০৫:৪১ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৮ জুন ২০২৫
ইউক্রেন দাবি করেছে বাংলাদেশের কিছু সংস্থার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দিক ইইউ কলকাতার কলেজ ক্যাম্পাসে ছাত্রীকে গণধর্ষণ, গ্রেফতার তিন ‘চুরির গম’ আমদানি: বাংলাদেশের ওপর ইইউ নিষেধাজ্ঞা চায় ইউক্রেন চীনের বৃহত্তম গভীর সমুদ্র গ্যাসক্ষেত্রের দ্বিতীয় পর্যায়ের উৎপাদন শুরু কেমন ছিলো শুক্রবারের কাঁচাবাজারের আবহাওয়া মাইক্রোক্রেডিটের ভাঙা প্রতিশ্রুতি: কেন কিছু ঋণগ্রহীতা বলছেন “আর না” ধর্ম অবমাননার অভিযোগ ও পুলিশের প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকা আরাকান আর্মির সাথে ‘লড়াইয়ের প্রস্তুতির’ কথা বলছে রোহিঙ্গারা, সরেজমিন প্রতিবেদন ঢাকার খিলক্ষেতে পূজা মণ্ডপ ভাঙা ও উচ্ছেদ নিয়ে কী জানা যাচ্ছে? বঙ্গোপসাগর থেকে বাংলাদেশের নদী–নদীতে যেসব হাঙরের রাজত্ব

কিছু গ্রহের আংটি রয়েছে, কেন?

  • Sarakhon Report
  • ০৮:০০:৪৭ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪
  • 15

নাদিরা মজুমদার

বৃহস্পতি গ্রহ দিয়ে শুরু: সূর্য থেকে অ-নে-ক-টা দূরে রয়েছে সে। তার আংটি রয়েছে, বৃহস্পতি থেকে পর পর বাকি তিনটে গ্রহ: শনি, ইউরেনাস এবং নেপচুনেরও আংটি রয়েছে। এসব গ্রহের আংটিগুলো নানা রকমের কণিকা দিয়ে তৈরি হয়েছে, এবং সেগুলো যার যার তার তার গ্রহকে ঘিরে নিজস্ব কক্ষপথে পরিক্রমণ করছে। এসব কণিকা আবার নানা রকমের শিলা, বরফ ও ধূলিকণার হতে পারে, হয়ে থাকেও। কিন্তু, আংটির জন্ম হলো কিভাবে? মনে করা হয় যে মহাশূন্যীয় পরিবেশে গ্রহের উপরে ধূমকেতু, গ্রহাণু বা এমনকি নিজের চাঁদেরই ভেঙ্গে গুড়িয়ে ধ্বংসাবশেষ সৃষ্টির নজির রয়েছে, এবং সেইসব ধ্বংসাবশেষকে গ্রহের অভিকর্ষীয় ক্ষেত্র গ্রহের কাছে টেনে নিয়ে এসেছে। ধ্বংসাবশেষ থেকে সৃষ্ট কণিকারা গ্রহটিকে পরিক্রমণ করার সময় আংটির জন্ম দেয়, বা আংটির আকারে পরিক্রমণ করতে থাকে। আংটি বা রিংগুলোর সাইজ এবং দেখতে কেমন হবে বা চেহারাপত্র কেমন হবে তা নির্ভর করে কণিকাদের সাইজ ও তারা কি কি উপাদান দিয়ে তৈরি, সেগুলোর ভিত্তিতে এবং অবশ্যই সংশ্লিষ্ট গ্রহের নিজের কাছে টেনে আনার ক্ষমতার উপরে অর্থাৎ অভিকর্ষের তেজ কতোটুকু তার উপরে। কিছু কিছু গ্রহের, যেমন: আমাদের মনোচেতনায় শনি তার বিরাট সাইজের সহজে দৃষ্ট স্বতন্ত্র আংটি সিস্টেম নিয়ে ‘লর্ড অব দি রিংস’-য়ের আসনে অবস্থান করছে। অনেককাল ধরে আমাদের ধারণা ছিলো যে আমাদের সৌরজগতে কেবলমাত্র শনি’ই আংটি পড়ে আছে।

আরো তিন গ্রহেরও আংটি সিস্টেম রয়েছে কিন্তু। শক্তিশালী টেলিস্কোপ ব্যবহার করে মহাকাশবিজ্ঞানীরা দেখেন যে শনি ছাড়াও বৃহস্পতি, ইউরেনাস ও নেপচুনের আংটি সিস্টেম রয়েছে। সূর্য থেকে অ-নে-ক দূরে, প্রধানত গ্যাস দিয়ে সৃষ্ট প্রতিটি গ্রহই নিজস্ব আংটি সিস্টেমের গ্লেমার নিয়ে অবস্থান করছে।

যাহোক, আমাদের জন্য বাস্তবতা হলো যে আংটিগুলো কিভাবে কাজ করে অথবা তাদের জন্ম হলো কিভাবে আমরা কিন্তু জানি না, তবে কিছু বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব রয়েছে। যেমন, একটি তত্ত্ব বলছে যে সংশ্লিষ্ট গ্রহের যখন জন্ম হয়, সেই জন্মলগ্নের সময়ই আংটিগুলোরও জন্ম হয়। কিভাবে বা কেনো? গ্রহটি যে গ্যাস ও ধূলিকণা দিয়ে জন্ম নিয়েছে সেই উপাদানগুলোর কিছুটা পরিমাণ, গ্রহের কেন্দ্র থেকে দূ-রে, বেশ খানিকটা দূরে থেকে যাওয়াতে, সেগুলোকে যে একত্রে থুপিয়ে থাপিয়ে পিষে গ্রহের সঙ্গে জুড়ে দেবে সে তেজ অভিকর্ষের (গ্রহের) ছিলো না। ফলে, সেই উপাদানগুলো সেখানেই থেকে যায় ও ক্রমান্বয়ে আংটি সিস্টেম সৃষ্টি করে।

দ্বিতীয় তত্ত্ব অনুযায়ী: গ্রহটির যখন জন্ম হয় সেসময়ে দুটো চাঁদেরও জন্ম হয়েছিলো; গ্রহটিকে পরিক্রমণ করে কক্ষপথে চলার সময় সেই চাঁদ দুটোর চলার পথ বা কক্ষপথ কোনো না কোনো কারণে বাধাগ্রস্ত বা বিপদগ্রস্ত হয় এবং চাঁদ দুটো হুড়মুড় করে একে অন্যের উপরে ধ্বসে পড়ে। বি-শা-ল বিরাট মাপের এই ধ্বংসযজ্ঞের দরুণ দুই চাঁদ থেকে যে পরিমাণ ধ্বংসাবশেষের সৃষ্টি হয়েছিলো সেটির পক্ষে নতুন করে নতুন একটি চাঁদ সৃষ্টি করা সম্ভব ছিলো না। বরং সেই ধ্বংসাবশেষ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আংটি বা রিং সিস্টেম তৈরি করে, আমরা তাদের দেখছি।

