে পাকিস্তানি হামলার পরিপ্রেক্ষিতে আপনার মায়ের বাড়ি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের একটা কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠেছিলো বলে আমরা শুনেছি-এ সম্পর্কে আপনি কি জানেন?

উ: এ কাজের একটা পটভূমি আছে। ‘হেরাল্ড ট্রিবিউন’ বলে একটা পত্রিকা আছে। পত্রিকাটি আমেরিকার নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত হয়। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের পরপরই সেই পত্রিকায় বাংলাদেশের কেউ একজন খবর দিয়েছিলেন যে, ড. নীলিমা ইব্রাহীম এবং কবি সুফিয়া কামালকেও পাকিস্তান আর্মি মেরে ফেলেছে। পত্রিকাটিতে সে খবর ফলাও করে প্রকাশিত হয়। খবরটি ‘হেরাল্ড ট্রিবিউন’ পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ার পর প্রবাসী বাঙালি যারা আমেরিকায় ছিলেন তারা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। তারা তখন পাকিস্তানস্থ আমেরিকান অ্যামবেসির থ্রতে বাংলাদেশের খবর নিতে চেষ্টা করলেন যে, আসলে ঘটনা সত্যি কিনা। আমার মা তখন সোভিয়েত-পাকিস্তান মৈত্রী সমিতির চেয়ারপার্সন ছিলেন। সোভিয়েত (বর্তমানে রাশিয়া) সরকারও বিষয়টা সম্পর্কে পাকিস্তান সরকারের কাছে জানতে চাইলো। তারা এ ব্যাপারে যে ভীষণভাবে উদ্বিগ্ন সে কথাও জানালো। তারা জানতে চাইলো আমার মা আদৌ বেঁচে আছেন কি না? বেঁচে থাকলে প্রমাণসহ বিস্তারিত জানাতে বললো।

এদিকে ঐ সময় আবার আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্র থেকেও এ বিষয়ে সংবাদ পরিক্রমায় সংবাদ প্রচারিত হয়। দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায় সেই সংবাদ পরিক্রমায় বললেন যে, পাকিস্তান সেনাবাহিনী আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত সুফিয়া কামালকেও হত্যা করেছে। তাঁকে হত্যা করা মানে সব বাঙালিকেই হত্যা করা ইত্যাদি।

এ সবের প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা গেলো পাকিস্তানিদের মধ্যে। যেহেতু মা বেঁচে আছেন, তাঁর কোনো ক্ষতি হয়নি, এই সুযোগটা নিয়ে পাক সামরিক জান্তার লোকজন পরদিনই মার ছবি তুলে নিয়ে গেলো আমাদের বাড়িতে এসে। তখন ওদের কাছ থেকে যে আচরণটা আমরা পেতে লাগলাম, সেটা খুবই আয়রনিক্যাল সেই সিচুয়েশনে। তখন ওদেরই (পাকিস্তানিদের) যেন দায়িত্ব হয়ে গেলো মাকে বাঁচিয়ে রাখা। তারা মাকে সামনে রেখে এটা প্রমাণ করতে চাইলো যে, ওদের বিরুদ্ধে বুদ্ধিজীবী হত্যার যে অভিযোগ আসছে সেটা মিথ্যা। এর ফলে আমাদের বাড়িটা তখন মোটামুটি একটা ইমিউনিটি পেয়েছিলো এবং সেটার সুযোগ আমরা পুরোদমে গ্রহণ করি। সেই অর্থে যদি বলা যায় যে, আমাদের বাড়িটা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সেন্টার ছিলো, তাহলে আমি বলবো, হ্যাঁ। আমাদের বাড়ি থেকে আমরা মুক্তিযোদ্ধাদের তথ্য সরবরাহ করেছি। অর্থ সংগ্রহ করে সে অর্থ মুক্তিযুদ্ধের কাজে লাগানোর জন্য পাঠিয়ে দিয়েছি। তারপর যারা আমাদের বাড়িতে এসেছে তাদের মাধ্যমে বিভিন্ন জায়গায় আমরা খবর পাঠিয়েছি। তখন আমরা পরস্পরের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করতে শুরু করেছিলাম। যেহেতু মা তখন বিরাট পরিচিতি পেয়েছিলো, সেহেতু আমাদের ধারণা হয়ে গিয়েছিলো যে, আমাদের এখন আর ওরা কিছু করার সাহস পাবে না। এই সুযোগটা নিয়ে আমরা মাকে কেন্দ্র করে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করতে শুরু করেছিলাম।

প্র: আপনাদের বাড়িতে কারা কারা আসতেন?

