০৪:৫৫ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৮ জুন ২০২৫

জালালউদ্দিন রুমী: মানবপ্রেমী সুফি সাধক

  • Sarakhon Report
  • ০৮:০০:৫৬ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২১ ডিসেম্বর ২০২৪
  • 17

মোহাম্মদ মাহমুদুজ্জামান

১২০৭ সালে বর্তমান আফগানিস্তানের বালখ নগরে জন্মগ্রহণ করেন মওলানা জালালউদ্দিন মোহাম্মদ বালখি। যিনি পৃথিবী জুড়ে বেশি পরিচিত রুমী নামে। জন্মের ৮০০ বছর পেরিয়ে গেলেও রুমী নিয়ে গবেষণার শেষ নেই। একজন ফারসি কবি, ধর্মীয় পতি, সুফি সাধক হিসেবে রুমীর প্রভাব পর্যায়ক্রমে ইরান, তুরস্ক, তাজিকিস্তান, গ্রিস, আফগানিস্তান বা উপমহাদেশে ছড়াতে শুরু করলেও এখন তা পরিণত হয়েছে বিশ্বব্যাপী। পশ্চিমি বিশ্বে এখনো যে মুসলিম সুফিকে নিয়ে সবচেয়ে বেশি আগ্রহ তার নাম জালালউদ্দিন রুমী। তার লেখা বা তাকে নিয়ে লেখা বই বেস্ট সেলারের তালিকায় চলে আসে। রুমীর সবচেয়ে বড় রচনা হিসেবে মসনবী বিবেচিত হয়। তার ভক্তদের মাঝে প্রচলিত আছে যে, এই বইটি কোনো সাধারণ বই নয়। এটি আধ্যাত্মিক শক্তিরও উৎস। কেউ কোনো সমস্যা নিয়ে একান্ত মনে বইটির যে কোনো পাতা উল্টালে সেখানেই তার সমস্যার সমাধান পেয়ে যাবেন।

রুমী নামটি তার সঙ্গে যোগ হয়েছে রোম শব্দ থেকে। রুমীর আরবি অর্থ হচ্ছে রোমান। আনাতোলিয়ার সেলজুকদের রাজত্বে তিনি দীর্ঘ সময় কাটান। যারা পূর্ব রোমান সাম্রাজ্য দখল করেছিল। যদিও তার জীবনকালে রুমী নামে তাকে ডাকা হতো না! ইরান এবং তুরস্কে তিনি মওলানা নামেই পরিচিত ছিলেন। আবার কেউ কেউ তাকে মৌলভী নামে ডেকে থাকেন । জীবনের অনেকটা সময় তাকে অভিবাসী এবং রিফিউজি হিসেবে কাটাতে হয়েছে। তার জীবন কালে ২৫০০ কিলোমিটার এলাকার মধ্যে তার বিচরণ ছিল।

শুরুতে একজন ইসলামিক স্কলার হিসেবেই রুমী পরিচিত ছিলেন। আর দশজনের মতো তিনি তার শিষ্যদের ধর্মীয় শিক্ষা দিতেন। কিন্তু তার ৩৭ বছর বয়সে তিনি দেখা পান এক বিস্ময়কর চরিত্র শামস তাবরেজীর। এই প্রবীণ তার আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব দিয়ে রুমীর পুরো জীবনের মোড় বদলে দেন। তাদের সম্পর্ক বেশি দিন টেকে নি। মাত্র তিন বছরের মতো। কিন্তু এই সময়টি রুমীর পরবর্তী জীবনের তৈরি হওয়ার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র হিসেবে বিবেচিত হয়।

রুমীর অনুসারীগণ এক ধরনের সমবেত নৃত্যের মাধ্যমে মেডিটেশন করে থাকেন। এর মাধ্যমেই তারা ষ্টাকে খুঁজে পেতে চান। বলা হয়, একবার জালালউদ্দিন রুমী যখন বাজারের ভেতর দিয়ে যাচ্ছিলেন তখন এক স্বর্ণকার হাতুড়ি দিয়ে গলিত সোনায় আঘাত