এই দুই তত্ত্ব যা বলছে, তার উত্তর আমরা কিন্তু এখনো জানি না।

তবে বিভিন্ন তত্ত্বের তত্ত্বভিত্ত্বিক অনুসন্ধান ও পরীক্ষানিরীক্ষা চলছে; অব্যাহত রয়েছে। দিনকে দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে, আমরা জানি যে ভিন্ন ভিন্ন গ্রহকে ঘিরে যে আংটিগুলো রয়েছে তারা সবাই-ই একে অন্যের থেকে যৎকিঞ্চিত বিভিন্ন হয়ে তাকে, আবার অবশ্য বৈশিষ্ট্যগত সমমিলও রয়েছে। যেমন: স-ব, সব কয়টি আংটি তারা যতোটুকু না চওড়া, সেই তুলনায় বিস্ময়করভাবে অত্যন্ত কম পুরু বা মোটা হয়ে থাকে। শনির আংটিগুলোর কথাই ধরা যাক। গ্রহ থেকে তারা প্রায় দুইশো একাশি হাজার (২৮১,০০০) কিলোমিটার পর্যন্ত প্রসারিত, চওড়া প্রশস্ত অথচ মাত্র প্রায় দুইশো মিটার পুরু বা মোটা। অনেকটা যেনো প্রায় এরকম: সকালের নাস্তায় কুচি কুচি করে কাটা আলু ভাজা দিয়ে হাল্কা পাতলা আটা রুটি খাবেন, রান্না ঘরের চুলায় সেঁকে সেই রুটিটি যখন ভাত খাওয়ার বড়ো থালায় দেয়া হয়, দেখেন যে পুরো খালা জুড়ে হালকা পাতলা ফিনফিনে বিশাল রুটি বসে আছে।

তাছাড়াও, গ্রহগুলোর রিং বা আংটি সিস্টেমের মধ্যে আরেকটি মিল হলো যে তারা সবাই বরফ ও শিলার ছোট্ট ছোট্ট কণিকা দিয়ে গঠিত। এই কণিকাদের ক্ষুদ্রতম সাইজ হলো ধূলির সাইজের সমান, সর্বোচ্চ সাইজ হলো ব্যাসে প্রায় বিশ মিটার (অর্থাৎ স্কুলের বড়ো হলঘরের সমান)। আবার, গ্রহগুলোকে ঘিরে যে আংটিগুলো রয়েছে, সেইসব আংটিও নিজেদের মধ্যে ব্যবধান বা দূরত্ব বজায় রাখে, এবং এই দূরত্ব বা ব্যবধান কখনোবা অনেকগুলো কিলোমিটার হয়ে থাকে। কেনো হয়ে থাকে? প্রথম দিকে এটি একটা প্রহেলিকার মতো ছিলো। পরবর্তীতে আমরা জানতে পারি যে এই ব্যবধান সৃষ্টির জন্য দায়ী হলো ছোটো ছোটো চাঁদ’রা, তারা রিং বা আংটি সিস্টেমের বিশেষ অংশের সবটুকু বস্তু দ্রুত ‘খেয়ে ফেলে’ বলে সৃষ্টি হয় ব্যবধানের।

শনির আংটিগুলোর সঙ্গে বাকি গ্যাস-দানব গ্রহগুলোর আংটির প্রধান পার্থক্য হলো যে তার আংটিগুলো যে কণিকা দিয়ে সৃষ্টি হয়েছে তারা চমৎকারভাবে সূর্যালোককে প্রতিফলিত করে পৃথিবীর দিকে পাঠিয়ে দিচ্ছে। এর অর্থ, এমনকি স্রেফ সাদামাটা টেলিস্কোপে চোখ লাগিয়েও আমরা অত্যন্ত উজ্জ্বল আংটিগুলো দেখতে পাই। তাছাড়াও, অ-ধি-ক, অধিকতর সংখ্যক কণিকা শনির আংটির ফাঁদে আটকা পড়ায় তারা দেখতে যেমন বিশালতর তেমনি তারা চওড়া প্রশস্ততর, তাই শনির আংটিগুলো যতো সহজে নজরে পড়ে বাকি তিন গ্যাস-দানবের আংটিগুলো পড়ে না।

তাই সৌরমণ্ডলের যেসব গ্রহ আমাদের প্রিয় ডালিং গ্রহের মর্যাদা পেয়েছে, সেই তালিকায় শনিও রয়েছে। শনির রহস্যাবৃত আংটিগুলো তার জনপ্রিয় হওয়ার অন্যতম একটি কারণ। জনমানবহীন মহাকাশে দীপ্তি ও উজ্জ্বলতা নিয়ে শনির আংটিগুলো ভেসে রয়েছে, কেমন যেন বিস্ময়ের উদ্রেক করে। এইসব আংটি শনির কেমন করে হলো, আর সেগুলো সেখানে বহাল তবিয়তে রয়েছে কেনো?

আমাদের সৌরজগতে, সূর্য থেকে শনি ছয় নম্বর স্থানে অবস্থান করছে (আমাদের পৃথিবী তৃতীয় স্থানে রয়েছে)। শনির জাঁকজমকপূর্ণ আংটির মালা রয়েছে যা আমাদেরকে মোহিত করে রেখেছে, তবে সূর্য থেকে দূরে অবস্থিত বাকি গ্রহগুলোরও আংটি সিস্টেম রয়েছে। বৃহস্পতি (সূর্য থেকে পাঁচ নম্বরে রয়েছে), ইউরেনাস ও নেপচুন (সূর্য থেকে যথাক্রমে সাত ও আট নম্বরে রয়েছে), এদেরকে ঘিরে যেসব আংটির মালা রয়েছে সেগুলোকে দেখতে চাইলে অত্যন্ত শক্তিশালী, তাই অত্যন্ত দামী টেলিস্কোপের দরকার হয়। সাধারণ মানুষের কাছে তারা তাই অজানা অপরিচিত থেকে গেছে। তবে সত্যি যে মহাশূন্যে, প্রায় দুইশো একাশি হাজার কিলোমিটার জায়গা নিয়ে শনি সৌরজগতের বৃহত্তম ও মহাসমারোহপূর্ণ জমকালো আংটি মালার মেলা বানিয়ে রেখেছে। এই আংটি মালার মেলা যে কতো বিশাল বড়ো তার কিছুটা আন্দাজ দিচ্ছি; যেমন: পৃথিবী ও চাঁদের মধ্যে যে দূরত্ব সেই দূরত্বের প্রায় দুই তৃতীয়াংশ পরিমাণ জায়গা জুড়ে শনির আংটি সিস্টেম অবস্থান করছে, (পৃথিবী-চাঁদের দূরত্ব ৩৮৪, ৪০০ কিলোমিটার)। অবশ্য আংটিগুলো প্রশস্ত চওড়া হলে কি হবে খুবই হালকা পাতলা, প্রায় দশ মিটার থেকে সর্বোচ্চ প্রায় বিরানব্বই, বা তিরানব্বই বা পঁচানব্বই মিটার মোটা, পুরু। (ভাত খাওয়ার বড়ো থালাতে হাতে বানানো সেঁকা পাতলা আটাকুটির মতো)।

১০.১০.২০১৩ তারিখে শনি ও তার আংটিগুলোকে দেখে ক্যাসিনির ভালো লাগে, ঝটপট ইমেজ তুলে নেয়; সৌজন্যে: নাসা, জেপিএল-ক্যালটেক, স্পেস সায়েন্স ইনস্টিটিউট

শনির আংটি সম্বন্ধে আমাদের প্রথম বাস্তব জ্ঞান বা নলেজ হয় যে আংটিগুলো মোটেই কঠিণ নয়; আর হয় বা কি করে? তারা সবাই নানা সাইজের বরফকুচি ও শিলা দিয়ে গঠিত; ফিনফিনে মিহি বালুর সাইজের থেকে বড়ো বাড়ির সাইজের উপাদানে তৈরি তারা। সূর্যোদয়ের প্রায় আশি মিনিট বাদে যখন সূর্যরশ্মি নানা সাইজের বরফের উপরে গিয়ে পড়ে তা প্রতিফলিত হয়। ফলে, শিখাহীন সমারোহপূর্ণ উজ্জ্বলতায় আংটিগুলো ঝলমলিয়ে দেখা দেয়। ক্যাসিনি নভোযান যখন আমাদেরকে আংটিগুলোর আরো কাছে, নিকটে নিয়ে যায়, দেখি যে শনি’কে ঘিরে আংটিগুলো বি-শা-ল বেগে লাটিমের মতো বনবন করে ঘুরছে এবং অজস্র ছোটো ছোটো আংটি মিলে মিশে বড়ো বড়ো আংটি তৈরি করেছে। (ছোটো ছোটো আংটিকে ‘রিংলেট’ বলা হয়)।