উ: আমাদের বাড়িতে অনেক পরিচিত এবং নাম না জানা অনেকেই এসেছেন। তাঁরা থেকেছেন। শহীদ শহীদুল্লা কায়সার, তারপর প্রফেসর গিয়াসউদ্দীন আহমদ, প্রফেসর বোরহানউদ্দীন খান জাহাঙ্গীর, এরাও অনবরত এসে আমাদের সাথে যোগাযোগ রাখতেন এবং আমাদের মাধ্যমে অন্যদের সাথে যোগসূত্র স্থাপন করতেন। শহীদুল্লা কায়সার আর গিয়াসউদ্দীন আহমদ তো অনেক সময় ফেরিওয়ালা সেজে মুক্তিযোদ্ধা যারা দেশের ভেতরে ঢুকেছিলো শেষের দিকে অর্থাৎ অক্টোবর-নভেম্বরের দিকে তাদের জন্যে খাবার, কাপড়-চোপড় পৌছে দিয়েছেন।

প্র: ঐ সময় আপনি কি ঢাকাতে ছিলেন?

উ: না, এটা আমি পরে শুনেছি। তখন আমি ভারতে ছিলাম। আমার ছোট বোন টুলু এবং আমি ঢাকা ছেড়েছি জুনের পনেরো তারিখের দিকে। সেটারও একটা কারণ ছিলো। এপ্রিলের পর থেকে আমাদের বাড়িতে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকজনের আনাগোনা চলছিলো এবং আমরা জানতাম যে, কারা মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিচ্ছে, কারা কোথায় যাচ্ছে, কিভাবে যাচ্ছে ইত্যাদি। সেই সূত্র এবং খবরগুলি আমরা অন্যদেরকেও দিতাম। মানে যারা ইচ্ছুক ছিলো মুক্তিযুদ্ধে বা মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিতে। যেমন আমাদের বাড়ির সামনেই তখন পাকিস্তান বিমান বাহিনীর একজন ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট থাকতেন। দেশ স্বাধীনের পর উনি খুব সম্ভবত উইং কমান্ডার হিসেবে অবসর নেন। তাঁর নাম হামিদুল্লাহ। হামিদুল্লাহ ভাই মাঝে মাঝে আমাদের বাড়িতে এসে আমাদেরকে নানা কথা বলতেন। আমরা তাঁকে ভাই ডাকতাম, যেহেতু উনি আমাদের প্রতিবেশী ছিলেন। উনি মাঝে মাঝে এসে বলতেন এয়ারফোর্স থেকে অমুক অমুক অফিসারকে পাক আর্মিরা ডেকে নিয়ে গেছে। কিন্তু তাদের আর খবর পাওয়া যাচ্ছে না কিংবা তাদেরকে বিভিন্নভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। একদিন তিনি উদভ্রান্তের মতোই এসে মাকে বললেন যে, আমার ওপর একটা ভয়ানক দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। আমাকে বলা হয়েছে যে, রায়ের বাজারে যে হিন্দু এলাকাগুলি আছে সেগুলি চিহ্নিত করে কালকে ওখানে আর্মি নিয়ে যেতে হবে। এই অপারেশনে আমাকে তাদের সঙ্গী হতে হবে। কিন্তু আমি এটা তো মন থেকে কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না। আমি এখন কি করতে পারি।

তখন হামিদুল্লাহ ভাইয়ের স্ত্রী এবং তাঁর তিনটা ছোট ছোট বাচ্চা ছিলো। হামিদুল্লাহ ভাইয়ের উপস্থিতিতেই মা আমাকে আড়ালে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন যে, আমরা তাকে কিভাবে সাহায্য করতে পারি? তখন আমি বললাম যে, দেখি কি করতে পারি। কিছু করা সম্ভব হলে আমি হামিদুল্লাহ ভাইকে জানাচ্ছি। এরপর আমি একজনের সঙ্গে কথা বললাম, আমার যতদূর মনে পড়ে উনি শাহাদত চৌধুরী ছিলেন। সাপ্তাহিক বিচিত্রার যিনি সম্পাদক ছিলেন পরে। তারপর শাহাদত ভাই আমাদের বাড়িতে এসে আমাকে একটা পত্রিকা দিয়ে বলেছিলেন যে, তুমি হামিদুল্লাহকে বলো এই পত্রিকাটা হাতে নিয়ে কাল বায়তুল মোকাররমের অমুক দোকানটার সামনে অমুক সময় দাঁড়িয়ে থাকতে। তখন আমি হামিদুল্লাহ ভাইকে গিয়ে সেটা জানালাম। তাঁকে পত্রিকা দিয়ে বললাম যে, আপনি ওখানে পত্রিকাটা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবেন। তার পরদিন উনি নির্দিষ্ট সমটায় দাঁড়িয়ে থাকেন। তখন একজন মুক্তিযোদ্ধা এসে হামিদুল্লাহ ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করে এবং তাঁকে নিয়ে বোধহয় ঐ দিনই ইন্ডিয়াতে রওনা হয়ে যায়। পরে তিনি মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেন।

