সারাক্ষণ রিপোর্ট
দেশের ব্যাংকিং খাত সংকটের মুখোমুখি,যা আর এই সংকটগুলোর মূল শিকড় অনেক গভীরে। সাধারণত এ ধরনের পরিস্থিতিগুলো সংক্রামক রোগের মতো,আর এই রোগের জীবানু দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার প্রভাব সেক্টরজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে পুরো ব্যবস্থাকে অস্থিতিশীল করার হুমকি সৃষ্টি করছে।এই ক্ষতির মূল কারণ হলো শাসন ব্যবস্থার ব্যর্থতা, যা পুরো সেক্টরের বিভিন্ন স্তরে স্পষ্টভাবে প্রকাশিত হচ্ছে।এই সংকটের কেন্দ্রে রয়েছে ব্যাংকিং ব্যবস্থার কাঠামোগত উপাদানের ব্যর্থতা। এই উপাদানগুলি, যেমন ঋণের ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা, একসময় সেক্টরকে স্থিতিশীল রাখার জন্য প্রয়োজনীয় সুরক্ষা সরবরাহ করত।
তবে এই মূল কাঠামোগুলির দুর্বলতা এখন ‘পদ্ধতিগত ঝুঁকি’ সৃষ্টি করেছে। এই ঝুঁকির সমাধান করা না হলে নিকট ভবিষ্যতে পুরো ব্যাংকিং খাতকে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে। যারা শাসন নীতিমালা উপেক্ষা করেছে এবং আর্থিকভাবে দুর্বল অবস্থায় ছিল, তারা এই সংকটের সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের জন্য আর্থিক ও কাঠামোগতভাবে ক্ষতির মাত্রা গুরুতর হয়েছে এবং এই ক্ষতি সারাতে যথেষ্ট সময় ও প্রচেষ্টা প্রয়োজন হবে।
এই খাতের দুর্বলতার অন্যতম বড় কারণ হলো অব্যবস্থাপিত ঋণের (এনপিএল) পরিমাণ। এই ঋণগুলোর মূল কারণ হলো নীতিমালা, কর্মী এবং প্রক্রিয়া—এই তিনটি মৌলিক উপাদানের ব্যর্থতা। নীতিমালা, যা ঋণ অনুমোদন ও আমানত গ্রহণের মতো কার্যক্রম পরিচালিত করার একটি মূল ভিত্তি হওয়া উচিত, তা দুর্নীতিগ্রস্ত হয়েছে। ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার নীতিগুলি, যা এই কার্যক্রম পরিচালিত করার নির্দেশ দেয়, সেগুলি উপেক্ষা করা হয়েছে।
অন্যদিকে, নীতিমালা পরিচালনার জন্য দায়ী ব্যক্তিরা—ব্যাংকের নেতৃত্ব এবং কর্মীরা—প্রায়ই প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের অভাব অনুভব করেছেন এবং ঝুঁকি কমানোর জন্য যে প্রক্রিয়াগুলো থাকা উচিত, সেগুলি দুর্বল বা অকার্যকর রাখা হয়েছে। এমনকি অনেকগুলো তাদের জানাও নেই।
দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, এবং রাজনৈতিক প্রভাব আরও এই শাসনব্যবস্থার ব্যর্থতাকে জটিল করেছে, যা পুরো ব্যবস্থাকে দুর্বল করে তুলেছে। এগুলো শুধুমাত্র একটি ভাঙা ব্যবস্থার উপসর্গ নয়; বরং এগুলিই পুরো ব্যবস্থার ভঙ্গুরতার মূল কারণ। এবং এর শুরুটাও হেয়েছে দীর্ঘ সময় ধরে। কখনই প্রকৃত ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।অর্থনীতি বড় হওয়া ও শিল্পায়নের ব্যাংকের গুরুত্ব বেড়ে যাওয়ায় আজ তা স্পষ্ট ভাবে মানুষ দেখতে পাচ্ছে।