কবে কখন প্রথমবারের মতো আদি আংটির জন্ম হয়েছিলো, কেউ কিন্তু নিশ্চিতভাবে জানে না। শনির কক্ষপথে অনেকগুলো চাঁদ রয়েছে, অন্তত একশো ছেচল্লিশটি তো হবেই (অন্য আর কোনো গ্রহের এতোগুলো চাঁদ নেই)। কারো কারো মতে, হতে পারে যে শনির একটি চাঁদ হুড়মুড় করে বিধ্বস্ত হয়ে আরেকটি চাঁদের উপরে গিয়ে পড়ে এবং ছোটো ছোটো টুকরোয় ভেঙ্গে যায়। আরেকটি আইডিয়া হলো যে শনিকে ঘিরে তো অসংখ্য অগুনতি গ্রহাণু পরিক্রমণ করছে, এবং কোনো কারণবশতঃ এসব গ্রহাণুর কয়েকটি নিজেদের মধ্যে বিধ্বস্ত হতে পারে এবং, কালক্রমে সেই ধ্বংসাবশেষ আংটির রূপ নিতে পারে। শনির অভিকর্ষ হয়ত বা ধ্বংসাবশেষে সৃষ্ট কিছু টুকরো নিজের কাছাকাছি রেখে দিতে পারে এবং, সময়মতো টুকরোগুলো এক সঙ্গে গুচ্ছ বা ঝাঁক বাঁধতে শুরু করে এবং ক্রমে ক্রমে তারা আংটিতে রূপান্তরিত হয়।

আরেকটি আবিষ্কার ছিলো যে আংটিগুলোর নিজেদের মধ্যে ফাঁকা খালি জায়গা বা ‘গ্যাপ’ রয়েছে। বিজ্ঞানীদের বিস্মিত প্রশ্ন হলো যে শনির অভিকর্ষ কেনো আংটিগুলোকে নিজের দিকে টেনে টেনে নিয়ে আসেনি, আনছে না? তাই তখন প্রশ্ন ওঠে আংটিগুলোর বয়স কতো হতে পারে? তারা কি স্বয়ং গ্রহেরই বয়সী, নাকি তুলনামূলকভাবে তারা নবীন, ব্র্যান্ড নিউ অস্তিত্ব? আচ্ছা, শনির ‘ঈ-রিং বা আংটি’র (E-ring) বি-শা-ল বিকীর্ণ জায়গা নিয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে অবস্থান নেয়ার বিষয়টি বিজ্ঞানীদের বিমূঢ় হতবুদ্ধ করে রাখে। অস্পষ্ট খর্বাকার চেহারার আংটিগুলো গুচ্ছাকারে কুণ্ডলীর মতো শনি’র চারদিকে দিব্যি পরিক্রমণ করে চলেছে। (‘ঈ-রিং বা আংটি’র সত্যিকারের পরিসর জানলে বাস্তবিকই আমাদেরকে বিস্ময়ে অভিভূত হতে হয়, স্তম্ভিত হতে হয়। শনির বিষুব রেখার, প্রায় একশোবিশ হাজার (১২০,০০০) কিলোমিটার থেকে প্রায় চারশোবিশ হাজার (৪২০,০০০) কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত জায়গা জুড়ে ‘ঈ-রিং’ প্রসারিত। অর্থাৎ, তিনটি থেকে অন্তত আটটি শনি গ্রহের ব্যাসার্ধের যে পরিমাণ ঈ-আংটি’র পরিসর তার সমান। আমরা যদি ঈ-আংটি’র বাইরের দিককার আংটি-গুচ্ছ থেকে তার ভেতরের সীমানা পর্যন্ত হাইওয়ে নির্মাণ করি, এবং এই হাইওয়েতে নন-স্টপ ঘন্টাপ্রতি একশোএকষট্টি (১৬১) কিলোমিটার বেগে গাড়ি চালিয়ে হাইওয়ের আরেক মাথায় পৌঁছাতে চাই, কতোটা সময় লাগবে, জানেন? প্রায় আড়াই মাস লেগে যাবে।)।

শনির আংটি সংক্রান্ত বিমূঢ় অবস্থার অবসান ঘটায় ‘ক্যাসিনি’ (Cassini)। ক্যাসিনি কে? ক্যাসিনি একটি জটিল সফিসটিকেটেড, রবোটিক নভোযান। ১৯৯৭ সালের অক্টোবর মাসের পনেরো তারিখে ক্যাসিনিকে পাঠানো হয় শনি গ্রহকে আপাদ-মন্ত্রক পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষানিরীক্ষা করার জন্য। ক্যাসিনি’র এই ‘অ্যাডভেঞ্চার’টি ছিলো দীর্ঘমেয়াদী, তাই তার তিন স্পনসর নাসা, এসা (ইউরোপীয়ান স্পেস এজেন্সি) ও এএসআই (ইটালিয়ান স্পেস এজেন্সি) বারোটি বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি, এবং যন্ত্রপাতি ও নভোযানকে সচল রাখতে দরকারি শক্তি বা পাওয়ার সরবরাহের জন্য দিয়ে দেয় বত্রিশ দশমিক সাত (৩২.৭) কিলোগ্রাম প্লুটোনিয়াম। উৎক্ষেপণকালে, মালপত্র ও জ্বালানিসমেত ক্যাসিনির ওজন ছিলো প্রায় পাঁচ হাজার ছয়শো (৫,৬০০) কিলোগ্রাম।

শব্দহীন দীর্ঘ মহাকাশীয় পথ অতিক্রম করে ক্যাসিনি অবশেষে ২০০৪ সালে শনি গ্রহে এসে হাজির হয়; এবং ২০১৭ সাল পর্যন্ত অবস্থান করে। এক দশকেরও অধিক কাল অবস্থানকালে ক্যাসিনি দুইশো চুয়ান্নবার (২৫৪) গ্রহটির চারদিকে পরিক্রমণ করে এবং আমাদেরকে আংটি সজ্জিত গ্রহ সম্বন্ধে শিক্ষিত করে। যেমন: ক্যাসিনির যন্ত্রপাতিগুলোর সাহায্যে শনির বায়ুমণ্ডল ও আংটিগুলোর কাঠামো, নির্মিতি ইত্যাদি মাপজোক করা হয়, এবং একই সময়ে শনির গ্রহগুলোর সঙ্গে তারা কিভাবে মিথস্ক্রিয়ায় লিপ্ত হয়, নির্ধারণ করা হয়। তাছাড়াও, ছয় ছয়টি চাঁদ আবিষ্কার হয় যেগুলোর প্রতিটির নাম রয়েছে, এবং ‘এনসেলাডাস’ ও ‘টাইটান’ চাঁদদুটোতে প্রাণের অস্তিত্ব থাকার সম্ভাবনার কথা জানায়। সাদামাটা ভাষায়, ক্যাসিনির মাধ্যমে আমরা শনি গ্রহ এবং তার আংটি ও চাঁদের জটিল সিস্টেমের অভূতপূর্ব পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা পাই। (দ্রষ্টব্য: ‘শনি: লর্ড অব দি রিংস’, জুন, ২০২৪, অন-লাইন জার্নাল ‘সারাক্ষণ’)।