এ ভাবেই আমরা কাজ করতাম। এরপর আমরা একদিন জানতে পারলাম যে, হামিদুল্লাহ ভাইয়ের বাড়ির একজন কাজের লোককে আর্মিরা ধরে নিয়ে গেছে। তখন আমরা সবাই একটু শঙ্কিত হয়ে পড়লাম। আমরা মনে করলাম ওর মুখ থেকে যদি বেরিয়ে যায় যে, হামিদুল্লাহ ভাই আমাদের বাসায় আসতেন, যোগাযোগ রাখতে যদি তাহলে হয়তো আমাদের বাসায় এসে তারা খোঁজখবর করবে। মনে করলাম কোনো কারণে যদি আমাদেরকে ধরে তাহলে একটা পুরা চেইন ধরা পড়ে যেতে পারে। এই অবস্থায় তখনই আমরা সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম যে, আমার এবং আমার ছোট বোনের ঢাকায় থাকা উচিত হবে না। এরপরই আমরা দু’জন ধানমন্ডিতেই আরেকটা বাড়িতে চলে গেলাম। এটা পুরাতন ছাব্বিশ নম্বর রোডে। সেখানেও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকজন আসতো। আতিয়া হক বলে একজন ভদ্রমহিলা, তাঁর বাড়িতে। কবি সিকান্দার আবু জাফরের ছেলে সমু সেখানে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতো। তারপর মাহমুদুর রহমান বেণু, মিলিয়া এরাও যোগাযোগ রাখতো। আতিয়া হক আবার মিলিয়াদের আত্মীয় ছিলো। আমরা সবাই মিলে সেখানটায় প্রায়ই একত্রিত হতাম। ওখান থেকেই আমরা পনেরোই জুন ভারতের পথে রওনা দেই। তখন হামিদুল্লাহ ভাইয়ের পরিবার, বেণু, তারপর মিলিয়া আমাদের সঙ্গে ছিলো। বেণু ভাই আমাদেরকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলো। বেণু ভাই কিন্তু তখন ভারতে নিয়মিত আসাযাওয়া করতেন। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকজনদের আনা-নেওয়ার ব্যাপারে এবং সংবাদ আদান-প্রদানের ব্যাপারে উনি সহযোগিতা করতেন। এছাড়া উনি আরো কিছু কাজ করতেন। মাহমুদুর রহমান বেণু গানের শিল্পীদের নিয়ে একটি টিম করেছিলেন। তিনি সেটার টিম লিডার ছিলেন। এই টিম বিভিন্ন জায়গায় সঙ্গীত পরিবেশন করে বেড়াতো। মিলিয়ার ছোটবোন সোনিয়াও আমাদের সঙ্গে গিয়েছিলো। এখন আওয়ামী লীগের একজন এম. পি. ইমরান আহমেদ, তাঁর স্ত্রী শিলু, সেও আমাদের সঙ্গে গিয়েছিলো। তার মা তখন আওয়ামী লীগে ছিলেন। ১৯৭০ সালে মহিলা এম.এন. এ. নির্বাচিত হয়েছিলেন। ওর মায়ের নাম বদরুন্নেসা আহমেদ। শিলু আমাদের বন্ধু। আমরা সবাই কিন্তু একসঙ্গেই কাজ করতাম। আমরা মোটামুটি ঠিক করলাম যে, আমরা সবাই ভারতেই চলে যাবো। ওখানে যেয়ে মুক্তিযুদ্ধের কাজ করবো। এরপর আমরা ঢাকা থেকে কুমিল্লার চান্দিনা বলে একটা জায়গায় ট্যাক্সি করে গেলাম। যাওয়ার সময় আমরা এমন ভাব করছিলাম যে, কুমিল্লায় আমাদের এক বোনের বিয়ে, সেখানে যাচ্ছি বিয়ে খেতে। ওইরকমভাবেই পোশাক আশাক এবং গয়নাগাটি পরেছিলাম। চাকচিক্যময় একটা ভাব নিয়ে ওয়েল-ড্রেসড্ হয়ে আমরা কুমিল্লার চান্দিনায় চলে গেলাম।

প্র: আপনারা পথে পাক আর্মির সামনে পড়েননি?

উ: কুমিল্লার পথে কয়েক জায়গায় তখন তো ফেরী ছিলো। এক জায়গায় ফেরীতে আমরা যখন নদী পার হচ্ছি তখন এক গাড়ি ভর্তি আর্মি বিপরীত দিক থেকে ঘাটে আসছে। তারা আমাদের দেখে জিজ্ঞেস করলো যে, কোথায় যাচ্ছি আমরা। আমিই তখন গলা বার করে উর্দুতে বললাম যে, মেরা বোহিনকা শাদী হ্যায় কুমিল্লামে। এটা শুনে তারা বললো, আচ্ছা, ঠিক হ্যায়, ঠিক হ্যায়, চলা যাও। আর কিছু বলেনি। তারপরে আমরা নদী পার হয়ে চান্দিনাতে এসে গাড়ি থেকে নেমে রিকসা নিয়ে সীমান্ত পর্যন্ত গিয়ে সোনামুড়া দিয়ে ভারতে প্রবেশ করি। নির্বিঘ্নেই পৌঁছে গেলাম।

প্র: ভারতে গিয়ে আপনি কি করলেন?