করছিলেন আর বলছিলেন, লা ইলাহা ইল্লাললাহ। রুমীর কাছে মুহূর্তটি এতো বেশি অসাধারণ মনে হয় যে তিনি সেখানেই তার দুই হাত ছড়িয়ে দিয়ে ঘুরতে থাকেন এবং এষ্টার নাম নিতে থাকেন। এভাবেই তিনি এক ধরনের নাচের মধ্য দিয়েষ্টাকে অনুসন্ধানের পথ খুঁজে পান।

রুমীর কবিতায় মানব প্রেম এতো বেশি প্রকাশিত হয়েছে যে ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে মানুষ তার অনুসারী হয়েছেন। শুধু তার জীবিত থাকা অবস্থায় নয়, এখনো তিনি খুবই জনপ্রিয়। পণ্যদাসত্বে জর্জরিত মানুষ আত্মিক মুক্তির পথ খুঁজতে রুমীকে আশ্রয় করেন।

প্রখ্যাত মোটিভেশনাল লেখক দীপক চোপড়ার তত্ত্বাবধানে আমেরিকা থেকে রুমীর কবিতা নিয়ে ‘এ গিফট অফ লাভ’ নামে একটি অ্যালবাম প্রকাশিত হয়। এই অ্যালবামে অংশ নেন পপস্টার ম্যাডোনা এবং হলিউড অভিনেত্রী ডেমি মুর। আমেরিকান কম্পোজার ফিলিপ গ্লাস রুমীর কবিতা নিয়ে একটি চেম্বার অপেরা তৈরি করেন। রুমীর কবিতার রেকর্ড আমেরিকার বিলবোর্ডের সেরা ২০-এর তালিকায় চলে আসে।

১৭ ডিসেম্বর ১২৭৩ সালে রুমী মারা যান তুরস্কের কোনিয়ায়। ছয় খ-রে মসনবী লেখার পাশাপাশি তিনি তিন হাজারের বেশি গজল এবং দুই হাজারের বেশি রুবাইয়াত রচনা করে গিয়েছেন। মৃত্যুর প্রায় সাড়ে সাতশ বছর পরেও তিনি বেঁচে আছেন ‘পয়েট অফ লাভ’ বা ভালোবাসার কবি নামে।

লেখক পরিচিতি: সাংবাদিক ও গবেষক

জালালউদ্দিন রুমী: মানবপ্রেমী সুফি সাধক

০৮:০০:৫৬ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২১ ডিসেম্বর ২০২৪

মোহাম্মদ মাহমুদুজ্জামান

১২০৭ সালে বর্তমান আফগানিস্তানের বালখ নগরে জন্মগ্রহণ করেন মওলানা জালালউদ্দিন মোহাম্মদ বালখি। যিনি পৃথিবী জুড়ে বেশি পরিচিত রুমী নামে। জন্মের ৮০০ বছর পেরিয়ে গেলেও রুমী নিয়ে গবেষণার শেষ নেই। একজন ফারসি কবি, ধর্মীয় পতি, সুফি সাধক হিসেবে রুমীর প্রভাব পর্যায়ক্রমে ইরান, তুরস্ক, তাজিকিস্তান, গ্রিস, আফগানিস্তান বা উপমহাদেশে ছড়াতে শুরু করলেও এখন তা পরিণত হয়েছে বিশ্বব্যাপী। পশ্চিমি বিশ্বে এখনো যে মুসলিম সুফিকে নিয়ে সবচেয়ে বেশি আগ্রহ তার নাম জালালউদ্দিন রুমী। তার লেখা বা তাকে নিয়ে লেখা বই বেস্ট সেলারের তালিকায় চলে আসে। রুমীর সবচেয়ে বড় রচনা হিসেবে মসনবী বিবেচিত হয়। তার ভক্তদের মাঝে প্রচলিত আছে যে, এই বইটি কোনো সাধারণ বই নয়। এটি আধ্যাত্মিক শক্তিরও উৎস। কেউ কোনো সমস্যা নিয়ে একান্ত মনে বইটির যে কোনো পাতা উল্টালে সেখানেই তার সমস্যার সমাধান পেয়ে যাবেন।