শনির আংটিগুলোর মাঝখানে সৃষ্ট ফাঁকা জায়গায় ‘ক্যাসিনি নভোযান’; সৌজন্যে:নাসা, এসা

ক্যাসিনিকে ধন্যবাদ দিতে হয় যে সে ঈ-আংটির কাছাকাছি গিয়েছিলো। শনির এই ঈ-আংটির ঘণতম এলাকায়, চওড়ায় প্রায় পাঁচশো (৫০০) কিলোমিটার ‘এনসেলাডাস’ (Enceladus) নামক চাঁদটি শনিকে পরিক্রমণ করে চলেছে। বিশাল বিশাল ফাটলসহ (টাইগার স্ট্রাইপস) ‘এনসেলাডাস’-য়ের পৃষ্ঠদেশ অতিশয় শীতল, কিন্তু এই শীতল আবরণের নিচেয় রয়েছে নোনাজলের মহাসাগর। বিস্ময়কর যে চাঁদটির দক্ষিণ মেরু অঞ্চল তারুন্যপূর্ণ, প্রায় ফাটলমুক্ত ও অতিময় সক্রিয়, এবং এই অঞ্চলে চাঁদের ভেতর থেকে গমকে গমকে বিপুল পরিমাণ উত্তপ্ত জলীয়বাষ্পের গেইজার বেরিয়ে আসছে, চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ছে। সঙ্গে চাঁদের ভেতরকার কণিকারাও। আপাতত সমাধান হিসেবে সৃষ্টি করেছে অস্পষ্ট ঈ-আংটির চমৎকার দৃশ্যের। কারণ, এভাবে নির্গত জলীয়বাষ্প ও কণিকাদের আটকে ধরে রাখার জন্য যতোটুকু অভিকর্ষের দরকার, ছোট্ট ‘এনসেলাডাস’-য়ের নেই। তাই, আংটির কণিকারা বিরামহীনভাবে বার বার একত্রিত হচ্ছে এবং আবার ভেঙ্গে যাচ্ছে, মুহূর্তের মধ্যে ভাঙ্গা-গড়া চলছে, যাকে রিসাইক্লিং প্রক্রিয়া বলা চলে, বলেই ঈ-আংটির আংটিগুলোকে দেখতে ব্র্যান্ড-নিউ, ঝকঝকে তকতকে তরুণ বরফে ঢাকা বলে মনে হয়।

শনি’র যেসব চাঁদ আমাদেরকে সবচেয়ে অধিক মুগ্ধ করে ‘এনসেলাডাস’ হলো সেগুলোর একটি। তার বড়ো গোপনীয়তা হলো যে অতিশয় শীতল আবরণের নীচে লুকিয়ে থাকা মহাসাগরের যে নোনাজল গেইজার হয়ে বেরিয়ে আসছে তা দিয়ে সে শনি গ্রহের বাইরের দিকের একটি আংটি মালার সৃষ্টি করেছে। অন্য অনেক চাঁদই কিন্তু ‘এনসেলাডাস’-য়ের মতো নিজস্ব গ্রহীয় আংটি সৃষ্টির বড়াই করতে পারে না।

যাহোক, বিজ্ঞানীদের প্রশ্ন ছিলো, শনির আংটির বয়স কতো? একটা সময়ে মনে করা হতো যে আংটিগুলোর বয়স একশো মিলিয়ন থেকে চারশো মিলিয়ন বছরের মধ্যে। কিন্তু ক্যাসিনি সনাক্ত করে যে আংটি-সিস্টেম যে হারে ক্রমে ক্রমে ধূলিকণা পুঞ্জীভূত করছে, তা করতে বিলিয়ন বিলিয়ন বছর লেগে যাওয়ার কথা। এর অর্থ, সৌরজগতের সূচনার সময়েই শনির আংটিগুলোরও আত্মপ্রকাশ ঘটে।

বলতে গেলে সভ্যতার প্রায় আদিকাল থেকেই শনির আংটির সঙ্গে মানুষ পরিচিত। তবে শনি ছাড়াও সৌরজগতের আরো তিনটি গ্রহ বৃহস্পতি, ইউরেনাস ও নেপচুনেরও আংটি রয়েছে; এদের প্রত্যেকের আংটিগুলো একের অপরের থেকে বিভিন্ন। যেমন: বৃহস্পতি গ্রহের আংটির জন্ম ইতিহাস ভিন্ন রকমের। নাসার ‘নিউ হরাইজন’ নভোযানটি ২০০৭ সালে বৃহস্পতিকে ‘ফ্লাই বাই’ করার সময় নির্ধারণ করে যে গ্রহটির চাঁদগুলোর সঙ্গে মাইক্রো-উল্কাপিণ্ডের সংঘর্ষের দরুণ যে বি-পু-ল পরিমাণ ধূলিকণার সৃষ্টি হয়, সেসব ধূলিকণা দিয়ে বৃহস্পতির আংটিগুলোর সৃষ্টি হয়েছে, এবং তাদের কাঠামো বা নির্মিতি গ্রহের ‘ম্যাগনেটোস্ফিয়ারের উপর নির্ভরশীল। এই আংটিগুলোও শনির ঈ-আংটির মতো, রিসাইক্লিং প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নিরত চলমান রয়েছে।

২২.৮.২০২২ তারিখে জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপের ক্যামেরায় বৃহস্পতির তড়িৎচুম্বকীয় উধ্যমেরু ও অংটিগুলো ধরা পড়ে, সৌজন্যে:ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ

ইউরেনাস ও নেপচুনকে (বরফ-দানব নামেও পরিচিত) ঘিরে থাকা আংটিগুলো সম্বন্ধে আমাদের উপলব্ধি এখনও প্রায় অস্পষ্ট, রহস্যময়। ইউরেনাসের আংটিগুলো প্রধানত বিরাট বিরাট শিলার খণ্ড দিয়ে সৃষ্টি হয়েছে; আবার এই দুই গ্রহেরই আংটিগুলো ধোঁয়ার কালির গুঁড়ার মতো গভীর গাঢ় রঙের বস্তু দিয়ে সৃষ্টি হয়েছে, এবং তাতে রয়েছে মিথেন ও অ্যামোনিয়া। গভীর গাঢ় রঙের হওয়াতে আংটিগুলো সূর্যের আলোকে প্রতিফলিত করতে খুব একটা পারদর্শী নয়, তাদেরকে তাই দেখতে পাওয়াও সহজ নয়।

জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপের ক্যামেরায় নেপচুনের  আংটিগুলো ধরা পড়ে, সৌজন্যে: ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ

অর্থাৎ, বৃহস্পতি, ইউরেনাস ও নেপচুনের আংটিগুলো দৃষ্টিগ্রাহ্য আলোতে (ভিজিবল লাইট) গাঢ় ও অস্পষ্ট, অস্বচ্ছ, কিন্তু অবলোহিত আলোতে (ইনফ্রারেড লাইট) তাদেরকে অ-নে-ক স্বচ্ছ স্পষ্ট দেখা যায়। জেমস ওয়েব নভোটেলিস্কোপের অবলোহিত আলোয় সজ্জিত ‘চোখ’ (ক্যামেরা) বৃহস্পতি, ইউরেনাস ও নেপচুনের আংটিগুলোর উপরে সতর্ক দৃষ্টি রেখেছে। ওয়েব টেলিস্কোপের কাজ হলো: আংটিগুলো ঘণনিবিড় নাকি সুক্ষরগ্ধযুক্ত নির্ধারণ করা, তাদের রাসায়নিক উপাদানগুলো জানা, ‘স্পেকট্রোস্কোপি’র সাহায্যে আংটির বরফের বয়স হিসাব করা ইত্যাদি ইত্যাদি। এভাবে, ওয়েব টেলিস্কোপের মাধ্যমে তথ্যগুলো পাওয়ার পরে বিজ্ঞানীরা সহজেই বলতে পারবেন আংটির জন্ম হয়েছে গ্রহীয় চাঁদের ধ্বংস হওয়া ধ্বংসাবশেষ থেকে, নাকি গ্রহের অভিকর্ষ ‘কাইপার কেন্ট’ থেকে কোনো বস্তুকে প্রথমে টেনে নিয়ে আসে, তারপরে সেই বস্তু দুমড়েমুচড়ে ভেঙ্গে যায় এবং আংটি হয়ে আবির্ভূত হয়। অবশেষে, যখন এসব তথ্য অর্জন সম্পন্ন হবে সৌরজগতের ক্রমবিবর্তন সংশ্লিষ্ট আমাদের উপলব্ধি ও জ্ঞানের অপূর্ণ ফাঁকা জায়গাটি পূরণ হবে।

লেখক: অনন্যা ও বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কারপ্রাপ্ত সিনিয়র সাংবাদিক

ইউক্রেন দাবি করেছে বাংলাদেশের কিছু সংস্থার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দিক ইইউ

কিছু গ্রহের আংটি রয়েছে, কেন?