উ: আমরা যেতে যেতেই বলাবলি করছিলাম যে, কে কোথায় যাবো, কি করবো। আমাদের একেকজনের একেক ধরনের কাজ করার পরিকল্পনা আগে থেকেই ছিলো। শিলুর স্বামী ভারতে গিয়েছিলো আগেই। কিন্তু শিলুর স্বামীর বাবা ছিলেন পাঞ্জাবি। উনি তখন বাংলাদেশে বসবাস করতেন। শিলুর স্বামীর পরিবারের সবাই বাঙালিদেরই মতো ছিলো। বিশেষত আচার-আচরণের দিক থেকে। শিলু খবর পেয়েছিলো যে, ওর স্বামীকে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ আটক করে রেখেছে। শিলুর প্রথম কাজটা ছিলো ওর স্বামীকে আটক অবস্থা থেকে বের করে আনা। মিলিয়ারা ঠিক করেছিলো যে, কলকাতায় গিয়ে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে যোগ দেবে কিংবা সাংস্কৃতিক স্কোয়াডে যোগ দেবে। আমি আর আমার ছোটবোন ঠিক করলাম যে, আমরা সীমান্ত এলাকাতেই থেকে যাবো এবং চেষ্টা করবো মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিতে। সরাসরি যুদ্ধের ট্রেনিং নেবো- এই প্রতিজ্ঞা নিয়েই আমি ভারতে গিয়েছিলাম।

এদিকে ভারতে যাওয়ার সময় পথে আমাদের সঙ্গে দেখা হলো ফতেহ চৌধুরীর সঙ্গে। সে শাহাদত চৌধুরীর ছোট ভাই। সে ততোদিনে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিয়েছে। ফতেহ মূলত খবর আদান-প্রদান করতো বিভিন্ন জায়গায় এসে। রেকি করা যাকে বলে আর্মির ভাষায়। বাংলাদেশের ভিতরে এসে রেকি করে যেতো সে। আমরা যখন সীমান্তে র কাছাকাছি তখন ফতেহ চৌধুরী বর্ডার পার হয়ে বাংলাদেশের দিকে আসছিলো। ওর সঙ্গে যখন দেখা হয় তখন আমি আর আমার ছোটবোন টুলু তাকে বলেছিলাম যে, আমরা কিন্তু কলকাতায় যাবো না। আমরা আগরতলাতেই থাকতে চাই। তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম ওখানে কি করতে পারি, কে কে আছে ওখানে এই সব। তখন ফতেহ চৌধুরী বললো যে, তোরা যে আসবি সে খবর আমরা পেয়েছি। ওখানে লে. আকতার আছেন। তোরা তাঁর সাথে কাজ করতে পারিস। আকতার আর্মির ডাক্তার ছিলেন। আমরা ভারতে যাওয়ার আগেই শুনেছিলাম যে, উনি ছোট্ট একটা চিকিৎসা কেন্দ্রের মতোন করেছেন এবং একাই সেখানে কাজ করছেন।

তাই আমরা সেখানে পৌঁছেই প্রথমে আকতার ভাইকে খোঁজ করলাম। তাঁর সঙ্গে দেখা হওয়ার পর তাঁকে বললাম যে, আকতার ভাই আমরা কলকাতায় যাবো না, আমরা এখানেই থাকবো। আমরা মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিতে চাই। আকতার ভাই বললেন যে, নিশ্চয় তোমরা এখানেই থাকবে। কিন্তু আপাতত তোমরা আমার কাছেই থাকো। মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিতে হলে খালেদ মোশাররফের সঙ্গে আগে কথা বলতে হবে। খালেদ মোশাররফ দিল্লীতে গেছেন। উনি এলেই আমি এ ব্যাপারে একটা ব্যবস্থা করবো। তার পর থেকে আমরা আগরতলাতেই থেকে গেলাম এবং আকতার ভাইয়ের সঙ্গে কাজ করতে শুরু করলাম। এর মধ্যে খালেদ মোশাররফ ফিরে এলেন। তাঁর সঙ্গে আমরা কথা বলার পর তিনি বললেন যে, হ্যাঁ অবশ্যই তোমরা এখানে থাকবে। আমি খুব খুশি হয়েছি যে, তোমরা এসেছো। আমরা চিন্তা করছি এখানে একটা ছোটখাটো হাসপাতাল তৈরি করবো। কারণ যেভাবে বাংলাদেশ থেকে আহত লোকজন এখানে আসছে তাতে তাদের চিকিৎসার জন্য আমাদের একটা হাসপাতালের ভীষণ প্রয়োজন। তোমরা যদি রাজি হও তো আমরা সেটা বড় আকারে করতে পারি। তখন আমি বললাম যে, আমরা আহতদের সেবা করতেও রাজি আছি। কিন্তু আমরা মুক্তিবাহিনীতেও যোগ দিতে চাই। খালেদ মোশাররফ বললেন, ঠিক আছে। এর আগে কিন্তু আমরা জিয়াউর রহমানের সঙ্গেও দেখা করেছিলাম। তিনি তখন আগরতলায় কি এক কাজে এসেছিলেন। আমরা আবার সেদিন বেরিয়েছিলাম ওষুধ সংগ্রহ করতে। সেই সময় আর্টস অ্যান্ড ক্রাফট হোস্টেলে তাঁর সঙ্গে আমাদের দেখা হয়েছিলো। তখন তাঁকেও আমি বলেছিলাম যে, আমরা মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিতে চাই। তখন জিয়াউর রহমান সাহেব আমাকে আর টুলুকে বলেছিলেন যে, আপনারা যদি পাঁচজন মেয়ে একত্র হতে পারেন তাহলে আমি আপনাদের ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করতে পারি। পাঁচজনের কম হলে এটা হবে না। আপনারা পাঁচজন হলে আমাকে জানাবেন, আমি আপনাদের ট্রেনিং দেওয়ার ব্যবস্থা করবো। যাহোক, তারপর থেকে আমরা হাসপাতালেই কাজ করতে লাগলাম। যদিও সব সময়ই আমাদের ইচ্ছা ছিলো যে, আমরা আর্মস ট্রেনিং নেবো। এটা আর পরবর্তীতে হয়ে ওঠেনি নানা কারণে।