রুমী নামটি তার সঙ্গে যোগ হয়েছে রোম শব্দ থেকে। রুমীর আরবি অর্থ হচ্ছে রোমান। আনাতোলিয়ার সেলজুকদের রাজত্বে তিনি দীর্ঘ সময় কাটান। যারা পূর্ব রোমান সাম্রাজ্য দখল করেছিল। যদিও তার জীবনকালে রুমী নামে তাকে ডাকা হতো না! ইরান এবং তুরস্কে তিনি মওলানা নামেই পরিচিত ছিলেন। আবার কেউ কেউ তাকে মৌলভী নামে ডেকে থাকেন । জীবনের অনেকটা সময় তাকে অভিবাসী এবং রিফিউজি হিসেবে কাটাতে হয়েছে। তার জীবন কালে ২৫০০ কিলোমিটার এলাকার মধ্যে তার বিচরণ ছিল।

শুরুতে একজন ইসলামিক স্কলার হিসেবেই রুমী পরিচিত ছিলেন। আর দশজনের মতো তিনি তার শিষ্যদের ধর্মীয় শিক্ষা দিতেন। কিন্তু তার ৩৭ বছর বয়সে তিনি দেখা পান এক বিস্ময়কর চরিত্র শামস তাবরেজীর। এই প্রবীণ তার আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব দিয়ে রুমীর পুরো জীবনের মোড় বদলে দেন। তাদের সম্পর্ক বেশি দিন টেকে নি। মাত্র তিন বছরের মতো। কিন্তু এই সময়টি রুমীর পরবর্তী জীবনের তৈরি হওয়ার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র হিসেবে বিবেচিত হয়।

রুমীর অনুসারীগণ এক ধরনের সমবেত নৃত্যের মাধ্যমে মেডিটেশন করে থাকেন। এর মাধ্যমেই তারা ষ্টাকে খুঁজে পেতে চান। বলা হয়, একবার জালালউদ্দিন রুমী যখন বাজারের ভেতর দিয়ে যাচ্ছিলেন তখন এক স্বর্ণকার হাতুড়ি দিয়ে গলিত সোনায় আঘাত

করছিলেন আর বলছিলেন, লা ইলাহা ইল্লাললাহ। রুমীর কাছে মুহূর্তটি এতো বেশি অসাধারণ মনে হয় যে তিনি সেখানেই তার দুই হাত ছড়িয়ে দিয়ে ঘুরতে থাকেন এবং এষ্টার নাম নিতে থাকেন। এভাবেই তিনি এক ধরনের নাচের মধ্য দিয়েষ্টাকে অনুসন্ধানের পথ খুঁজে পান।

রুমীর কবিতায় মানব প্রেম এতো বেশি প্রকাশিত হয়েছে যে ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে মানুষ তার অনুসারী হয়েছেন। শুধু তার জীবিত থাকা অবস্থায় নয়, এখনো তিনি খুবই জনপ্রিয়। পণ্যদাসত্বে জর্জরিত মানুষ আত্মিক মুক্তির পথ খুঁজতে রুমীকে আশ্রয় করেন।

প্রখ্যাত মোটিভেশনাল লেখক দীপক চোপড়ার তত্ত্বাবধানে আমেরিকা থেকে রুমীর কবিতা নিয়ে ‘এ গিফট অফ লাভ’ নামে একটি অ্যালবাম প্রকাশিত হয়। এই অ্যালবামে অংশ নেন পপস্টার ম্যাডোনা এবং হলিউড অভিনেত্রী ডেমি মুর। আমেরিকান কম্পোজার ফিলিপ গ্লাস রুমীর কবিতা নিয়ে একটি চেম্বার অপেরা তৈরি করেন। রুমীর কবিতার রেকর্ড আমেরিকার বিলবোর্ডের সেরা ২০-এর তালিকায় চলে আসে।

১৭ ডিসেম্বর ১২৭৩ সালে রুমী মারা যান তুরস্কের কোনিয়ায়। ছয় খ-রে মসনবী লেখার পাশাপাশি তিনি তিন হাজারের বেশি গজল এবং দুই হাজারের বেশি রুবাইয়াত রচনা করে গিয়েছেন। মৃত্যুর প্রায় সাড়ে সাতশ বছর পরেও তিনি বেঁচে আছেন ‘পয়েট অফ লাভ’ বা ভালোবাসার কবি নামে।

লেখক পরিচিতি: সাংবাদিক ও গবেষক