০৮:০০:৪৭ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪

নাদিরা মজুমদার

বৃহস্পতি গ্রহ দিয়ে শুরু: সূর্য থেকে অ-নে-ক-টা দূরে রয়েছে সে। তার আংটি রয়েছে, বৃহস্পতি থেকে পর পর বাকি তিনটে গ্রহ: শনি, ইউরেনাস এবং নেপচুনেরও আংটি রয়েছে। এসব গ্রহের আংটিগুলো নানা রকমের কণিকা দিয়ে তৈরি হয়েছে, এবং সেগুলো যার যার তার তার গ্রহকে ঘিরে নিজস্ব কক্ষপথে পরিক্রমণ করছে। এসব কণিকা আবার নানা রকমের শিলা, বরফ ও ধূলিকণার হতে পারে, হয়ে থাকেও। কিন্তু, আংটির জন্ম হলো কিভাবে? মনে করা হয় যে মহাশূন্যীয় পরিবেশে গ্রহের উপরে ধূমকেতু, গ্রহাণু বা এমনকি নিজের চাঁদেরই ভেঙ্গে গুড়িয়ে ধ্বংসাবশেষ সৃষ্টির নজির রয়েছে, এবং সেইসব ধ্বংসাবশেষকে গ্রহের অভিকর্ষীয় ক্ষেত্র গ্রহের কাছে টেনে নিয়ে এসেছে। ধ্বংসাবশেষ থেকে সৃষ্ট কণিকারা গ্রহটিকে পরিক্রমণ করার সময় আংটির জন্ম দেয়, বা আংটির আকারে পরিক্রমণ করতে থাকে। আংটি বা রিংগুলোর সাইজ এবং দেখতে কেমন হবে বা চেহারাপত্র কেমন হবে তা নির্ভর করে কণিকাদের সাইজ ও তারা কি কি উপাদান দিয়ে তৈরি, সেগুলোর ভিত্তিতে এবং অবশ্যই সংশ্লিষ্ট গ্রহের নিজের কাছে টেনে আনার ক্ষমতার উপরে অর্থাৎ অভিকর্ষের তেজ কতোটুকু তার উপরে। কিছু কিছু গ্রহের, যেমন: আমাদের মনোচেতনায় শনি তার বিরাট সাইজের সহজে দৃষ্ট স্বতন্ত্র আংটি সিস্টেম নিয়ে ‘লর্ড অব দি রিংস’-য়ের আসনে অবস্থান করছে। অনেককাল ধরে আমাদের ধারণা ছিলো যে আমাদের সৌরজগতে কেবলমাত্র শনি’ই আংটি পড়ে আছে।

আরো তিন গ্রহেরও আংটি সিস্টেম রয়েছে কিন্তু। শক্তিশালী টেলিস্কোপ ব্যবহার করে মহাকাশবিজ্ঞানীরা দেখেন যে শনি ছাড়াও বৃহস্পতি, ইউরেনাস ও নেপচুনের আংটি সিস্টেম রয়েছে। সূর্য থেকে অ-নে-ক দূরে, প্রধানত গ্যাস দিয়ে সৃষ্ট প্রতিটি গ্রহই নিজস্ব আংটি সিস্টেমের গ্লেমার নিয়ে অবস্থান করছে।

যাহোক, আমাদের জন্য বাস্তবতা হলো যে আংটিগুলো কিভাবে কাজ করে অথবা তাদের জন্ম হলো কিভাবে আমরা কিন্তু জানি না, তবে কিছু বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব রয়েছে। যেমন, একটি তত্ত্ব বলছে যে সংশ্লিষ্ট গ্রহের যখন জন্ম হয়, সেই জন্মলগ্নের সময়ই আংটিগুলোরও জন্ম হয়। কিভাবে বা কেনো? গ্রহটি যে গ্যাস ও ধূলিকণা দিয়ে জন্ম নিয়েছে সেই উপাদানগুলোর কিছুটা পরিমাণ, গ্রহের কেন্দ্র থেকে দূ-রে, বেশ খানিকটা দূরে থেকে যাওয়াতে, সেগুলোকে যে একত্রে থুপিয়ে থাপিয়ে পিষে গ্রহের সঙ্গে জুড়ে দেবে সে তেজ অভিকর্ষের (গ্রহের) ছিলো না। ফলে, সেই উপাদানগুলো সেখানেই থেকে যায় ও ক্রমান্বয়ে আংটি সিস্টেম সৃষ্টি করে।

দ্বিতীয় তত্ত্ব অনুযায়ী: গ্রহটির যখন জন্ম হয় সেসময়ে দুটো চাঁদেরও জন্ম হয়েছিলো; গ্রহটিকে পরিক্রমণ করে কক্ষপথে চলার সময় সেই চাঁদ দুটোর চলার পথ বা কক্ষপথ কোনো না কোনো কারণে বাধাগ্রস্ত বা বিপদগ্রস্ত হয় এবং চাঁদ দুটো হুড়মুড় করে একে অন্যের উপরে ধ্বসে পড়ে। বি-শা-ল বিরাট মাপের এই ধ্বংসযজ্ঞের দরুণ দুই চাঁদ থেকে যে পরিমাণ ধ্বংসাবশেষের সৃষ্টি হয়েছিলো সেটির পক্ষে নতুন করে নতুন একটি চাঁদ সৃষ্টি করা সম্ভব ছিলো না। বরং সেই ধ্বংসাবশেষ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আংটি বা রিং সিস্টেম তৈরি করে, আমরা তাদের দেখছি।

এই দুই তত্ত্ব যা বলছে, তার উত্তর আমরা কিন্তু এখনো জানি না।

তবে বিভিন্ন তত্ত্বের তত্ত্বভিত্ত্বিক অনুসন্ধান ও পরীক্ষানিরীক্ষা চলছে; অব্যাহত রয়েছে। দিনকে দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে, আমরা জানি যে ভিন্ন ভিন্ন গ্রহকে ঘিরে যে আংটিগুলো রয়েছে তারা সবাই-ই একে অন্যের থেকে যৎকিঞ্চিত বিভিন্ন হয়ে তাকে, আবার অবশ্য বৈশিষ্ট্যগত সমমিলও রয়েছে। যেমন: স-ব, সব কয়টি আংটি তারা যতোটুকু না চওড়া, সেই তুলনায় বিস্ময়করভাবে অত্যন্ত কম পুরু বা মোটা হয়ে থাকে। শনির আংটিগুলোর কথাই ধরা যাক। গ্রহ থেকে তারা প্রায় দুইশো একাশি হাজার (২৮১,০০০) কিলোমিটার পর্যন্ত প্রসারিত, চওড়া প্রশস্ত অথচ মাত্র প্রায় দুইশো মিটার পুরু বা মোটা। অনেকটা যেনো প্রায় এরকম: সকালের নাস্তায় কুচি কুচি করে কাটা আলু ভাজা দিয়ে হাল্কা পাতলা আটা রুটি খাবেন, রান্না ঘরের চুলায় সেঁকে সেই রুটিটি যখন ভাত খাওয়ার বড়ো থালায় দেয়া হয়, দেখেন যে পুরো খালা জুড়ে হালকা পাতলা ফিনফিনে বিশাল রুটি বসে আছে।