প্র: হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য কাদেরকে বেশি নিয়ে আসা হতো?

উ: আমরা গেলাম জুন মাসে। তখন তো আমরা ছিলাম একদম সীমান্ত বরাবর। সেখানে আমরা প্রথম দিকে যে আহতদেরকে পেতাম তাদের অধিকাংশই সাধারণ গ্রামবাসী। কারণ সীমান্ত এলাকায় প্রায় দিনই হঠাৎ হঠাৎ পাক আর্মি এসে আক্রমণ করতো। তাদের আক্রমণে প্রায়ই কিছু না কিছু লোক হতাহত হতো। যারা মারা যায়নি, বেঁচে গেছে কিন্তু বেশ আহত তাদেরকে মুক্তিযোদ্ধা ছেলেরাই আবার নিয়ে যেতো সীমান্তের ওপারে। সেই সময় আমরা কিছু আহত ছাত্রকেও পেয়েছি। এরা দেশের ভিতরে বিভিন্ন ধরনের কাজ করতো। যেমন ফতেহ চৌধুরী যে কাজগুলি করতো। এই ছেলেগুলোও ফতেহ চৌধুরীর মতো দেশের ভেতরে ঢুকেছিলো জায়গা চিহ্নিত করতে। তখন পর্যন্ত কিন্তু মুক্তিবাহিনী অফেনসিভে যায়নি। আর্মির ভাষায় তারা আক্রমণ শুরু করেনি। এই আক্রমণটা তারা শুরু করেছে জুলাইয়ের দিক থেকে, এটা আমি দেখেছি। ঐ সময় বর্ষাটাও এসে গিয়েছিলো। তখন তাদের ট্রেনিংটাও মোটামুটি একটা পর্যায়ে পৌঁছেছে। জুলাই পরবর্তী আমরা যে আহতদেরকে পেয়েছি তারা বেশিরভাগই কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা কিংবা যারা সেনাবাহিনী থেকে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিয়েছে তারা। এখানে ছাত্র, সাধারণ কৃষক, শ্রমিক বা গ্রামবাসী, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছে তারা আসতো চিকিৎসার জন্য। যখন আমরা পুরোপুরি কাজ শুরু করেছি তখন মুক্তিযোদ্ধাদেরই আমরা বেশি পেয়েছি।