অন্যদিকে যেসব ব্যাংক রাজনৈতিক প্রভাবের ভিত্তিতে লাইসেন্স পেয়েছে এবং আর্থিক নীতির পরিবর্তে রাজনৈতিক সংযোগের ভিত্তিতে ঋণ অনুমোদন করেছে, তারা এই সেক্টরের স্থিতিশীলতার ক্ষতি করেছে। মানবসম্পদ এবং ক্রয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলোও যথাঅনুশীলন অনুসরণ না করার ফলে সংকট আরো বেড়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক (বিবি), যা কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ, প্রভাবশালী ব্যবসায়ীদের সুবিধা দেওয়ার অভিযোগে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েছে। সেক্টরের বিশ্বাসযোগ্যতা এবং অখণ্ডতা পুনরুদ্ধার করতে, বিবিকে দৃঢ় এবং স্বচ্ছ পদক্ষেপ নিতে হবে। এর মধ্যে রয়েছে ব্যাংকগুলোর নেতৃত্বে থাকা ব্যর্থ ব্যক্তিদের অপসারণ এবং একটি শক্তিশালী নিয়ন্ত্রক কাঠামো বাস্তবায়ন, যা সব প্রতিষ্ঠানকে দায়বদ্ধ রাখবে।
যদিও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিবর্তন কার্যকর করার নিয়ন্ত্রক ক্ষমতা রয়েছে, তাদের পদক্ষেপ প্রায়ই প্রত্যাশিত প্রভাব ফেলতে ব্যর্থ হয়েছে। নেওয়া পদক্ষেপগুলো শুধু তাত্ক্ষণিক সমস্যাগুলোর সমাধান নয়, বরং অন্যান্য ব্যাংকগুলোকে এই ধরনের পথ অনুসরণ থেকে নিরুৎসাহিত করার জন্য একটি স্পষ্ট বার্তা প্রদান করা উচিত।
বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত সংস্কার একটি বিশাল কাজ, তবে এটি অসম্ভব নয়। তবে এর জন্য গত দীর্ঘদিনের ক্ষতিগ্রস্ত অবস্থা সম্পর্কে একটি সমন্বিত বোঝাপড়া এবং পুনরুদ্ধারের একটি স্পষ্ট কৌশল প্রয়োজন।
শাসন ব্যবস্থার ব্যর্থতাগুলোকে প্রাথমিক কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হলেও, এটি বোঝা জরুরি যে এই ব্যর্থতাগুলো একটি বৃহত্তর পরিকল্পনার অংশ ছিল, যার উদ্দেশ্য ছিল সব সময়ই এই সেক্টরকে লুট করা। সরকারি সংস্থাগুলোর সঙ্গে সমঝোতা এবং বড় আর্থিক কারসাজি থেকে শুরু করে এই ব্যাংকিং সেক্টরে ‘হাইজ্যাক’ করার প্রচেষ্টা ছিল একটি পরিকল্পিত চক্রান্ত। এর পুরো ক্ষতির মাত্রা উন্মোচন করতে একটি গভীর তদন্ত প্রয়োজন।
সংস্কার সফল করতে হলে, সরকারকে সংকটের মূল কারণগুলো চিহ্নিত ও মোকাবেলা করতে হবে, শুধুমাত্র উপসর্গগুলোর চিকিৎসা নয়। এর মধ্যে রয়েছে আইনগত এবং নিয়ন্ত্রক কাঠামো শক্তিশালী করা, মানবসম্পদের দক্ষতা বাড়ানো এবং টেকসই সংস্কার নিশ্চিত করা।
এই প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক সদিচ্ছা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ যে কোনো সরকারকে কঠিন এবং প্রায়ই অপ্রিয় সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এর ফলে স্বল্পমেয়াদী রাজনৈতিক জনপ্রিয়তার ঝুঁকি থাকতে পারে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধারের জন্য এটি অপরিহার্য।
অতীতে এশিয়ার অনেক দেশ অলিগার ও সরকারের অব্যবস্থাপনা এবং অদক্ষত মানব সম্পদের কারণে ঘটে যাওয়া সংকট থেকে তাদরে ব্যাংক ব্যবস্থাপনা একটি ক্রটি মুক্ত জায়গায় নিয়ে এসেছে। বাংলাদেশের জন্যে এ কাজটি চ্যালেঞ্জিং দুই কারণে এক, রাজনৈতিক দলের লোক ও সমাজের সুবিধাভোগীরা এর সঙ্গে জড়িত। আর সব সময়ই ব্যাংকার ও প্রশাসন জানা লোকদের বদলে ভিন্ন পেশার লোককে কেন্দ্রিয় ব্যাংকের জন্যে উপযুক্ত মনে করা হচ্ছে। এখান থেকে চিন্তাকে বের করে না না পারলে সম্ভব নয় বলে মনে করেন অনেক সিনিয়র ব্যাংকার ও প্রতিশ্রুতিশীল দক্ষ শিল্পপতি।