তাছাড়াও, গ্রহগুলোর রিং বা আংটি সিস্টেমের মধ্যে আরেকটি মিল হলো যে তারা সবাই বরফ ও শিলার ছোট্ট ছোট্ট কণিকা দিয়ে গঠিত। এই কণিকাদের ক্ষুদ্রতম সাইজ হলো ধূলির সাইজের সমান, সর্বোচ্চ সাইজ হলো ব্যাসে প্রায় বিশ মিটার (অর্থাৎ স্কুলের বড়ো হলঘরের সমান)। আবার, গ্রহগুলোকে ঘিরে যে আংটিগুলো রয়েছে, সেইসব আংটিও নিজেদের মধ্যে ব্যবধান বা দূরত্ব বজায় রাখে, এবং এই দূরত্ব বা ব্যবধান কখনোবা অনেকগুলো কিলোমিটার হয়ে থাকে। কেনো হয়ে থাকে? প্রথম দিকে এটি একটা প্রহেলিকার মতো ছিলো। পরবর্তীতে আমরা জানতে পারি যে এই ব্যবধান সৃষ্টির জন্য দায়ী হলো ছোটো ছোটো চাঁদ’রা, তারা রিং বা আংটি সিস্টেমের বিশেষ অংশের সবটুকু বস্তু দ্রুত ‘খেয়ে ফেলে’ বলে সৃষ্টি হয় ব্যবধানের।

শনির আংটিগুলোর সঙ্গে বাকি গ্যাস-দানব গ্রহগুলোর আংটির প্রধান পার্থক্য হলো যে তার আংটিগুলো যে কণিকা দিয়ে সৃষ্টি হয়েছে তারা চমৎকারভাবে সূর্যালোককে প্রতিফলিত করে পৃথিবীর দিকে পাঠিয়ে দিচ্ছে। এর অর্থ, এমনকি স্রেফ সাদামাটা টেলিস্কোপে চোখ লাগিয়েও আমরা অত্যন্ত উজ্জ্বল আংটিগুলো দেখতে পাই। তাছাড়াও, অ-ধি-ক, অধিকতর সংখ্যক কণিকা শনির আংটির ফাঁদে আটকা পড়ায় তারা দেখতে যেমন বিশালতর তেমনি তারা চওড়া প্রশস্ততর, তাই শনির আংটিগুলো যতো সহজে নজরে পড়ে বাকি তিন গ্যাস-দানবের আংটিগুলো পড়ে না।

তাই সৌরমণ্ডলের যেসব গ্রহ আমাদের প্রিয় ডালিং গ্রহের মর্যাদা পেয়েছে, সেই তালিকায় শনিও রয়েছে। শনির রহস্যাবৃত আংটিগুলো তার জনপ্রিয় হওয়ার অন্যতম একটি কারণ। জনমানবহীন মহাকাশে দীপ্তি ও উজ্জ্বলতা নিয়ে শনির আংটিগুলো ভেসে রয়েছে, কেমন যেন বিস্ময়ের উদ্রেক করে। এইসব আংটি শনির কেমন করে হলো, আর সেগুলো সেখানে বহাল তবিয়তে রয়েছে কেনো?

আমাদের সৌরজগতে, সূর্য থেকে শনি ছয় নম্বর স্থানে অবস্থান করছে (আমাদের পৃথিবী তৃতীয় স্থানে রয়েছে)। শনির জাঁকজমকপূর্ণ আংটির মালা রয়েছে যা আমাদেরকে মোহিত করে রেখেছে, তবে সূর্য থেকে দূরে অবস্থিত বাকি গ্রহগুলোরও আংটি সিস্টেম রয়েছে। বৃহস্পতি (সূর্য থেকে পাঁচ নম্বরে রয়েছে), ইউরেনাস ও নেপচুন (সূর্য থেকে যথাক্রমে সাত ও আট নম্বরে রয়েছে), এদেরকে ঘিরে যেসব আংটির মালা রয়েছে সেগুলোকে দেখতে চাইলে অত্যন্ত শক্তিশালী, তাই অত্যন্ত দামী টেলিস্কোপের দরকার হয়। সাধারণ মানুষের কাছে তারা তাই অজানা অপরিচিত থেকে গেছে। তবে সত্যি যে মহাশূন্যে, প্রায় দুইশো একাশি হাজার কিলোমিটার জায়গা নিয়ে শনি সৌরজগতের বৃহত্তম ও মহাসমারোহপূর্ণ জমকালো আংটি মালার মেলা বানিয়ে রেখেছে। এই আংটি মালার মেলা যে কতো বিশাল বড়ো তার কিছুটা আন্দাজ দিচ্ছি; যেমন: পৃথিবী ও চাঁদের মধ্যে যে দূরত্ব সেই দূরত্বের প্রায় দুই তৃতীয়াংশ পরিমাণ জায়গা জুড়ে শনির আংটি সিস্টেম অবস্থান করছে, (পৃথিবী-চাঁদের দূরত্ব ৩৮৪, ৪০০ কিলোমিটার)। অবশ্য আংটিগুলো প্রশস্ত চওড়া হলে কি হবে খুবই হালকা পাতলা, প্রায় দশ মিটার থেকে সর্বোচ্চ প্রায় বিরানব্বই, বা তিরানব্বই বা পঁচানব্বই মিটার মোটা, পুরু। (ভাত খাওয়ার বড়ো থালাতে হাতে বানানো সেঁকা পাতলা আটাকুটির মতো)।

১০.১০.২০১৩ তারিখে শনি ও তার আংটিগুলোকে দেখে ক্যাসিনির ভালো লাগে, ঝটপট ইমেজ তুলে নেয়; সৌজন্যে: নাসা, জেপিএল-ক্যালটেক, স্পেস সায়েন্স ইনস্টিটিউট

শনির আংটি সম্বন্ধে আমাদের প্রথম বাস্তব জ্ঞান বা নলেজ হয় যে আংটিগুলো মোটেই কঠিণ নয়; আর হয় বা কি করে? তারা সবাই নানা সাইজের বরফকুচি ও শিলা দিয়ে গঠিত; ফিনফিনে মিহি বালুর সাইজের থেকে বড়ো বাড়ির সাইজের উপাদানে তৈরি তারা। সূর্যোদয়ের প্রায় আশি মিনিট বাদে যখন সূর্যরশ্মি নানা সাইজের বরফের উপরে গিয়ে পড়ে তা প্রতিফলিত হয়। ফলে, শিখাহীন সমারোহপূর্ণ উজ্জ্বলতায় আংটিগুলো ঝলমলিয়ে দেখা দেয়। ক্যাসিনি নভোযান যখন আমাদেরকে আংটিগুলোর আরো কাছে, নিকটে নিয়ে যায়, দেখি যে শনি’কে ঘিরে আংটিগুলো বি-শা-ল বেগে লাটিমের মতো বনবন করে ঘুরছে এবং অজস্র ছোটো ছোটো আংটি মিলে মিশে বড়ো বড়ো আংটি তৈরি করেছে। (ছোটো ছোটো আংটিকে ‘রিংলেট’ বলা হয়)।