আর একটি কথা, এটা হয়তো এখানে প্রাসঙ্গিক হবে না, তবু বলতে চাই। সেটা হলো- এই এলাকা সেক্টর টু-এর অধীনে ছিলো। এই সেক্টরেই সবচেয়ে বড় গেরিলা বাহিনী ছিলো। এই গেরিলা বাহিনীতে যারা যোগ দিয়েছিলো তারা কিন্তু বিভিন্ন রাজনৈতিক পটভূমি থেকে এসেছিলো। কেউ ছাত্র লীগের ছিলো, কেউ ছাত্র ইউনিয়নের ছিলো। অনেকে আবার সরাসরি কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্য ছিলো না। কিন্তু উদ্বুদ্ধ হয়েই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলো। তাদের মধ্যে রাজনৈতিক ব্যাপারে বিরোধ থাকলেও একটা বিষয়ে খুবই সাযুজ্য ছিলো- প্রত্যেকেই মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপারে অসম্ভব রকমের আন্তরিক ছিলো। এ ব্যাপারে তাদের মধ্যে কোনো রকম অবিশ্বাস বা বিরোধিতা আমি দেখতে পাইনি। আরেকটা দল যারা ছিলো তারা রেগুলার আর্মির লোক। এরা একটা বিষয়ে নিজেদের মধ্যে কোনো সময় হয়তো হাসির ছলে, কখনো ঠাট্টার ছলে, আলোচনা করেছে যে, যুদ্ধটা কি রেগুলার আর্মিই করবে না গেরিলা বাহিনী করবে। কোন যুদ্ধটা বেশি ফলপ্রসূ তা নিয়ে ওখানে কথাবার্তা হতো। যারা সরাসরি সেনাবাহিনী থেকে এসেছিলো তাদের মধ্যে আবার অন্য রকম একটা ভাব ছিলো। তারা মনে করতো যুদ্ধটা তাদেরই ব্যাপার এবং সরাসরি যুদ্ধ ছাড়া পাকিস্তান বাহিনীকে পরাজিত করা যাবে না। অন্যদিকে যারা গেরিলা বাহিনীতে ছিলো তারা মনে করতো সরাসরি যুদ্ধ করে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মতোন একটা শক্তিশালী বাহিনীকে হয়তো পরাজিত করা যাবে না। ট্রেইন্ড আর্মির সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধ করে কখনোই পারা যাবে না। তাদেরকে নাস্তানাবুদ বা কাবু করতে হবে গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে। এইগুলি নিয়ে ওদের মধ্যে আলোচনা হতো, তর্ক হতো। কিন্তু এই দ্বন্দ্ব খুব প্রকট হয়ে দেখা দেয় নাই। আমরা অনেক সময় নিজেদের মধ্যেও এই ব্যাপারগুলো নিয়ে আলোচনা করতাম। এর পাশাপাশি খালেদ মোশাররফ, যিনি আমাদের সেক্টর কমান্ডার ছিলেন, তাঁর মধ্যে তখন একটা উদ্বেগ আমি অনেক সময় লক্ষ্য করেছি। তাঁর ভাবনায় যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর আমাদের মধ্যে যে ইউনিটিটা আছে সেই ইউনিটিটা পরবর্তীতে কতখানি বজায় থাকবে বা এই ইউনিটিটা শেষ পর্যন্ত কতখানি ধরে রাখা যাবে।

প্র: আপনি হাসপাতালে কি ধরনের কাজ করতেন?

উ: আমি হাসপাতালে বিভিন্ন পর্যায়ের কাজ করেছি। প্রথম তো হাসপাতাল ছিলো

সোনামুড়ায়। এরপর দারোগাবাগিচা বলে একটা জায়গায় সেই হাসপাতাল পুনঃস্থাপন করা হয়। সেখানে আমরা তাঁবু গেড়ে কাজ করতে শুরু করি। কারণ সোনামুড়াটা তখন বেশি পরিচিত হয়ে গিয়েছিলো পাকিস্তান আর্মির কাছে। তারা প্রায়ই সেখানে মর্টার শেলিং করতো এবং তার ফলে সেখানকার জনজীবন বিপর্যন্ত হচ্ছিলো। আমাদের হাসপাতালটাও পাক আর্মিদের লক্ষ্যবস্তু ছিলো। তার ফলে আমরা তখন দারোগাবাগিচায় কিছুদিনের জন্যে চলে যাই।

এদিকে তার আগে থেকেই বাংলাদেশ সরকারের অনুমোদনক্রমে ওখানে ষাট শয্যার একটা হাসপাতাল তৈরি করার স্কিম নেওয়া হয়েছিলো। পরবর্তীতে সেই হাসপাতালটি ওখানে স্থাপন করা হয়েছিলো। আগরতলা থেকে ষাট মাইল দূরে একটা জায়গায় হাবুল ব্যানার্জী বলে এক ভদ্রলোকের ফলের বাগান ছিলো। সেই বাগানটা উনি ঐ হাসপাতাল করার জন্য ছেড়ে দিয়েছিলেন। জায়গাটার নাম বিশ্রামগঞ্জ। আমরা পরে ঐ বিশ্রামগঞ্জে চলে যাই। সেখানেই ঘাট শয্যার হাসপাতালটা হয়। পরবর্তীতে ঐ হাসপাতালের শয্যা আরো বাড়ানো হয়। সেখানটায় আমরা কাজ শুরু করি জুলাইয়ের শেষ থেকে। আমাদের প্রায় পনেরো জনের একটা টিম হয়েছিলো। আসমা, রেশমা, জাকিয়া, নীলিমা, পদ্মা, তারপরে মিনু এরা সবাই এসে সেখানে যোগ দেয়। ওরা যোগ দিয়েছিলো একটা বিশেষ পরিপ্রেক্ষিতে। জাহানারা ইমামের ছেলে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা রুমির কথা অনেকেই জানে। এই রুমি এবং তাঁর দলবল যেমন আবুল বারক আলভী, সে এখন আর্ট কলেজের শিক্ষক, তারপর আলতাফ ভাই, কাজী কামাল, এরা কিন্তু পাক আর্মির হাতে ধরা পড়েছিলো অগাস্টের শেষের দিকে। মিনু, আসমা, রেশমা তারপর এদের সবচেয়ে ছোটবোন শাহনাজ, এরা কিন্তু এদের অস্ত্র এবং গুলিটুলি লুকিয়ে রাখতো। আলভীসহ কয়েকজন অস্ত্র এবং অ্যামুনেশন লুকিয়ে রাখতো আলতাফ ভাইয়ের বাড়িতে। পাক আর্মি কিভাবে খবর পেয়ে হঠাৎ ঐ বাড়িতে হামলা করে অস্ত্রগুলি উদ্ধার করে। আলভীকে বাঁচাতে যেয়ে আলতাফ ভাই ধরা পড়েন। ঐ অবস্থায় আলতাফ ভাই সম্পূর্ণ দায়িত্বটা নিজের কাঁধে নিয়েছিলেন। আলভী-আলতাফ ভাই ধরা পড়ার পর মিনু, আসমা, রেশমা ভারতে পালিয়ে এসে ঐ হাসপাতালে যোগ দেয়। এরা আসার পর আমরা ১৫ জনের একটা টিম হয়ে যাই। আমরা সবাই মিলে তখন কাজ করতে থাকি। নভেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত আমরা ঐ হাসপাতালের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম।