কবে কখন প্রথমবারের মতো আদি আংটির জন্ম হয়েছিলো, কেউ কিন্তু নিশ্চিতভাবে জানে না। শনির কক্ষপথে অনেকগুলো চাঁদ রয়েছে, অন্তত একশো ছেচল্লিশটি তো হবেই (অন্য আর কোনো গ্রহের এতোগুলো চাঁদ নেই)। কারো কারো মতে, হতে পারে যে শনির একটি চাঁদ হুড়মুড় করে বিধ্বস্ত হয়ে আরেকটি চাঁদের উপরে গিয়ে পড়ে এবং ছোটো ছোটো টুকরোয় ভেঙ্গে যায়। আরেকটি আইডিয়া হলো যে শনিকে ঘিরে তো অসংখ্য অগুনতি গ্রহাণু পরিক্রমণ করছে, এবং কোনো কারণবশতঃ এসব গ্রহাণুর কয়েকটি নিজেদের মধ্যে বিধ্বস্ত হতে পারে এবং, কালক্রমে সেই ধ্বংসাবশেষ আংটির রূপ নিতে পারে। শনির অভিকর্ষ হয়ত বা ধ্বংসাবশেষে সৃষ্ট কিছু টুকরো নিজের কাছাকাছি রেখে দিতে পারে এবং, সময়মতো টুকরোগুলো এক সঙ্গে গুচ্ছ বা ঝাঁক বাঁধতে শুরু করে এবং ক্রমে ক্রমে তারা আংটিতে রূপান্তরিত হয়।

আরেকটি আবিষ্কার ছিলো যে আংটিগুলোর নিজেদের মধ্যে ফাঁকা খালি জায়গা বা ‘গ্যাপ’ রয়েছে। বিজ্ঞানীদের বিস্মিত প্রশ্ন হলো যে শনির অভিকর্ষ কেনো আংটিগুলোকে নিজের দিকে টেনে টেনে নিয়ে আসেনি, আনছে না? তাই তখন প্রশ্ন ওঠে আংটিগুলোর বয়স কতো হতে পারে? তারা কি স্বয়ং গ্রহেরই বয়সী, নাকি তুলনামূলকভাবে তারা নবীন, ব্র্যান্ড নিউ অস্তিত্ব? আচ্ছা, শনির ‘ঈ-রিং বা আংটি’র (E-ring) বি-শা-ল বিকীর্ণ জায়গা নিয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে অবস্থান নেয়ার বিষয়টি বিজ্ঞানীদের বিমূঢ় হতবুদ্ধ করে রাখে। অস্পষ্ট খর্বাকার চেহারার আংটিগুলো গুচ্ছাকারে কুণ্ডলীর মতো শনি’র চারদিকে দিব্যি পরিক্রমণ করে চলেছে। (‘ঈ-রিং বা আংটি’র সত্যিকারের পরিসর জানলে বাস্তবিকই আমাদেরকে বিস্ময়ে অভিভূত হতে হয়, স্তম্ভিত হতে হয়। শনির বিষুব রেখার, প্রায় একশোবিশ হাজার (১২০,০০০) কিলোমিটার থেকে প্রায় চারশোবিশ হাজার (৪২০,০০০) কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত জায়গা জুড়ে ‘ঈ-রিং’ প্রসারিত। অর্থাৎ, তিনটি থেকে অন্তত আটটি শনি গ্রহের ব্যাসার্ধের যে পরিমাণ ঈ-আংটি’র পরিসর তার সমান। আমরা যদি ঈ-আংটি’র বাইরের দিককার আংটি-গুচ্ছ থেকে তার ভেতরের সীমানা পর্যন্ত হাইওয়ে নির্মাণ করি, এবং এই হাইওয়েতে নন-স্টপ ঘন্টাপ্রতি একশোএকষট্টি (১৬১) কিলোমিটার বেগে গাড়ি চালিয়ে হাইওয়ের আরেক মাথায় পৌঁছাতে চাই, কতোটা সময় লাগবে, জানেন? প্রায় আড়াই মাস লেগে যাবে।)।

শনির আংটি সংক্রান্ত বিমূঢ় অবস্থার অবসান ঘটায় ‘ক্যাসিনি’ (Cassini)। ক্যাসিনি কে? ক্যাসিনি একটি জটিল সফিসটিকেটেড, রবোটিক নভোযান। ১৯৯৭ সালের অক্টোবর মাসের পনেরো তারিখে ক্যাসিনিকে পাঠানো হয় শনি গ্রহকে আপাদ-মন্ত্রক পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষানিরীক্ষা করার জন্য। ক্যাসিনি’র এই ‘অ্যাডভেঞ্চার’টি ছিলো দীর্ঘমেয়াদী, তাই তার তিন স্পনসর নাসা, এসা (ইউরোপীয়ান স্পেস এজেন্সি) ও এএসআই (ইটালিয়ান স্পেস এজেন্সি) বারোটি বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি, এবং যন্ত্রপাতি ও নভোযানকে সচল রাখতে দরকারি শক্তি বা পাওয়ার সরবরাহের জন্য দিয়ে দেয় বত্রিশ দশমিক সাত (৩২.৭) কিলোগ্রাম প্লুটোনিয়াম। উৎক্ষেপণকালে, মালপত্র ও জ্বালানিসমেত ক্যাসিনির ওজন ছিলো প্রায় পাঁচ হাজার ছয়শো (৫,৬০০) কিলোগ্রাম।

শব্দহীন দীর্ঘ মহাকাশীয় পথ অতিক্রম করে ক্যাসিনি অবশেষে ২০০৪ সালে শনি গ্রহে এসে হাজির হয়; এবং ২০১৭ সাল পর্যন্ত অবস্থান করে। এক দশকেরও অধিক কাল অবস্থানকালে ক্যাসিনি দুইশো চুয়ান্নবার (২৫৪) গ্রহটির চারদিকে পরিক্রমণ করে এবং আমাদেরকে আংটি সজ্জিত গ্রহ সম্বন্ধে শিক্ষিত করে। যেমন: ক্যাসিনির যন্ত্রপাতিগুলোর সাহায্যে শনির বায়ুমণ্ডল ও আংটিগুলোর কাঠামো, নির্মিতি ইত্যাদি মাপজোক করা হয়, এবং একই সময়ে শনির গ্রহগুলোর সঙ্গে তারা কিভাবে মিথস্ক্রিয়ায় লিপ্ত হয়, নির্ধারণ করা হয়। তাছাড়াও, ছয় ছয়টি চাঁদ আবিষ্কার হয় যেগুলোর প্রতিটির নাম রয়েছে, এবং ‘এনসেলাডাস’ ও ‘টাইটান’ চাঁদদুটোতে প্রাণের অস্তিত্ব থাকার সম্ভাবনার কথা জানায়। সাদামাটা ভাষায়, ক্যাসিনির মাধ্যমে আমরা শনি গ্রহ এবং তার আংটি ও চাঁদের জটিল সিস্টেমের অভূতপূর্ব পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা পাই। (দ্রষ্টব্য: ‘শনি: লর্ড অব দি রিংস’, জুন, ২০২৪, অন-লাইন জার্নাল ‘সারাক্ষণ’)।

শনির আংটিগুলোর মাঝখানে সৃষ্ট ফাঁকা জায়গায় ‘ক্যাসিনি নভোযান’; সৌজন্যে:নাসা, এসা

ক্যাসিনিকে ধন্যবাদ দিতে হয় যে সে ঈ-আংটির কাছাকাছি গিয়েছিলো। শনির এই ঈ-আংটির ঘণতম এলাকায়, চওড়ায় প্রায় পাঁচশো (৫০০) কিলোমিটার ‘এনসেলাডাস’ (Enceladus) নামক চাঁদটি শনিকে পরিক্রমণ করে চলেছে। বিশাল বিশাল ফাটলসহ (টাইগার স্ট্রাইপস) ‘এনসেলাডাস’-য়ের পৃষ্ঠদেশ অতিশয় শীতল, কিন্তু এই শীতল আবরণের নিচেয় রয়েছে নোনাজলের মহাসাগর। বিস্ময়কর যে চাঁদটির দক্ষিণ মেরু অঞ্চল তারুন্যপূর্ণ, প্রায় ফাটলমুক্ত ও অতিময় সক্রিয়, এবং এই অঞ্চলে চাঁদের ভেতর থেকে গমকে গমকে বিপুল পরিমাণ উত্তপ্ত জলীয়বাষ্পের গেইজার বেরিয়ে আসছে, চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ছে। সঙ্গে চাঁদের ভেতরকার কণিকারাও। আপাতত সমাধান হিসেবে সৃষ্টি করেছে অস্পষ্ট ঈ-আংটির চমৎকার দৃশ্যের। কারণ, এভাবে নির্গত জলীয়বাষ্প ও কণিকাদের আটকে ধরে রাখার জন্য যতোটুকু অভিকর্ষের দরকার, ছোট্ট ‘এনসেলাডাস’-য়ের নেই। তাই, আংটির কণিকারা বিরামহীনভাবে বার বার একত্রিত হচ্ছে এবং আবার ভেঙ্গে যাচ্ছে, মুহূর্তের মধ্যে ভাঙ্গা-গড়া চলছে, যাকে রিসাইক্লিং প্রক্রিয়া বলা চলে, বলেই ঈ-আংটির আংটিগুলোকে দেখতে ব্র্যান্ড-নিউ, ঝকঝকে তকতকে তরুণ বরফে ঢাকা বলে মনে হয়।

শনি’র যেসব চাঁদ আমাদেরকে সবচেয়ে অধিক মুগ্ধ করে ‘এনসেলাডাস’ হলো সেগুলোর একটি। তার বড়ো গোপনীয়তা হলো যে অতিশয় শীতল আবরণের নীচে লুকিয়ে থাকা মহাসাগরের যে নোনাজল গেইজার হয়ে বেরিয়ে আসছে তা দিয়ে সে শনি গ্রহের বাইরের দিকের একটি আংটি মালার সৃষ্টি করেছে। অন্য অনেক চাঁদই কিন্তু ‘এনসেলাডাস’-য়ের মতো নিজস্ব গ্রহীয় আংটি সৃষ্টির বড়াই করতে পারে না।

যাহোক, বিজ্ঞানীদের প্রশ্ন ছিলো, শনির আংটির বয়স কতো? একটা সময়ে মনে করা হতো যে আংটিগুলোর বয়স একশো মিলিয়ন থেকে চারশো মিলিয়ন বছরের মধ্যে। কিন্তু ক্যাসিনি সনাক্ত করে যে আংটি-সিস্টেম যে হারে ক্রমে ক্রমে ধূলিকণা পুঞ্জীভূত করছে, তা করতে বিলিয়ন বিলিয়ন বছর লেগে যাওয়ার কথা। এর অর্থ, সৌরজগতের সূচনার সময়েই শনির আংটিগুলোরও আত্মপ্রকাশ ঘটে।

বলতে গেলে সভ্যতার প্রায় আদিকাল থেকেই শনির আংটির সঙ্গে মানুষ পরিচিত। তবে শনি ছাড়াও সৌরজগতের আরো তিনটি গ্রহ বৃহস্পতি, ইউরেনাস ও নেপচুনেরও আংটি রয়েছে; এদের প্রত্যেকের আংটিগুলো একের অপরের থেকে বিভিন্ন। যেমন: বৃহস্পতি গ্রহের আংটির জন্ম ইতিহাস ভিন্ন রকমের। নাসার ‘নিউ হরাইজন’ নভোযানটি ২০০৭ সালে বৃহস্পতিকে ‘ফ্লাই বাই’ করার সময় নির্ধারণ করে যে গ্রহটির চাঁদগুলোর সঙ্গে মাইক্রো-উল্কাপিণ্ডের সংঘর্ষের দরুণ যে বি-পু-ল পরিমাণ ধূলিকণার সৃষ্টি হয়, সেসব ধূলিকণা দিয়ে বৃহস্পতির আংটিগুলোর সৃষ্টি হয়েছে, এবং তাদের কাঠামো বা নির্মিতি গ্রহের ‘ম্যাগনেটোস্ফিয়ারের উপর নির্ভরশীল। এই আংটিগুলোও শনির ঈ-আংটির মতো, রিসাইক্লিং প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নিরত চলমান রয়েছে।

২২.৮.২০২২ তারিখে জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপের ক্যামেরায় বৃহস্পতির তড়িৎচুম্বকীয় উধ্যমেরু ও অংটিগুলো ধরা পড়ে, সৌজন্যে:ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ

ইউরেনাস ও নেপচুনকে (বরফ-দানব নামেও পরিচিত) ঘিরে থাকা আংটিগুলো সম্বন্ধে আমাদের উপলব্ধি এখনও প্রায় অস্পষ্ট, রহস্যময়। ইউরেনাসের আংটিগুলো প্রধানত বিরাট বিরাট শিলার খণ্ড দিয়ে সৃষ্টি হয়েছে; আবার এই দুই গ্রহেরই আংটিগুলো ধোঁয়ার কালির গুঁড়ার মতো গভীর গাঢ় রঙের বস্তু দিয়ে সৃষ্টি হয়েছে, এবং তাতে রয়েছে মিথেন ও অ্যামোনিয়া। গভীর গাঢ় রঙের হওয়াতে আংটিগুলো সূর্যের আলোকে প্রতিফলিত করতে খুব একটা পারদর্শী নয়, তাদেরকে তাই দেখতে পাওয়াও সহজ নয়।

জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপের ক্যামেরায় নেপচুনের  আংটিগুলো ধরা পড়ে, সৌজন্যে: ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ

অর্থাৎ, বৃহস্পতি, ইউরেনাস ও নেপচুনের আংটিগুলো দৃষ্টিগ্রাহ্য আলোতে (ভিজিবল লাইট) গাঢ় ও অস্পষ্ট, অস্বচ্ছ, কিন্তু অবলোহিত আলোতে (ইনফ্রারেড লাইট) তাদেরকে অ-নে-ক স্বচ্ছ স্পষ্ট দেখা যায়। জেমস ওয়েব নভোটেলিস্কোপের অবলোহিত আলোয় সজ্জিত ‘চোখ’ (ক্যামেরা) বৃহস্পতি, ইউরেনাস ও নেপচুনের আংটিগুলোর উপরে সতর্ক দৃষ্টি রেখেছে। ওয়েব টেলিস্কোপের কাজ হলো: আংটিগুলো ঘণনিবিড় নাকি সুক্ষরগ্ধযুক্ত নির্ধারণ করা, তাদের রাসায়নিক উপাদানগুলো জানা, ‘স্পেকট্রোস্কোপি’র সাহায্যে আংটির বরফের বয়স হিসাব করা ইত্যাদি ইত্যাদি। এভাবে, ওয়েব টেলিস্কোপের মাধ্যমে তথ্যগুলো পাওয়ার পরে বিজ্ঞানীরা সহজেই বলতে পারবেন আংটির জন্ম হয়েছে গ্রহীয় চাঁদের ধ্বংস হওয়া ধ্বংসাবশেষ থেকে, নাকি গ্রহের অভিকর্ষ ‘কাইপার কেন্ট’ থেকে কোনো বস্তুকে প্রথমে টেনে নিয়ে আসে, তারপরে সেই বস্তু দুমড়েমুচড়ে ভেঙ্গে যায় এবং আংটি হয়ে আবির্ভূত হয়। অবশেষে, যখন এসব তথ্য অর্জন সম্পন্ন হবে সৌরজগতের ক্রমবিবর্তন সংশ্লিষ্ট আমাদের উপলব্ধি ও জ্ঞানের অপূর্ণ ফাঁকা জায়গাটি পূরণ হবে।

লেখক: অনন্যা ও বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কারপ্রাপ্ত সিনিয়র সাংবাদিক