প্র: তখন কি ক্যাপ্টেন ডা. সিতারা বেগম ওখানে ছিলেন?

উ: হ্যাঁ, ক্যাপ্টেন ডা. সিতারা আমাদের হাসপাতালে এসে যোগ দেন সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে। তিনি আর্মির ডাক্তার ছিলেন। ঐ সময় আরো কিছু মেয়ে, যারা গোবরা ক্যাম্পে নার্সিং ট্রেনিং নিয়েছিলো, তারাও এসে তখন কিন্তু যোগ দেয়। এদিকে আমরা যারা প্রথমদিকে এই হাসপাতালটা তৈরির সঙ্গে যুক্ত ছিলাম তারা নভেম্বর পর্যন্ত ওখানে ছিলাম। নভেম্বরের মাঝামাঝি ওখান থেকে আমরা কলকাতায় চলে যাই। কলকাতায় গিয়ে মৈয়েত্রী দেবীসহ আরো ক’জনের সঙ্গে যোগাযোগ হয় আমাদের। কিন্তু সেই সময় ওখানে নতুন কোনো কাজ করার আর স্কোপ ছিলো না। ওখানে সবাই যার যার কাজ তখন করে যাচ্ছিলো। এদিকে তখন যুদ্ধও প্রায় শেষের দিকে চলে এসেছে। যুদ্ধের ব্যাপারটা নিয়েই তখন অনেক বেশি কথাবার্তা চলছে। এই অবস্থায় আমরা তখন কিছু বুদ্ধিজীবীর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে বাংলাদেশ সম্পর্কে জনমত গঠনের কাজই করেছি। এর বেশি আর কিছু কলকাতায় আমি করিনি।

প্র: আপনি কোন সময় ঢাকায় ফিরে আসলেন?

উ: আমি তো ঢাকায় ফিরে আসি জানুয়ারি মাসের চার তারিখে। আমরা কলকাতা থেকে জানুয়ারির দুই তারিখে রওনা হয়ে চার তারিখে ঢাকায় পৌঁছাই। আসার সময় আমরা তখন এমন কোনো ব্রিজ দেখি নাই যেটা ভাঙা না। বড় একটা ব্রিজও ছিলো না। নদী পার হতে গেলে নৌকা ডেকে আনতে হয়েছে। সব জায়গায় আবার নৌকার মাঝি পাওয়া যায়নি। পথে বাস পড়ে আছে কিন্তু বাসের চালক নেই। রাস্তাঘাট ভাঙা, ব্রিজ নেই, নদীর ঘাটে নৌকা নেই। তবু মানুষের মনে একটা স্বস্তির ভাব, যে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে।

যাহোক, দেশে ফিরে দেখি আমার মা অত্যন্ত মন খারাপ করে বসে আছেন। আমাদের পরিবারে একটা শোকের আবহাওয়া চলছে। কারণ আমার বড় ভগ্নিপতিকে মেরে ফেলা হয়েছে। কয়দিন পর বিশ্ববিদ্যালয়ে গেলাম। তখন আমরা বন্ধুবান্ধবরা কেউ কারো মুখের দিকে তাকাতে পারছি না। ঐ অবস্থার মধ্যে থেকেও সঙ্গে সঙ্গে আবার প্রতিজ্ঞাও নিলাম যে, দেশটার জন্যে যা কিছু করা যায় আমাকে সেটা করতেই হবে। আমার মাকে তখন নারী পুনর্বাসন বোর্ডের সভাপতি করা হয়েছিলো। আমি তখন মার

সঙ্গে থেকে কিছু কাজ করতে শুরু করলাম। সেই সূত্রে আমি তখন নারী পুনর্বাসন কেন্দ্রের উনিশ জন মেয়ের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। সেটা ছিলো রিহ্যাভিলিটেশন প্রোগ্রামে, তাদের কি অবস্থান হবে না হবে, কতদূর সাহায্য দিতে হবে না হবে ইত্যাদি বিষয়ে। কিছু ইন্টারভিউ নিতে হচ্ছিলো। এদের মধ্যে অন্তত সাত-আটজনকে আমি পেয়েছিলাম যারা পাকিস্তানি সেনাদের অত্যাচারে গর্ভবতী হয়ে পড়েছিলো। এরা পাক আর্মির বিভিন্ন ক্যাম্পে আটক ছিলো। এদের উপর প্রচণ্ড নির্যাতন করা হয়েছিলো।

তাদেরকে ধর্ষণ করা হয়েছিলো। শুধু ধর্ষণই না তাদেরকে আরো নানাভাবে অত্যাচার করা হয়েছিলো। কিছু কিছু মহিলাকে দেখেছি যে, তারা গর্ভবতী অবস্থাতেই সেখানে এসেছিলেন।

প্র: এ সব মহিলাদের সঙ্গে আপনার এখন যোগাযোগ আছে কি?

উ: না। যোগাযোগ খুব বেশিদিন আমি ব্যক্তিগতভাবে তাদের সাথে আর রাখতে পারি নাই। কারণ আমার পড়াশুনার তখনও একটা অংশ বাকি ছিলো। আমি তখন এম. এ. ক্লাশের ছাত্রী ছিলাম। কিছুদিন পর আমার পরীক্ষার তারিখ পড়ে গেলো। তখন আমি পড়াশুনা করতে ফিরে গিয়েছিলাম। কিন্তু আমি জানি যে, রিহ্যাভিলিটেশন প্রোগ্রামের মাধ্যমে এদের পরবর্তীতে কোথাও না কোথাও রিহ্যাভিলিটেড করা হয়েছে। যারা গর্ভবতী মহিলা ছিলেন তাদেরকে ক্লিনিক্যাল সার্ভিস দেওয়া হয়েছিলো। কয়েকজন আবার নিজেদের পরিবারেই ফিরে গেছেন। তাদের সঙ্গে আমার পরবর্তীতে আর যোগাযোগ রাখা সম্ভব হয়নি।

প্র: মুক্তিযুদ্ধের সময় আপনার পরিবারের কেউ শহীদ হয়েছেন কি?

উ: আমাদের পরিবারে সরাসরি কেউ শহীদ হননি। আমার বড় ভগ্নিপতি তখন চট্টগ্রামে কর্মরত ছিলেন। তিনি চট্টগ্রামে পাকিস্তান রেডিওর পরিচালক ছিলেন। ২৫ মার্চের পর আমার ভগ্নিপতি মুক্তিযোদ্ধাদেরকে বলে দিয়েছিলেন যে, তোমরা চাটগাঁ বেতার কেন্দ্রে কাজ করতে পারবে না। কারণ এখানে সিকিউরিটি অত্যন্ত বেশি। তোমরা বরং কালুরঘাটে চলে যাও। আমি জানি সেখানে তেমন সিকিউরিটি নাই। যাহোক, পরবর্তীতে কোনো একটা কারণে তাকে হত্যা করা হয়। মুক্তিবাহিনী দাবি করে যে, তারাই রেডিওর ডিরেক্টর হিসাবে তাকে হত্যা করেছে। কিন্তু আমরা খোঁজ-খবর নিয়ে জানতে পেরেছিলাম যে, আসলে ঘটনাটা সেরকম ছিলো না। ঘটনাক্রমে তার উপর আক্রমণ হয় এবং তাঁকে ভুল করেই তখন হত্যা করা হয়। আমাদের পরিবারের একমাত্র তিনিই মুক্তিযুদ্ধের সময় নিহত হয়েছিলেন।

 

নাম: সুলতানা কামাল, সাবেক উপদেষ্টা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও মানবাধিকার নেত্রী।

পিতা: কামালউদ্দীন আহমদ খান

মা: কবি সুফিয়া কামাল

গ্রাম/মহল্লা: বাড়ি ১৫ (সাঁঝের মায়া), সড়ক: ১১ (পুরাতন ৩২)

ধানমন্ডি আবাসিক এলাকা

ইউনিয়ন/পৌরসভা: ঢাকা সিটি করপোরেশন

থানা: ধানমন্ডি (মেট্রোপলিটন থানা), জেলা: ঢাকা

শিক্ষাগত যোগ্যতা: এম. এ.

১৯৭১ সালে বয়স: ২২

১৯৭১ সালে পেশা: ছাত্রী

 

সাক্ষাৎকার গ্রহণকারীর নাম: সাঈদা খানম

সাক্ষাৎকার গ্রহণের তারিখ: জানুয়ারি ০৬, ১৯৯৭